সন্দেশখালি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন

আন্দোলনের স্বরূপ বুঝতে, পুলিশ-প্রশাসন এবং জমিলুঠেরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাধারণ মানুষকে নিগ্রহ, নির্যাতন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন জানতে-বুঝতে শ্রমিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এবং ক্ষেত্র গবেষণার দল-এর পক্ষ থেকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং ৮ মার্চ সন্দেশখালি ব্লকের কয়েকটি গ্রামে তথ্যানুসন্ধান করা হয়। এখানে সেই তথ্যানুসন্ধানের নির্যাস।

সন্দেশখালি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন

পশ্চিমবঙ্গ ক্ষেত মজুর সমিতি, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর), আমরা এক সচেতন প্রয়াস এবং শ্রমজীবী মহিলা সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত।

তথ্যানুসন্ধানে যারা গিয়েছিলেন- বিজয়া চন্দ, দেবাশিস ভট্টাচার্য, দীপ্যমান অধিকারী, সুচিত্রা হালদার, মহারানী সরদার, হাবীব, খাদিজা খাতুন, সরোজ কুমার মণ্ডল, মঞ্জু গায়েন, দীপ্তাংশু কর, মায়া সরদার, মোহিত রণদীপ, শমিন্দ্র সরকার, অমিতাভ সেনগুপ্ত, উপমা নির্ঝরিণী, শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী।

সম্পাদনা- শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী  

প্রকাশনার তারিখ- ২২ মার্চ, ২০২৪

স্থান- কোলকাতা প্রেস ক্লাব 

জব জুলম-ও-সিতাম কে কোহ-ই-গরান, রুই কি তারাহ উর যায়েঙ্গে
হাম মেহকুমন কে পাওঁ তালে ইয়ে ধরতি ধর ধর ধরকেগি
অর আহলে হাকাম কে সার ওপার
জব বিজলি কার কার কারকেগি, হাম দেখেঙ্গে……

সেইদিন সব অন্যায় জুলুম তুলার মতো বাতাসে উড়ে যাবে
আমাদের সাধারণের পদতলের নিচের ধরণী ধকধক করে কাঁপতে থাকবে
সব জালিমের মাথার উপরের আকাশে কড়কড় করে বাজ পড়তে থাকবে
আমরা দেখবো, আমরা দেখব, সেদিন আসবে……

সেদিন এসেছিল। আমরা দেখেছি। আমাদের জানা নেই তা কদিন স্থায়ী হবে! আমাদের জানা নেই সব অন্যায় উড়ে যাবে কিনা! আমাদের এও জানা নেই সন্দেশখালির মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন রাজনীতির পাঁকে আটকে যাবে কিনা! যখন এই সময়ের রাজনীতি মানে সাম্প্রদায়িকতা, রাজনীতি মানে দুর্নীতি। যখন লোকসভা ভোট সামনে, যখন ধর্মীয় শোভাযাত্রা এমন এক রাজনৈতিক প্রকল্প যা ব্যবহার করে মেরুকরণ ও হিংসা ঘটানো যায়। তবু ২০২৪-এর শুরুতে সন্দেশখালি আমাদের কাছে প্রতিবাদের বার্তা নিয়ে এলো। ফৈজ আহমেদ ফৈজের কবিতার মত দ্বীপের মাটি প্রতিবাদী মানুষের পায়ের নিচে ধকধক করে কাঁপতে থাকলো।

প্রাককথন

কিভাবে সন্দেশখালি এলাকা জুড়ে ক্ষমতার এক নিরুপদ্রব আধিপত্য চলছিল যা জানতে হলে আমাদের ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে। এই ইতিহাস একই সাথে ক্ষমতার এবং তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধেরও ইতিহাস। ১৯০৩ সালের কথা দিয়েই শুরু হোক, সন্দেশখালির চারটি এলাকা ইজারা পেয়েছিলেন ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন। সুন্দরবন সংলগ্ন এই ভূভাগে জঙ্গল সাফ করে বসতি বানানো হল, ফলস্বরূপ ইংরেজ সরকার ‘স্যার’ উপাধি দেন হ্যামিল্টনকে। জঙ্গল পরিস্কারের পুরস্কার হিসাবে জমিদারেরা প্রথমে সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে ফলনের এক ভাগ দাবি করেছিলেন। সেই দাবি তাঁরা আদায় করতেন কৃষকদের কাছ থেকে। শুরু হয়েছিল কর আদায়ের নামে সন্দেশখালি জুড়ে গোমস্তা, নায়েব আর জমিদারের লেঠেল বাহিনির অত্যাচার। কিন্তু জমিদারেদের লালসা বাড়তে থাকলো দিন দিন। যেহেতু উর্বর জমি আর চাষিদের শ্রমে ফলন ভালোই হচ্ছিল, তারা ফলনের দুভাগ এমনকি তিনভাগও দাবি করতে লাগলো। আর মুখ বুজে থাকলেন না, চাষিরা। ফলনের তিনভাগ দিতে অস্বীকার করেন তাঁরা। শুরু হয় পুলিশ আর লেঠেল বাহিনির সঙ্গে চাষিদের সংঘর্ষ। শুরু হয় তেভাগা আন্দোলন। বেড়মজুর, রামপুর, দুর্গামণ্ডপ, রাজবাড়ি থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। ১৯৪৭ সালের ৮ মার্চ বেড়মজুর গ্রামের জোতদার দেবেন্দ্রনাথ সরদারের কাছারি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। জমিদারের লেঠেল বাহিনী এবং পুলিশের গুলিতে বহু মানুষের রক্ত ঝরে। শোনা যায়, কলাগাছি নদীর জল আর সবুজ ধানের খেত সে দিন লালে লাল হয়ে গিয়েছিল রক্তের দাগে। হেমন্ত ঘোষালের নেতৃত্বে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রতিরাম সর্দার, রবিরাম সর্দার, চামু বিশাল, পারুল সর্দার, বাতাসি সর্দার-সহ অনেকে। প্রাণ হারান সকলে। নাড়াবুনিয়া, শাকদা, রাজবাড়ি, পাথরঘাটা-সহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা বহু মানুষ আহত হন। হতাহতদের টেনে ফেলা হয় নদীর জলে। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সন্দেশখালি তখন উত্তাল। রাতারাতি সন্দেশখালির নাম ছড়িয়ে পড়ে দেশের মানুষের কাছে।

প্রকৃত অর্থে তেভাগা আন্দোলন ছিল সম্প্রদায় নির্বিশেষে খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলন, জমিদার জোতদারেদের বিরুদ্ধে। দিনাজপুর জেলায় পুলিশের গুলিতে সামসুদ্দিনের মৃত্যু হলে ক্ষিপ্ত হয় আদিবাসী যুবক শিবরাম। পুলিশের বিরুদ্ধে ধনুক তুলে নেয়, পরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় শিবরাম। [নির্মল বসু, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩৪, আনন্দবাজার; সঞ্জয় পুততুণ্ড, ১ মে, ২০২২, শ্রমজীবী ভাষা]

আজ আবার ‘সামসুদ্দিন-শিবরাম’-দের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেগে উঠেছে সন্দেশখালি। সংবাদপত্রে, সামাজিক মাধ্যমে ছয়লাপ সংবাদে। শেখ শাহজাহান, উত্তম সরদার, শিবপ্রসাদ হাজরার পোলট্রি ফার্মে, আলাঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে জনতা। আবার রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে গ্রামের মানুষ। মানুষের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে হার্মাদ বাহিনী। আজ আবার পথে নেমেছে, সজোরে আওয়াজ তুলেছে নিমাই সরদার, উত্তরা সরদার, কলিম শেখ, দেবু মণ্ডলরা। শাহজাহান এবং তাঁর অনুচরদের গ্রেফতারের দাবিতে পোস্টার দেখছে সন্দেশখালি।

তবে সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমকে দেখতে হলে একটু পিছনে দেখতে হয়। গত অক্টোবর, ২০২৩-এ তৃণমূল নেতা এবং পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী (একসময় যিনি খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন) জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল রেশন ও খাদ্য সরবরাহে বরাদ্দ টাকা তিনি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের খাতে পাঠিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় তাঁর নেটওয়ার্কে যুক্ত প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে অন্যতম শেখ শাহজাহান বলে অভিযোগ ওঠে। যেসব ব্যক্তি সিপিএম আমলে ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল আবার সরকার বদল হতেই রাতারাতি রঙ পাল্টালো, শেখ শাহজাহান তেমনই একজন। তৃণমূল শাসনে তার আধিপত্য কয়েকগুণ বাড়ল তা বলা বাহুল্য। সন্দেশখালি এলাকায় সেই হয়ে উঠলো শেষ কথা। গত ৫ জানুয়ারিতে এনফোর্সমেণ্ট ডাইরেক্টোরেট (ইডি) তার বাড়িতে হানা দিলে তার সমর্থকদের হামলার শিকার হয়। আহত হন কয়েকজন ইডি আধিকারিক। সারা রাজ্য জুড়ে ‘শেখ শাহাজাহান’ চর্চায় চলে আসে। সন্দেশখালিতে সে এবং তার অনুচররা কিভাবে ‘রাজ’ চালাচ্ছে, কিভাবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার জন্য তারা পুলিশ প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে তা চর্চায় আসে। জমি দখল, মাছের ভেড়ি, লক্ষ-কোটি টাকার লেনদেন, কমিশন কোথায় যাচ্ছে, চলে এলো চর্চায়। সন্দেশখালিতেও এসেছিল এই খবর।

এদিকে ধিকি ধিকি জ্বলছিল মানুষের ক্ষোভ। ৭ ফেব্রুয়ারি উত্তম সরদার পাত্রপাড়ায় শাসাতে এলে মানুষ প্রথম ক্ষোভে ফেটে পরে। শাহাজাহান বাহিনী তখনও বুঝতে পারেনি কি হতে চলেছে। শাজাহান সাম্রাজ্যে চমকানো ধমকানো দিয়েই এদের চুপ করে রাখা যাবে এই ছিল তাদের এতদিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু ইতিহাস বোধহয় এইভাবেই দ্রোহকাল আসে। তিন দশকের বেশি বাম শাসনে যেরকম এসেছিল নন্দীগ্রামে। সন্দেশখালির প্রতিরোধ ছড়িয়ে গেলো আশেপাশের গ্রাম পঞ্চায়েতেও, জেলিয়াখালি, বেড়মজুর। প্রতিরোধের মানচিত্র বাড়তে থাকলো দিনে দিনে। পুলিশের ধরপাকড়, মামলা দেওয়াও চলতে থাকলো। তার বাড়িতে অভিযানের ৫৫ দিনের মাথায় রাজ্য পুলিশ গ্রেফতার করল শেখ শাহজাহানকে। তার সঙ্গি উত্তম সরদার ও শিবপ্রসাদ হাজরা গ্রেফতার হয় যথাক্রমে ১০ ও ১৭ ফেব্রুয়ারি।

ভৌগলিক অবস্থান

সন্দেশখালি নিম্ন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে অবস্থিত ইছামতি-রায়মঙ্গল সমভূমির একটি অংশ। বাদাবন, হিংস্র শ্বাপদ, উপকূলীয় নদীর জল আর বাইরে থেকে আসা আদিবাসীদের নিয়েই ছিল সন্দেশখালির আদি রূপ। আজ তার ছবি অনেকটাই বদলেছে। সন্দেশখালি দুটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক, সন্দেশখালি-১ ও সন্দেশখালি-২। দুটি ব্লক নিয়ে জনসংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ। দুটি ব্লকের ১৬ টি গ্রাম পঞ্চায়েত, কিন্তু থানা মাত্র ১ টি। বর্তমানে যে এলাকা সংবাদের শিরোনামে তা মূলত সন্দেশখালি-২ ব্লকে। এর মধ্যে চারিদিকে নদী ঘেরা যে ভূখণ্ডটি সন্দেশখালি নামে পরিচিত সেখানেই সাম্প্রতিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সুত্রপাত। এটি আসলে একটি দ্বীপ, এর উত্তরে বেতনি নদী, উত্তর-পূর্বে ডাসা নদী, দক্ষিণ-পশ্চিমে কলাগাছি আর দক্ষিণ-পূর্ব জুড়ে বইছে রায়মঙ্গল। সন্দেশখালি গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামগুলি এখানেই। পরবর্তীতে সন্দেশখালি থেকে জমিলুঠেরা বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পরে আশেপাশের গ্রাম পঞ্চায়েতের গ্রামগুলিতে, যেমন জেলিয়াখালি, বেড়মজুর প্রভৃতি।

আন্দোলনের স্বরূপ বুঝতে, পুলিশ-প্রশাসন এবং জমিলুঠেরা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাধারণ মানুষকে নিগ্রহ, নির্যাতন তথা মানবাধিকার লঙ্ঘন জানতে-বুঝতে শ্রমিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এবং ক্ষেত্র গবেষণার দল-এর পক্ষ থেকে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এবং ৮ মার্চ সন্দেশখালি ব্লকের কয়েকটি গ্রামে তথ্যানুসন্ধান করা হয়। এখানে সেই তথ্যানুসন্ধানের নির্যাস।   

 

[বিশদে পোস্ট করা হবে ১ মে, ২০২৪]

 
 
 
 
 

About author
Generic placeholder image
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.
Do you want to get informed about new articles?

Most Viewed
0 Comments
Leave a reply