আর এস এস সদর দপ্তরে 'কামান দাগা'
আর এস এস-এর স্বরূপ কতটা সাংঘাতিক তা জানা জরুরি। জানা জরুরি হিন্দুত্বের তত্ত্ব ও তা রূপায়নের হালহকিকত, যার মধ্যে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসের পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রথিত আছে। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এই সব কিছু জানতে এবং রাজনৈতিক ধর্মের স্বরূপ উন্মোচনে প্রায় দশক-অধিক কাল তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছে। সদর দপ্তরে যাওয়া এবং এই প্রতিবেদন উক্ত প্রচেষ্টার ভগ্নাংশ মাত্র।
আর এস এস সদর দপ্তরে 'কামান দাগা'
একটি ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’ প্রতিবেদন
ভারতবর্ষের ইতিহাসে আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বিভেদের রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ। এবং একই সাথে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারক ও বাহক। আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। যিনি সাভারকারের ভক্ত। সাভারকার জিন্নার মত হিন্দু ও মুসলিম ভিন্ন জাতি এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। দ্বিজাতিতত্ত্বে তাঁরা সহমত থাকলেও দুইটি ভিন্ন জাতি কিভাবে থাকবে এই বিষয়ে ভিন্নতা ছিল মতের। জিন্না চাইতেন মুসলিমদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, মুসলিমদের জন্য পাকিস্থান, হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্থান। সাভারকারের ইপ্সা ছিল, ভারত ভাগ হবে না। তবে স্বাধীন ভারতে হিন্দু জাতি থাকবে কর্তৃত্বে, মুসলিমরা থাকবে অধীনে, হিন্দু জাতির সঙ্গে সহযোগিতা করে। (পাকিস্তান ওর দ্য পার্টিশান অফ ইন্ডিয়া, বি আর আম্বেডকার)। আর এস এস-এর অবিভক্ত ভারত ও হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনা উক্ত তত্ত্বেই আবর্তিত।
কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার
আদ্যন্ত মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণা দিয়ে যদি কারও জীবন শুরু হয়ে থাকে তবে তিনি হলেন কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা, ভারতকে সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা যে প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য।
তাঁর সারাজীবনে এই ঘৃণার বিবিধ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এখানে তার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ থাকলো। প্রসঙ্গত জানায় তার নামাঙ্কিত সংগ্রহশালায় রক্ষিত উক্ত ছবি দেখে আমরা অবাক হয়নি কিছুই, কেননা হেডগেওয়ার নিজে ‘লিঞ্চিং’ করছেন বা করাচ্ছেন এই ঘটনার ফটোগ্রাফি না থাকায় কাউকে দিয়ে তা আঁকানো হতেই পারে, কারণ এই ‘মহান’ কর্মটি হিন্দুত্বের স্বচ্ছাসেবকদের অনুপ্রাণিত করে যে! অবাক করেছে প্রকাশ্যে তার প্রদর্শন। অবশ্য সংগ্রহশালায় আমাদের ‘অনুপ্রবেশ’ তাদের ‘অনুমোদিত’ ছিল না, বলা বাহুল্য। আমাদের ‘কৌশল’ হয়তো আমাদের কাছে এই অকাঙ্খিত সুযোগ এনে দিয়েছিল।
এখন দেখা যাক, মুসলিম বিদ্বেষ ও ঘৃণার হোতা হেডগেওয়ারের কয়েকটি কারনামা, যা মূলত তার জীবনী থেকে নেওয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন শুরু হয়ে গেছে। পুনাতে লোকমান্য তিলকের সঙ্গে দেখা করার পর হেডগেওয়ার গিয়েছিলেন শিবনেরী, উল্লেখ্য শিবাজির বাল্যকাল সেখানে কেটেছে। শিবাজির জন্মস্থানের কাছেই মসজিদ ও দরগা দেখতে পান তিনি। দেখে কি মনে হল তাঁর? নারায়ণ হরি পালকর রচিত ‘হেডগেওয়ার জীবন চরিত’ (পৃষ্ঠা-৭১) থেকে জানতে পারছি, ‘এই সংগতিহীন দৃশ্য দেখে তাঁর বড় বেদনা হল। এরপর যখনই শিবনেরীর উল্লেখ করা হত, তখনই সেই বেদনা নতুন করে তাঁর মনকে নাড়া দিত’।
১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা। ঋষি অরবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে ডাঃ মুঞ্জে ও হেডগেওয়ার পন্ডিচেরির উদ্দেশ্যে ট্রেন যাত্রা করেন। দুজনে একই ট্রেনে থাকলেও কামরা ছিল ভিন্ন। ডাঃ মুঞ্জে ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে, হেডগেওয়ার তৃতীয়তে। মাঝেমধ্যেই মুঞ্জের কামরায় আসছিলেন হেডগেওয়ার, কিন্তু একবার ট্রেন ছেড়ে দেয়, তিনি নিজের কামরায় ফিরতে পারেন না। টিকিট চেকার ওঠে ট্রেনে, সমস্যায় পরেন হেডগেওয়ার। দুপক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ শুরু হয়। ডাঃ মুঞ্জের উঁচুগলা কালো টুপি আর লম্বা দাড়ি দেখে টিকিট চেকার তাঁকে মুসলমান ভেবে বলেন, ‘আমার ওপর মেজাজ দেখাবেন না। মনে রাখবেন এটা মুসলমানদের দেশ নয়’। এই চরম আক্রমনাত্বক কথা শুনে ডাঃ মুঞ্জে ও হেডগেওয়ার মনে মনে খুব খুশি হন। উপরিউক্ত বইটি থেকে সেই ঘটনায় তাঁদের উৎফুল্লতার নিদর্শন রাখছি।
‘তাঁদের মনে এক প্রকার তৃপ্তির অনুভব হল। সেই সময়ে চতুর্দিকে এই কথাই প্রচলিত ছিল যে হিন্দুস্থানে বসবাসকারী সবাই এই দেশের মালিক। কিন্তু সংঘাতের উপক্রম হলেই হিন্দু মনের দেশভক্তি কি রূপ জাগ্রত হয় এবং এই দেশ যে কেবল হিন্দুদের, এই ইতিহাস-নিষ্ঠ সত্য কেমন নির্ভীকভাবে মুখে এসে পড়ে, তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ দেখে তাঁদের হৃদয় আনন্দ-বিভোর হয়ে উঠলো’ পরবর্তীকালে হিন্দুদের ‘দেশপ্রেম’-এর কথা উল্লেখ করতে হলে হেডগেওয়ার বহুবার এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
১৯১০ সালে কলকাতায় দাঙ্গা হয়। কলকাতায় ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি (এল এম এস) পড়তে হেডগেওয়ার তখন কলকাতায়। দাঙ্গা পীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে কলেজের ছাত্ররা একটি শুশ্রূষা-বাহিনী গঠন করে বলে জানা যায়। হেডগেওয়ার এই বাহিনীতে ছিলেন। একবার এই বাহিনী এক অচৈতন্য ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে, হটাৎ তাদের সামনেই একজন হিন্দু ব্যক্তি জনৈক পাঠান (মুসলমান) –এর পিঠে ছোরায় আঘাত করে। শুশ্রূষা-বাহিনীর একজন স্বাভাবিক কারণেই উদ্গ্রিব হয়ে ওঠেন, বলেন, ‘এর এখুনি চিকিৎসা দরকার’। কিন্তু বাধা দেন হেডগেওয়ার, বলে ওঠেন, ‘আমাদের মধ্যে থেকে কেউ চিকিৎসা করাতে গেলে পুলিশ এসে আমাদেরই ধরে নিয়ে যাবে, কেননা আমরা সবাই হিন্দু’। চিকিৎসা শাস্ত্রের একজন ছাত্র হয়েও চরম মুসলিম বিদ্বেষ তাকে সেবা থেকে নিরস্ত করে। অন্যদেরও মিথ্যা আশঙ্কা দেখিয়ে নিবৃত্ত করে।
মুসলমান মানেই গুন্ডা, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয় না, দাঙ্গা একমুখী, অর্থাৎ মুসলমানরাই দাঙ্গা করে- এই ছিল তার মনোভাব। কেউ যদি কখনও তার সামনে বলে ফেলত, ‘অমুক স্থানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছে’, হেডগেওয়ার তৎক্ষণাৎ তাকে থামিয়ে দিতেন, বলতেন, ‘মুসলমানের দাঙ্গা বোলো, ওটাই সঠিক’।
ঘৃণা ও দাঙ্গার অন্য নাম আর এস এস
প্রতিষ্ঠাতার এই চরম মুসলিম বিদ্বেষ দিয়েই আর এস এস-এর জন্ম। একটু পিছনে তাকানো যাক। সারা দেশেই হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং কয়েক শতক ধরে সহাবস্থানের স্বাভাবিকতা কমে আসছিল। ভারতের বিভিন্ন শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হচ্ছিল। ১৯২৩ সালে ১১ টি, ১৯২৪ সালে ১৮ টি, ১৯২৫ সালে ১৬ টি এবং ১৯২৬ সালে ৩৫ টি দাঙ্গার ঘটনার উল্লেখ আছে। হয়তো এই তথ্য সম্পূর্ণ বা নিরপেক্ষ নয়। বলা হচ্ছে, এর মধ্যে বাংলা, পাঞ্জাব এবং যুক্ত প্রদেশ (বর্তমান উত্তর প্রদেশ)সব থেকে বেশি হয়েছে দাঙ্গা। লাহোর দাঙ্গা, ১৯২৭-এ সবথেকে বেশি মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানা যায়।(পাকিস্তান- দ্য হার্ট অফ এশিয়া, লিয়াকত আলি)।
১৯২৩ সালে নাগপুরে দাঙ্গা হয়। হিন্দু মহাসভা একটি মসজিদের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা করে, জোরালো বাজনা বাজানো হয়। মুসলিমরা এর বিরোধ করে, শুরু হয় দাঙ্গা। (গান্ধী ইন হিস টাইম অ্যান্ড আওয়ার্স, ডেভিড হার্ডিম্যান)।.১৯২৫ সালের কথা। দাঙ্গার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হেডগেওয়ার আর এস এস গঠন করেন। উপরিউক্ত কারণ ছাড়াও বিভিন্ন কারণে নাগপুরে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিরোধ লেগে ছিল। অন্যান্য বিরোধের মধ্যে মসজিদের সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা যাওয়া নিয়ে বিরোধ ছিল অন্যতম। ১৯২৪ সালে মুসলমানদের আর্থিক বয়কটও করা হয়। এই বিরোধ মীমাংসার জন্য মতিলাল নেহরু, ডাঃ মহমুদ এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে একটি তদন্ত সমিতি গঠিত হয় কংগ্রেসের উদ্যোগে। এই সমিতি রায় দেয়-
ভোঁসলে পরিবার এবং জাগোবারের যে কোন শোভাযাত্রা মসজিদের সামনে দিয়ে যেকোন সময় যেতে পারবে। এদের বাদ দিয়ে অন্য শোভাযাত্রাগুলি শহরের পাঁচটি প্রধান মসজিদের সামনে দিয়ে দুপুরে ও সন্ধ্যায় নমাজের আধঘণ্টা করে সময়াবধি বাদ দিয়ে অন্য সময়ে বাজনা বাজিয়ে যেতে পারবে।
সহাবস্থান কায়েম রাখতে এই সিদ্ধান্ত উভয় সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ মেনে নেয়, কিন্তু হেডগেওয়ারের তা নাপসন্দ। আজানের জন্য বরাদ্দ সময়ে বাজনা বন্ধ রাখতে উনি রাজি ছিলেন না। ওনার ভাষায়, ‘মুসলমানরা যখনই বলবে ‘বাজনা বন্ধ কর’, তখনই যেন আরও জোরে জোরে কর্কশ আওয়াজে বাজনা বাজানো হয়’। উনি স্বয়ংসেবকদের নির্দেশ দিলেন এই শোভাযাত্রাগুলিতে অংশগ্রহণ করতে।
তীব্র মুসলিম বিরোধিতার মনোভাব নিয়ে আর এস এস-এর প্রসার হতে থাকলো নাগপুরে। হিন্দু আধিপত্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমরা ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকলো। শুধু শোভাযাত্রা নয় স্বয়ং সেবকদের মোতায়েন করা হতে থাকলো সেই সব জায়গায়, যেখানে সাধারণত মুসলিমদের আনাগোনা ছিল, যেমন শুক্রবার-তালাও বা তুলসীবাগ ইত্যাদি স্থান।
নাগপুরের সাধারণ হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী করতে সংঘ হিন্দু একতার ওপর জোর দেয়। এই একতা যে আসলে মুসলিম বিরোধিতার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প রচনা ভিন্ন কিছু নয় তা অচিরেই বোঝা যায়। হেডগেওয়ারের ভাষায়, ‘হিন্দুদের মনের মধ্যে ‘আমি’র স্থানে, ‘আমরা’ পঁয়ত্রিশ কোটি’ এই রাষ্ট্রীয় অস্মিতার মনোভাব গড়ে তোলা আবশ্যক’। সংঘের ইতিহাসে থেকে জানতে পারছি, নাগপুর দিয়েই তাদের ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষ’ প্রকল্পের হাতেখড়ি। আক্রান্ত হলে মুসলমানরা কতটা তা জানতে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হল। মহারাষ্ট্রে গনেশ উৎসব এক এক বড় পার্বণ, আমরা জানি। গনেশ উৎসবকে ‘রাজনৈতিক ধর্ম’-এর বড় হাতিয়ার করেছিলেন তিলক। বলা যেতে পারে ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নির্মাণে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে সে প্রসঙ্গে আলোচনা রাখা হচ্ছে না।
বিজেপি’র রাজ্যসভা সদস্য (এমপি) রাকেশ সিনহা হলেন হেডগেওয়ারের জীবনীকার। উনি বলেছেন, ‘হিন্দুদের একত্রিত করার জন্য হেডগেওয়ার আর এস এস গঠন করেন। উনি দীর্ঘকালীন ব্রিটিশ-মুঘল শাসনে হিন্দুদের ওপর চাপানো বিধিনিষেধ থেকে তাদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁরা যাতে তাদের সংস্কৃতি পালন করতে পারে তার জায়গা দিতে চেয়েছিলেন। আর এস এসের শপথেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে হিন্দু জাতির স্বাধীনতার উল্লেখ আছে’।
হেডগেওয়ারের অন্যতম জীবনীকার, সি পি ভিসিকার তাঁর গ্রন্থ, ‘কেশব সংঘনির্মাতা’-তে দেখিয়েছেন কিভাবে আর এস এসের প্রতিষ্ঠাতা মুসলিমদের বিষাক্ত সাপের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
(১)
নাগপুরে সেবারে গনেশ উৎসব এবং একটি মুসলিম শোভাযাত্রা এক দিনে পরে গিয়েছিল। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯২৭ এ মুসলমানদের এই শোভাযাত্রা ছিল, এর তিন বছর আগে সৈয়দ মীর সাহেবের মৃত্যু হয় তার স্মরণে। এদিকে মহারাষ্ট্রের গণেশ উৎসবে মহালক্ষী একটি বিশেষ দিন, বিশেষ অনুষ্ঠান। শোভাযাত্রা একই দিনে থাকায় হিংসার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য, নাগপুর বহুবার দাঙ্গার হিংসা দেখেছে। এবার আর এস এস-এর নির্দেশে সংঘর্ষের সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে অস্ত্র মজুদ করা হল।
নাগপুর দাঙ্গা, ১৯২৭; যা থেকে আর এস এস-এর প্রসার-
নাগপুরে মোহিতের প্রাসাদে ১৯২৫-এ যে সংঘের শুরু ১৯২৭ সালে এসে তার বিস্তার লক্ষ্য করার মত। বয়সের ক্রমানুসারে পৃথক পৃথক দল গঠন করা হয়। যেমন ‘লব’ এবং ‘চিলিয়া’ নামক দলে দশ বছরের কম বয়সী ছেলেদের রাখা হয়। ‘কুশ’, ‘ধ্রুব’ ও ‘প্রহ্লাদ’ নামক দলে যথাক্রমে সদ্য তরুণ, কিশোর ও বালকদের রাখা হয়। ‘ভীম’ দলে বড় বয়সী তরুণ এবং ‘ভীষ্ম’ দলে প্রৌঢ়দের রাখা হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গায় সংঘের শিবির হতে থাকে। সেই শিবিরগুলিতে ৭০-৮০ জন তরুণের লাঠি নিয়ে আক্রমনাত্বক অনুশীলন উপস্থিত পথচারীদের উত্তেজিত করতো। বলা বাহুল্য পথচারীদের মধ্যে যারা মুসলিম তাদের উত্তেজনায় আশঙ্কা অধিক ছিল।
‘প্রহার’ এই শব্দে জোর দেওয়া হত। সংঘের প্রথম দিকের কর্মকর্তা আন্না সোহোনী ভাষায়, ‘প্রহারে এমন উদ্দীপনা ও বেগ থাকা উচিত যেন সামনে দাঁড়ানো শত্রু মার খেয়েই জমিতে পরে যায়।’ তিনি নিজেও এই রকম ‘প্রহার’-এ অংশগ্রহণ করতেন তা বলা বাহুল্য। স্বয়ং সেবকদের দৈহিক কসরতের সাথে সাথে ‘মগজ ধোলাই’ করার জন্য বই পড়তে দেওয়া হত। দুটি বাজেয়াপ্ত বই, ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘খতরে কি ঘণ্টি’ এই তালিকায় ছিল। সাধারণ হিন্দুদের আরও বেশী করে হিন্দুত্বে আকৃষ্ট করতে বইদুটি বিলিও করা হত।
যে আন্না সোহোনীর কথা এলো আলোচনা প্রসঙ্গে তাকে নিয়ে দু কথা বলা যাক। এই ব্যক্তিটি ছিলো দাঙ্গাবাজ। সংঘীদের অস্ত্রপ্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে নিজের গৃহ একটি অস্ত্র কারখানায় পরিনত করেন তিনি। বাঘনখ, ছুরি, বর্শা, তলোয়ার ইত্যাদি সেখানে নির্মিত হতো বলে সংঘ সূত্রেই জানা যায়। হেডগেওয়ারের জন্মদিনে সোহোনী তাকে একটি ছুরি উপহার দেন। প্রকাশ্যে তা দেওয়াই হেডগেওয়ার অবশ্য সতর্ক করেন, বলেন, ‘যে কাজ করতে বলা হয়েছে সেটা করতে হবে, কিন্তু তার জন্য এতো ঢাকঢোল পেটাবার দরকার নেই’।
৪ সেপ্টেম্বর হেডগেওয়ার নাগপুরে ছিলেন না। হিন্দুদের পক্ষ থেকে যে কোন আক্রমণ হতে পারে এই রকম কোন আন্দাজ মুসলমানদের ছিল না। পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে হেডগেওয়ারের নাগপুর থেকে চলে যাওয়া ছিল মুসলমানদের আরও বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যেই। দাঙ্গায় যাতে হিন্দুরা ‘জয়লাভ’ করে সেই জন্য পরিকল্পনা মাফিক ব্লুপ্রিন্ট রচনা করে গিয়েছিলেন তিনি। ওনার নির্দেশ মোতাবেক আন্না সোহোনীর নেতৃত্বে স্বয়ংসেবকরা মোহিতের প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের আড়ালে বেলা ১১ টা থেকে জড়ো হতে থাকে। আন্না তাদের ১৬ টি দলে ভাগ করে। ডাঃ মুঞ্জের বাড়ি থেকে মহাল পর্যন্ত সব গলি-ঘুঁজিতে সশস্ত্র স্বয়ংসেবক মোতায়েন থাকে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২৫ জন যুবক থাকে পথে। সশস্ত্র। (ডাঃ হেডগেওয়ার জীবন চরিত, নারায়ণ হরি পালকর)
নারায়ণ হরি পালকর রচিত, হেডগেওয়ার জীবন চরিত স্বয়ং সেবকদের কাছে মূল্যবান একটি বই। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে (পৃষ্ঠা ১৫৯-১৬১) দাঙ্গায় হিন্দুদের বীরগাথার যেরূপ বর্ণনা আছে তা এই রকম-
তারা (স্বয়ংসেবকরা) আত্মরক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিল। নিজেদের পরাক্রম তথা পুরুষার্থের উপর তাদের ভরসা ছিল। উত্তেজনায় তাদের বাহুদন্ডের মাংসপেশীগুলি টান-টান হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষণ পরেই মিছিল (মুসলমানদের) বড়ো রাস্তা ছেড়ে গালিগালাজ ও মারপিট করতে করতে ওয়াইকর গলিতে ঢুকে পড়ল। কিন্তু গলির মধ্যে এক পাশে চুপিসারে সে স্বয়ংসেবকরা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা ওই সংকীর্ণ গলিতে গুণ্ডারা (মুসলমানরা) প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর প্রহার মার শুরু করে দিল। মুসলমানরা মাথা ফেটে রক্তাক্ত শরীরে পিছন ফিরে পালাতে শুরু করে দিল।
...রবিবার সারা শহরে সংঘর্ষ চলতে থাকে, কিন্তু তাতে হিন্দুদেরই আধিপত্য ছিল।
......তিন-চার দিন ধরে জাতি, পন্থ, পেশা, ইত্যাদির কৃত্রিম বিভেদ ভুলে হিন্দুরা যে একতা ও জাগরুকতার প্রদর্শন করে, তার ফলে মুসলমানদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল এবং ওরা সরকারি সৈন্যদের ছত্রছায়ায় তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের গোন্ডরাজার কেল্লায় নিয়ে গেল। কয়েকশত মুসলমান হাসপাতালে নিজেদের পাপের ফল ভোগ করতে লাগলো। প্রায় দশ-পনেরো জন ইহলোক ত্যাগ করে চিরদিনের মতো হিজরত করতে চলে গেল। হিন্দুদের মধ্যে চার-পাঁচজন বীরগতি লাভ করল। এই সংঘর্ষের দরুন নাগপুরের জীবনে হিন্দুদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হোল।
নাগপুরের প্রত্যেকটি চৌমাথায় এখন সৈনিকদের সঙ্গীনের চমক প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছিল। সেনারা না এলে হিন্দুদের প্রতিকারের ফলে পরাভূত মুসলমানদের অবস্থা আরও খারাপ হত।
মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার (১৮৮৯-১৯৪০)-এর পর আরএসএস-এর সরসংঘচালক হন মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার (১৯০৬-১৯৭৩)। আর এস এস-এর প্রসারে তাঁর অবদান যথেষ্ট। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ, ‘We or Our Nationhood Defined’-এ হিন্দু জাতীয়তাবাদ নিয়ে তিনি স্পষ্ট অবস্থান রাখেন। বলা যেতে পারে হিন্দুত্বের অন্যতম আকর গ্রন্থ সেটি। অ-হিন্দুদের প্রসঙ্গে ভয়ঙ্কর কিছু কথা এই বইয়ে লেখা হয়।
“হিন্দুস্থানের অ-হিন্দু জনগণকে হয় হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতে শিখতে হবে, হিন্দু জাতি (race) এবং সংস্কৃতির মহিমা প্রচার ব্যতীত অন্য কোনও ধারণা বর্জন করতে হবে। অর্থাৎ তাদের কেবল এই দেশে ও তার যুগযুগান্ত ব্যাপি ঐতিহ্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও কৃতঘ্নতার দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করলেই হবে না বরং তার পরিবর্তে ভালোবাসা ও আরাধনার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে”
হ্যাঁ, এই বাচন (ও আচরণ) যে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের ‘ঘরানা’, নাগপুর দাঙ্গা দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের হিংসায় হাতেখড়ি-যা আজকের এই সময়ে সংঘ পরিবার এবং তার রাজনৈতিক শক্তি ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি অনুসরণ করে, অক্ষরে অক্ষরে। এই ঘরানার অনুসারী ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী। গুজরাট গণহত্যায় যার উত্থান এবং ‘হেট ক্যাম্পেনিং’; ‘মব লিঞ্চিং’; ‘নাগরিকত্ব আইন, ২০১৯’; ‘রাম মন্দিরের উদ্বোধন’ ইত্যাদিতে যার বিস্তার।
তাই এর স্বরূপ কতটা সাংঘাতিক তা জানা জরুরি। জানা জরুরী হিন্দুত্বের তত্ত্ব ও তা রূপায়নের হালহকিকত, যার মধ্যে হিন্দুত্ব সন্ত্রাসের পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রথিত আছে। পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়খণ্ড সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামগুলিতে আর এস এস নতুন নতুন শিবিরের উদ্বোধন করে চলেছে। বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি সংগঠনের মাধ্যমে লোকসংস্কৃতিতে ভক্তি ও সহজিয়ার চিরায়ত পথে হিন্দুত্বের মিশেল ঘটাতে সচেষ্ট থাকছে। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এই সব কিছু জানতে এবং রাজনৈতিক ধর্মের স্বরূপ উন্মোচনে প্রায় দশক-অধিক কাল তথ্যানুসন্ধান চালাচ্ছে। আর এস এস সদর দপ্তরে যাওয়া সেই ধারাবাহিকতার এক অংশ মাত্র।
(২)
আর এস এস সদর দপ্তরে ‘কামান দাগা’
দিনটা ছিল, ২০২০-র জানুয়ারি মাসের একটা দিন, সকাল গড়িয়ে দুপুরের কাছাকাছি, বেলা ১১ টা। ত্রিস্তরের নিরাপত্তা বলতে যা বোঝানো হয়, প্রথমেই কার্যত তার সম্মুখীন হোই আমরা। তবে সরকারি বাহিনীর অতিরিক্ত নিজস্ব বাহিনীও যে ছিল তা আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি। আমরা যখন দ্বিতীয় বাঁকের সামনে, সরাসরি গেট দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দেখতে পাওয়া যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আর এস এস-এর প্রধান কার্যালয়। গেটের অনেক আগেই আমাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। প্যারা মিলিটারি ফোর্সের দুইজন জওয়ান জানান ভিতরে যাওয়া যাবে না। জানতে চান আমরা কেন এখানে এসেছি। আমরা জানায় আমরা লাইব্রেরিতে যাবো, যাবো সংগ্রহশালায়। ‘কিন্তু লাইব্রেরি তো বিকেল ৪ টায় খোলা হবে’, জানানো হয় আমাদের। আমরা অনুরোধ করি, একটু অফিসের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে দিন, আমরা বহু দূর থেকে এসেছি ইত্যাদি। অফিস মানে গেটের সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর অফিস। সেখানে মেটাল ডিটেক্টার, স্ক্যানার, ক্যামেরা বিবিধ সরঞ্জাম। সেখানেও একই প্রশ্ন করা হয়। এবার আমরা উদ্দেশ্য হিসাবে জানায় গবেষণার অংশ হিসাবেই লাইব্রেরি এবং সংগ্রহশালা দেখায় অভিপ্রায়। দায়িত্বে থাকা মহিলা অফিসার একজন আদিবাসি (তাঁর নাম জানাতে পারছি না, দুঃখিত) আমাদের পরিচয় জানতে চান, দেখতে চান আধার কার্ড। এবারে একটু ফাঁফরে পরি আমরা, দুই সদস্যের ‘আমরা’ দলে দ্বিতীয় জন নাম-পরিচয়ে ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুভুক্ত, আরবি নাম। আমরা দুজনেই কার্ড দেখাতে তৎপর হয়ে উঠি। কার্ড বের করার সময় অন্য এক অফিসার উপস্থিত হন, জাতিতে মারাঠি ব্রাহ্মণ, তিনি কর্কশ স্বরে বলে ওঠেন, যদি গবেষণার উদ্দেশ্য তাহলে সঙ্গে ক্যামেরা কেন? আমরা জানায় আমরা নাগপুরে নতুন, বেরাতে বেড়িয়েছি, তাই; ‘এই যেমন দীক্ষাভূমি গিয়েছিলাম’। উনি এবার তুলনামূলক স্বাভাবিক গলায় বলেন, ‘জমা দিয়ে ভিতরে যান’। আমরা জানায়, ‘আপত্তি নেই, কিন্তু দামি ক্যামেরা আপনাদের জিম্মায় রেখে যেতে পারি, দায়িত্ব আপনাদের’। এই জবাবে কাজ হয়, ‘ঠিক আছে নিয়ে যান, কিন্তু ক্যামেরা ভিতরে অ্যালাও নয়, আমরা সব নজরে রাখছি’, জানান তিনি। মেন রোড থেকে সিসিক্যামেরার নজরে যখন আমরা, তখন একথা আমাদের জানা, কথা না বাড়িয়ে আমরা এগুতে যাবো, মহিলা অফিসার কার্ড-এর কপি জমা রাখতে বলেন। দেন একটা রেজিস্টার্ড খাতা। ইতিমধ্যে সেখানে একটি যুব দল উপস্থিত হয়েছে, ফোন এসেছে ভিতর থেকে তাদের নির্বিঘ্নে ভিতরে পৌঁছে দিতে। নিরাপত্তা অফিসটির অন্যান্যরা যেন একটু বেশি ব্যস্ত মনে হোল, ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সেই মহিলা অফিসারও। আমাদের নিয়ে তাঁদের বাকি কাজগুলো (অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন, কার্ড দেখা ইত্যাদি) দায়সারা গোছের হয়ে উঠলো। আমরা বাগানের সামনে উপস্থিত হলাম।
গলায় গেরুয়া উত্তরীয়ধারী কয়েকজন সেখানে আমাদের থামায়, জানতে চাই লাইব্রেরি তো এখন বন্ধ, যাবেন কোথায়?
আমরা- কিন্তু আমাদের ট্রেন তো সন্ধ্যেয়, ফিরে যেতে হবে। এত কাছে এসেছি, তাই ডাক্টারজীর স্মৃতিধন্য সংগ্রহশালায় একবার যেতে চাই।
গেরুয়া উত্তরীয়ধারী- আপনারা কারা?
আমরা- নাগপুরে এসেছি একটি অনুষ্ঠানে। খুব ইচ্ছে ছিল এখানে আসার, লাইব্রেরিতে শুনেছি বই কেনারও অপশন আছে।
গেরুয়া উত্তরীয়ধারী- তাহলে বিকেলে আসুন। কিন্তু আপনাদের পরিচয়?
আমরা- জমা দিয়েছি অফিসে। (আদিবাসি অফিসারের নাম নিয়ে), উনিও তাই জানালেন, লাইব্রেরি বিকেলে খুলবে। বাঃ আপনাদের বাগান তো বেশ ভালো।
গেরুয়া উত্তরীয়ধারী- হ্যাঁ, পরিচর্যা করা হয়। কোথা থেকে আসছেন?
আমরা- মতলোগজী এখানে আছেন শুনেছি, বহুদিন ছিলেন তিনি ওখানে, আমরা আসছি সেই কোলকাতা থেকে।
গেরুয়া উত্তরীয়ধারী- ও আচ্ছা। (কিছু মুহূর্ত আপাদমস্তক নজর করে) একটু এগিয়েই বামদিকে সংগ্রহশালা, যান।
ভেবেছিলাম কোলকাতা আর একটা গেড়ো হয়ে উঠবে, কিন্তু এক্ষত্রে তা সহজ এন্ট্রির টোটকা হয়ে উঠলো। যাইহোক আমরা এগোতে থাকলাম। আমাদের অল্প পিছনেই তখন সেই যুব দল, যথারীতি বাগান ও গেরুয়া উত্তরীয়ধারীদের মুখোমুখি। (পরে অবশ্য বুঝেছিলাম তাঁদের আমাদের মত প্রশ্নবাণের মুখে পরতে হয়নি, হওয়ার কথাও অবশ্য নয়)
হেডগেওয়ার সংগ্রহশালা
সংগ্রহশালার রিশেপসানে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। ‘লাইব্রেরি এখন বন্ধ-আমাদের উদ্দেশ্য- ডাক্টরজীর স্মৃতিধন্য ভবন দেখার ইচ্ছা’ এই পর্ব যখন চলছে, তখনই যুবদলটির প্রবেশ। অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা বজরঙ দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এরা। এরা সরাসরি তিনতলায় সংগ্রহশালায় যাবার জন্য অগ্রসর হতেই আমরাও পিছু নিলাম।
সংগ্রহশালাটিতে কি আছে সে তালিকা দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, বলা যেতে পারে হিন্দুত্বের ভক্তদের কাছে তা আগ্রহের বা জ্ঞাত একটি বিষয়। বিশাল এই সংগ্রহশালাটি ডাঃ হেডগেওয়ারের জীবনের বিভিন্ন ‘কীর্তি’-র বিবিধ চিহ্ন, স্মারক, ছবি (ফটোগ্রাফি ও পেন্টিং) ও ব্যবহৃত দ্রব্যের আধার। ভক্তদের বাইরে গবেষকদের কাছেও তা আগ্রহের বিষয় হতে পারে। ভক্তদের কাছে অবশ্য এটি কাশি-কাবার থেকে কম কিছু নয়। যেমন এই বজরঙ দলের কর্মকর্তাদের কাছে। সংগ্রহশালার গাইড/কিউরেটর হেডগেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, তিনি বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে বর্ণনা দিচ্ছিলেন। আমরা শুনছিলাম, নোটও নিচ্ছিলাম। ক্যামেরা তা সে মোবাইল ক্যামেরা হোক না কেন, তা থেকে ছবি তোলার অনুমতি নেই। কিন্তু একটা ছবির কাছে গিয়ে আমাদের চোখ আটকে গেলো।
একদল লোক মারছে কাউকে, যাকে মারছে তার গায়ে রক্তের ছাপ। একটু কাছে যেতেই নজরে পরলও, প্রহৃত ব্যক্তিটি মুসলমান। গাইডকে প্রশ্ন করা হোল, এই ছবির ইতিহাস কি?
গাইড- গোমাতা রক্ষা করতে ডাক্টারজীর যুদ্ধের একটি দৃশ্য এটি।
আমরা- যুদ্ধ, কার সঙ্গে?
গাইড- (এইটা আবার প্রশ্ন নাকি, এই চোখে তাকিয়ে) কাদের সঙ্গে আবার, মুসলমানদের সঙ্গে।
আমরা- (কৌতূহলী ছাত্রের মত) একটু যদি বিশদে বলেন।
গাইড- ডাক্তারজী গিয়েছিলেন জল সত্যাগ্রহের জন্য ...। রাস্তায় দেখলেন একদল মুসলমান জবাই করবে বলে গরু নিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারজী জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, উত্তর আসে জবাই করতে। সঙ্গেসঙ্গে প্রতিবাদ করেন তিনি, দাম দিয়ে গরুটি কিনে নিতে চান। কিন্তু বদমাশরা রাজি হয় না। তখন উত্তমমধ্যম দেওয়া হয়।
আমরা- ডাক্তারজী প্রহার করেন?
গাইড- শুধু তিনি কেন, সঙ্গে উপস্থিত সংঘের স্বেচ্ছাসেবকরাও।
আমরা- এই যে রক্তপাত হচ্ছে মুসলমানদের, তার মানে তারা শুধু মার খেয়েছে, প্রতিরোধ করতে পারেনি?
গাইড- ডাক্তারজীর প্রতাপের সামনে বাঘও মূষিকে পরিণত হয়, তো এই মুসলমানরা কোন ছার।
এই কথোপকথনের সময় বজরঙ দলের যুবকেরা খুব উত্তেজিত এবং ডাক্তারজীর প্রতি সপ্রশংস হয়ে ওঠে। আমরা বাস্তবিক বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, হেগডেওয়ারের জীবনীতে এই ঘটনার উল্লেখ থাকলেও, তা আঁকা ছবি হিসাবে সংগ্রহশালায় থাকতে পারে তা ছিল আমাদের চিন্তার বাইরে। আমরা গাইডকে জিজ্ঞেস করি (যতটা সম্ভব আমাদের উষ্মা, ক্ষোভ প্রকাশ না করে)।
আমরা- এখানে তো অনেক ছবি আছে, আছে বিভিন্ন স্থান বা সংগঠন থেকে ওনার প্রাপ্ত উপহার সামগ্রীও। কিন্তু এই ছবি অন্যরকম।
গাইড- হ্যাঁ হিন্দু শৌর্যের জাগরণ ঘটিয়েছিলেন উনি। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন ছিল ওনার। এই ছবি আমাদের কি করতে হবে তা শেখায়।
আমরা- ‘গোমাতা’ রক্ষার জন্য সারা দেশে হিন্দু যুবকেরা এখন যা যা করছে, এই ঘটনা, এই ছবি তার প্রেরণা বলতে চাইছেন?
গাইড- অবশ্যই।
আমরা- এই ছবি প্রিন্ট নিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় না?
গাইড- না নির্দেশ আছে। ছবি তোলা যাবে না।
আমরা- ছবি তোলার কথা বলছি না। এই ছবি ছাপিয়ে বার্তা দেওয়ার কথা বলতে চাইছি।
পাশ থেকে বজরঙ দলের একজন সদস্য বলে ওঠে, সেকুলার আইন আছে। কি করা যাবে। অর্থাৎ কিনা দেশ হিন্দু রাষ্ট্র হলে এসব করা যাবে, মৃদু স্বরে তাদের কাছে জানতে চাই। সম্মতির হাসি দিয়ে এগিয়ে যায় দলটি। আমরা দুইজনে ভাগ হয়ে যায়, একজন গাইড সহ দলটিকে নানাবিধ প্রশ্ন করতে থাকে। বিশেষত তারা যখন হেডগেওয়ারের কোলকাতা পর্বের ছবিগুলির সামনে। অন্যজন আর এস এস হেডকোয়ার্টারের ‘আইন’ অমান্য করে ছবি তোলে, এবং সঙ্গে সঙ্গে তা হোয়াটসঅ্যাপে আমরা গ্রুপে শেয়ার করে দেয়। বলাবাহুল্য মোবাইল কেড়ে নেওয়ার বা জোর করে ছবিগুলি ডিলিট করার সম্ভাবনা ছিলই। এই ঘৃণ্য ঘটনার ছবি তোলা যাতে আর এস এস-এর প্রতিষ্ঠাতার নিরীহ মুসলমানদের রক্তপাত করে ‘শৌর্য’ প্রকাশ করা যায়, তা আমাদের মানবিক কর্তব্য বলেই আমরা মনে করেছি।
উল্লেখ্য উক্ত ছবির পিছনের একটা ইতিহাস আছে, যার উল্লেখ গাইড করেছিলেন। নারায়ণ হরি পালকর রচিত, হেডগেওয়ার জীবন চরিত (পৃষ্ঠা-১৯৩-১৯৪)বইয়ে এই রকম একটি ঘটনার উল্লেখ আছে। যদিও তাতে মুসলমানদের মারধোরের কথা নেই। উক্ত বইয়ে ‘জঙ্গল সত্যগ্রহ’-এ হেডগেওয়ারের শামিল হওয়ার উল্লেখ আছে। সেখানে যাওয়ার সময়, পুসদের একটি ঘটনা উল্লিখিত।
প্রাতঃকালে নদী থেকে শৌচাদি সমাপ্ত করে ডাক্তারজী ফিরে আসছিলেন, তখন তিনি দুজন মুসলমানকে এক হৃষ্ট-পুষ্ট জোয়ান গরুকে ধরে নিয়ে যেতে দেখলেন। ডাক্তারজী জানতে চাইলেন, ‘গরু কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’ তারা উত্তর দিন, ‘নিয়ে যাচ্ছি না কোথাও। একটু পরেই এখানে কুরবানি করব।’ ডাক্তারজী ক্রুদ্ধ হলেন, তিনি গরুর দাম জিজ্ঞেস করলেন। ওরা জবাব দিল, ‘বারো টাকায় কিনেছি, কিন্তু আমাদের কসাইয়ের ব্যবসা, তাই এটা আমরা বিক্রি করবো না।’ হেডগেওয়ার নাছোড়, আর কসাই গরু দিতে চাইছে না। হেডগেওয়ার গরুর দড়ি নিজের হাতে নিয়ে হুমকি দিতে থাকলেন। কসাই বোঝাতে থাকেন, ‘এখানে গরু কাটা একটা প্রথাগত ব্যাপার, আপনি আমাদের ছেড়ে দিন’। একজন বোঝাবার চেষ্টা করেন, ‘এখানে জঙ্গল সত্যাগ্রহে এসে ফালতু বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন কেন?’ হেডগেওয়ার গর্জে ওঠেন, ‘হিন্দুদের পুজ্য গরুকে রক্ষা করা কি ফালতু ব্যাপার? জঙ্গল সত্যগ্রহ করা বা গরুর জন্য সত্যগ্রহ করা আমার কাছে দুটোই সমান’। সঙ্গে থাকা স্বয়ংসেবকরা আরও আক্রমক হয়ে ওঠে। এক পুলিশ অফিসার এসে দুই পক্ষকে থামাবার চেষ্টা করেন, গ্রেফতার করা হবে দু পক্ষকে তা জানান। শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা গরু করবানি থেকে বিরত হয়। হেডগেওয়ার টাকা দিয়ে গরু কিনে তা স্থানীয় গো-রক্ষণ সংস্থাকে উপহার হিসাবে দিয়ে দেন।
এরপর আমরা সেই গাইডকেই শ্রীকৃষ্ণ মতলোগের সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায়, আমাদের ‘গবেষণা’র কাজে যা জরুরি, তাও জানায়। গাইড জানায় তা সম্ভব নয়। আমরা ‘কোলকাতা-পূর্ব পরিচয় (স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি-গবেষণা’ আওরাতে থাকি, অনুরোধ করি বারংবার। ইতিমধ্যে বজরংদলটিও চলে গেছে। অবশেষে গাইড ফোন করে, আমাদের বিষয়ে কারুর কাছে অনুমতি চাই। অপেক্ষা চলে। প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষার পর আমাদের জানানো হয়, অল্প সময়ের জন্য এই কথোপকথন বরাদ্দ হয়েছে, আমাদের কথা বলতে হবে অন্যের উপস্থিতিতে। আমরা সঙ্গেসঙ্গেই রাজি হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের পূর্বাঞ্চলীয় প্রচারক শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ। ৩১ জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর প্রায় ১ টার সময় তাঁর সঙ্গে আমাদের কথোপকথন। কথোপকথন হয় নাগপুরে আরএসএস-এর হেডকোয়ার্টারে। ১৯৮১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত উনি পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন। ১৯৬২ তে উনি গৌহাটিতে আর এস এস-এর শাখা মজবুত করার দায়িত্ব পান। প্রায় ১০ বছর উনি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে হিন্দুত্বের প্রসারে যুক্ত থাকেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, ‘খ্রিষ্টান মিশনারিরা উত্তর-পূর্বকে খ্রিষ্টান ল্যান্ড বানাতে চাইছিল। আমাদের কাজ ছিল স্থানীয়দের মধ্যে হিন্দুত্বের প্রসার ঘটানো’। শুরু হয় আমাদের কথোপকথন, আগে ও পরের অংশ নিয়ে, এডিটেড।
আমরা- আমরা কোলকাতা থেকে এসেছি। শুনলাম আপনি কোলকাতায় ছিলেন প্রায় বিশ বছর।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ ছিলাম।
আমরা- আপনার বাংলাও বেশ ভালো। আপনার আদি নিবাস কোথায়?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- মহারাষ্ট্র। এই নাগপুরের কাছেই।
আমরা- মানে বিদর্ভে। নাগপুর তো হিন্দুত্ব রাজনীতির কাছে মক্কার মত। আপনার গর্ব হয় না?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সারা ভারতই নাগপুর।
আমরা- হবে না হয়ে গেছে?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- (সহাস্যে) হবে, হবেই।
আমরা- পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন বহু বছর। আরএসএস-এর পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকাকালীন বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছিল নিশ্চয়। রাজ্যের শাসক হিসাবে সিপিএম, তৃণমূল দুটি দলকেই দেখেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করেন।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- পলিটিক্যাল পার্টি হিসাবে সিপিএম অনেক মজবুত সংগঠন ছিল। ওদের আইডলজি ছিল হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে। ওদের ক্যাডাররাজ ছিল, আর এস এস-এর কাজ করা তখন মুশকিল ছিল। হিন্দুত্বের কোন প্রোগ্রাম নিলে বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করতো।
আমরা- সি পি এম-এর শাসনের সময়ের কথা বলছেন?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ বামফ্রন্ট আমলের কথা।
আমরা- এখন কি রকম অবস্থা? আপনাদের কাজ করার ক্ষেত্রে?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- এখন তো সিপিএম-এর রাজ নেই। ওদের রাজ চলে যাওয়ার পর ওদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এখন মমতার রাজত্ব, আর মমতার কোন আইডলজি নেই। মমতার পার্টি কোন ক্যাডার বেসড পার্টি নয়।(হটাৎ সন্দিগ্ধ চোখে) আপনারা কি পত্রকার (সাংবাদিক)?
আমরা- না আমরা ক্ষেত্র গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, সংঘর্ষ ও সহাবস্থান নিয়ে কাজ করি।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- এখানে কেন এসেছেন?
আমরা- আমরা আজ সকালে দীক্ষাভূমি গেছিলাম (যেখানে আম্বেদকার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন)। এখানেও এসেছিলাম এখানের লাইব্রেরিতে কিছু বই দেখবো বলে। আমরা কয়েকটি বই কিনতেও চাই?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- কি বই?
আমরা- এই যেমন গোলওয়ালকরের তর্জমা করা জি ডি সাভারকারের বই, ‘উই, ওর আওয়ার ন্যাশানালিজিম ডিফাইন্ড’। পাবো কি সেটা?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- এটি মারাঠি ভাষায় লেখা ছিল, বইটির নাম ‘রাষ্ট্র মীমাংসা’।
আমরা- বইটি ছিল সংক্ষিপ্ত তর্জমা। সংঘের কর্মীদের কাছে অবশ্য ‘গীতা’ তুল্য।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- কোলকাতাতেই তো এটি পেয়ে যেতেন।
আমরা- না পায়নি। ‘রাষ্ট্র মীমাংসা’ কি এখানে পাবো?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- দেখুন পাবেন কিনা! কোথায় উঠেছেন এখানে?
আমরা- এক বন্ধুর বাড়িতে। কয়দিন থাকবো। আবার এখানে আসার ইচ্ছে আছে। এখন বোধহয় লাইব্রেরি খোলা পাবো না।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- না।
আমরা- আচ্ছা একটা সময় শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁর অনেক সঙ্গে আর এস এস-এর মিলত না। উনি নিজের মত চলতেন।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- নরেন্দ্র মোদী তো আর এস এসেরই। উনি প্রচারক ছিলেন। পরে রাজনীতিতে চলে গেছেন।
আমরা- কোন কি মতভেদ ছিল?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- না না না। কোন মতভেদ থাকবে কেন? সংঘের পুরো ব্যাপারটায় সুচিন্তিত, পরিকল্পিত। আপনারা কি সংঘের কাজ সমন্ধে জানেন কিছু?
আমরা- সেভাবে না হলেও বই পড়ে জেনেছি।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সংঘের মধ্যে যারা রাজনীতিতে ইচ্ছে থাকে তাঁরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে, যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে চায় তাঁরা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রবেশ করে, যারা মজদুরদের নিয়ে কাজ করতে চাই তাঁরা মজদুর সংঘে ঢোকে।
আমরা- যেমন ‘বনবাসী কল্যাণ পরিষদ’, যারা আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ।
আমরা- আদিবাসীদের ‘হিন্দু’ হিসাবে গড়ে তুলতে বনবাসী কল্যাণ পরিষদ কি কি কাজ করে?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- ওরা তো হিন্দুই।
আমরা- তাহলে আবার ‘ধর্মান্তরকরণ’ করতে হয় কেন?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- ধর্মান্তরকরণ নয় ঘর ওয়াপসি। খ্রিষ্টান থেকে হিন্দু।
আমরা- এই কাজ তো বিশ্ব হিন্দু পরিষদ করে থাকে। ওরা তো আপনাদেরই অঙ্গ।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ।
আমরা- বজরঙ্গ দলের অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন কিছুক্ষণ আগে। ওরাও তো আপনাদের অঙ্গ।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- অবশ্যই।
আমরা- আর যারা সংস্কৃতি রক্ষার জন্য পথে নামে? ১৪ ফেব্রুয়ারি কিছু প্রোগ্রাম আছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, যেমন বানর সেনা ইত্যাদি।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সব খবর জানি না। তবে দেশ ও সংস্কৃতি রক্ষায় যারা আছে আরএসএস তাদের সঙ্গে থাকবে।
আমরা- সংস্কৃতি মানে কি ধর্ম?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- আমাদের কাছে দুটিই এক।
আমরা- ওড়িশাতেও বজরঙ্গ দল আছে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের রুখতে যারা সামনে, তাই না?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- অবশ্যই।
আমরা- দারা সিং তাহলে আপনাদের সম্পদ।
উত্তর না দিয়ে মুচকি হাসলেন।
আমরা- বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যেভাবে চলছে, যেসব আইন নিয়ে আসছে তাতে আপনাদের সহমত আছে?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সহমত তো আছেই।
আমরা- এই যে ধরুন এন আর সিতে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেলো, তাঁর মধ্যে ১২ লক্ষ হিন্দু। কেন্দ্র সরকার নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী নিয়ে এলো। যার প্রতিবাদে দেশ জুড়ে বিক্ষোভ। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- এটাতে তো কেন্দ্রীয় সরকার এবং আর এস এস-এর ইনভল্ভড হওয়ার কথা। হিন্দুদের বিষয় যখন।(পরে একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে)তবে এই সব রাজনৈতিক বিষয়ে আর এস এস স্টেটমেন্ট দেয় না।
আমরা- মানে এই বিষয়ে আপনাদের কোন স্টেটমেন্ট নেই? যাইহোক, একটা কথা, মানুষকে আরও ‘মানুষ’ করার বিষয়ে তো সংঘের একটা রোল ছিল। মানে সমাজ নিয়ে সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে? সেসব নিয়ে কি ট্রেনিং হয়?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- যখন থেকে সংঘ আরম্ভ হয়েছে তখন থেকে হয়। আপনি কি সংঘের কোন শাখা দেখেছেন, কার্যক্রম দেখেছেন কি?
আমরা- কার্যক্রম দেখেছি ধানবাদে।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সংঘ কোথায় কোথায় কি করবে তা কেউ জানেনা। আগেও জানতো না। তাই জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। এরা প্যারামিলিটারি হতে পারে। ওরা এটা হতে পারে। ওটা হতে পারে। যখন প্রত্যক্ষভাবে সংঘের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবেন তখন বুঝতে পারবেন সংঘ কি।
আমরা- যুবকদের সামরিকীকরণ, হ্যাপ প্যান্ট, শারীরিক কসরত- এসব কি আসন্ন সংঘর্ষের প্রস্তুতি?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ আমাদের সবসময় সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।
আমরা- ডাক্তারজীও (হেগরেওয়ার) সেরকমই চেয়েছিলেন। তাই তো?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- উনি তো সংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমরা- যেমন উনি ১৯৩০ সালে নাগপুরে মুসলমানদের শবক শিখিয়েছিলেন সংঘের মাধ্যমে, তাই না? স্বেচ্ছাসেবকরা লাঠি হাতে পাহারা দিত।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- ঠিক।
আমরা- আপনার কথা বলুন, পরাশুনা ইত্যাদি।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- আমি ১৯৬২ তে প্রচারক সংঘের হিসাবে কাজ করি। আমি নাগপুরের ভিএনআইটি(ভিশ্বেশ্বরা ন্যাশান্যাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি)আগে যা ছিল ভিআরসি(ভিশ্বেশ্বরা রিজিওন্যাল কলেজ),আমি ওখান থেকে গ্রাজুয়েশান করেছি। গ্রাজুয়েশান করার পর আমি প্রচারক হয়েছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার হলেও কোনদিন কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কাজ করিনি।
আমরা- আপনার পরিবার নেই?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- পরিবার ছিল, এখন নেই। পরিবারের সবথেকে বড় ছিলাম আমি। কিন্তু আমরা যারা প্রচারক, যেমন নরেন্দ্র মোদী প্রচারক ছিলেন তাঁরা কোনদিন বিয়ে করতে পারেন না। আমিও করিনি।
আমরা- কিন্তু নরেন্দ্র মোদী তো বিয়ে করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- খুব কম বয়সে করেছিলেন, উনি তখন জানতেনও না বিয়ে কি জিনিষ। আগে এইরকম হত, তাই না? কিন্তু যখন বড় হয়েছেন, বুঝেছেন এই লাইনটা ঠিক নয়, আমাকে সংঘের লাইন নিতে হবে তখন ত্যাগ করেন। তারপর তিনি প্রচারক হয়েছেন। এখানে থেকেছেন। আমিও ছিলাম সে সময়। ফ্যামিলি না থাকার কারণে কোন বার্ডেন নেই। টাকা পয়সা কারুর জন্য রাখার কোন দরকার নেই।
আমরা- তা নেই। আচ্ছা কালচারাল ন্যাশানালিজিম মানে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ, এর অধীনে কীভাবে সারা ভারতে সকলকে আনা যায়, ইনভল্ভড করা যায়?
উনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। উত্তর দেন না। আমি আবার রিপিট করি, এবার হিন্দিতে।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সেই পথেই তো আমরা চলেছি। পথ তো একটাই। আস্তে আস্তে যখন মানুষ বুঝবে তখন আসবে। আমি তো বহুদিন ছিলাম কোলকাতায়। ওখানে সিপিএমের কার্যকর্তাদের সঙ্গে বসেছি। তাঁরা বলেছে তাঁরা জানতোই না এসব।
আমরা- তাঁরা কি কনভিন্স হয়েছিল?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- হ্যাঁ হয়েছিল। তারাও তো ডেডিকেটেড ওয়ার্কার ছিল। তাঁরা বলেছিল তারা এসব জানতোই না। আগে যদি জানতে পারতাম তো ভালো হতো।
আমরা- তাঁরা কি রাজ্য স্তরের নেতা?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- রাজ্য স্তরের, জেলা স্তরের। এমনকি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গেও। তবে তাঁদের নাম বলতে পারবো না।
আমরা- একজনেরও?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- না।
আমরা- উদ্দেশ্য?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- আমাদের উদ্দেশ্য একটাই।
আমরা- হিন্দুরাষ্ট্র।
উত্তরে উনি মৃদু হাসলেন। আমাদের কথা বেশিরভাগ এখন বাংলাতেই হচ্ছিল। আমাদের ওপর নজর রাখা একজন তখন একটু তফাতে দাঁড়িয়েছেন, সম্ভবত বুঝতে না পেরে। আমরা আবার শুরু করলাম।
আমরা- আপনার কি মনে হয় ভারত একদিন হিন্দুরাষ্ট্র হবে?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- আছেই হিন্দুরাষ্ট্র।
আমরা- হ্যাঁ ডিফ্যাক্টো। কিন্তু ঘোষণা?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- ঘোষণার আবশ্যকতাই নেই।
আমরা- সংবিধানের পরিবর্তনের দরকার নেই?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- সংবিধানের পরিবর্তন? এটা যেটা পরিবর্তন হোল (নাগরিকত্ব আইন) সেই রকমই হতে পারে। সংবিধানের জন্য মানুষ না মানুষের জন্য সংবিধান?
আমরা- মানুষের জন্যই সংবিধান। কিন্তু সেই মানুষ তো সকলেই, সব ধর্মের, সব ভাষার।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- আগেই বলেছি আর এস এস ও বিজেপি একই লক্ষ্যে চলছে।
আমরা- লক্ষ্যটা স্পষ্ট, হিন্দুরাষ্ট্র। তাইতো?
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- অবশ্যই। কিন্তু আপনারা করেন টা কি?
আমরা- ওই যে বললাম। রিসার্চের কাজ। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ ও ভালোবাসা দুটোই বোঝার চেষ্টা করি।
একজন মাঝবয়েসী লোক ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনার জায়গায় চলে এসেছেন। মারাঠিতে কিছু জিজ্ঞেস করলেন শ্রীকৃষ্ণ মতলোগকে, উনি মৃদু স্বরে কিছু বললেন।
শ্রীকৃষ্ণ মতলোগ- এবার আমায় উঠতে হবে।
আমরা- ধন্যবাদ, আমাদের সময় দেবার জন্য (শ্রীকৃষ্ণ মতলোগের দিকে তাকিয়ে)।
মাঝবয়েসী লোকটি হিন্দিতে রূঢ় স্বরে আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
মাঝবয়েসী লোকটি- বরাদ্দ সময়ের অনেক বেশি আপনারা কথা বলেছেন। আপনারা কিছু রেকর্ড করেছেন কি? ছবি তুলছিলেন দেখলাম।
আমরা- ওনাকে জিজ্ঞেস করেই ওনার ছবি নিয়েছি।
মাঝবয়েসী লোকটি- আপনারা কি জন্যে এসেছেন?
আমরা- আমরা ওনাকে জানিয়েছি, জিজ্ঞেস করে নিন।
রিসেপসানে গিয়ে সেখানে মোতায়েন ব্যক্তিকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বাংলায় কথাবার্তা হওয়াই কিছুই বুঝতে পারেননি তা বলেন।
মাঝবয়েসী লোকটি- ঠিক আছে আপনারা যান। ওনার বিশ্রামের সময় হয়ে গেছে।
এরপর আমরা সেখান থেকে চলে আসি।
(সেইদিন আর একবার আমরা একটা প্রয়াস চালায় লাইব্রেরি যাওয়ার। আমরা লাইব্রেরিতে পৌঁছয়। তখন আরও কিছু মানুষ এসেছিলেন লাইব্রেরিতে। কিন্তু আমাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছিল তা আমরা বুঝতে পারি। লাইব্রেরি সংলগ্ন অংশে একজন মোবাইলে কাউকে বলছিলেন, ‘কলকাত্তা সে আয়া’। ইতিপূর্বে প্রাপ্ত তথ্যগুলির সংরক্ষণের জন্য আমরা চলে আসি। গেরুয়া গামছা গলায় একজনকে দেখি আমাদের অনুসরণ করতে। কিন্তু আমরা চলে আসতে সক্ষম হই।)
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.-
পশ্চিমবঙ্গ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৭ বসিরহাট, বাদুরিয়া
বছর সতেরোর এক কিশোরের... -
FACT-FINDING REPORT ON HALDWANI VIOLENCE OF FEBRUARY 8, 2024 AND ITS AFTERMATH
Violent incident occurred on 8.02.2024 in Banbhulpura,... -
The Language of the People by the River
The rivers that flow by the hills have strong current.... -
Mapping Polarisation: Four Ethnographic Cases from West Bengal
Religious polarisation is on the rise in India especially...