পশ্চিমবঙ্গ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৬

‘অল্প হিন্দু থেকে বেশি হিন্দু’ কিংবা ‘অল্প মুসলমান থেকে বেশি মুসলমান’ হওয়ার বাতাবরণে, পারস্পরিক সন্দেহ, বিদ্বেষের যে সাম্প্রদায়িক বিষ সমাজের সকল স্তরের মানুষের মননে ছড়িয়ে যাচ্ছে, তারই ফলশ্রুতি ধূলাগড়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এর সাথে যুক্ত রয়েছে প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক নেতাদের ধূর্ততা, শঠতার অভিসন্ধির বিবরণ।

পশ্চিমবঙ্গ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৬
ধুলাগড়, চন্দননগর, হাজিনগর (নৈহাটি)

তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন।


Conflict area study – 4

Paschimbanga: Sampradayik Danga, 2016
(Dhulagarh, Chandannagar, Hajinagar (Naihati), A Factfinding report
Published: 1 July, 2017

পশ্চিমবঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৬
ধুলাগড়, চন্দননগর, হাজিনগর (নৈহাটি)
প্রকাশ : ১৬ আষাঢ়, ১৪২৪ (1 July, 2017)

তথ্যসংগ্রহ - ধুলাগড় (দুই পর্যায়) :
ফারুক উল ইসলাম, সুস্মিতা রায়চৌধুরী এবং সুভাষ দাস

চন্দননগর (দুই পর্যায়) :
সুভাষ দাস, অনুপম দাস অধিকারী এবং শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী

হাজিনগর (দুই পর্যায়) :
শমীন্দ্র সরকার, ফারুক উল ইসলাম, অনুপম দাস অধিকারী, সুস্মিতা রায়চৌধুরী,
শুভপ্রতিম রায় চৌধুরী।

অক্ষরবিন্যাস : টুটুন মুখার্জী
সম্পাদনা : শুভপ্রতিম রায় চৌধুরী।

প্রকাশনা, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : অনুপম দাস অধিকারী
আমরা - এক সচেতন প্রয়াস, ৩৯৩, সার্ভেপার্ক কলকাতা-৭০০০৭৫

ফোন : ৯০৩৮৫ ৩০৬৯০, ৮০১৭৯ ৫৪১২৬
ই-মেল : aamrasachetan@gmail.com

মুদ্রণ : লেজার এইড ৩৫-এ/৩, বিপ্লবী বারীন ঘোষ সরণী,
কলকাতা- ৭০০০৬৭

বিনিময় : ২০ টাকা

 

সচেতন প্রয়াস


‘শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস’– রবীন্দ্রনাথের এই আশঙ্কা আজ বাস্তবতা। আমরা জানি প্রতিটি যুদ্ধের পরে শান্তি, প্রতিটি দাঙ্গার পরে সহাবস্থানের কথা উচ্চারিত হয়। এর যথার্থতাও আছে। আমরা মনে করি দাঙ্গার স্বরূপ (তা যত কুরূপই হোক) উঘাটিত হওয়া উচিত। অন্যথায় গুজব হাতিয়ার হয়ে ওঠে, দাঙ্গা প্রসারিত হয়। আমাদের প্রয়াস, তথ্যায়ন ও প্রকাশনার মাধ্যমে পাল্টা হাতিয়ার হয়ে ওঠার; শান্তি ও সহাবস্থানের পক্ষে।
আমরা নিতান্তের সামর্থ্যে, গভীর নিষ্ঠায় সংঘর্ষ ও সহাবস্থানের তথ্যায়ন করে থাকি। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মুখ (এবং মুখোশ) এর সাথে কথা বলে, দলিল দস্তাবেজ (যদি পাওয়া যায়) ঘেঁটে, চেষ্টা করি তুলে ধরতে সমাজ-মনের অবস্থান। মৌলবাদ (বিভিন্ন পরিসরে যা বিদ্যামান), রাজনৈতিক ধর্ম, রাষ্ট্রীয়-কৌম সামাজিক-গোষ্ঠীয় হেজিমনির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। অবস্থানের স্পষ্টতা রেখেও চলে তথ্যায়ন পর্বে সংগৃহীত তথ্যের নিটোল পরিবেশন ও বিশ্লেষণ।
২০১৬-র পশ্চিমবঙ্গ, এক অশনি সঙ্কেতের বার্তা আনে। সংগঠিত শক্তির প্ররোচনায় এবং প্রকল্পে সাম্প্রদায়িক মেরকরণের লক্ষ্যে হিংসা-দাঙ্গা-অবিশ্বাস তৈরির প্রথম বছর, ২০১৬। ধর্মান্তরকরণ (খরমাডাঙ্গা, বীরভূম, ২০১৫) এবং সাম্প্রদায়িক হিংসা (কালিয়াচক, মালদহ, ২০১৬) সহ বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা জেনেছি রাজ্যে হিন্দুত্ব ও জেহাদি শক্তির অস্তিত্ব ও বিস্তৃতি। তখনও তা ভগ্নাংশে। ২০১৬-র শেষে এবং ২০১৭-র প্রথমে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, গঙ্গা আরতি (বেনারসের আদলে এখন এই রাজ্যের গঙ্গা তীরে নতুন ইভেন্ট), গণপতি উৎসব, হনুমান পুজোর অনুপ্রবেশ। ফতেয়া দোহজ দহম বা নবী দিবস পালনে নব উৎসাহ। মহরমে ও রামনবমীতে সশস্ত্র মিছিল।
এই পর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনটি জনপদ চন্দননগর, হাজিনগর (নৈহাটি) এবং ধুলাগড়ে আমাদের তথ্যানুসন্ধান দল যায় একাধিক বার।
পশ্চিমবঙ্গে আরো কয়েকটি স্থানে দাঙ্গার ঘটনা ঘটলেও আমরা সেখানে তথ্যানুসন্ধানে যেতে পারিনি। চন্দননগর, হাজিনগর এবং ধুলাগড়ে কথা হয়। সাধারণ মানুষের সঙ্গে। কথা হয় দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, অধিকার রক্ষা কর্মী, দাঙ্গা প্রতিরোধকারী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মনে বিদ্বেষ পুষে রাখা মানুষের সঙ্গে। কেউ ছিলেন অকপট, কারো কপটতা বোঝা যাচ্ছিল, আবার কেউ ছিলেন ভীত (তাদের নাম পরিবর্তিত রূপে এসেছে প্রতিবেদনে)। ১৪৪ ধারা জারি থাকার কারণে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন আমাদের যেতে বাধা দেওয়ার কারণে দাঙ্গার তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে পারিনি। যখন গেছি তখনও পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং আতঙ্ক এক তুঙ্গ অবস্থায়। যে মরমী মন সহাবস্থানকে দৃঢ় করে তার অভাব আমরা দেখেছি। মানুষ ক্রমে ‘অল্প হিন্দু, অল্প মুসলমান’ থেকে ‘বেশী হিন্দু, বেশী মুসলমান’ হয়েছে। তবে জমাট অন্ধকারেও দীপশিখার মত পেয়েছি কতিপয়।
মুখ ও মত নির্বিশেষে যে কথায় সম্মতি প্রায় সকলের তা হল প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রসঙ্গ, রাজনৈতিক নেতাদের ধূর্ততা, শঠতার অভিসন্ধির বিবরণ। এতো নির্দিষ্ট ছিল সেই আঙুল যে আমরা যোগাযোগ করি তাদের বক্তব্য জানতে; ব্যর্থ হই। ইমেল পাঠালেও উত্তর আসেনি আজ অবধি। ধুলাগড় ও সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কথা বলি ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য কার্যালয়ে, জামায়াতে ইসলামী হিন্দ-এর রাজ্য কার্যালয়ে।
তথ্যায়নের বিশ্লেষণে যা পাওয়া গেছে তা উদ্বেগের। কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলের ভূমিকা প্রশ্নচিহ্নের সামনে। সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা ধর্মকে সামনে রেখে সাধারণ হিন্দুকে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পথে নিয়ে যেতে কখনও পুজো, কখনও ওয়েবসাইটে লাগাতার মুসলিম বিরোধী প্রচার, বানানো সংবাদ, কখনও দাঙ্গা ঘটাতে প্রকল্প রচনা করেছে। মুসলিম মানসে রাজনৈতিক ইসলামের প্রচারে এমনিতেই মসজিদের ভূমিকা যথেষ্ট। সম্প্রতি অল ইন্ডিয়া মজলিসএ ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের আনাগোনা হয়েছে, ধুলাগড়ে, হাজিনগরে। জামায়াতে ইসলামী হিন্দ-এর নবী দিবস পালনে সংগঠিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। আগের তুলনায় ‘ইসলামি জলসা’র সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। সামগ্রিক এই অবস্থার প্রেক্ষিতে জনপদ তিনটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সহ সংঘর্ষের বিবরণ রাখা হল। রাখা হল আমাদের উপলব্ধি।
ধুলাগড় : যে এলাকায় আগে কখনও সাম্প্রদায়িক হিংসা হয়নি, এবারে সেখানেও প্রসারিত হিংসা। সমাজে বিভাজন, পারস্পরিক দ্বেষ কোথাও প্রকট, কোথাও অপ্রকট ছিল। ২০১৬, বিভাজনকে প্রকাশ করেছে। ভূমি প্রস্তুত ছিল, তাই খেলার মাঠের দখল দেশলাইয়ের ভূমিকা নিল। রাজনীতির মদত ছাড়া শতাধিক বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত ও ভস্মীভূত হওয়া বাস্তব নয়।
চন্দননগর : দাঙ্গা প্রভাবিত উর্দি বাজার, লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার বিভাজিত। লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারে মুসলিম দোকান বা উর্দি বাজারে হিন্দু দোকান আক্রমণের শিকার। কিন্তু কোথাও অনুশোচনার কোনও প্রকাশ (লোক দেখানো হলেও) ছিল না। হিন্দুমানসে ‘মুসলিমদের শিক্ষা দেওয়া গেছে’– এরকম অভিব্যক্তি ব্যাপক। প্রশাসন ও রাজনীতি যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযুক্ত। রাজ্যের শাসক দলে যুক্ত অথচ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এজেন্ডার রূপকার, এই অভিযোগ আক্রান্ত মুসলিম বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির। ২০১৫-র রামনবমী পালন (বাস্তবে আস্ফালন, আক্রমণ) দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের উপদ্রুতকরণের শুরু। নেপথ্যে সংঘ পরিবার।
হাজিনগর, নৈহাটি : চশমা বাবার মাজার, হিন্দু-মুসলিম চুক্তি সহাবস্থানের নিদর্শন; যা রসদ হতে পারতো বিভাজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হয়নি। হুকুমচাঁদ জুট মিলের শ্রমিক আন্দোলন, মুছতে পারতো বিভেদ, এককাট্টা লড়াইয়ে শ্রমিক পরিচিতি। হয়নি। বোমাবাজিতে মরেনি কেউ, মরেছে ‘মিনি ইন্ডিয়া’। স্পষ্ট উচ্চারণে এসেছে যাদের নাম তারা দিনে তৃণমূল রাত্রে আরএসএস। দুটি ক্লাব, কিছু মানুষ করেছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। নাহলে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলার সেই রাত্রি আর একটা ভাগলপুর বা বেস্ট বেকারি হতে পারত। সঙ্ঘ পরিবার কীভাবে, কোন কোন এলাকা দিয়ে অতগুলো দাঙ্গাবাজকে একত্রিত করলো, আক্রমণের সময় পুলিশ কেন প্রথমে নির্লিপ্ত ভূমিকায় থাকলো — এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইছে হাজিনগর।
দাঙ্গায় অভিযুক্তরা অধরা রইলো, লুকিয়ে রইলো ক্ষমতার আশ্রয়ে। স্থানীয় বিধায়কের ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নাতীত নয়।
শুভপ্রতিম আমরা, এক সচেতন প্রয়াস
চন্দননগরে আমরা দুই পর্যায়ে যাই।প্রথমে অশান্তি চলাকালীন।কিন্তু উত্তেজনা, ১৪৪ ধারা জারি থাকায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। এলাকার বাইরে যা কথা হয়েছ তা বেশীরভাগই গুজব মনে হয়েছে। যেমন প্রচুর হিন্দুর দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বা ‘মহরমের মিছিল এদিকেও আসবে’ ইত্যাদি। তবে সংগঠিত প্রয়াসে এবং ধর্মীয় মানসিকতার কারণে গুজব সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি পেয়েছে, এই রকমই অভিজ্ঞতা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের যাওয়া ১৯.১১. ২০১৬ তারিখে। সজি বিক্রেতা, মৃৎশিল্পী, ফার্নিচার বিক্রেতা, গৃহবধূ, ক্ষতিগ্রস্ত মাংসের দোকানের মালিক, ইত্যাদি মানুষের সাথে কথা হয়। আমরা এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু অসফল হই।

।। ১ ।।


লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের দুইজন কাঁচা আনাজ বিক্রেতার সঙ্গে কথোপকথন :
১ম বিক্রেতা : ওরা (মুসলমান) সব ঠাণ্ডা মেরে গেছে। ওরা বুঝে গেছে। এরাও (হিন্দু) কি রকমের আছে।
২য় বিক্রেতা : ওরা (মুসলমান) বুঝে গেছে আমরাও (হিন্দু) রেডি আছি। ওরা ঝামেলা করলো কেন মহরমের আগের দিন? এতোটা আওয়াজ সকালে তো হয়নি।
১ম বিক্রেতা : আমরা ওদের পাশ দিয়ে গেলে বলছে গুলি করে দেবো। তোদের পাওয়ার নেই, তোরা বাঙালি। ওদের ভয়ে কি আমাদের থাকতে হবে, মাথা নীচু করে?
প্রশ্ন : এখানে হিন্দুদের সংগঠন আছে?
২য় বিক্রেতা : আছে মানে? এখন একবার যাও না। সব ‘জয় শ্রীরাম’ হয়েছে। গুনে শেষ করতে পারবে না।
১ম বিক্রেতা : বিহারীরা আছে। সেদিন আড়াই হাজার লোক বেরিয়েছিল। এখন একবার ডাকলেই দশ হাজার লোক জড়ো হবে। যদি শুধু বাঙালি থাকতো তবে এতো হতো কি?

।। ২ ।।


ছোটেলাল - মৃৎশিল্পী : এখানে কয় ঘর কুমোর আছে, সবাই হিন্দুস্তানি (অর্থাৎ হিন্দিভাষী)। এখন ঝামেলা নেই। দাঙ্গার সময় ব্যবসার ক্ষতি হয়। পুজোর সময় বা পরে মাটির জিনিসের চাহিদা থাকে। আমাদের লস হয়।
প্রশ্ন : কিভাবে দাঙ্গা হল ?
ছোটেলাল : কাল ধরুন মহরম, আজ রাত্রে হয়েছিল দাঙ্গা। মুসলমানরা মহরমে লাঠি খেলে। তখন হিন্দুদের দোকান ভাঙচুর, লুঠপাট করতে লাগলো। পুলিশ এলো, পাহারা দিতে লাগলো। কেউ আহত হয়নি।
প্রশ্ন : এইকি প্রথম, না আগেও হয়েছে?
ছোটেলাল : না, হয়েছে আগে। গেল বছর রামনবমীর সময় ঝামেলা হয়। তখন থেকেই টুকটাক লেগে আছে।
প্রশ্ন : হিন্দুদের হয়ে কোন সংগঠন আছে? কোথায় আছে তাদের অফিস?
ছোটেলাল : কেন, বজরঙ্গ দল, শিবসেনা! শুধু লিচুপট্টি কেন, সব জায়গাতেই বজরঙ্গ দলের লোক আছে। এখানে আর কি হয়েছে, আমরা তো শুনেছি নৈহাটির হাজিনগরে সাংঘাতিক হয়েছে। এখানে না হলেও হাজিনগরে মার্ডার হয়েছে, হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই। ওখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশী।
প্রশ্ন : এই কথা আপনাদের কে বলল?
ছোটেলাল : সবাই জানে। তাই তো আমরা একজোট হলাম।

।।৩।।


সন্ধ্যাঘোষ (গৃহবধূ) - রামনবমীর সময় মারামারি হয়েছিল। এবারে মহরম নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। হিন্দুরা বিসর্জন নিয়ে মিছিলে যেতে পারেনি। আমরা খুব ভয়ে আছি। আমার দুই মেয়ে।।
বাজারে মুসলমান মালিকের মালের দোকানে ঝামেলা হয়েছে। এদিকের মুরগীর দোকানগুলো বাঙালির। ঝামেলায় লোকালরাও ছিল।
মন্দিরটা আমাদেরই। ঘোষ পরিবারের।

।।৪।।


জাফর কুরেশী - মাংসর দোকানের মালিক কলিম কুরেশীর ভাইপো
দোকান – হাজি মহ রুল্লা কুরাইশি মিট শপ লক্ষ্মীগঞ্জ বাজার। জগন্নাথ বাড়ি মোড়।
প্রশ্ন : সেদিন কি হয়েছিল?
জাফর : মারধর হয়েছিল। ভাঙচুর হয়েছিল আমাদের দোকানে। এইসব এখন নতুন করে লাগানো হয়েছে (টাইলস)।
প্রশ্ন : তুমি কি সেদিন ছিলে?
জাফর : না আমি ছিলাম না।
প্রশ্ন : এখন যে আবার দোকান খুলছো, কোনো ভয় আছে?
জাফর : সে তো আছে।
(আমরা যখন সেখানে যাই তখন দোকান ধোওয়া হচ্ছিল, নতুনভাবে টাইলস বসানো হয়েছে তা বোঝা যাচ্ছিল। সকালের বেচাকেনার পর তখন দোকান বন্ধ করার সময়)

।।৫।।


মহম্মদ সাকরেল - ফার্নিচার দোকানের মালিক :
উর্দিবাজার মেন রোড।
মহম্মদ সাকরেল : এখন পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ। কিছু দোকান তখন লুঠ হয়। মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর হয়েছে। হিন্দুদের সেরকম কিছু হয়নি।
প্রশ্ন : এখানে এসব কিছু হবার পর কোনো নেতা এসেছিলেন?
মহ. সাকরেল : না না। এসব নেতাদেরই তো কাজ। বিজেপি সরকার কেন্দ্রে আসার পর এসব কিছু বেড়ে গেছে। কোনো শান্তি মিছিলও হয়নি এখানে।
প্রশ্ন : একটু বিশদে যদি বলেন, কিভাবে উত্তেজনা ছড়ালো?
মহ. সাকরেল : শুরু কিরকম হয়েছিল জানেন তো? আগে চন্দননগরে কোনোদিনই এখনের মত রামনবমী হত না। আগে পুজোআচ্চা হত। মাথায় ফেট্টি বেঁধে রাম নাম নিত। বাড়িতে ঝাণ্ডা টাঙাতো। এখন হল কি অশোক সাহু এমএলএ হন তৃণমূল থেকে। সে বলল কি মহরমের দিন ওরা লাঠি, তলোয়ার নিয়ে মিছিল করে তোমরাও রামনবমীর দিন মিছিল করো। এই কথায় উৎসাহিত হয়ে হিন্দুরা রামনবমীর দিন দু-আড়াই হাজার লোকের মিছিল বের করলো এই ২০১৬ সালেই। সশস্ত্র। এতো বড় মিছিল, কিন্তু কোনো পুলিশ পাহারা নেই। কোনোদিন আগে অবশ্য এসবের দরকার হয়নি। লিচুপট্টি থেকে উর্দিবাজার হয়ে ওই মোড়টাতে, ওই আজমীর শরিফের চাদর যেখানে থাকে সেদিকে কিছু লোক বলল মিছিল নিয়ে যাবে। কিছু শিক্ষিত লোক ছিল, তারা বলল এটা ঠিক হবে না। এই দিকটা মুসলিমদের গড়। সেদিন বিভিন্ন জায়গায় সারারাত লুঠপাট হল। আমার একটা নতুন বাইক ছিল, তা ভাঙচুর হল। আমার ছেলে এইসব ছবি ক্যামেরায় তুলেছে।
প্রশ্ন : আপনারা এসব জানিয়ে প্রশাসনের কাছে যাননি?
মহ. সাকরেল : হ্যা গেছিলাম। উত্তরে প্রশাসন বলেছে এইসব সামান্য ব্যাপার। এইসব একটু আধটু হতে পারে। আমরা বললাম তাহলে আমরা মোবাইল ক্যামেরায় তোলা ছবি অল ইন্ডিয়া ছেড়ে দিচ্ছি। প্রশাসন বলল, না না ওসব করতে হবে না। আমার ছেলে ক্যালকাটা পুলিশে চাকরি করে। সে প্রশাসনের কাছে জানতে চাইল, মিছিল যে হল তার জন্য এমএলএ কি প্রশাসনকে জানিয়েছে? বলা হল, আমরা এই ছবি, এই দাঙ্গার কথা ইনসিউরেন্স কোম্পানিকে জানাব। ইয়ামাহা গাড়ি ছিল আমাদের। যাইহোক টাকাটা আমরা পেয়েছি। এখন তো মিডিয়ার যুগ। কিছু হলেই সারা পৃথিবী জেনে যাচ্ছে। রামনবমীর ঘটনার বদলা নিতে মুসলিম যুবকরাও মহরমের অজুহাতে দোকান ভাঙচুর করে। তলোয়ার নিয়ে ওই দোকানটার (সামনের রাস্তার বিপরীতে) চাল ফুটো করে দেয়। পানের দোকান। যদিও দোকানদার সামান্য ক্ষতিকে বড় করে দেখিয়েছে। কিছু সপ্তাহ বাদে ধনেখালি থেকে, বাঁকুড়া থেকে লোক জমায়েত হয়। দুই ধর্মের যারা সমাজবিরোধী তারাই এসব করছে। আর এমএলএ-র কথা যদি বলেন, অশোক সাহু নিজেই আরএসএস। তৃণমূল থেকে দাঁড়িয়েছে, তবু আরএসএস। এই যে তেওয়ারি, এলাকার কাউন্সিলর, ওর ছেলেরা সব তৃণমূল করে। দেড়শো বছর আগে আমার দাদুরা বিহার থেকে এখানে এসেছিল কাঠের ব্যবসা নিয়ে। উর্দিবাজারে সবথেকে বড় কাঠের ব্যবসা আমাদেরটাই।

।।৬।।


বিশ্বনাথ মিত্র – বিজেপি ঘনিষ্ঠ : আলাপচারিতা চায়ের দোকানে।
বিশ্বনাথ : এখন পরিস্থিতি শান্ত। এখানে খাসির দোকানে ভাঙচুর হয়, লুঠপাট হয়। এখন পুলিশ টহল দিচ্ছে।
প্রশ্ন : চন্দননগর সম্বন্ধে ধারণা অন্যরকম ছিল। কি হল বলুন তো?
বিশ্বনাথ : সেই রকম আর নেই। এখন অনেক পাল্টে গেছে চন্দননগর।
প্রশ্ন : কম্যুনালাইজেশন অফ সোসাইটি হয়ে গেছে কি?
বিশ্বনাথ : হ্যাঁ, হয়ে গেছে। এখন প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে, সরিয়ে দেনা মালটাকে। অদ্ভুত সব লোকজন পাবেন দেখতে যাদের আমরা কখনও দেখিনি। আমরা নিজেরাই নোহোয়্যার হয়ে গেছি। আমরা এখন চায়ের দোকানেও আড্ডা মারি না। গত চল্লিশ বছরের বেশী হয়ে গেলো এই দোকানটায় আসছি। আমার ছোটবেলার বন্ধু, তাই আসি।
প্রশ্ন : সাধারণ মানুষ যারা আলু বিক্রি করে, চায়ের দোকান চালায়, তাদের অবস্থান কি?
বিশ্বনাথ : না সাধারণ মানুষ বলে আর কিছু নেই। এখন সবাই খুব ক্রিটিক্যাল আর দালাল। এখন সর্বোচ্চ স্তরেও দালাল। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বৈঠক হবে, ঠিক করে দিচ্ছে দালালরা। ডিপ্লোম্যাটরা পাত্তা পাচ্ছে না। এখানে চন্দননগরে যা হয়েছে তা প্ল্যান মোতাবেক।
প্রশ্ন : বামপন্থীদের ভূমিকা কী?
বিশ্বনাথ : বামপন্থী বলে কেউ আছে নাকি? বহুদিন থেকে এখানে মেরুকরণ হয়েছে। এখন এটা ক্ষমতায়ণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বাম আমলেও মুসলিম এলাকার ভোটে মুসলিম প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। সকলে হিন্দু নয়, বাই বার্থ হিন্দু হওয়া যায় না। এটা অর্জন করতে হয়। দেখুন কতশত মাদ্রাসা সীমান্ত এলাকায়। সেগুলির ভূমিকা কি সরকার জানে না? কোথা থেকে সেগুলির টাকা আসে? আমি রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত।
প্রশ্ন : বিভিন্ন স্থানে আরএসএস-এর শিবির চালু হয়েছে। আপনার কি মনে হয়?
বিশ্বনাথ : এসব তো হবেই। কতদিন চুপচাপ বসে থাকা যায়?
প্রশ্ন : চন্দননগরের দাঙ্গায় হিন্দুসংগঠনের ভূমিকা কেমন ছিল?
বিশ্বনাথ : যতটা হওয়া উচিত ছিল সেই তুলনায় নেই বললেই চলে। শিবসেনা রেডি ছিল।
প্রশ্ন : শিবসেনা আছে এখানে, নাকি বজরঙ্গ দল?
বিশ্বনাথ : হ্যাঁ আছে। ওরা বাইরে থেকে লোক এনেছিল। প্রশাসন যদি হিন্দু স্বার্থ না দেখে আমরা দেখব। তাদের ভয়েই কিন্তু ওরা (মুসলিম) মিছিল বের করতে পারছে না। শিবসেনা বলছে মিছিল বের করলেই আমরা ক্যালাবো। প্রশাসনের কথা আর কতদিন হিন্দুরা শুনবে বলুন তো?
প্রশ্ন : মেরুকরণের কথা বললেন, আপনার কি মনে হয় এই মেরুকরণ ফল দেবে? পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সম্ভাবনা কতদূর?
বিশ্বনাথ : সম্ভাবনা আছে। ভালো ছেলে যদি আরো থাকত এখনই ভোল বদলানো যেত। শমীক ভট্টাচার্যর মত নেতা যদি থাকত কিছু করা যেত। কৃশানু মিত্র, অমল চ্যাটার্জী। এখানে সংগঠনে কিছু ফালতু লোককে দেওয়া হয়েছে। এরা অনেকেই ম্যাদা মার্কা। একটা কথা বলার ক্ষমতা নেই। আমি রাজ্য সরকারের কর্মী ছিলাম। সংগঠন করতাম বলে রাজনাথ সিংহের সাথে পরিচিত ছিলাম। উনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবার পরে একবার দেখা হয়। দেখলাম উনি চিনতে পারছেন।
প্রশ্ন : আপনি বিজেপি কর্মী সংগঠন করেন?
উত্তর : হ্যাঁ। উনি বললেন কিছু করছি না কেন? আমি বললাম, এখানে একদিন প্রকৃত পরিবর্তন হবেই।

।। ৭ ।।


শ্মশানঘাট ও কিছু হিন্দু যুবক
শ্মশানের দিকে কোনো ঝামেলা হয়নি। মুসলমানরা এদিকে এলে কচুকাটা হত। লিচুপট্টিতে বজরঙ্গ দলের বৈঠক হয় নিয়মিত। আমাদের কয়েকজন শিবসেনাও করি। শুধু বিজেপিকে দিয়ে হবে না। তৃণমূলের জমানায় মুসলমানদের বাড় বেড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও মুসলমান হয়েছে। এসব করেই হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে দিল। তবে লোকাল নেতারা সবাই আমাদের দিকে। ঝামেলা হলে ওসব পার্টিফার্টি নেই। সবাই হিন্দু।
হাজিনগর, নৈহাটি
আমরা-র পক্ষ থেকে নৈহাটি যাওয়া হয় ২০.১১.২০১৬ এবং ০২.০১.২০১৭ তারিখে। কথা হয় বিভিন্ন পর্যায়ে অধিকার রক্ষা কর্মী, প্রাইভেট টিউটর, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, দোকানদার, ছাত্র, স্থানীয় ক্লাবের সদস্য, ডাক্তার, মাজার সংলগ্ন দোকানদার, ওয়াকফ কমিটির প্রেসিডেন্ট-এর সঙ্গে। নিরাপত্তার স্বার্থে অনেকের নাম প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। তবে তাদের পরিচিতি ও বয়ান অপরিবর্তিত থাকছে।

।। ১।।|


চশমা বাবা মাজার —
হাজিনগর দাঙ্গার বিষয়ে জানতে হলে চশমা বাবা মাজার জানা আবশ্যিক। চশমা বাবা কে ছিলেন? প্রায় ৪৫ বছর আগে তার ইন্তেকাল (মৃত্যু) হয়। আদতে বিহারের মানুষ এই চশমা বাবা বা ইউসুফ কামাল পরিচিত ছিলেন তার সঙ্গের লাঠি, ছাতা, গামছা এবং সর্বোপরি চশমার জন্য। লোকমুখে তার কিছু ‘অলৌকিক’ কথা ছড়িয়ে পড়ে যা আজও হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রচলিত। এমনই এক করিশ্মা বা অলৌকিক কাণ্ডের কথা আমরা জানতে পারি। একবার ট্রেনে ব্যান্ডেল নেমেছিলেন উনি। উনি নামতেই গাড়ি আর চলে না । ইঞ্জিন দেখা হয়, দেখা হয় আরও কিছু। কিন্তু গাড়ি নির্বিকার। শেষে গার্ড এসে বাবাকে অনুরোধ করেন। বলেন, আপনি অনুমতি দিন, ট্রেন চলুক। সহৃদয় চশমা বাবা অনুমতি দেন এবং ট্রেন চলতে লাগে। আরও অনেক মিথ আছে তাকে ঘিরে। সবই লোকমুখে, না কোনো বই নেই। অসহিষ্ণুতা, দাঙ্গা সত্ত্বেও তা বিরাজমান ধর্ম নির্বিশেষে।।
এখানে মার্চ মাসে উরস হয়। এখন যেখানে মাজার বানিয়ে দিয়েছেন বাবার ভক্ত এক মারোয়ারি হিরালাল সাউ। এটা আগে চা কোম্পানির জমি ছিল। মাজারের পিছনের ময়দানে মেলা বসে। কাওয়ালির আসর বসে। এই মাজারকে কেন্দ্র করে একটি চুক্তি হয় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে। সাল জানতে না পারলেও তা প্রায় শতক প্রাচীন।
হিন্দু-মুসলমানের সমঝোতা —
চুক্তি হয় দু-পক্ষের। মাজারের সামনে দিয়ে কোনো বিসর্জনের মিছিল যাবে না। বিয়ের বা অন্য কোনো মিছিল (রাজনৈতিক) গেলে বাধা নেই। ঐখানে বড় রাস্তার পাশে কোনো গরুর মাংসের দোকানও থাকবে না। দুই ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে আস্থা ও বন্ধুত্ব বাড়াতে এই চুক্তি বেশ কার্যকরী ভূমিকা নেয়। চুক্তিটির কোনো লিখিত প্রতিলিপি পাওয়া যায় নি। মনে করা হয় এই চুক্তি মৌখিক এবং প্রায় একশ বছর ধরে তা পালিত হচ্ছে।
হুকুমচাঁদ জুটমিল —
হুকুমচাঁদ ও নৈহাটি জুটমিলকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশ ও বিহার থেকে বহু মানুষ এখানে আসেন। পাট শিল্পের সংকট, বন্ধ হওয়া এবং খোলা, শ্রমিকদের জীবনে ও যাপনে প্রভাব বিস্তার করে। দীর্ঘদিনের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনের প্রবল উপস্থিতি সত্ত্বেও এখানে ধর্মীয় বিভাজন ঠেকানো যায় নি। কথা হচ্ছিল তৃণমূল ট্রেড ইউনিয়নের একজন মাঝারি মাপের নেতার সঙ্গে। আগে সিটুর ট্রেড ইউনিয়ন, বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানালেন, এখানে শ্রমিকদের মধ্যে ভেদভাব প্রচুর। শ্রমিক নেতারা তা দূর করতে চেষ্টা করে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দূর করবে কি তারা নিজেরাই বড় বদমাশ। হিন্দু নেতারা হিন্দুদের, মুসলিম নেতারা মুসলমানদের উস্কানি দেয়। কথা হচ্ছিল মেন গেটের সামনে। জুট মিলের অন্য গেটে কথা হচ্ছিল কিছু শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা দাঙ্গার জন্য সরাসরি দায়ী করল রাজনৈতিক নেতাদের। বললো, সাধারণ মানুষ এসবের মধ্যে নেই। নেতারা এসব শুরু করে এবং ছড়িয়ে দেয়। সমস্বরে বলে উঠলো, ‘কাম নেহী হ্যায়, মজহব দিখাতে হ্যায়’।
আদর্শ হিন্দী হাইস্কুল —
সরকারি এই উচ্চমাধ্যমিক স্কুলটিতে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন স্পষ্ট ও নগ্ন। প্রায় ছাত্ররা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে। মুসলমান ছাত্রর সংখ্যা জনসংখ্যার নিরিখেই কম। স্কুলটি কো-এড। ছাত্রদের মধ্যে মারপিট হলে শিক্ষকদের কার্যকরী ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। এই স্কুলের দুইজন শিক্ষক ধর্মপ্রচারের জন্য রথযাত্রার আয়োজন করেন, ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। নেপথ্যে বিজয় সাউ। স্কুলটিতে উর্দুমাধ্যমের সুবিধা নেই।
বিজয় সাউ —
আগে শাসক দলের ছত্রছায়ায় ছিলেন, এখন আরএসএস-এর সঙ্গে। ধর্মপ্রচারের রথযাত্রায় তার ভূমিকা সর্বাগ্রে। অর্থ ও পেশী-শক্তির অন্য নাম বিজয় সাউ। চশমা বাবার মাজারের সামনে দিয়ে হরিশ মিত্র রোড ধরে যাওয়া নিষেধ, কিন্তু শোনা হলো না। উত্তেজনা দেখা দিল। পুলিশ এলো। মিছিল গেলো বেলুড় পাড়ার দিকে। এখানে মুসলমান জনা পঞ্চাশ, কিন্তু হিন্দু হাজার সাতেকের বসতি। মুসলমানদের ৪-৫টি ঘরের দোকান ভাঙচুর হল।
শুভ্রাংশু রায় —
অভিযোগ মুসলিমদের হয়ে কথা বলা যেমন আছে তেমনই দুই পক্ষকে উস্কে দেওয়ার নির্দিষ্ট অভিযোগও আছে। অভিযোগ হচ্ছে দাঙ্গায় অভিযুক্ত হিন্দু ও মুসলমান মাথাদের আশ্রয় দেওয়ার। যদিও এসব অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি অভিযোগকারীরা। আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু অসফল হই।
এই প্রেক্ষিতে শুভ্রাংশু রায় সহ অন্যান্য কয়েকজন বিধায়ককে চিঠি দেওয়া হয়। পরিশিষ্টে তার উল্লেখ আছে।
বালকসঙ্ঘ ও নজরুল সঙ্ঘ —
ক্লাবদুটি বাঙালি হিন্দু-মুসলমান মিত্র এলাকায়, দুটিতেই হিন্দু ও মুসলমান সদস্য আছে। বালক সঙ্ঘতে হিন্দুর সংখ্যা বেশি, নজরুল সঙ্ঘে মুসলমানের। ক্লাব দুটিতে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ নেই। সদস্যদের কথা অনুযায়ী, “আমরা আগে যেমন ছিলাম তেমনই আছি।” আক্রমণের রাত্রে বালক সঙ্ঘের ছেলেরা বহিরাগত হিন্দু দাঙ্গাবাজদের ঢুকতে দেয়নি এলাকায়। রাত্রি জেগে পাহারা দিয়েছে।
কথা হচ্ছিল ক্লাব সদস্য বিজয় দাসের সঙ্গে। সাথে ছিলেন অপর সদস্য মোস্তাফা। দুজনেই যা বলেন তার নির্যাস এই — অশান্তি সচেতনভাবে বাইরের লোক দিয়ে আমদানি করা হয়েছে। মানুষ যথেষ্ট আতঙ্কিত ছিল। প্রচুর বোমা মারা হয়ছে। সবই করেছে বাইরের লোক। বেশ কিছু মানুষ ঘরছাড়া হয়েছিল। সেই সুযোগে এলাকার ছিচকে চোর, বিশেষত ড্রাগ নেয় এমন অনেকে এইসব ছেড়ে যাওয়া ঘরে ঢুকে চুরি করেছে। বড়সড় মারামারি আমাদের কাছাকাছি হয়নি। যা হয়েছে তা ঠেলাঠেলি। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য দুই সম্প্রদায়ই মিছিল বের করে। ‘জয় শ্রীরাম’, ‘আল্লাহো আকবর’ শ্লোগান দিয়ে আমাদের এখানে ঢুকতে চেয়েছে। আমরা বাধা দিয়েছি।
কলেজের ছাত্ররা —
মারওয়ারি কল থেকে নেলসন রোডের কাছে কথা হয়েছিল কয়েকজন কলেজ পড়ুয়ার সঙ্গে। নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল তারা। দুই সম্প্রদায়ের কিছু গুণ্ডাশ্রেণীর লোক এই দাঙ্গা ঘটিয়েছে জানালো তারা। মুসলিম ছাত্ররা নাম করলো কয়েকজন মুসলিম বাহুবলীর।

।।২।।


সাজিদ কামাল - গৃহশিক্ষক, অধিকার রক্ষাকর্মী :
যে কোনো ঘটনার এক প্রেক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রেও কোনো একটা দিক ধরে বলা ঠিক হবে না। ঘটনার একটা রাজনৈতিক দিক তো থাকেই। লজ্জার কথা হলো, শিক্ষার এতো বিস্তার সত্ত্বেও এখনও মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি প্রবল। রাজনৈতিক দলগুলো এই অনুভূতিকে কাজে লাগাতে পারছে। লাগাতে কিছুটা সফল হচ্ছে হিন্দি-উর্দুভাষীদের মধ্যে। বাঙালিদের মধ্যে ততটা নয়। নৈহাটি থেকে হাজিনগর ঢুকতে কিছুটা এলাকা বাঙালি অধ্যুষিত। যেই জুটমিলের এলাকা শুরু হল বাঙালি কমতে শুরু হল। পরপর দুটো জুটমিল, রঙকল এসবে শ্রমিক বেশী। বেশীরভাগ  বিহার উত্তরপ্রদেশ থেকে। আমার পূর্বপুরুষরাও এইরকমই মাইগ্রেট করে এসেছিলেন। আমাদের এই বাড়িটা ১৯৩০-এ তৈরী। সাম্প্রদায়িক মনোভাব যারা মাইগ্রেট করে এসেছে তাদের মধ্যে বেশী।
এই অঞ্চলটা মিনি ইন্ডিয়া। তেলেগু, উড়িয়া, বিহারী, উত্তরপ্রদেশী, নেপালি কে নেই? আগে বিরোধ ছিল। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ। কিন্তু এতটা প্রকাশ্য কখনই ছিল না। পরিবর্তনের পর দেখছি সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু হলো দু’পক্ষকেই। ৮০ শতাংশের বেশী হিন্দু জনসংখ্যা এখানে। ২০১৪-র পর বিশেষ করে বাড়তে লাগলো বজরঙ্গ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি। মহিলাদের মধ্যে দুর্গাবাহিনী। সকালবেলায় গঙ্গার ধারে তলোয়ার নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের শিবির করা হতে থাকলো পরিকল্পিতভাবে। আমার অনেক হিন্দু বন্ধু এখন দেখছি বজরঙ্গ দলের সঙ্গে যুক্ত। গঙ্গার ধারে গঙ্গা আরতি চালু হয়েছে। সবকিছুতেই রাজনৈতিক নেতাদের উপস্থিতি হতে লাগলো।
চশমা বাবার মাজারে উরস হতো, মিছিল হতো, এখন সেখানে বিধায়ক, তৃণমূলের নেতারা উপস্থিত থাকছেন। মানুষের উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক অনেক বেশী। এখানে হনুমান পুজো হয়। প্রধানতঃ হিন্দীভাষীরা করে। আগে মেরেকেটে একশো-দুশো লোক থাকত, লাঠি নিয়ে মিছিল হতো, এখন দেখা যাচ্ছে পাঁচ থেকে দশ হাজারের মিছিল। সবার হাতে তলোয়ার। মহরমের মিছিলে লাঠিখেলা হতো। রামনবমীর মিছিল হোক বা মহরম হিন্দু-মুসলমান সকলেই থাকতো তাতে, এখন তা আর নেই। মহরমের মিছিলে তলোয়ার নিয়ে আস্ফালন, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব। ভারতে শিখদেরই তলোয়ার বা কৃপাণ নিয়ে চলাফেরার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিভাবে মহরমে, রামনবমীতে তলোয়ার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? প্রশাসন কি করছে?
আমি নিজে তৎপর হয়ে জেলাশাসক, পুলিশ সুপারকে ফোন করি, দরখাস্ত দিই। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সশস্ত্র মিছিল যে কোনো সময় হিংসাত্মক হতে পারে, আমার আশঙ্কা। কিন্তু প্রশাসন নীরব। তাদের নীরবতার মানে বুঝি। পুজোয়, মহরমে যদি রাজনৈতিক নেতারা থাকে তাহলে কি হবে? পুলিশ যদি বাধা দেয় তালোয়ার খেলায়, তখন নেতারা বলবে, তুমি কেন এসেছ, বাধা দিচ্ছো? আমি আছি, আমি দেখছি। পশ্চিমবঙ্গে থানা কখনও পার্টি অফিস (পরিবর্তনের আগে হোক বা পরে)-এর উপরে কর্তৃত্ব করতে পারেনি।
১৫ আগস্ট ২০১৬-র ঘটনা। কারবালা মোড়ের কাছে সকালে জাতীয় পতাকা তোলা হয়, সন্ধ্যের সময় নামানো হয় যথারীতি। প্রতিবার এইরকমই হয়ে আসছে। এবারে দুই যুবকের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। ঝামেলা তাদের নিজস্ব বিষয় নিয়ে। মুসলিম যুবকটি সমাজবিরোধী। রটিয়ে দেওয়া হলো পতাকা ছিড়ে দিয়েছে সে। মুহূর্তের মধ্যে সাত-আটশো লোক জড়ো হয়ে গেল, ঘিরে ফেললো মুসলিম মহল্লা। সন্ধ্যে থেকে শুরু হয়ে রাত্রি পর্যন্ত চলল উত্তেজনা। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটার সময় পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। কেউ জানতে চাইলো না সন্ধ্যে সাতটার পরে পতাকা কিভাবে টাঙানো থাকতে পারে যে তা ছিড়ে ফেলা হবে।
নিত্য নতুন পুজো এবং পুরনো পুজো পরবগুলি উদ্যাপন এখন রীতি হয়ে উঠেছে। দুই বছর আগের কথা। হঠাৎ গায়ত্রী পরিবারের পক্ষ থেকে গায়ত্রী পুজো শুরু হল। চশমা বাবার মাজারের সামনে দিয়ে পুজোর মিছিল নিয়ে যাওয়া হলো। চুক্তি মোতাবেক ওখান দিয়ে কোনো পুজোর মিছিল যাবে না। মানা হলো না চুক্তি। প্রশাসনকে না জানিয়ে মিছিল এলো। মাজারের পাশেই মসজিদ। মুসলমানরা প্রতিরোধ শুরু করল। ১৪৪ ধারা জারি হলো। পরিস্থিতি থমথমে।
সেই যে আগুন লাগলো দুই সম্প্রদায়ের মনে মনে তা দিন দিন বাড়তে লাগলো। যখনই কোনো পুজো আসে, পরব আসে, মানুষের মধ্যে বেড়ে যায় দ্বেষ, হিংসা, রেষারেষি। মানুষ ক্রমেই আরো হিন্দু বা আরও মুসলমান হয়ে যাচ্ছে। যারা একটু মাঝামাঝি ছিল, কোনোদিন সেইরকমভাবে পুজোয়, নামাজে থাকতো না তারাও এখন দেখছি বড় ভক্ত হয়ে উঠেছে।
এই মেরুকরণের নগ্নরূপ দেখা গেলো ২০১৬-র অক্টোবরে। এবারে মহরম ও বিজয়া দমশমী একসাথে এলো। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন বিসর্জন বিজয়ার দিনই করতে হবে। দুর্গাপুজো হচ্ছে আমাদের এই রাজ্যের সবথেকে বড় পুজো, বড় উৎসব। মহরম মুসলিমদের বড় পরব নয়, বাস্তবে মহরম কোনো উৎসব নয়, শোকের দিন। এই কথা যদি মুখ্যমন্ত্রীর মাথায় থাকত, বড় কোনো ইমামকে নিয়ে আলোচনা করে মহরমের মিছিল একদিন বাদে করাতেন, তাহলে ঝামেলা মেটানো যেত। এ আমার যুক্তি। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) বলে দিলেন চারটের মধ্যে বিসর্জন দিতে হবে। এই যে উনি এসব বললেন, প্রশাসন থেকে কোথাও কোথাও মাইকে ঘোষণা করা হলো, এতে দাবানলের কাজ হলো। ওনার স্টেটমেন্ট ওনাকে মমতা ব্যানার্জী থেকে মমতাজ বেগম করে দিলো। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে কি করে communaly দেখা হলো সমগ্র বিষয়টাকে।
দশমীর দিন, দুর্গাপুজোর বিসর্জনের মিছিল। এখানে ইন্ডিয়ান পাল্প এন্ড পেপার (প্রাইভেট) লিমিটেডের কারখানা বা স্থানীয়ভাবে পেপারমিলের কাছে মানিক পীরের মাজার আছে। মেরে কেটে ১০ বা তার বেশি কিছু ঘর মুসলমান এখানে থাকে। বিসর্জনের মিছিল, গান-নাচ থাকবেই। এবার সঙ্গে উঠলো শ্লোগান, জয় শ্রীরাম। মিছিল থেকে একটা ঢিল পড়লো মাজারে। তাতে কোনো বড় ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এই খবর আগুনের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো । পুরো মুসলিম মহল্লায় উত্তেজনা ছড়ালো। সেই রাত্রে আর কিছু হয়নি।
পরের দিন ছিল মহরম। প্রতিবার মারোয়ারি কল থেকে একটা মিছিল আসে আমাদের দিকে। তাজিয়া নিয়ে লাঠি খেলা হয়। এবার যখন তাজিয়া বের হবে একটা বোম্বিং হলো। বয়স্ক মুসলিমরা সিদ্ধান্ত নিল আর যাবে না। পুলিশ বলল কিছু হবে না, চলুন। সেখানে অ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ কমিশনার, আইবি ছিল। তারপর আর কিছু হয়নি।।
মহরমের পরের দিন। পেপার মিলের পাশের মসজিদ থেকে যখন তাজিয়া বের করা হয় আবার বোমা পড়ে। কিছু লোক আহত হয়। দুষ্কৃতীরা বোমা মারতে মারতে পালাচ্ছিল। পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। মুসলমানদের হাতে তলোয়ার ছিল। বেছে বেছে হিন্দুদের দোকান ভাঙচুর করল তারা। ছোট দোকান, আয়রন বা ইস্ত্রির দোকানও রেহাই পেল না। বেচারির অনেক কাপড় লুঠ হলো।
নামে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, তারাও ভাঙচুরে সামিল। বারংবার পুলিশে ফোন করি। দুই যুযুধান পক্ষ মুখোমুখি। মারোয়ারি কলের ওখানে একেবারে সামনাসামনি। পিছনেই হুকুমচাঁদ জুটমিল, ট্রেড ইউনিয়ন অফিস। পুলিশ জানালো মোড়ে পুলিশ আছে। কিন্তু কোথায় পুলিশ? পুলিশ যখন এলো তখন ভাঙচুর যা হবার হয়ে গেছে। দুপুর ১২টা থেকে ভাঙাভাঙির শুরু, পুলিশ এলো তখন দুপুর ২.৩০টা। তবে এত দীর্ঘ এলাকাব্যাপী দাঙ্গায় কোথাও মুসলিমরা কোথাও হিন্দুরা অন্যধর্মের মেয়েদের নিরাপত্তা দিয়েছে। সরে যেতে বলেছে। সব এলাকাতেই বাইরে থেকে লোক এসেছিলো। স্থানীয় মুসলমানরা যখন দেখল বাইরে থেকে মুসলমানরা এসে পাড়ার হিন্দু মেয়েদের খারাপ নজরে দেখছে তখন তাদের সরে যেতে বলল। কোথাও কোথাও নিজেদের ঘরে জায়গা দিলো। একই রকমভাবে বাইরের হিন্দুদের থেকে স্থানীয় মুসলিম মেয়েদের রক্ষা করতে হিন্দুরাও শেল্টার দেয় মুসলিম মেয়েদের। এতো হিংসা, অবিশ্বাসের মাঝে এসব ঘটনাই আশার আলো। মিথ্যাবাদী পুলিশ অফিসার আমাকে জানালো, আমি স্পটে আছি। আপনি কিভাবে স্পটে আছেন? চারিদিকে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, আপনি স্পটে?
এখানে এমন বহু স্থান আছে যেখানে রাস্তার একদিক বীজপুর বিধানসভা অপর দিক নৈহাটি বিধানসভার অন্তর্গত। নৈহাটি বিধানসভার বিধায়ক তাপস চ্যাটার্জী এই এলাকায় না এসে বললো শুক্রবার রাত্রে মিটিং হবে। শনিবার হবে শান্তি মিছিল। ডাক দিলো, নৈহাটি এলাকায় যত দোকান আছে তারা যেন শান্তি মিছিলে সামিল হয়। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় মিটিং হলো। কিন্তু রাত্রি দশটার পরেই পরিস্থিতি পালটে গেল। হাজিনগরে ঢোকার বারোটি পয়েন্ট থেকে মুসলিম এলাকাকে ঘিরে শুরু হল আক্রমণ। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে দু-তিনশো লোক ঢুকতে লাগলো। কিভাবে যে বোম্বিং হচ্ছে কি বলবো। একসাথে আটটা-দশটা বোমের আওয়াজ, আর জয় শ্রীরাম হুঙ্কার। আমরা ভাবছিলাম আর বোধহয় বাঁচবো না। আমাদের বাড়িতে আট-দশজন মহিলা। ভয়ে সবাই কাঁদতে লাগল। চারদিকে অসহায় হয়ে ফোন করতে লাগলাম। এপিডিআর-এর স্থানীয় নেতাদের, এসপি কে, ডিএম কে, এসডিও-কে। কোনো হেল্প কারো কাছে পাওয়া যায়নি। তিন ঘণ্টা ধরে uninterrupted bombing হলো। একসময়ে এতগুলো জায়গা দিয়ে অ্যাটাক। ওদের নেটওয়ার্ক কতটা স্ট্রং বুঝুন। অথচ তখন কার্ফিউ, ১৪৪ ধারা চলছিল। হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ৪৬ জন গ্রেপ্তার হয় যার মধ্যে অধিকাংশ বহিরাগত। মুসলমানদের গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও সকলেই জামিনে মুক্ত হয়।
শান্তি মিছিল হল ১ সপ্তাহ বাদে। কিন্তু কার্যত শান্তি মিছিল মুসলমানদের মিছিল হয়ে গেলো। ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল সেই মিছিলে। মিছিলে মুকল রায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ছিলেন, কিন্তু স্থানীয় কোনো তৃণমূল কাউন্সিলর ছিল না। হঠাৎই শুনলাম আমরা মিছিল আসছে, কার মিছিল? না, তৃণমূলের মিছিল। শুভ্রাংশুর মত অর্জুন সিঙের ভূমিকাও ভালো নয়। দুটো শান্তিমিছিল হয়েছে। একটা তৃণমূল স্পনসর্ড, যাতে বাইরের লোক ছিল। অন্যটা পুলিশ স্পনসর্ড।
আমি প্রাইভেট টিউশন করি। উভয় সম্প্রদায়ের ছাত্রদের সঙ্গে কথা হয়। তারাই বলে সামনের বছর আবার হবে। এখন যেহেতু কোনো উৎসব নেই, চাপা উত্তেজনা আছে।

।।৩।।


আক্তার আলি - মাছচাষি :
এখন শান্তি আছে। কিন্তু সেইসময় আমাদের মতো মানুষের খুব ক্ষতি হয়েছিল। ওই যে ঠেলার দোকানটা দেখছেন, ছেলেটা হালুয়া বিক্রি করে। ঝামেলার সময় তখন হালুয়া কে কিনবে? আব্বাস-এর বাড়ি লুঠ হয়েছে। মিত্র রোডের পিছনে বাড়ি। আগে ভেঙে দিয়েছিল হিন্দুরা, এখন প্রশাসন থেকে টালিচালা করে দিয়েছে। মিলের ওদিকে মুস্কান বিড়িওয়ালা ছিল। ওর লক্ষ টাকার মাল লুঠ। ঝামেলা দ্বারিক জঙ্গল রোডেও হয়েছে। হুকুমচাঁদের আশেপাশে চল্লিশটা মুসলিম বাড়ি লুঠ হলো, আগুন লাগালো, কম্পানির কোয়ার্টার, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। 
এমএলএ, আমাদের কোনো হেল্প করেনি। ও হিন্দুদের দিকেই আছে। ও শুরু থেকে বিজেপি। অর্জুন সিংয়ের কাছ থেকে অনেক সাপোর্ট পেয়েছি। ওই তো ফোর্স পাঠাল। দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) শুভ্রাংশু রায়ের কথা শুনলো। শেষপর্যন্ত অর্জুন সিং, ফুরফুরা শরিফ (ত্বহা সিদ্দিকি) যখন বলল তখন শুনলো, ফোর্স এলো।
শান্তিমিছিল আসলে একটা চাল। শান্তিমিছিল করে আরএসএসদের পার করে দেওয়া হলো। শুভ্রাংশু রায় ওদের পার করলো। ওর বাবা জানে।
আরএসএস এখানে আছে তবে ওপেনে নেই। আর ট্রেড ইউনিয়ন, ইতনা ভিতু হ্যায়, ক্যা বোলে।।

।।৪।।


কাজি রসিদুল ইসলাম - কোয়াক ডাক্তার :
এখন একটু থমথমে ভাব আছে। একটা গ্রুপ ওইদিক থেকে ওস্কাচ্ছে, একটা গ্রুপ এইদিকে। ঠাণ্ডা মাথায় ওস্কানি চলছে। পলিটিক্যাল দিক থেকে। আমি ওপেনলি বলছি টিএমসির একটা গ্রুপ ওস্কাচ্ছে। যখন ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তখন বলছে শালা বিজেপিরা এ সমস্ত করেছে। বলছে কখনও হিন্দুরা এসব করছে। অন্যদিকে মুসলমানদের দোষ দিচ্ছে। আমি বলছি, মুকুল রায়ের গ্রুপটাই এসব করছে। শুভ্রাংশু রায় এবং নৈহাটি মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান অশোক চ্যাটার্জি।
এখানে তৃণমূলের তিনটে গ্রুপ কাজ করে। একটা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের, একটা মুকল রায়ের একটা অর্জুন সিংয়ের। তবে অনেকেই তলে তলে মুকুল রায়ের গ্রুপে নাম লিখিয়েছে। হাইলাইটে আছে মুকুল রায় আর অর্জুন সিংয়ের গ্রুপ। জগদ্দলের এমএলএ শীলভদ্র দত্ত এদের থেকে আলাদা। মাথা হল মুকুল আর জ্যোতিপ্রিয়। এইসব গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে তলে তলে বিজেপি সংগঠন বাড়াচ্ছে। সুযোগটা নিতে চাইছে।
প্রশ্ন : দাঙ্গা হচ্ছে কেন? এই খেলাটা শাসক দল খেলছে কেন? 
রসিদুল : এটা একদম রাজনৈতিক। দোষটা বিজেপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। আমরা এসব থেকে কিছু ফায়দা করবো। কিন্তু এখানে মুখোশ খুলে গেছে।
প্রশ্ন : কিন্তু এতে তো আখেরে ক্ষতিই। হিন্দু ভোট চলে গেলে তো হেরে যাবে।
রসিদুল : শুনুন না কাণ্ড। যেমন চেয়ারম্যান বলছে আমার আগে রহিম পরে রাম। বলছে কোথায় না মুসলিম এলাকায়। ঠিক যখন হিন্দু মেজরিটি এলাকায় যাচ্ছে তখন বলছে আমার আগে রাম পরে রহিম। মানুষ ক্ষেপে গেছে, বুঝতে পেরেছে কারচুপি। লোক বাঁশ নিয়ে তেড়েছে।
প্রশ্ন : কাকে?
রসিদুল : ওই যে নৈহাটি পুরসভার চেয়ারম্যান অশোর চ্যাটার্জি। মানুষ ওকে ঘৃণা করে। আমি নাম করে বলে দেবো কোন কোন লোক দাঙ্গায় জড়িত। এই যে দোকানে (চায়ের দোকান) বসে আছেন, এই দোকানে ভাঙচুর হয়েছিল। এখন তারই রিপেয়ারিং হচ্ছে। (তখন রাজমিস্ত্রি কাজ করছিল)। যেদিন গণ্ডগোল হয় আমি এখানে ছিলাম। খুব সূক্ষ্মভাবে এখানে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকে গেল। আগেও ছিল, কিন্তু এখন বেশীরভাগ মানুষের মধ্যে বাইরে থেকে প্রচুর লোক আনা হয়েছে।
আর্মস এনে রেখেছে টিএমসি, মুসলিম লোকদের কাছে। তারপর যখন গণ্ডগোল লেগেছে আমি প্রশাসনকে বারবার বলেছি এই তিনটে স্পটে যান। এখানে যে কোনো সময় কিছু ঘটে যেতে পারে। কিন্তু প্রশাসন শোনেনি। ঠিক ওই তিনটি স্পটেই হলো।
পরে শুনলাম ওই পুলিশ অফিসার বদলি হয়েছে, গাফিলতির জন্য। যখন এখানে-ওখানে ঝামেলা হচ্ছে আমি ফোন করে বলছি আপনারা আসুন। আমি সেই অফিসারের নামে বলতে পারব না, আমাকে জানাচ্ছে, আমাদের ওপর নির্দেশ আছে, তোমরা দেখো কিন্তু ধরো না। চাপটা আসলে নেতাদের। পরে টিএমসির যারা শান্তিমিছিলে এসেছিল তা লোক দেখানো।
আমি পুলিশকে বলছি যেহেতু আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে যে আসুন এই জায়গায় প্রচুর আর্মস মজুদ আছে। কিন্তু পুলিশ সেখানে গেল না। ঘটনা ঘটছে যখন তখনও পুলিশ প্রশাসন দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অনেক দোকান ভাঙচুর হয়। পুলিশকে ডাকলাম, শুধু আমি নয়, অনেকেই। পুলিশ জানালো, ‘মরার জন্য যাবো নাকি!
এই আক্রমণ স্থানীয় ও বাইরের লোক সবাই করেছিল। হিন্দু-মুসলমান দু-পক্ষই। আমার একটা বদনাম আছে, কিছু পুলিশই তার জন্য দায়ী, যে ওখানে ডাক্তার আছে, ও সিআইডি-র ঘরের লোক। এই নিয়ে ভয় আছে। অনেকের মধ্যে। কিন্তু সেদিন আমার গায়েও হাত দিলো। যেহেতু আমি মুসলমান হয়েও হিন্দু পরিবারদের বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়েছি। এখানে একটা ননবেঙ্গলি হিন্দু মেয়ে আছে। বাংলা এমএ পড়ছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চারিদিকে তখন বাইরের গুণ্ডা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এনেছিল স্থানীয় মুসলমানরাই। মেয়েটির দিকে খারাপ নজর পড়লো। আমি প্রতিবাদ করলাম। মেয়েটিকে সরে যেতে বললাম। ওদের রাগ হলো।
এই একটু আগে এক মহিলা থাকেন। দোকান চালান। তার স্বামী থেকেও নেই। দুটো বাচ্চা আছে। একটা মেয়ে। যখন গণ্ডগোল চলছে। তখন তার ছেলের বয়সী একজন তাকে বেইজ্জতের চেষ্টা করে। মেয়েটি আমাকে দাদা ডাকে। মেয়েটি বলে, দাদা পাড়ার ছেলেটিই আমার জামার ভিতর হাত ঢোকায়। আমি বসে গেছি। তখন আমার চোখে মুখে ঘুষি মারছে। আমি অন্ধকার দেখছি। যার নাম বললো সেই ছেলেটি কলেজে পড়ে, আমরা ভদ্র বলেই জানি। আমাদের ইজ্জত করেই চলে। মেয়েটার মুখে এখনও দাগ আছে, কালশিটের দাগ।
প্রশ্ন : আপনার ওপর আক্রমণ কারা করেছিলো?
রসিদুল : ওই মুসলিমরা। আমাকে মসজিদের সামনেই বললো, এই তুই এখান থেকে যা। যে আমাকে আপনি বলে, সে বললো এখান থেকে যা। আমি মোবাইল বের করেছি, আমায় বললো, রেন্ডির বাচ্চা, কোথায় ফোন করছিস, পুলিশকে? যে বললো সে আমায় চেনে না, বাইরের লোক। কিন্তু যারা ওকে এনেছে তারা আমায় চেনে, স্থানীয় মুসলমান। আমি তখন গাল দিয়ে বললাম, খানকির বাচ্চা, আমায় চিনিস, এইখানে গুলি করে মেরে দেব। তখন ওর সাথে যার ছিল তারা সরিয়ে নিয়ে গেলো। কেননা ওরা জানে আমি গুলি মারতে পারি। ওটা অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জির ফোন।
টিএমসির যারা নেতা আছে তারা লাথখোর নেতা আছে। দাঁড়িয়ে থেকে লুঠপাট করছে, আর পুলিশকে মদ আর মাংস দিচ্ছে। বলছে, আপনারা তো ডিউটি করছেন, আপনাদের দেখা আমাদের কর্তব্য, আপনারা খান। দিলীপ সাহু এ সমস্ত করে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন : এখানে তো বজরঙ্গ দল আছে, তাদের নেতা কে?
রসিদুল : এখানে দিলীপ ঘোষ এসেছিল। অনেকেই এসেছিল। এখানে যারা লোকাল, ... আরএসএস নেতা বিজয় সাহু। বিনয় দাস, বিনোদ সাহু। প্রতি হিন্দু পরিবারে এখন বিজেপি ঢুকেছে। এখন আর সংগঠন করার দরকার নেই, অটোমেটিক হয়ে গেছে। এখানে টিএমসি ভেঙে চুরমার, এখন সব হিন্দুরাই তলে তলে বিজেপি। টিএমসি-র অবস্থা খুব খারাপ। পাপ্পু কুরেশীকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না প্রশাসন। পাপ্পু কুরেশীকে খুঁজে না পাওয়ার কথা আসলে পুলিশের জাস্ট আইওয়াশ। ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে শুভ্রাংশুকে ধরলে। পাপ্পু টিএমসি-র লোক।
প্রশ্ন : পাপ্পু কুরেশীর বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?
রসিদুল : অভিযোগ ও মুসলিমদের হয়ে হিন্দুদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এখন শুভ্রাংশুর হেফাজতে। আবার হিন্দু দাঙ্গাকারীরা যেমন রাজু সাহানী, দিলীপ সাহু, দিলীপ সিং, মনোজ দাস, শ্যামল দাস এরা সকলেই টিএমসির এবং শুভ্রাংশুর লোক। আবার কুরেশীও শুভ্রাংশুর লোক। সকলে ওর আশ্রয়ে।
প্রশ্ন : মানে হিন্দু-মুসলমান দুই পক্ষের দাঙ্গাকারীদের যে নাচাচ্ছে সে শুভ্রাংশু রায়?
রসিদুল : হ্যাঁ, একজনই, সে শুভ্রাংশু রায়। পুতুল নাচ নাচাচ্ছে। পাপ্পু কুরেশীকে পুলিশ খুঁজে পাচ্ছে না, কেন পাচ্ছে না? কেননা পুলিশকে বলা হয়েছে ওকে ধরবে না। একইরকমভাবে কিছু গুণ্ডাদেরও ধরতে মানা করা হয়েছে।
এতো বড় একটা দাঙ্গা হলো, না বীজপুর থানা না নৈহাটি থানা — কোথাও কোনো রায়ট কেস নিল না। ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯ ধারায় লড়াই, মারপিটের কেস দিল, জামিন হলো, তিন-চারশো টাকায়। প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ হয়ে দাঙ্গার নেতাদের ধরত, বেল না দেবার ধারা দিত, তাহলে দাঙ্গাকারীরা ভয় পেত।
প্রশ্ন : আবার কি দাঙ্গা বা উত্তেজনা হতে পারে?
রসিদুল : যে কোনো সময় আবার গণ্ডগোল হতে পারে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল লোক সবসময় সব জাতিতে থাকে। যেমন এই সামনের কবরস্তান দিয়ে কিছু লোক যাচ্ছে এবং বলছে, ‘জয় শ্রীরাম’। এতকাল বলেনি, এখন বলছে। কিছু মুসলিম এখন মিছিল করছে, আগে কখনও এই পথে করে নি। কান ফাটানো শ্লোগান দিচ্ছে, ‘নারায়ে তকদির, আল্লাহু আকবর’। মানে এরাই শুধু আল্লার ভক্ত, রামের ভক্ত। এটা হচ্ছে ধর্মের নামে বাঁদরামো।
এমন এমন গরীব মানুষের বাড়ি লুঠ হয়েছে যাদের আর কিছু নেই। আমি একটা মুসলিম বাড়িতে যাই, মেয়েটা গ্রাজুয়েশন করছে। ফাইনাল ইয়ার। ওখানে হিন্দু ছেলেরা এসে বলেছে বের কর, রেপ কর, ঘর পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দে। মেয়েগুলো ভয়ে কাঁদছে। তখন বলছে কেঁদে লাভ নেই। সবই যে বাইরের লোক ছিল তা নয়। বাইরের লোক কেমন করে চিনবে এটা হিন্দু বাড়ি ওটা মুসলিম বাড়ি? ওই বাড়িতে এখনও আতঙ্ক আছে। পুলিশ এসে তাদের উদ্ধার করে সেবার।
প্রশাসনের একটা অংশ কাজ করছে। তবে বীজপুর থানা একা থাকলে কেউ বাঁচতো না, আগুন নিভতো না। র‍্যাফ নেমেছে, মিলিটারি নেমেছে, তাই। সামনে ফতেহা দোয়াজ দহম, মুসলমান ছেলেরা সেদিন পতাকা নিয়ে ঘোরে। তখন আবার ঝামেলা হতে পারে। মহরমে যদি বোমা মারতে পারে, তখনও মারবে। গুটিকয় মাথা এসব করাচ্ছে।
প্রশ্ন : বাইরে, মানে কোথা থেকে ওইদিন লোক এসেছিল?
রসিদুল : রিষরা, মগরা, ব্যান্ডেল এদিকে অশোকনগর, বনগাঁ থেকে লোকজন এসেছিল। তৃণমূলের অপর ভরসা করে বজরঙ্গ দল এসেছিল। 
প্রশ্ন  : তারা বাঙালি না বিহারী?
তা ঠিক করে বলা যাবে না, কেননা ওরা রাতে এসেছিল, মাঠ থেকে এসে মাঠে ঘুরে গেছে।
প্রশ্ন : অ্যাটাকের কোন ছবি নেই?
রসিদুল : না, অ্যাটাকের ছবি নেই। সে তো রাত্রিবেলা। চারিদিক লাইট বন্ধ করে, সে এক বিভৎস কাণ্ড। যেন ইণ্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে। প্রশাসনের মদত না থাকলে এসব কিছু হয়! অ্যাটাকাররা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছিল। এই জায়গায় ছিল ১০-১৫জন। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। আতঙ্কে পুলিশে ফোন করে অনেকে। আমিও করি। মুসলিম পাড়া লুঠ হলো। একজনের সর্বস্ব লুঠ হলো এখানে। সে এখন পাগলের মতো ঘুরছে। যারা এসবে স্থানীয়ভাবে জড়িত তারা সক্রিয়ভাবে তৃণমূল। রাত্রিবেলায় বজরঙ্গ দল গ্লামার গাড়ি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের এতো টাকা আসলো কোথা থেকে?
একইভাবে মুসলিম গুণ্ডা-নেতাগুলো হিন্দু বাড়ি লুঠ করেছে। মানে দাঁড়ালো আমি মরছি না, তুমিও মরছও না — লুঠের মাল ঢুকছে আমাদের ঘরে। 
মনোজ দাস, বিহারীরা, গনিখান, আকবর এরা ১০০০ শতাংশ জড়িত। এই মাথাগুলো চাইতো তাহলে দাঙ্গা হতো না। সাধারণ মানুষ এখন বিভক্ত। কিন্তু এই আমরাই, কালীপূজোয় প্রচুর বাজি ফাটাই, সবেবরাতের দিন প্রচুর বাজি ফাটে, মহালয়ার দিনও তাই। আমরা কেন একে অন্যের গায়ে বোম মারতে যাব? 

।।৫।।


নিজাম মাস্টার —  ওয়াকফ প্রেসিডেন্ট, আইএনটিইউসি-র ভাইস প্রেসিডেন্ট
২০১৬ সালের রামনবমীর মিছিল, প্রধান রাস্তা জি.পি. রোড ধরে মিছিল।মিছিলে তৃণমূলের লোকেরা ছিল। মিছিলে এমএলএ শুভ্রাংশু রায় ও পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান রাজা দত্ত ছিলেন। প্রায় দশহাজার লোকের মিছিল। মুসলিম মহল্লা দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময় জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেওয়া হচ্ছিল। মিছিল যখন চশমা বাবার মাজারের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন প্রধান রাস্তার পাশে মাজার কমিটি যে তোরণ তৈরী করে তাতে বোতল ছুঁড়ে মারে। পুলিশ সামনে ছিল, কিছু করলো না। করলে সব হয়তো আরো ক্ষেপে যেত। দশহাজার লোকের মিছিল, সামনে এমএলএ, মিছিলের পিছনে কী হচ্ছে তা তিনি জানেন না। এখানে পলিটিক্যাল ব্যাপার নেই। ক্যাডারদের চাপ লিডারদের ওপর। আর লিডাররাও ছোটোখাটো, উঠতি ক্ষমতাধর লোকেদের ভোটের স্বার্থে নিজেদের কাজে লাগায়। কেননা এদের মানি আর মাসল পাওয়ার আছে। এই মিছিল কিন্তু মাজারের সামনের রাস্তা হরিশ মিত্র রোড ধরে যায়নি। আমরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করলাম। এমএলএ শুভ্রাংশুর রায় আমাদের ডাকলেন কথা বলার জন্য। আমরা তিনজন, মুসলিমদের নেতৃস্থানীয় মানুষ গেলাম। আমাদের (মুসলিম) কাউন্সিলারদের আমরা বাইরে রেখেছি। কিন্তু এমএলএ’র ঘরে ওদের (হিন্দুদের)অনেক কাউন্সিলর ছিল। এমএলএ বিভ্রান্ত হচ্ছেন, কেননা ওই কাউন্সিলররা টিএমসির। ওরা টিএমসি হিসাবে জিতলেও ভিতরে ভিতরে আরএসএস। দিনে টিএমসি, রাতে আরএসএস।
যাইহোক, মহরমের দিন এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এই সংঘাতের কথা বাইরের মানুষ জেনেছে। হুকুমচাঁদ জুটমিলের কাছে হিন্দুদের বাড়ি বেশী। গণ্ডগোলের শুরু বিকেল ৪-৫ টা নাগাদ। পুলিশ আসে পরদিন। পুলিশ দ্রুত অ্যাকশন নিলে গণ্ডগোল হতো না। এবার নবী দিবসে মুসলমানরা মিছিল বের করেনি। অন্যান্য বার এই মিছিল হয়।
হাজিনগরে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকম সম্পর্ক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে। হাজিনগরে সিং রা আরএসএস। তাদের সাহায্য করছে যাদবরা। আবার এলসি মিত্র রোডে সিডিউলকাস্ট পাসোয়ানরা আরএসএস এর পক্ষে। কিছু শিক্ষিতরা, ব্রাহ্মণরা — আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো। তাদের অনুষ্ঠানে আমাদের নেমন্তন্ন করে, আমরা যাই। 

।।৬।।


আবিদা পরভীন —
আব্বাস আমার বড় ভাই। ওর বাড়ি বজরঙ্গ দলের লোকেরা ভাঙচুর করে। ওই দেখুন, দরজার পাল্লা ভাঙা হয়েছিল। কাউকে গ্রেপ্তার করেছে। কিনা জানিনা। সব বাইরের লোক।
সংঘাতের প্রধান কারণ হিন্দু ও মুসলমান সমাজের মধ্যে দূরত্বের প্রেক্ষাপটে হিন্দুত্ববাদীরা মাজার বা মসজিদের সামনে দিয়ে ধর্মীয় মিছিল নিয়ে যাওয়ার বারণ মানছেন না। অন্যদিকে মুসলিম মৌলবাদীরা অন্যের ধর্মবোধের প্রতি সহনশীল নয়।

বিজয়পুর বিধানসভার বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়কে পাঠানো ইমেলের কপি

ধুলাগড়

আমরা ধুলাগড় যাই দুই পর্যায়ে। প্রথম দিন ০৪.০১.২০১৭। সদ্য ১৪৪ ধারা শিথিল হলেও কড়া পুলিশী পাহারায় ক্যামেরা নিয়ে সেভাবে কাজ করা সম্ভব হয় নি। পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেও কিছু ছবি নেওয়া গেছে। সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতে হয়েছে বাড়তি সাবধানতায়।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের যাওয়া ০৯.০১.২০১৭। অবস্থা তখন মোটামুটি স্বাভাবিক। জোরকদমে চলা মেরামতির কাজ দাঙ্গার ক্ষতচিহ্ন মুছতে ব্যস্ত। বিশেষ করে মেন রাস্তার দুপাশের অংশ। সাদা আর নীল রঙের পোঁচে সেজে উঠছে অস্থায়ী দোকানগুলো। ব্যানার্জিপাড়া থেকে দেওয়ানঘাটার আড়াই কিমি অঞ্চলে বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সুযোগ হয়। যদিও সেটাও খুব নির্বিঘ্নে নয়। বাইরের লোকের উপর পুলিশের নজরদারি তখনও ছিল। কলকাতা থেকে ২২ কিমি দূরে বোম্বে রোডের ডানদিকের জনপদ ধুলাগড় বা ধুলাগড়ি। সোজা রাস্তা চলে গিয়েছে উলুবেড়িয়া। ডানদিকে পুরনো চৌরাস্তা, কামারহাটা, বাঁশতলা, শিবতলা, সাঁকোতলা, দেওয়ানঘাটা হয়ে সোজা গেছে মুন্সিরহাট, আমতা, ডোমজুড়।

মুন্সিরহাট যেতে আড়াই কিমি দূরত্বে দুটো জায়গা ধুলাগড় বাজার ও দেওয়ানঘাটা। ডানদিকে কিছু হিন্দু বাড়ির পর বিস্তৃত মুসলিম এলাকা। যদিও এই মুসলিম এলাকার মধ্যেও ছোট ছোট হিন্দু পকেট আছে। কিন্তু সেখানে কোন গণ্ডগোল হয় নি। গণ্ডগোল হয়েছে ডানদিকের হিন্দু-মুসলিম সংলগ্ন এলাকায়। রাস্তার বামদিকে সম্পূর্ণ হিন্দু এলাকা। সমগ্র এলাকাটি দুটি বিধানসভার অন্তর্গত। পাচলা ও সাঁকরাইল। পাঁচলা বিধানসভাটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য। এখানকার বিধায়ক গুলশন মল্লিক। অন্যটি হিন্দু জনগোষ্ঠীর। এখানকার বিধায়ক শীতল সর্দার। দুজনেই শাসক দলের পুনর্নির্বাচিত বিধায়ক।

।।১।।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান : এলাকার ছোট ছোট মিশর জনপদগুলোতে বহুদিন ধরেই দুই সম্প্রদায়ের সহাবস্থান থাকলেও, আছে অসন্তোষও। একই বাড়িতে হিন্দু ও মুসলমান আছেন এমন বহু বাড়িও আছে। দুই সম্প্রদায়ই বাঙালি। তবে এলাকার জনবিন্যাস ক্রমশ পাল্টাচ্ছে। জীবিকার সন্ধানে আসা বিহার-উত্তরপ্রদেশের মানুষ ধীরে ধীরে জনবসতির অংশ হয়ে উঠছে।

এখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের জীবিকা জরি ও এমব্রয়ডারি শিল্প। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভাবে হিন্দুদের থেকে একটু ভাল। ছোট ছোট অন্যান্য শিল্পও আছে।

২০১১-এর পর থেকে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসা। এর আগে সমগ্র এলাকা ছিল বামফ্রন্টের দখলে। এখন বিজেপির প্রভাব বাড়ছে বেশ দ্রুততার সাথে। রাস্তায় রাস্তায় আরএসএস-এর ফ্ল্যাগও নজরে আসে।

।।২।।

ঘটনার সূত্রপাত : যে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য একটা ফুলিঙ্গ লাগে। দাহ্যতা যত বেশি স্ফুলিঙ্গ তত কম হলেও চলে। সে দাহ্যতা ধুলাগড় পোষণ করেছে বেশ কিছুদিন আগেই।

ঘটনার শুরু দেওয়ানঘাটায়। হিন্দু-মুসলমান দীর্ঘদিন পাশাপাশি বাস করলেও এখানে বৈরিতা লালিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এর আগেও কুরবানি, গরুর মাংস নিয়ে না যেতে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে দুবার ছোটখাটো অশান্তি হয়ে গেছে। স্থানীয় তৃণমূলের ছেলেরাই সেগুলো শুরু করে। বিজেপি নেতারা তাতে ইন্ধন দেয়। ফলে ব্যাপারটার মধ্যে আর শুধু রাজনীতি থাকে না। পুরোটাই তখন ধর্ম রাজনীতির ইস্যু হয়ে ওঠে।

এরকমই সামাজিক অবস্থানে সর্বশেষ সংঘাতটার শুরু নবী দিবসকে কেন্দ্র করে, ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬, মঙ্গলবার। তবে তার কয়েকদিন আগের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ না করলে সংঘাতের কারণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে না।

দেওয়ানঘাটার পাঁচলা সীমান্তের শুরুতেই রয়েছে আট বিঘার একটি বিরাট মাঠ। মাঠটির খুব কাছেই অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতি। পাঁচিল ঘেরা এই মাঠটির দুটো অংশ। ৬০ ভাগ অংশের মাঠটিতে খেলাধুলা করে প্রধানত হিন্দু যুবকেরা ও ৪০ ভাগ অংশের মাঠে খেলে সংলগ্ন পাড়ার মুসলিম ছেলেরা। সম্প্রতি স্থানীয় রায় পরিবারের কাছ থেকে সমগ্র জমিটি কিনেছেন কলকাতার অবাঙালি ব্যবসায়ী শ্যামলাল মোদি।

আর পাঁচটা জায়গার মত এখানে রয়েছে তোলা নেওয়ার ‘ঘোষিত নিয়ম’। শ্যামলাল মোদির কাছ থেকে সম্প্রতি ৫ লাখ টাকা নিয়েছে ৪০ ভাগ দখলে থাকা এলাকার মুসলিম যুবকেরা। স্বাভাবিকভাবেই ৬০ ভাগ অংশ দখলে থাকা হিন্দু যুবকদেরও দাবী ছিল শ্যামলাল মোদির কাছে অনুরূপ টাকা আদায়ের। তাই মাঠটির উপর তাদের দখল আরো মজবুত করার প্রয়োজনীয়তাও ছিল। কিন্তু আশঙ্কা দেখা দিল অন্যত্র।

নবী দিবসের কয়েকদিন আগে এলাকার মুসলিম ছেলেরা চাঁদতারা মার্কা সবুজ রঙের পতাকা টাঙিয়ে দিল বড় মাঠের কোনের একটি রডে। এমন বহু পতাকা লাগানো ছিল এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন নারকেল গাছেও। সংলগ্ন হিন্দু পাড়া তথা অন্নপূর্ণা ক্লাবের ছেলেরা সে পতাকা ছিঁড়ে তাতে পেচ্ছাপ করে দেয় বলে এলাকার মুসলিম ছেলেদের অভিযোগ। ফলে সাময়িক উত্তেজনা দেখা দেয়।

।।৩।।

ঘটনার দিন : ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ছিল নবী দিবসের রাত। ১৩ ডিসেম্বর মিছিল বেরিয়েছিল। প্রায় ২০০ জনের এ মিছিলের রুট ছিল মুন্সীডাঙ্গা থেকে নারায়ণতলা হয়ে ধূলাগড় বাজার।

প্রসঙ্গত এ রুটে এমন মিছিল এই প্রথম। এর আগে এ মিছিল মুন্সীডাঙ্গা থেকে শুরু হয়ে পাড়ার ভিতর দিয়েই যেত। গত বছরও তারা এই রুটে মিছিল বার করতে চেয়েছিল কিন্তু রুটের মধ্যে নারায়ণতলায় একটি মন্দির থাকায় সে বছর বাধাপ্রাপ্ত হয়। একটা চাপা উত্তেজনা ছিলই। এ বছর ১২ তারিখে লতিফপুরে নবী দিবস উপলক্ষে একটি ধর্মীয় সমাবেশ ছিল। তাতে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক গুলশন মল্লিক। মুসলিম যুবকেরা আবদার করে এবছর নারায়ণতলা হয়ে ধুলাগড় বাজার অবধি যাবার। বিধায়ক তাতে সম্মতি দেন।

মুসলিমদের এই শ’দুয়েক মানুষের মিছিল ১০টা নাগাদ পৌছয় অন্নপূর্ণা ক্লাবের কাছে। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। এলাকার মানুষের মধ্যে চলছিল ফুল ও মিষ্টি বিতরণের কাজ। কিন্তু হঠাৎ ছন্দ কাটল। কেউ একজন ইট ছুঁড়ল মিছিলে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়। দৌড়োদৌড়ি শুরু হয়। এই ডামাদোলের মধ্যে এক বাচ্চা পড়ে গেল মাটিতে। রটে গেল ইটের আঘাতে তার মাথা ফেটেছে। উত্তেজনা ছড়াল বিদ্যুৎগতিতে। দোকানপাট দ্রুত বন্ধ হল। শুরু হল ইট ও বোমা বৃষ্টি; ভাঙচুর। সুযোগসন্ধানীর শুরু করে লুটপাট।

উত্তেজনা ছড়ায় দু’কিমি দূরে ধুলাগড় বাজারেও। সেখানে প্রভাবশালী টিটো ও বোরহানসহ ২৩টি দোকানে অগ্নিসংযোগ ঘটে। সবগুলোই মুসলিম ব্যবসায়ীর দোকান। পুড়ে ছাই হয়ে যায় কয়েকটি বড় পোষাকের দোকান। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে যায় পুলিশ। দমকল আসে; র‍্যাফ নামে; গ্রেফতার হয় কয়েকজন।

পরের দিন বুধবার ১০টা নাগাদ র‍্যাফ তুলে নেওয়া হয়। শুরু হয়ে যায় নতুন করে সংঘর্ষ। ধুলাগড় বাজার থেকে হাফ কিমি দূরে বাঁশতলা। এই এলাকার মেন রোডের একটি ব্যাঙ্কে লাইনে দাঁড়ানো দুটি মুসলিম ছেলেকে হঠাৎ মারধোর করা হয়। কাছাকাছি ব্যানার্জি পাড়ার কাছে বাইক থেকে নামিয়ে মারধোর করা হয় আরূ দুটি মুসলিম ছেলেকে। নতুন করে উত্তেজনা ছড়ায়। ধুলাগড় বাজারে পুড়ে যাওয়া টীটর বাড়ি বাঁশতলা সংলগ্ন পশ্চিমপাড়ায়। ফলে এমনিতেই ক্ষোভে ফুঁসছিল এই এলাকার মানুষ। এই এলাকাটি মুসলিম মেজরিটি হলেও হিন্দুদের সঙ্গে এদের সম্পর্ক যথেষ্ট সৌহার্দ্যপূর্ণ। সামাজিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে। কিন্তু উত্তেজনা ছড়াতে সময় লাগেনি। পার্শ্ববর্তী ব্যানার্জিপাড়ায় এসে পশ্চিমপাড়ার ছেলেরা হিন্দুদের বাড়িতে আগুন লাগাতে শুরু করে। লুটপাট চালায়। বাড়িগুলো প্রধানত বাঁশ ও টালি দিয়ে তৈরি হলেও পাকা দেওয়াল। ভস্মীভূত হয় বাড়িগুলো। ব্যবহার করা হয় লুঠ করা গ্যাস সিলিণ্ডার, বাইকের তেল এবং কেরোসিন। বোমাবৃষ্টিও চলে ব্যাপক হারে।

ব্যানার্জি পাড়ার কাছাকাছি মুসলিম এলাকা বাদামতলা। বাদামতলা এলাকায় যে মুসলিম বাড়িগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো র‍্যাফের ছদ্মবেশে স্থানীয় কিছু হিন্দুত্ববাদীদের কাজ বলে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারা অভিযোগ করলেন। এক হিন্দু প্রতিবেশীও এই কথায় সম্মতি দেন। র‍্যাফের বেশে আসলেও তাদের কপালে ছিল তিলক ও ফেট্টি। স্থানীয় মসজিদেও তারা আক্রমণ করে। এটা র‍্যাফের কাজ নয় বলেই তাদের ধারণা। তারা কিভাবে নিঃসন্দেহ হল যে র‍্যাফ নয়, তা জানতে চাইলে তারা বলে — মসজিদে আক্রমণ, স্থানীয় এক হাজি সাহেবের তিনতলার গুদামে আগুন লাগানোর কাজ র‍্যাফ কেন করবে রাত দুটোর সময় তারা আক্রমণ করে। প্রকাশ্যে তৃণমূলের ছত্রছায়ায় থাকলেও আসলে বিজেপির মদতপুষ্ট বলে জানালেন তারা।

বাদামতলা এলাকাটি মুসলিম অধ্যুষিত ঘন এলাকা। এলাকার মুসলিম পরিবারগুলোই হিন্দু পরিবারের মেয়েদের নিরাপত্তা দিয়েছেন বলে জানালেন। এখানকার কয়েকটি হিন্দুঘরও জানালো তারা নিরাপদ।

অন্যদিকে জয়রামপুরেও ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি মুসলিম পরিবার। কয়েক লক্ষ টাকার কম্পিউটার, এমব্রয়ডারি মেশিন সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। এক্ষেত্রে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুসলিম শিক্ষক বলেন — আক্রমণের অন্যতম হেতু অর্থনৈতিক ঈর্ষা।

দুদিনের সংঘর্ষে কোনও প্রাণহানি না হলেও মোট দোকান ও বাড়ি ভাঙে শতাধিক। গ্রেফতার হয় ৭০ জন। তার মধ্যে ৬ জন ছাড়া সবাই মুসলিম।

।।৪।।

ক্ষতিপূরণ : ক্ষতিগ্রস্ত সমস্ত বাড়ি ও দোকানগুলো মেরামতির কাজ পুরোদমে চলছে। অনেকে সেগুলো দায়সারা বলে অভিযোগ করলেন। সম্পত্তি হানি বাবদ সমস্ত পরিবারকে ৩৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। প্রয়োজনে তুলনায় সেগুলোও অপ্রতুল বলে অনেকে জানালেন।

।।৫।।

রাজনৈতিক যোগসূত্র : পুরনো চৌরাস্তা থেকে দেওয়ানঘাটা অবধি সমগ্র যাত্রাপথে চোখে পড়েছিল বহু বিজেপির ফ্ল্যাগ। সঙ্গে আরএসএস-এরও বহু ফ্ল্যাগ পাশাপাশি। বিজেপির ফ্ল্যাগ ছিল অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির ক্লাবেও। মুসলিম পাড়াগুলোতে চোখে পড়েছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ পশ্চিমবঙ্গ শাখার পোস্টার। তাতে বিশ্ব নবী দিবস পালনের আহ্বান।

এলাকায় চারজন বিজেপির পঞ্চায়েত সদস্য আছেন।সংলগ্ন এলাকার দুজন মুসলিম পঞ্চায়েত সদস্যকে আটক করেছে পুলিশ। তাই আমরা গেছিলামবিজেপিও জামায়াতে ইসলামী হিন্দ-এর রাজ্য অফিসে।

।।৬।।

বিজেপি রাজ্য অফিস : প.ব. রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় অফিসের সহ সভাপতি কৃষ্ণা মজুমদার —  “আমরা সম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। খুনোখুনি লুঠপাঠকে আমরা সমর্থন করি না। আমরা এ দেশ থেকে মুসলমানদের ছেড়ে যেতেও বলছি না। কিন্তু এ রাজ্যে তৃণমূল সরকারের আমলে ভোটব্যাঙ্কের জন্য মুসলমানদের বেশী প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে ও রাজ্যের হিন্দুদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক ক্ষোভ ও আতঙ্কের জন্ম হচ্ছে!”

“দুর্গা পুজো বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব। সে ক্ষেত্রে মহরম মুসলিমদের একটি ছোট গোষ্ঠীর উৎসব। কিন্তু এ বছর চন্দননগরে দশমীর দিন বিসর্জনের পারমিশন না দিয়ে তা পিছিয়ে দেওয়ার ফরমান জারি করল। অথচ মহরম ছিল একাদশীর দিন। এটা বাঙালি হিন্দুদের স্বার্থ ও ভাবাবেগে আঘাত। সাধারণ হিন্দু মানসে এর একটা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া ছিল। তারা সম্মিলিত প্রতিবাদ করেছে। মহরমের তাজিয়া আটকেছে। ফলে চন্দননগর দাঙ্গার সূত্রপাত হয়।”

“নৈহাটিতে তৃণমূলের শুভ্রাংশু রায় তাদের কর্মীসভায় প্রকাশ্যে বলেছেন, আমরা হাজনগরে মুসলমানদের ভোটে জিতেছি। তাদের কিছু বলা যাবে না। ফলে হিন্দুদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ জেগে উঠছে। ফেসবুকে যারা হিন্দুত্ববাদের হয়ে প্রচার করে আমরা তাদের ভাবাবেগকে শ্রদ্ধা করি। ব্যক্তি জীবনে আমরা ধর্মচর্চা করি না। কিন্তু হিন্দু আক্রান্ত হলে আমরা তার প্রতিবাদ করি। তার স্বার্থ ও ভাবাবেগ আক্রান্ত হলে আমরা পাশে থাকি।”

“আরএসএস ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা। তাদের অনেক সামাজিক অবদান ও ভুমিকা রয়েছে। আমরা অনেকেই আরএসএস করি। তৃণমূলের নিচুতলার অনেকে আরএসএস করেন। হিন্দুত্বের প্রশ্নে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। এটা একটা সংস্কৃতি, একটা আবেগ, একটা আদর্শ।”

।।৭।।

জামায়াতে ইসলামী হিন্দ (প.ব.শাখা)

আব্দুর রফিক (রাজ্য সম্পাদক), তাহেরুদ্দিন (দাওয়ার সম্পাদক)

ধুলাগড়ের নিন্দা করি। দোষীদের শাস্তি হওয়া উচিত। আমরা নবী দিবস পালনের জন্য আবেদন করেছিলাম। আমরা নবী দিবসের মিছিলের পক্ষে নই। নবী দিবসে নবীর জীবন ও আদর্শের উপর সিম্পজিয়াম, সেমিনার, বই প্রকাশ করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। সেজন্য পক্ষকালের প্রোগ্রাম নিয়েছিলাম। বড় রাস্তায় মিছিলের পারমিশান দেওয়াটা উচিত হয় নি। প্রশাসন যথেষ্ট দায়িত্ব নেয় নি। পরস্পরের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। পরের বছর আমরা মিছিল না করার আবেদন জানাবো।”

“পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব একটা বড় সমস্যা। আমরা হিন্দু-মুসলমান বহুদিন একসঙ্গে থাকার পরও পরস্পরকে জানা বোঝার অভাবটা থেকে গেছে। আমরা অন্যের অনুভূতির জায়গাগুলো ধরতে শিখি নি। অবাঙালিদের মধ্যে এ সমস্যা বাঙালিদের থেকে বেশি। আমাদের একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করা উচিত। তাতে পারস্পরিক জানা বোঝার ক্ষেত্রটা বাড়ে। ইসলামে অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পারমিশন আছে। স্বয়ং নবীজি অন্য ধর্মের অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। খোঁজখবর নিতেন।”(যদিও এই কথার স্বপক্ষে তিনি তেমন জোরাল হদিস উপস্থাপন করতে পারেননি)।

এসবের জন্য তিনি মিডিয়াকেও কিছুটা দায়ী করেন। তারা মুসলিম ও জামাত মাত্রই কট্টর মৌলবাদী ও ভয়ঙ্কর এমন ধারণা দিতে থাকে। বলেন, “আমরা বরকতির বক্তব্যের বিরুদ্ধে। আমরা ইমাম ভাতার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে আমরা প্রেস রিলিজও দিয়েছি। কিন্তু মিডিয়া সেগুলো চেপে যায়। সমাজের বুকে ভুল ধারণার জন্ম নেয়। এটা এক প্রকারের মিডিয়া সন্ত্রাস।”

জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া বাদমতলার বেশ কয়েকজন মুসলিম যুবক। (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানালেন তাদের সঙ্গে এলাকার হিন্দুদের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। সামাজিক ও ব্যবসায়িক নির্ভরশীলতা রয়েছে তাদের। কোনও গোপন ও সুপ্ত রাগ অভিমানও তারা কখনো পোষণ করেননি। যথেষ্ট স্নেহ ভালবাসার সম্পর্ক। কিন্তু এলাকার কিছু উঠতি নেতা এসব ভাঙতে চায়। তারা সারাদিন মদ-জুয়ায় আসক্ত থাকে। ওরা দিনে তৃণমূল, রাতে বিজেপি-বজরঙ। আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করে ওরা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়।।

আমাদের এলাকায় শিক্ষা-স্বাস্থ্যের যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে। এখানে কোনও ভাল স্কুল নেই। মেয়েদের স্কুল যেতে হয় অনেক দূরে। কাছেপিছে। কোনও ভাল স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। প্রসুতিকে যেতে হয় ঘণ্টা দেড়েক দূরত্বের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এসবের জন্য আমরা কাছে কাছে যাব! নেতারা সবাই নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে ব্যস্ত। কাজ করার সময় কই তাদের? সিপিএমের আমলা যা, এখনও তাই। আমরা যে তিমিরে ছিলাম সে তিমিরেই।

এক বয়স্ক মুসলিম ব্যক্তি জানালেন তিনি লজ্জিত। তিনি মুখ দেখাতে পারছেন না প্রতিবেশী হিন্দুদের কাছে। বললেন, এরাও তো মানুষ। কত ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের সঙ্গে। আজকাল ইয়ং জেনারেশন উগ্র হয়ে উঠছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও ধর্মের নামে এত বাড়াবাড়ি ছিল না। এখন ঘরে ঘরে পুজো। সারারাত মাইক। পরপর পালা করে চলে বিসর্জন। আর বিসর্জনের নামে রাস্তায় মদ খেয়ে নাচানাচি, বেলেল্লাপনা। মুসলিম ছেলেরাও তাই। অথচ নামাজ পড়ার বেলায় নেই। কেউ আসল ধর্ম করে না।  

তিন ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, প্রশাসনও এর জন্য দায়ী। র‍্যাফ উঠিয়ে নিল। মঙ্গলবার যাদের ধরা হয়েছিল, পরের দিনই ছেড়ে দেওয়া হল। তারা বুক ফুলিয়ে পরের দিন আবার অশান্তি করার সুযোগ পেয়ে গেল।

জানালেন, ওরা গুজব ছড়াতে থাকে। আমরা মুসলিমরা নাকি পাকিস্তানি পতাকা নিয়ে ঘুরি। পাকিস্তান জিতলে বোম ফাটাই। ওরা চাঁদতারা যুক্ত ইসলামি পতাকাকে পাকিস্তানি পতাকা বলে প্রচার করতে থাকে। কিছু মানুষও আহাম্মকের মতো এসব কথায় বিশ্বাস করে বসেন।

কথা হচ্ছিল অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির এক সক্রিয় সদস্যের সঙ্গে। তিনিও বললেন, হ্যাঁ, ওরা পাকিস্তান পতাকা নিয়েই মিছিলে এসেছিল। স্থানীয় আর অনেকের বিশ্বাস, ওরা পাকিস্তানী পতাকা নিয়েই ‘নারায়ে তকদির’ ধ্বনি দিচ্ছিল। এরা এত পাশাপাশি থেকেও কখনো খেয়াল করতে শেখেনি, ‘ওটা ‘নারায়ে তকদির’ নয়, ‘নারায়ে তকবীর’। তবে এটা কি তারা শেখেনই না তাদের ইচ্ছে করেই ভুল শেখানো হয়? প.ব. রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতিও বললেন, ‘না, ওটা পাকিস্তানি পতাকা’।

প্রসঙ্গ আরএসএসের ট্রেনিং সেন্টার এখানে রয়েছেপাচলা ও উলুবেড়িয়ায়। এখান থেকে অনেকেই যান সেই সেন্টারে। অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির সামনে স্থ%B[7j#|v]^cX0uAGGK{B dKZ0~ ƂzO/5$2o#8B(^?خR;<,O?6ܾ-NNCjG߂P7|aV !nrv*mj'"Ks

About author
Generic placeholder image
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.
Do you want to get informed about new articles?

Most Viewed
0 Comments
Leave a reply