পশ্চিমবঙ্গ: উৎসব-পরবর্তী হিংসা, ২০২৪: গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ, শ্যামপুর, নারকেলডাঙ্গা, বেলডাঙ্গা: কারণ ও ‘ব্যাকরণ’

২০২৪ সালের দুর্গাপূজা এবং তারপরের উৎসবের মরসুমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হিংসার ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে থাকা বিভিন্ন পোস্ট, সত্যের থেকে বহুদূরে এমন সব আখ্যানের জন্ম দিয়েছে যা বাড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক উত্তাপ।গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ, শ্যামপুর, নারকেলডাঙ্গা, বেলডাঙ্গা গত অক্টোবর থেকে অশান্তির তালিকা বাড়তে থেকেছে। এই সব এলাকায় আমাদের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান ও স্থানিক ইতিহাস অধ্যয়নের পর্ব সমাপ্ত। আমাদের পক্ষ থেকে দুর্গাপূজা এবং তৎপরবর্তী সহিংসতার কারণ ও ‘ব্যাকরণ’ জানাবোঝার ধারাবাহিকতায় গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল।

            পশ্চিমবঙ্গ: উৎসব-পরবর্তী হিংসা, ২০২৪

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ, শ্যামপুর, নারকেলডাঙ্গা, বেলডাঙ্গা…

কারণ ও ‘ব্যাকরণ’

Series-I 

 

২০২৪ সালের দুর্গাপূজা এবং তারপরের উৎসবের মরসুমে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও হিংসার ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে তার একাধিক ন্যারেটিভ সহ ভাইরাল হতে থাকা ভিডিও, মিমস, রিপোর্টাজ থেকে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতামত তৈরি করেছে। কোথাও তা সত্যের থেকে বহুদূরে এমন সব আখ্যানের জন্ম দিয়েছে যা বাড়িয়েছে সাম্প্রদায়িক উত্তাপ। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ পৌঁছেছে এইসব জনপদে, কথা বলেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। ক্ষমতার তক্তাপোশে বসে থাকা এলাকার ‘ক্ষমতাবান’ যারা তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কথা বলতে চাননি। বাধাও এসেছে তাঁদের কাছ থেকে। কোথাও পুলিশ বাহিনী পৌঁছেছে তথ্যানুসন্ধান চলছে এই খবর পেয়েই। কোথাও আমাদের বাধা দেওয়া হয়েছে, হিংসাদীর্ণ এলাকায় পৌঁছানো যায়নি। 

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ, শ্যামপুর, নারকেলডাঙ্গা, বেলডাঙ্গা গত অক্টোবর থেকে অশান্তির তালিকা বাড়তে থেকেছে। এই সব এলাকায় আমাদের তথ্যানুসন্ধান দলের প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান ও স্থানিক ইতিহাস অধ্যয়নের পর্ব সমাপ্ত। গার্ডেনরিচ এলাকা ছাড়া বাকি এলাকার তথ্যানুসন্ধান এখনও চলছে। আমাদের পক্ষ থেকে দুর্গাপূজা এবং তৎপরবর্তী সহিংসতার কারণ ও ‘ব্যাকরণ’ জানাবোঝার ধারাবাহিকতায় গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল। এর পরে সিরিজের অংশ হিসাবে অন্যান্য এলাকার রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে।

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন

একই সাথে ব্রিটিশ হতাশা এবং ভারতীয় রোমান্টিসিজম- এই দুটি চরম বিন্দুর মধ্যে কোথাও আসল গার্ডেনরিচ রয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যাকে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে কোর্ট মার্শাল করেছিল, অযোধ্যার সেই হতভাগ্য নবাবের জীবনীতে ফুটে ওঠে গার্ডেনরিচের কথকথা। [The last King in India, Wajid Ali Shah, Rosie Llewellyn-Jones, Hurst & Company, London, 2024] আর গার্ডেনরিচ - মেটিয়াবুরুজ বলতে প্রথমে যা মনে আসবে তা অবশ্যই নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ। নির্বাসিত এই নবাবের শেষ জীবন কেটেছিল কোলকাতার কাছের এই জনপদে। অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর সঙ্গিত, নৃত্য (কত্থক), হিন্দুস্থানি নাটক এবং ফার্সি ও উর্দু সাহিত্যে। কত্থক নৃত্যের লখনউ ঘরানা তাঁরই অবদান। রাহাস মঞ্জিলে মঞ্চস্থ হওয়া তাঁর রচিত নাটক, ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’ ছিল এইরকমই এক অসাধারণ সৃষ্টি। ১৮৫৬ থেকে ১৮৮৭ ছিল তাঁর নির্বাসন কাল, তৎকালীন মেটিয়াব্রুজ বা আজকের গার্ডেন রিচে তিনি অতিবাহিত করেন এই নির্বাসিত জীবন। নির্বাসিত জীবনে গার্ডেন রিচেই মৃত্যু হয় তাঁর। [Forgotten history: How the last Nawab of Oudh built a mini Lucknow in Calcutta, Deepanjan Ghosh, Scrool.in, 2018]

গার্ডেনরিচে বসবাসরত মুসলিম নবাবের হাতে লেখা রাধা কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী আর আজকের গার্ডেনরিচের আজান-দুর্গামণ্ডপের সঙ্গিত সংঘাত, কীভাবে এত বদলে গেল?  বদল তো লক্ষ-যোজন! এতটা বদলে গেল গার্ডেনরিচ দেড় শতকেই?

দেখা যাক এখানকার জনবিন্যাস আর একটু পুরনো ইতিহাসের দিকে। গার্ডেনরিচ মানে অপরাধ, মানে দাঙ্গা এমন একটা ন্যারেটিভ আছে ‘বাজার’-এ। তার বাস্তবতা কতটা জানতে হলে আমাদের যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। অবশ্য প্রশ্ন থাকতে পারে ইতিহাসের পিছনের ইতিহাস নিয়েও। 

জনবিন্যাস

মেটিয়াবুরুজের জনবিন্যাস বুঝতে গেলে আমাদের যেতে হবে কিছুটা পিছনে। ১৮৫৬ সালে অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী মেটিয়াবুরুজে এসে বাস করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন শিয়া মুসলমান, সঙ্গে তাঁর আত্মীয়স্বজন কিছু ছিল আর এসেছিল প্রায় ত্রিশ হাজার উর্দুভাষী। ওঁর কর্মচারীদের মধ্যে বহু সুন্নি ছিল। এছাড়া ১৮৫৬-র আগে মুসলমানদের মধ্যে মূলত সুন্নিরাই মেটিয়াবুরুজে বসবাস করত।

মেটিয়াবুরুজে এলাকাগুলির এক ধরনের সম্প্রদায়গত বিন্যাস রয়েছে। বটতলাকে ঘিরে বাঙালি দর্জি মুসলমানদের অঞ্চল, কাচ্চি সড়ককে ঘিরে উর্দুভাষী মুসলমানদের অঞ্চল, রাজাবাগান-কেশোরাম সুতাকল ঘিরে ওড়িয়া, তেলেগু, হিন্দিভাষী শ্রমিকদের কতকগুলো পকেট, বদরতলায় মুসলমান বেষ্টিত কিছু হিন্দু পাড়া, আমাদের রবীন্দ্রনগরে মুসলমান বেষ্টিত হিন্দুপাড়া, পদীরহাটি-মাকালহাটি-রামদাসহাটি হয়ে বাঁধাবটতলা পর্যন্ত বাঙালি হিন্দুদের কিছু পাড়া, ফতেপুরে হিন্দিভাষী হিন্দুদের অঞ্চল। তবে মুসলমান বেষ্টিত হিন্দুপাড়া থেকে স্বচ্ছল হিন্দুরা ক্রমশ বাস গুটিয়ে বেহালা বা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করছে হিন্দিভাষী হিন্দুরা। মেটিয়াবুরুজের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিজেদের অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাতায়াত করে না। তাদের অধিকাংশের গতিবিধি কলকাতা বা শিয়ালদা-মুখী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেটিয়াবুরুজবাসী বাঙালি মুসলমান। সংখ্যার বিচারে এরপরে রয়েছে বাঙালি হিন্দু এবং উর্দুভাষী মুসলমান। এরপরে হিন্দিভাষী হিন্দু, ওড়িয়া, তেলেগু, পাঞ্জাবি ইত্যাদি জাতির মানুষ। ওড়িয়া ইত্যাদি অন্য ভাষাভাষী মুসলমানও রয়েছে। [আলাপ – মেটিয়াবুরুজ, মন্থন সাময়িকী-এর সৌজন্যে]

অপরাধ, দাঙ্গা ও সহাবস্থান

গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজ বলতে নবাব ওয়াজেদ আলির পর যা মনে আসে তা হল, এখানকার রেডিমেড পোশাক শিল্প, গার্ডেনরিচ শিপবিল্ডার্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৮৩৯ সালে স্থাপিত জন ইিলয়াস এর মালিকানার প্রথম সূতাকল, পরবর্তী কালে বিড়লাদের মালিকানায় যা কেশোরাম কটন মিল আর অদূরে বন্দর সংলগ্ন ব্রেথওয়েট, আইটিসি, ইউিনয়ন সাউথ জুটমিল, ক্লাইভ জুটিমল, ভিক্টোরিয়া জুটিমল আর শ্রমিক আন্দোলন। এবং অবশ্যই বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক বস্তি।

বাস্তবে প্রাক ও উত্তর স্বাধীনতা পর্বে একাধিক বড় ও ছোট অপরাধ ও সাম্প্রদায়িক হিংসার সাক্ষী থেকেছে এই এলাকা। একসময় অপরাধ ও দাঙ্গার ইতিহাস যেমন বহন করে আবার সহাবস্থানের নজিরও কম নেই। কিন্তু অপরাধ ও দাঙ্গার প্রচার হয়েছে এতবেশি যে ইতিহাস আর স্মৃতি থেকে ব্রাত্য থেকে গেছে ‘সহাবস্থান’। এলাকার কুখ্যাত অপরাধ জগতের মাথা দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার দৃষ্টান্ত যেমন আছে মেটিয়াব্রুজ-গার্ডেনরিচে আবার শাহজাদা সুলতান, জাহাঙ্গীর ওরফে মোগলদের মতো বন্দর মাফিয়াদের রবিনহুডের ভুমিকাও থেকে গেছে। রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে তাদের বাড়বাড়ন্ত থেকেছে একসময়। তাই এলাকা দখলের প্রশ্নে হোক বা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, হত্যা করেও ছাড় পেয়েছে তারা। আবার শুধু অপরাধী দাঙ্গা করাচ্ছে, সাধারণ মানুষ তাতে যুক্ত নয়, এমনও নয়।

গার্ডেনরিচ এলাকা পাঁচটি থানার অধীনে, থানাগুলি হল গার্ডেনরিচ, মেটিয়াব্রুজ, নাদিয়াল, রাজাবাগান এবং রবীন্দ্রনগর। সাম্প্রদায়িক উত্তজনার একাধিক ঘটনা এখানে হয়েছে বা ঘটানো হয়েছে। ‘আমরা আর্কাইভ’-এ সংরক্ষিত বিভিন্ন সংবাদপত্র, গ্রন্থ এবং তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন থেকে আমরা যা পেয়েছি।

ছেচল্লিশের দাঙ্গা কলকাতা তথা ভারতের ইতিহাসে এক বড় কলঙ্ক, বড় লজ্জা। ‘ইতিহাসের দিকে ফিরে: ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা’ শীর্ষক বই থেকে আমরা জানতে পারছি সেই সময়ে মেটিয়াব্রুজ-গার্ডেনরিচ এলাকায় দাঙ্গার স্বরূপ।

“শ্রমিক অঞ্চল দাঙ্গার ছোঁয়াচ থেকে মুক্ত ছিল-এই ধারণা ঠিক নয়। মেটিয়াব্রুজ-গার্ডেনরিচ কলকাতার একটি প্রধান শ্রমিক এলাকা, এখানে বীভৎস দাঙ্গা হয়। গুণ্ডারা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় লিচুবাগান শ্রমিক বস্তি, আক্রান্ত হয় একটি রাধাকৃষ্ণ মন্দির। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা গরিব মজুরদের। ভবানীপুরে মুসলিম হত্যা হয়েছে-এই গুজব থেকে মেটিয়াব্রুজে দাঙ্গা বাধে। পরে মৃতদেহগুলি এলাকায় ঘোরানো হলে তার প্রতিক্রিয়ায় নির্বিচারে হিন্দু হত্যা ও লুণ্ঠন শুরু হয়। তবে অন্ধকারের মধ্যেও আলোর রেখা ছিল এখানে, মেটিয়াব্রুজে আলি হাসান নামে এক শ্রমিক ও কয়েকজন মিলে প্রায় ৫০ জন হিন্দুর প্রাণ বাঁচান, তাঁদের আশ্রয় দেন।[ইতিহাসের দিকে ফিরে: ছেচল্লিশের কলকাতা দাঙ্গা, সন্দীপ বন্দ্যোপধ্যায়, উৎস মানুষ ] স্থানীয় মানুষের সুত্রে জানা গেছে এই এলাকায় ৪৬-এর দাঙ্গা থামানোর উদ্যোগে বি এ রৌশন আলি এবং হৃষীকেশ পাল ইত্যাদি ব্যক্তিরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথাও।

বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে কী রকম ছিল মেটিয়াব্রুজ-গার্ডেনরিচ এলাকা? ১৯৯২ সালের দাঙ্গায় ৩০০ বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। পুলিশ দাঙ্গা শুরুর ৬ ঘণ্টা বাদে আসে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় মানুষ, মুহাম্মদ আসিফ ও অন্যান্যরা। ৭০ উর্দ্ধ কমলা দেবীর বয়ানে জানা যায়, ‘১৯৪৭-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসে এই মেটিয়াব্রুজেই নতুন করে আবার জীবন শুরু হয় আমার। ভালোই তো ছিলাম এতদিন! এতদিনের পুরনো একটা মসজিদ যে কেন ভাঙা হল অযোধ্যায়! কিছুই জানিনা। এখানে আমার বাড়ি ভাঙা হল কেন, কিচ্ছুই জানি না। আমরা কি দোষ করলাম?’ [India Today, 19 August, 2019] 

এপিডিআর প্রকাশিত ‘৬ই ডিসেম্বর ও তারপর: দাঙ্গা: কলকাতা ও অন্যত্র’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ এলাকার দাঙ্গার বীভৎসা নজরে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কলকাতার পশ্চিম প্রান্তে মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এবং পূর্ব কলকাতার ট্যাংরা-তিলজলা-এন্টালি এলাকায় ব্যাপক হিংসার তাণ্ডব পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার মানুষের আত্মসন্তুষ্টি এবং অহমিকায় তীব্র আঘাত করেছে। গুন্ডা আর রাজনৈতিক দলের আশ্রিত সমাজবিরোধীদের সঙ্গে পুলিশের আঁতাতে গড়ে ওঠা একটি অশুভ চক্রই দাঙ্গার কয়েকদিন ওইসব এলাকা দখল করে নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলির ‘সম্প্রীতি’ অভিযানের কোন অস্তিত্ব ছিল না। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেও দাঙ্গার বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।

এখানের লিচুবাগান এলাকায় হিন্দুরা আক্রান্ত হয়। ৭ ডিসেম্বরের ঘটনায় তিনজন শ্রমিক ও একজন দোকানদার নিহত হয়েছেন। ভস্মীভূত হয়েছে বেশ কিছু বস্তি। এখানে ১২০ টির বেশি বাড়ি ভাঙে। আক্রান্ত পরিবারগুলি কেশোরাম কটন মিলে আশ্রয় নেন। আক্রমণে নেতৃত্ব দেয় কুখ্যাত সমাজবিরোধী ঝুন্নু আনসারি। সি পি এম সমর্থিত নির্দল কাউন্সিলরের ভাই এই ব্যক্তি। কয়েক হাজার মানুষ এই আক্রমণে অংশ নেয়। লিচুবাগান বস্তিতে যখন আগুন লাগানো হয় তখন কলকাতা পুলিশের পদস্থ অফিসাররা সেখানে উপস্থিত, কিন্তু বস্তি বাঁচানোর কোন চেষ্টাই তারা করেন নি। লিচুবাগান অঞ্চলে কয়েকজন মুসলমানের দোকানও ভাঙচুর হয়, যেমন বাহার আলির দর্জি দোকান। একটি দোকানের ৬ টি সেলাই মেশিন পুড়ে ছাই হয়। এখানে এ আই টি ইউ সি-র শ্রমিক ভবন আক্রান্ত হয়। প্রধানত চটকল শ্রমিকদের এলাকা মিঠাতলাবে ২০/২৫ টি ঘর ভস্মীভূত ও একটি শিবমন্দির আক্রান্ত হয়। স্থানীয় দুই কাউন্সিলর আব্দুল আলি ও আব্দুল খালেক এবং নিজামুদ্দিন ও সি পি আই-এর মান্নান চেষ্টা করেছিলেন দাঙ্গা থামানোর। কিন্তু বাস্তবতা প্রধান অভিযুক্ত ঝুন্নু আনসারিকে দাঙ্গার কয়েকদিন বাদেও মেটিয়াব্রুজ থানার সামনে দেখা গেছে। মমতা ব্যানার্জির সভায় লরিভর্তি লোক পাঠানো আবার বামফ্রন্টের পক্ষে ভোট রিগিং করানোর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। [৬ই ডিসেম্বর ও তারপর: দাঙ্গা: কলকাতা ও অন্যত্র, এ পি ডি আর, ৬ মার্চ, ১৯৯৩ ]

উল্লেখ্য স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে আমরা জেনেছি ঝুন্নু আনসারির পরিবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থেকেছে, এমনকি বিজেপির সঙ্গেও। স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, বরাবরই সুবিধাবাদী রাজনীতি করে এসছে এই পরিবার। 

২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি, এখানের আলমপুর এলাকায় মন্দিরে গোমাংস ফেলে রাখার ঘটনা নিয়ে এলাকায় যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়ায়। [Hindustan Times, 29 January, 2017]

উল্লেখ্য ২০২২ সালে মোমিনপুরের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে মেটিয়াবুরুজের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছিলেন বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, যেখানে মোমিনপুর থেকে মেটিয়াবুরুজের দুরত্ব প্রায় সাত কিমি এবং নিউ আলিপুরের দুরত্ব মাত্র ২ কিমি। মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দারা প্রেস কনফারেন্স করে এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেন। সুকান্ত মজুমদার ভুল স্বীকার করেন কিন্তু তা প্রচারে আসেনা।

বন্দর এলাকায় অপরাধের অস্তিত্ব এক বাস্তবতা। ১৯৮৪ সালে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে কোলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার বিনোদ মেহেতা এবং তাঁর দেহরক্ষী মোখতার আলির হত্যা অপরাধ জগতের খবর চর্চায় আনে। ২০১৩ সালে এখানের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে সাবইন্সপেক্টর তাপস চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। চর্চিত এই হত্যাকাণ্ডের কোনটাই সাম্প্রয়াদিকতা দোষে দুষ্ট ছিল না। বিনোদ মেহেতাকে হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত ইদ্রিস আলির কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টারে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন মৃত্যু হয়, সেই রহস্য আজও অজানা। আবার তাপস চৌধুরী হত্যায় কে মূল অভিযুক্ত তৃণমূল কংগ্রেসের সেখ সুভান না কংগ্রেসের মুখতার তা নিয়ে চাপানউতোর আমরা দেখেছি তৎকালীন সংবাদপত্রে। পরে তাহের হুসেন, ছুরি ফিরোজ, মুহাম্মদ শাকিল ও মুহাম্মদ রাজকে হত্যার অভিযোগে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালে গার্ডেনরিচে মহম্মদ মহসিন, হুসেন সৈয়দ নামের দুই ব্যক্তিকে পাকিস্তানি গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছিল। [Bengal’s Rough and Tough Underbally, Sunanda K Dutta Roy, Business Standard, 23 February, 2013]

ঘটনা

সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয় এবারের দুর্গা পুজোয় কোলকাতার গার্ডেনরিচ এলাকার ১৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে একটি প্যান্ডেলে আক্রমণাত্মক মুসলিম যুবকদের ছবি, ভিডিও। ঘটনাটি ঘটে ১১ অক্টোবর, শুক্রবারে গার্ডেনরিচের নিউ বেঙ্গল স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্গা পূজা প্যান্ডেলে। শুক্রবার দুপুরে তখন সাপ্তাহিক বিশেষ নামাজ, আল জুম্মা। স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন মুক্তাদিরা। অভিযোগ, এই প্যান্ডেলে দুর্গা পূজা চলার সময় গান বাজে, তাতে জুম্মার নামাজে ব্যাঘাত হয় বলে কিছু মুসলিম যুবক প্যান্ডেলে এসে আক্রমণাত্মক কথা বলে। পুজো কমিটির লোকজনের সঙ্গে মুসলিম যুবকদের কথা কাটাকাটি হয়। পরপরেই মুসলিম সম্প্রদায়ের বয়স্ক ব্যক্তিরা হস্তক্ষেপ করেন, যুবকদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। পূজা কমিটির পক্ষ থেকে পুলিশকে অভিযোগ জানানো হয়।

ঘটনার প্রেক্ষিত বা পিছনে কী কী সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে তা না জেনেই, বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজ নিজ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ভিডিও ব্যবহার করতে থাকে, যা প্রকারন্তরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহের বাতাবরণ বৃদ্ধি করে। বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারি আসেন। সংবাদ মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য, সামাজিক মাধ্যমে তাঁর পোস্টে কোন শান্তি প্রচেষ্টার কথা থাকে না।  গত ১৫ অক্টোবর ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে। আমরা কথা বলি স্থানীয় পুজো কমিটি, মসজিদ কমিটি, সাধারণ দোকানদারদের সঙ্গে। এখানে তার সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন -

সম্প্রীতি যখন স্বাভাবিক ও এক পুরাতন অভ্যাস  

গন্তব্যে পৌঁছনর আগে পথে আমাদের দেখা হয় কোলকাতার রেড রোডে রাজ্যসরকার আয়োজিত পূজা কার্নিভ্যালে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত একটি পূজা কমিটির সঙ্গে। আমাদের কথা হয় ব্যানার্জি বাগান শিব মন্দির সার্বজনীন দুর্গা পূজা কমিটির দুই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে। সুশীল কুমার দুবে এবং আবদুল ওয়াজিদ। কার্নিভালের ‘স্টাইল’ অনুসারে আয়োজকদের অনেকেরই নীল পাঞ্জাবী সাদা পায়জামা ছিল পরিধান। ওয়াজিদ সাহেবও ছিলেন কমিটির ড্রেস কোডেই। ধার্মিক ওয়াজিদ সাহেবের পরনে একইসঙ্গে টুপি ও দাড়ি। গলায় দুর্গা প্রতিমার ছবি সহ বিশেষ আইডেন্টিটি কার্ড।

বহু পুরনো এক খাবারের দোকান

প্রায় ৫৫ বছরের পুরনো এক খাবারের দোকান। আমরা কথা বলি দোকানের মালিক, সুবীর দাস মোদকের সঙ্গে। ওনার বাবার আমলের দোকান। উনি জানালেন, মিশ্র জনবসতির এই এলাকায় সব শ্রেণির মানুষই আসেন তাঁর দোকানে। সকালে ঘুগনি পরোটা বানান ও বিক্রি করেন। এখানে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের সারাংশ -

দোকানদার - আমরা জানতাম না তবে আগেও এইরকম হয়েছিল।

আমরা - কী রকম?

দোকানদার - এই আজানের সময় পুজোর বাজনা বা মন্ত্র পড়া নিয়ে ঝামেলা। এই পাড়াতেই পুরনো এক পূজা হয়। মুসলিমরা আজানের সময় গান গাওয়া নিয়ে আপত্তি করে, পুলিশ পারমিশান দিচ্ছিল না। কিন্তু বাঙালি মুসলিমরা হিন্দুদের বলে, ‘তোমরা আজানের সময় শব্দ বন্ধ রাখবে, কোন অসুবিধা হবে না’। আমরা এতদিন জানতাম না ব্যাপারটা।

আমরা - পুরনো পুজো হওয়া সত্তেও পুলিশ পারমিশান দিচ্ছিল না!

দোকানদার - না এটা হয় যখন স্টার্ট করে, তা প্রায় ১৭-১৮ বছর আগের কথা হবে।

আমরা - এখন ওই পুজোতে কোন অশান্তি হয়নি?

দোকানদার - না, না, কোন অশান্তি হয়নি।

আমরা - যেখানে এবার গণ্ডগোল হল সেই পুজো কি নতুন?

দোকানদার - না এটা ওর থেকে পুরনো।

আমরা - তাহলে এখানের গণ্ডগোলের হেতু কী?

দোকানদার - যেহেতু লাউডস্পিকার জোরে জোরে বেজেছে, তাও কোন হিন্দি বা কোনো চটুল গান নয়, বাংলা গানই বাজছিল।

আমরা - তখন কী ওরা গিয়ে বলে যে বাজাবেন না, না কী ……?

দোকানদার - ব্যাপারটা হল কী, ওরা যদি আজানের আগে বলে আসতো, বাজাবেন না তাহলে এটা হত না। ওরা করলো কী যখন সব হয়ে গেছে, ওদের নামাজ-টামাজ, তারপর এখানে জমায়েত করে গেছে।

আমরা - ছবিতে দেখা গেছে ওদের মধ্যে কেউ কেউ থামাচ্ছে।

দোকানদার - হ্যাঁ, এখানে রাস্তাতেও দেখা গেছে, কেউ কেউ বলছে, ‘চল চল, এইসব ঝুট ঝামেলায় থাকিস না’। আমি তো বেশি কিছু জানিনা, আমি আমার দোকান নিয়ে ব্যস্ত। আমি বেশি কিছু হলে আমার দোকানের সাটার নামিয়ে দেবো। আমি রেডি হয়েছিলাম, বাইরে যে জিনিষগুলো ছিল ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।

আমরা - তারপর প্যান্ডেলের মধ্যে কী হয়েছিল?

দোকানদার - আমি অত জানিনা। তবে জানেনই তো, তিলকে তাল করার লোক অনেক! কেউ বলে ঠাকুর ভেঙে দিয়েছে, কেউ বলে বাচ্চাদের মেরেছে, কেউ বলে থ্রেটনিং করেছে এইসব। তবে ঠাকুরের ওপর ওরা কিছু করেনি। ঠাকুরের ওপর কিছু করলে বিরাট ব্যাপার হয়ে যেত। এই ঘটনার প্রতিবাদে আমাদের হিন্দুরা বাস বন্ধ করে, রাস্তা অবরোধ করে। রাস্তা জ্যাম লেগে গিয়েছিল।

আমরা - অবরোধের দাবি কী ছিল?

দোকানদার - যারা এসব করেছে তাদের এরেস্ট করতে হবে।

আমরা - কাউকে এরেস্ট করেনি?

দোকানদার - আমি অতশত জানিনা, আমি সাতেপাঁচে থাকিনা। আমার কাছে সবাই সমান।  

আমরা - আগে কি কখনও ঝামেলা হয়েছিল আপনাদের পাড়ায়?

দোকানদার - আগে বহু ঝামেলা হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, কালি ঠাকুরের ভাসান নিয়ে। কালি ঠাকুরের হাত ভেঙে দিয়েছিল। মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সে বিরাট ব্যাপার, কার্ফু হয়েছিল। আমার তখন ৫-৬ বছর বয়স। আবার ১৯৯২ এ বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় অশান্তি হয়েছিল।

আমরা - এই যে মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ শেষে প্যান্ডেলে ঝামেলা হয়, এই মসজিদ কি বাঙালি-বিহারি সকল মুসলিমদের?

দোকানদার - না, এটা বাঙালি মুসলমানদের। সেদিনের অশান্তি করে বিহারি মুসলিমরা।

গৌতম মান্না, নিউ চিত্তরঞ্জন এথেলেটিক ক্লাব

ক্লাবঘরেই ওনার সঙ্গে কথা হয় আমাদের। সঙ্গে ছিলেন ক্লাবের আর এক সদস্য। গৌতম মান্না ক্লাবের ক্যাশিয়ার। কথা শুরু হয় এইভাবে -

গৌতম মান্না - দেখুন, ঝামেলা করেছে কয়েকজন, করে পালিয়ে গেছে। বাকিরা বলেছে, অন্যায় হয়েছে, ভুল করেছে।

আমরা - মুসলিমরা স্বীকার করছে অন্যায় হয়েছে?

গৌতম - হ্যাঁ। তবে যারা করেছে তারা নয়, তারা তো পালিয়ে গেছে। সবাই তো ওরকম নয়, কিছু ভালো লোকও তো আছে। ওরা খারাপ ব্যবহার করে দিয়েছে, বাকিরা কী করবে? আর পুরো ঝামেলার সময় কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে। ফলে এখানের কথা সবাই জেনেছে।

আমরা - আগে কোনদিন এইরকম ঝামেলা হয়েছে?

গৌতম - ঝামেলা মানে, এইখানে (ক্লাবঘরের সামনে অব্যবহৃত একটা পুকুর, তার পার জুড়ে কিছু জমি, আশেপাশে বিল্ডিঙের মাঝখানে একটা পরিত্যক্ত জায়গা) কেউ হয়ত গাঁজা খেয়ে অশান্তি করলো। তখন ঝামেলা হয়। পুলিশ আসে। তবে আগে হিন্দু-মুসলিম ঝামেলা হয়েছে, আমরা তখন ছোট ছিলাম, আমরা ঠিক জানিনা।

আমরা - আপনাদেরও তো পুজো হয়, আপনারা আজানের সময় কি মাইক বন্ধ রাখেন?

গৌতম - (ইতস্তত করে) আমরা বুঝেসুঝে চলি। অশান্তি করি না। আমরা নিজেরাই বন্ধ করি।

আমরা - তার মানে আপনারা আজানের সময় বন্ধ রাখেন, বুঝেসুঝে চলেন বললেন, কেন?

গৌতম - আমরা কোন লোক মারা গেলেও বন্ধ রাখি।

আমরা - সে তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

গৌতম - এখানে ওদের ভিড় আছে, যাদের যেখানে বেশি ভিড় সেখানে তাদের র‍্যালা থাকবেই।

আমরা - মানে যাদের লোকজন বেশি!

গৌতম - হ্যাঁ, যারা যেখানে বেশি, এখানে ওরা (মুসলিম) বেশি, ওদের র‍্যালা তো থাকবেই। আর দেখুন, ঝামেলা কার সঙ্গে না হয়? ভাইয়ে ভাইয়ে হয়, পাড়ায় পাড়ায় হয়, সেইরকমই দুই ধর্মের মধ্যেও হতে পারে।

আমরা - আপনাদের পাশের পুজোতেই এবারে অশান্তি হল। এই ব্যাপারে কিছু বলুন।

গৌতম - আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। জানতে পেরে পরে যাই। তখন গাড়ি বন্ধ। পরে চেয়ারম্যান এসেছিলেন, মুক্তারদা বলে একজন আছেন (কংগ্রেস নেতা), তিনি এসেছিলেন। পরে শুভেন্দু অধিকারি এসেছিলেন।

আমরা - শুভেন্দু অধিকারি কী বললেন?

গৌতম - যারা করেছে ভুল কাজ করেছে। দুর্গা পূজা তো বন্ধ করতে পারবে না। আমরা তোমাদের সাথে আছি। 

মসজিদের ইমাম এবং কয়েকজন মুসল্লি

মুদিয়ালী জামে মসজিদ থেকেই নামাজিদের কয়েকজন পুজো প্যান্ডেলে গিয়ে গান বাজানোর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রতিবাদ করে। নামাজিদের মধ্যে অন্য কয়েকজন তাদের থামানোর চেষ্টা করে। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও সেইরকম ‘তথ্য’ দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের কথা শুরু হয় মসজিদের দরজায়। পাশেই ফতেপুর ভিলেজ রোড। আমরা অনুরোধ করি, বাইরে গাড়ির আওয়াজ কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, আমরা কি ভিতরে গিয়ে কথা বলতে পারি? ইমাম মোহম্মদ সাদেক আলি রাজি হন, তবে আমাদের মধ্যে থাকা মহিলা সদস্য অনুমতি পাননা। তাঁকে বাইরেই থাকতে হয়। এই মসজিদে নারীর প্রবেশ নিষেধ।

ইমাম - ব্যাপারটা মিটে যাওয়ার পরেও জিইয়ে রাখা হচ্ছে।

আমরা - এটার মধ্যে তাহলে কি রাজনীতি আছে?

ইমাম - জুম্মার দিনে জুম্মার নামাজ হচ্ছিল, তখন নামাজ প্রায় শেষ তো প্রায়? (মসজিদে উপস্থিত অন্যজনের প্রতি, তিনি সম্মতি জানান) হ্যাঁ, প্রায় শেষ হয়ে গেছে, মসজিদের ওপরতলা নিচুতলা প্রায় ভর্তি। কিছু লোক বাইরে নামাজ পড়ে, মানে রাস্তাতে। ওর মধ্যে চ্যাংড়া ছেলে থাকে একটু বেশি। আমরা তো ভিতরে ছিলাম, একদম সামনে আমি থাকি। কোন খবরই জানিনা, আপনারা যেমন শুনলেন সেইরকম আমারও শোনা। ওই সামনেই একটা পুজো প্যান্ডেল আছে, ওখানে গান জোর করে দিক বা আওয়াজ হওয়াতে এখান থেকে ছেলেরা ওখানে মানা করতে গিয়েছিল। আর মানা করতে যাওয়া মানে সেখানে তো অন্যদের লোকও আছে রে বাবা! একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হল। আমাদের কিছু সিনিয়াররা গিয়ে তাদের তাড়া করে নিয়ে এসেও গেছে।

অন্যজন - উনি (ইমাম) মানা করেও দিয়েছিলেন মাইকে।

ইমাম - হ্যাঁ, আমি আনাউন্স করে দিই।

অন্যজন - আর যে ছেলেগুলো গিয়েছিল তারা বাইরের ছেলে। আমাদের মহল্লার ছেলে নয়। আমাদের এখানে হিন্দু মুসলিম যতই ধর্ম নিয়ে থাক সদ্ভাবের সঙ্গেই আছে, কারও সঙ্গে ঝামেলা নেই।

দ্বিতীয়জন - যারা ছিল তারা কিন্তু নন-বেঙ্গলি ছিল, বাঙালি ছেলেরা কিন্তু এইসব করবে না।

ইমাম - তারপর পূজা কমিটি থানায় অভিযোগ দায়ের করে। থানা থেকে এলাকার ইমামদের ডাক করানো হয়। আমরা গিয়েছিলাম। শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায়। ওখানে আলাপ আলোচনা হল। বলা হল, ছেলেরা ভুলভাল করে ফেলেছে। যাই হোক এখান থেকে মিটিয়ে দিন। ওরা (পূজা কমিটি) বলল দেখছি, আমরা আলোচনা করছি। আমাদের এখানের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার গিয়েছিলেন থানায়। ওইদিন বিকেলে পুলিশ চার জনকে ধরেছিল। পরে ভোরের দিকে ছেড়ে দিয়েছিল।

আমরা - তারা কোথাকার?

ইমাম - পাশের পাড়ার ছেলে ছিল ৩ জন আর এই পাড়ার ১ জন। আসলে ভিড় করে গিয়েছিল অনেকেই। থামাতেও গিয়েছিল অনেকে।

আমরা - আমরা চাইছি ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া চারিদিকে একপেশে বার্তা যাচ্ছে। আপনি কি বলেন?

ইমাম - হ্যাঁ, আমার কাছে জি টিভি আসে, কিন্তু আমার সম্পূর্ণ কথা সম্প্রচার করে না। কেটে কেটে যা দেখায় তা আমার কথা তুলে ধরে না। আমি সদ্ভাবের কথা বলি। ভুল হয়েছে তা বলি।

আমরা - এই যে একটা মসজিদের ছবি দেখানো হচ্ছে (মোবাইল থেকে দেখিয়ে), বলা হচ্ছে এই মসজিদ থেকে নামাজিরা গিয়ে প্যান্ডেলে আক্রমণ করে, এটা তো আপনাদের মসজিদ নয়? দেখুন।

ইমাম - না এটা আমাদের মসজিদ নয়, এই এলাকার কোন মসজিদও নয়।

আমরা - এটা কোথাকার?

অন্যজন - আমরা বলতে পারছি না।

আমরা - আমরা এসেছি শান্তি ও সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থা, ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ থেকে। আমরা পুজো কমিটি আর মসজিদ কর্তৃপক্ষ সকলের কাছ শান্তি ও সহাবস্থানের আবেদন জানাচ্ছি। আপনাদের এখানে আসার সময় আমাদের ব্যানার্জি বাগানের পূজা কমিটির সঙ্গে দেখা হল । দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এই পুজোয় যুক্ত। তাঁরা কার্নিভ্যালে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিলেন। এই সম্প্রীতির বার্তা প্রচার হওয়া উচিত। তা কিন্তু প্রচার হচ্ছে না।

অন্যজন - এখানে এইটাই চিত্র। এখানে আজ পর্যন্ত কোন ঝামেলা হয়নি। আপনারা হিন্দুদের কাছেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। এটা কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলের কাজ। ওদের উচিত ছিল মসজিদ কমিটিকে জানানো, বা ইমাম সাহেবকে বলা। ওখানে পুলিশ পোস্টিং ছিল। ওদের গিয়ে বলতে পারতো। আমরা নামাজ পড়ছিলাম সেই সময় জোরে জোরে গান বাজানো হচ্ছিল।

আমরা - সেইসময় ওখানে পুলিশ পোস্টিং ছিল? শুনলাম সিভিক পুলিশ ছিল।

অন্যজন - যাইহোক, গিয়ে বলতে পারতো সাউন্ডটা কমিয়ে দিন। আমাদের নামাজটা হয়ে যাক। নামাজ প্রায় হয়েই গিয়েছিল, অল্প কিছুটা বাকি ছিল।

এরপরে শুভেন্দু অধিকারী এলো, তারপর সব ভাইরাল করতে থাকলো।

আমরা - শুভেন্দু অধিকারী কি আপনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন?

ইমাম - না, আমাদের সঙ্গে বলেনি।

আমরা - পাশের একটি পুজো কমিটির সঙ্গে কথা হয়েছে, তাঁরা বলেছেন বিজেপির লোক এসে আবার উস্কেছে। তাঁরা হিন্দু হয়েও এই কথা বলছেন। এইটা জানানো আমাদের পক্ষ থেকে উচিত। সবাই একমুখী নয়। কিছু হিন্দু আছে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। আবার কিছু মুসলমান আছে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে।

ইমাম - হ্যাঁ, অবশ্যই। বললাম তো! 

দ্বিতীয় জন - বিজেপি এতে ‘হাওয়া’ লাগানোর চেষ্টা করছে।

আমরা - দেখুন বিজেপি যেমন আছে তেমন জামাতও আছে। এই যে পুজোর সময় আজান নিয়ে যে সংঘাত এটা কি অভিপ্রেত? বছরে চারদিন পুজো হয়। আজান হয় বছরে সবদিনই।

ইমাম - অবশ্যই।

আমরা - এবার কোন পুজো কমিটি যদি বলে এইসময় আজান হচ্ছে আমরা গান বাজানো বন্ধ রাখি বা কম আওয়াজে করি, বা উল্টোদিকে মসজিদ যদি বলে বছরে চারদিন এই পুজো, আমরা আজানের আওয়াজ কম করি, এটা হতে পারে যদি পারস্পরিক ভালোবাসা, একে ওপরের প্রতি শ্রদ্ধা থাকে। উস্কানি কাজ দেয় যখন প্রেম না থাকে। কিন্তু তা যখন না থাকে তখন রাজনীতি করার সুযোগ পায়, বিজেপি বলুন বা জামাত।

ইমাম – ঠিক।

আমরা - আমাদের অনুরোধ, আমরা সকলকেই বলছি, বলবো, পরস্পরের সংস্কৃতি জানার, অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করবেন। আমরা যদি কোন কাজে লাগি, বলবেন।    

ইমাম - অবশ্যই জানাবো। একটা কথা, ওরা কিন্তু আজান হলে মাইক বন্ধ করে দেয়। এতদিন কোন অশান্তি হয়নি।

আমরা - সেদিন কি জোরে জোরে মাইকে গান বাজানো হয়েছিল?

ইমাম ও অন্যান্যরা- সেই আওয়াজ মসজিদের ভিতরে আসেনি। আমরা ভিতরে ছিলেম, কোন আওয়াজ পাইনি। যারা প্যান্ডেলে গিয়েছিল তারা রাস্তায় ছিল, ওরা আওয়াজ পেয়ে গিয়ে থাকতে পারে।

দ্বিতীয়জন - না বন্ধই ছিল, কেউ চালু করে দিয়েছে।

ইমাম - হয়তো ভেবেছে নামাজ শেষ হয়ে গেছে, তাই চালু করে দিয়ে থাকবে।

আমরা - একটা কমিউনিকেসান গ্যাপ হয়েছিল তার মানে।

শেখ আবুল হোসেন - যে ছেলেগুলো গিয়েছিল তাদের যাওয়া উচিত হয়নি। বললাম না ওরা ননবেঙ্গলি। ওরা জুম্মাতে একবারই আসে, এসেই ১০ মিনিট নামাজ পড়ে ওদের কাজ শেষ।

ইমাম - আর যারা পাঁচ টাইমে নামাজ পড়ে তারা জীবনেও ওসবে যাবে না। রেগুলার যারা নামাজ পড়ে তারা কোনদিন ওইসবে যাবে না। 

নিজামুদ্দিন আহমেদ (বয়স ৫২, তালপুকুর আড়া হাই মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষক ও ১৩৯ ওয়ার্ড কাউন্সিলের প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত।)

নিজামুদ্দিন:  আমি যতদূর জানি, অষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট ও নবমীর প্রথম 24 মিনিট এই সন্ধিক্ষণটা হিন্দু ধর্মীয় মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই আটচল্লিশ মিনিট টাই পড়েছিল জুম্মার নামাজের সময়। জুম্মার নামাজ তো হয় ৫২ সপ্তাহ। তার মধ্যে বড়জোর একদিন হয়তো পড়ে এই সন্ধিক্ষণ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি তাদের সম্মানার্থে এইটুকু এডজাস্ট করা যায়। ৫২ সপ্তাহের একদিন জুম্মার নামাজের সময় একটু এদিক-ওদিক হলে কোরআন হাদিস উল্টে যায় না। সেটুকু আলোচনা সাপেক্ষে করাই যেত। আর এটা হতেও দেখেছি।

আর যারা ওখানে গেছে আমি তো ব্যক্তিগতভাবে মনে করি، ওদেরকে উলঙ্গ করে মারা উচিত। তারা নিতান্তই গর্ধব ছাড়া আর কিছুই নয়। শুভেন্দু অধিকারীরা খুব স্বাভাবিকভাবেই তার পূর্ণ সুযোগ নিয়েছে। ওদের রান্না করা বিরিয়ানি গালে তুলে দেওয়া হয়েছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের দোষ বেশি। তারা জুম্মার আগেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিতে পারত।

আমরা: আমরা জেনেছি যে পূজা মন্ডপে যারা গেছিল তারা মসজিদের রেগুলার নামাজী নয়। তারা অবাঙালি সম্প্রদায়ের অল্প বয়সী কিছু ছেলে। মসজিদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন রকম আলোচনা না করেই তারা সরাসরি মন্ডপে চলে গেছিল। মসজিদ কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ এটা জানতে পেরে মাইকে তাদের ফিরে আসার নির্দেশ দিতে থাকে। পরে মসজিদ কর্তৃপক্ষের সিনিয়র লোকজনই তাদের বকাঝকা করে ফিরিয়ে আনতে গেছিল। যে ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যাচ্ছে এটা সেই ছবি। এটা হিন্দু ভার্সেস মুসলিমের সংঘর্ষের ছবি নয়।

নিজামুদ্দিন: হ্যাঁ এটাও একটা ভার্সন। কিন্তু তারা যে গেছিল এটা বাস্তবতা। আর এখানকার অবাঙালি সম্প্রদায়ের মানসিকতা একদমই অন্যরকম। তারা বুক ফুলিয়ে বলে, কচড়া ফেকনে কা কাম হামারা হ্যায়। সাফ করনে কা কাম কর্পোরেশন কা হ্যায়। এখানে প্রতিটি পাড়ায় অফিসিয়ালি ভ্যাট হয়তো কম আছে। কিন্তু জঞ্জাল ফেলার নির্দিষ্ট কিছু জায়গা আছে। কিন্তু তারা জঞ্জালও যেখানে সেখানে নিজের ইচ্ছামতো ফেলবে। এবং বুক ফুলিয়ে বলবে উঠানে কা কাম কর্পোরেশন কা হ্যায়। এটা একটা বড় সমস্যা। তারা কোনো সিস্টেমে থাকবে না। কোনো নিয়ম মানবে না।

আমাদের তথ্যানুসন্ধানের দল পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলার শামসুজ্জামান আনসারির সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন। পুজো কমিটির সেক্রেটারি, অশোক সাধুখান আমাদের সময় দিয়েও ওখানে পৌঁছে ফোন করার পর জানান, তিনি এবিষয়ে আর কোনো কথা বলবেন না। তবে শামসুজ্জামান আনসারির সঙ্গে কথা না বলতে পারলেও তার পুত্র এবং ঝুন্নু আনসারির ভাইপো তবরেজ আনসারির সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম।

তবরেজ আনসারি

আমরা: ঠিক কী হয়েছিল সেদিন?

আনসারি: ঘটনা এমন কিছু নয়। তুচ্ছ একটা ঘটনা। হিন্দু সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলতে গিয়েই শুভেন্দু অধিকারী এসব করছে। ছোট ঘটনাকে বাড়িয়েছে। মুদিয়ালির লোক জানে না এখানে কি হয়েছে। কয়েকটা বাচ্চা ছেলে হয়তো ভুল করেছে। তারা বলতে গেছে। বলতে গেছে মানেই সাম্প্রদায়িক তেমন নয়। এরকম হয়েই থাকে। মুসলিম কমিউনিটির লোকজনই তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে চলে এসেছে। ভিডিওতে সেটাই আছে। কিন্তু সেগুলো অন্যভাবে প্রচার হচ্ছে। হিন্দুদের সিম্পেথি কাজে লাগাতেই এভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় অপপ্রচার চলছে।

আমরা: মেটিয়াবুরুজে কি আগে এরকম ঘটনা ঘটেছে?

আনসারী: মেটিয়াবুরুজের একটা ইতিহাস আছে। একসময় অনেক গুন্ডাগার্দি হয়েছে। প্রচুর গরীব বস্তি ছিল। অভাব ছিল। সমস্যা ছিল। এখানে ব্যবসায়ী ঝগড়া হয়েছে। ভাই ভাইযে ঝামেলা হয়েছে। পলিটিক্যাল ঝগড়া আছে। কিন্তু জাত পাত নিয়ে ঝগড়া নেই। আপনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখুন। পুলিশ রেকর্ড খুঁজে দেখুন। জাত পাতের ঝগড়া পাবেন না। এখানে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে আছে বরাবরই।

এখানে পুলিশ অফিসার মেহতার হত্যা হয়েছে। কিন্তু সেটা সাম্প্রদায়িক নয়। ওটাতে হিন্দুও মারা গেছে আবার মুসলিমও মারা গেছে। মুসলিম মুসলিমকেই মেরেছে। এখানে যারা বাঙালি মুসলিম আছে তারা তো বনেদি লোক। এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা কেউ চাইবে না এসব ঝামেলায় গিয়ে তারা জেলে যাক। ওসব হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে রামনগর বাতিকল এলাকার বস্তি অঞ্চলে। তারা স্থানীয় নয়। এসব জায়গায় ক্রাইম হবার পরিস্থিতি থাকে। প্রচুর চোর চোট্টা আছে। ক্রিমিনাল আছে। তাদের জন্য মেটিয়াবুরুজের বদনাম হয়। বাকি এলাকায় চুরি ছিনতাই পকেটমারি নেই। এখানে মেয়েরা যতটা সিকিওর্ড অন্য জায়গায় নয়। এখানে মেয়েদের গায়ে হাত দেবার কোন কেস দেখান, পাবেন না। বা হয়রানির শিকার হচ্ছে দেখান, পাবেন না। লোকে প্রাণে মেরে দেবে। সারা কলকাতার লোক, হাওড়ার লোক এখানে মার্কেটিং করতে আসছে। এখানে দুর্ব্যবহার করলে তার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। কমিটির কাছে ফাইন দিতে হয়। দুদিন দোকান রাখতে হবে। এখানে কেউ চায় না কারো জন্য এলাকার বদনাম হোক। কোন ক্রাইম হোক।

এখানে কোনো তোলাবাজি নেই। বড়বাজার থেকে সবাই এখানে চলে আসছে। মঙ্গলা হাটে ওর সেফ নেই। সেখানে ছিনতাই হচ্ছে টাকা পয়সা। তার এখানে চলে আসছে। কারণ এখানে তোলাবাজি নেই। চাঁদা নেই। চুরি ছিনতাই নেই।

আমরা:  তাহলে কি পরিস্থিতি পাল্টেছে বলছেন?

আনসারী: এখানে এন্টি সোশ্যাল আগে ছিল। তাদের বয়স হয়েছে। অনেকে মারা গেছে। এখন মানুষের হাতে কাজ আছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। অনেক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। বস্তিগুলোর উন্নয়ন হয়েছে। এখানে হিন্দু মুসলিম সবারই ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। কাজের অবস্থা এখন খুব ভালো- তা নয়। কাজের ডিমান্ড আছে। কিন্তু ক্রাইম অনেক কম। তোলাবাজির ব্যাপারে এখানে কেউ জিজ্ঞাসও করতে আসে না।

[উল্লেখ্য যে আমাদের তথ্যানুসন্ধান দলটি যতজনের সঙ্গে কথা বলেছে এখানে তার সম্পূর্ণ অংশ রাখা হল]

আমাদের অনুভব -

উল্লেখ করা দরকার, আমাদের তথ্যানুসন্ধান পর্বে সকল স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে কথা বলা হয়নি। আমরা স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কয়েকজন ফোনে জানান নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আসতে। তাঁদের কথা মত আমাদের তথ্যানুসন্ধানী দল পৌঁছেও যায়। কিন্তু বলা উচিত আমাদের চেষ্টা বিফলে যায়। তাঁরা কথা বলতে চাননা। তাই এই তথ্যানুসন্ধান সেই অর্থে সম্পূর্ণ তা বলা যায় না। এলাকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ইতিহাস এবং স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে আমাদের কথোপকথনের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমাদের অনুভব এখানে রাখা হল।  

১। একই সাথে সহাবস্থানের এবং সংঘর্ষের অতীত ইতিহাস আছে এই মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ এলাকার। ১৯৪৬, ১৯৯২ যেমন দাঙ্গার ক্ষতচিহ্ন বহন করে তেমনই বহন করে পাশে থাকার একাধিক দিকচিহ্ন। ৪৬-এ আলি হাসান বা ৯২-এ আব্দুল বারি, আব্দুল খালেকরা চেষ্টা করেছিলেন ক্ষতি ও ক্ষত কমানোর, মানুষকে বাঁচানোর। দুঃখের কথা হল সংঘর্ষ বা দাঙ্গার কথা ইতিহাসে স্থান পায়, স্থান পায়না এইসব প্রচেষ্টার কথা। 

২। ২০২৪- এও যতটা প্রচারিত হয় উচ্ছৃঙ্খল কিছু মুসলিম যুবকদের দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে গিয়ে মারমুখী আচরণ, প্রচারিত হয় না সেখানেই উপস্থিত মুসলিম বয়স্ক ও মাঝবয়সীদের ঝামেলা থামানোর প্রচেষ্টা। প্রচারিত হয়না বা প্রচার করানো হয়না।

৩। বাস্তবতা যদি হয় নিউ বেঙ্গল স্পোর্টিং ক্লাবের দুর্গা পূজায় কিছু মুসলিম যুবকদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ তাহলে পাশের ওয়ার্ডের ব্যানার্জি বাগান শিব মন্দির সার্বজনীন দুর্গা পূজায় আব্দুল ওয়াজিদও বাস্তবতা। শুধুমাত্র বিদ্বেষের ভয়াবহতা বা শুধুমাত্র সম্প্রীতির রোমান্টিকতা নিয়ে বুঝতে গেলে ভুল হবে। আমাদের বুঝতে হবে দুটি বাস্তবের উপস্থিতিকে গুরুত্ব দিয়েই।

৪। অস্পষ্ট হলেও এই কথা উঠে এসেছে যে, উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে প্রতিবেশে থাকা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি আচরণে ফারাক আছে। আমাদের পক্ষ থেকে এর গভীরে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি।

৫। মিডিয়া তিলকে তাল করছে, এই বক্তব্য উঠে এসেছে। এমনকি তাঁদের বক্তব্যের নির্দিষ্ট অংশ বাদ দিয়ে বাকি অংশ প্রচারিত হয়েছে, এমন অভিযোগ করেছেন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। একই ভাবে হিন্দুত্ববাদী সামজিক মাধ্যমে একপেশে খবর, ভিডিও প্রচারিত হয়েছে বারংবার। এইগুলি শেয়ার হয়েছে বহুবার।

৬। আযান দেওয়ার সময় গানবাজনা বাজানো বন্ধ রাখা বা মাইকে অন্য কিছু প্রচার করা বন্ধ করার ঝোঁক বাড়ছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। যদিও সংখ্যাগত ভাবে এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। গার্ডেনরিচে আমরা সেই ঝোঁকের বহিঃপ্রকাশ দেখলাম। তবে যেখানে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া যথেষ্ট সেখানে বাজানো বন্ধ রাখা হয়, আযান দেওয়ার সময়। যেখানে বোঝাপড়া নেই বা কম আছে সেখানে ‘যার ক্ষমতা বেশি’ সে শব্দ-সময় দখল করে। গার্ডেনরিচের কিছু দুর্গাপূজা কমিটি আগে থেকেই এই শব্দ-সময় বিধি পালন করে চলেছে, জেনেছি আমরা। তা কতটা ভালোবাসায় আর কতটা বাধ্য হয়ে সেই প্রশ্ন থাকছে। গার্ডেনরিচের ঘটনা অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ।

৭। এখনও এলাকা স্পর্শকাতর। সাধারণ মানুষ বাইরের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য যদি ভুল ভাবে উপস্থাপিত হয় এই ভয় যেমন আছে,  তেমনই আছে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ঝামেলায় পড়ে যাওয়ার ভয়।

৮। ঘটনাটিকে এনক্যাশ করার জন্য হিন্দুত্ববাদী শক্তির ক্রমাগত প্রচার পরোক্ষভাবে এলাকায় সম্প্রীতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। শুভেন্দু অধিকারীর উপস্থিতি এবং এটা কলকাতা, ঢাকা নয় মন্তব্য আমরা দেখেছি উনি ওনার এক্স আকাউন্টে করেছিলেন। এলাকার সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলার কোন প্রচেষ্টা তাঁর ছিল না।

৯। তৃণমূল কংগ্রেস ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, মিডিয়া হোক বা অন্য কোথাও মুখ খুলতে চায়নি। 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা', ‘শুভেন্দু এসেই আরও প্রচার করেছে, এমন কিছু নয়’ - এই হচ্ছে তাঁদের অপ্রকাশিত বিবৃতি। সচেতনভাবেই মুসলিম যুবকদের কিছু অংশের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধিকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।

১০। সারা রাজ্য জুড়ে ধর্মপালনে অসংযম, শব্দবিধির লঙ্ঘন আমরা দেখছি। আমরা দেখছি নিত্যনতুন মসজিদ ও মন্দির গজিয়ে ওঠা। দুর্গা পূজার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা শাসক দলের মদত ছাড়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে পূজা কমিটিকে অনুদান বড় ভূমিকা নিচ্ছে। সামাজিক সম্প্রীতির জন্য যতটা তার থেকে বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য মেকি সম্প্রীতি দেখানো হচ্ছে। সম্প্রীতির সামাজিক ভিত্তি থাকলে এই ধরণের ঘটনা হয় না।

১১। কোন রাজনৈতিক এবং সামাজিক উদ্যোগ নজরে আসেনি যাতে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করা যায়। কোন শান্তি উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, সি সি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এর ফলে এলাকার সকল নাগরিকের গতিবিধি নজরে এসেছে।

আমাদের দাবি

১। পূজা প্যান্ডেলে গিয়ে অশান্তি সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করে বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনতে হবে এবং আইনানুগ শাস্তি দিতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক প্রচার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সাইবার আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

২। এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পূজা কমিটি, মসজিদ কমিটির পরিচালন সমিতির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এইরকম ঘটনা না হয়।

৩। একে অন্যের সংস্কৃতি জানার জন্য কর্মসূচি আশু প্রয়োজন। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার এবং সামাজিক সংস্থাগুলির উদ্যোগ কাম্য।  

 

তথ্যানুসন্ধান - ভূমিকা ভট্টাচার্য, ফারুক উল ইসলাম, শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী

তথ্য প্রাপ্তি - আমরা আর্কাইভ [‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর সংঘর্ষ ও শান্তি বিষয়ক আর্কাইভ]

প্রচ্ছদ- শুভঙ্কর সেনগুপ্ত

সম্পাদনা - ফারুক উল ইসলাম এবং ভূমিকা ভট্টাচার্য 

     

 

 

 

 

  

  

      

 

About author
Generic placeholder image
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.
Do you want to get informed about new articles?

Related articles
Most Viewed
0 Comments
Leave a reply