ধর্মান্তরকরণ : পশ্চিমবঙ্গ পর্যায়

ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুধর্মের প্রভাব বিস্তার প্রকল্পে ধর্মান্তকরণ শুরু হয়ে গেল বীরভূমের রামপুরহাট ১ নং ব্লকের বনহাট গ্রাম পঞ্চায়েতের খড়মাডাঙ্গা থেকে। হীরক রাজার মগজ ধোলাই মন্ত্রের মতো ‘বিশুদ্ধ হিন্দু’ হওয়ার মন্ত্রে চলছে ধর্মান্তকরণ …

ধর্মান্তরকরণ : পশ্চিমবঙ্গ পর্যায়

খড়মাডাঙ্গা, (রামপুরহাট) বীরভূম

তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন

 

Conflict area study - I

Dharmantarkoron : Paschimbanga Paryay

(A documentation of religious conversion at Rampurhat, Birbhum, West Bengal.)

Published 14th April, 2015

Documentation : Jakaria Rahman

Subhoprotim Roy Chowdhury

Anupam Das Adhikary

Photography  : Anupam Das Adhikary

Editing : Subhoprotim Roy Chowdhury

Published by : Anupam Das Adhikary

Aamra Ek Sachetan Prayas

393, Survey Park, Kolkata – 700075

Ph. : 90385 30690, 80179 54126

e-mail : aamrasachetan@gmail.com

Printing : Calcutta Graphic,

3B-Maniktalla Industrial Estate

Kolkata - 700054

 

 

ধর্মান্তরকরণ : পশ্চিমবঙ্গ পর্যায়

প্রকাশ : ১লা বৈশাখ, ১৪২২

তথ্যসংগ্রহ : জাকারিয়া রহমান

অনুপম দাস অধিকারী

শুভপ্রতিম রায় চৌধুরী

চিত্রগ্রহণ, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : অনুপম দাস অধিকারী

সম্পাদনা : শুভপ্রতিম রায় চৌধুরী

প্রকাশনা : অনুপম দাস অধিকারী

আমরা এক সচেতন প্রয়াস,

৩৯৩, সার্ভেপার্ক কলকাতা-৭০০০৭৫

ফোন : ৯০৩৮৫ ৩০৬৯০, ৮০১৭৯ ৫৪১২৬

ই-মেল  : aamrasachetan@gmail.com

মুদ্রণ : ক্যালকাটা গ্রাফিক, ৩বি, মানিকলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট, কলকাতা-৭০০০৫৪

 

সচেতন প্রয়াস

১৯৯২ উত্তর সময়ে ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুধর্মের প্রভাব এক ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), বিশ্বহিন্দু পরিষদ তথা সংঘপরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠন বৃদ্ধিকরেছে তার তৎপরতা। বাবরি মসজিদ কান্ড দিয়ে যার শুরু হয়েছিল তা ক্রমে রাজ্যে ও কেন্দ্রে ক্ষমতাদখল, সর্বক্ষেত্রে গৈরিকীকরণ, ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদিপ্রকল্পে প্রসারিত হয়েছে। ২০১৪'র লোকসভা ভোটের পর যা এখন এক চরম পর্যায়ে।

গত ২৮ জানুয়ারি, ২০১৫ তারিখে ধর্মান্তরকরণের ঘটনা হয় পশ্চিমবঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতা লাভের পর এটি প্রথম ঘটনা। বীরভূম জেলার রামপুরহাট ১নম্বর ব্লকের অধীনে বনহাট গ্রাম পঞ্চায়েত। এই পঞ্চায়েতের একটি গ্রাম খড়মাডাঙ্গা। খবরে প্রকাশ ২৮ জানুয়ারিতে খড়মাডাঙ্গা একটি মন্দিরে ৯জন খ্রীষ্টানকে হিন্দু করা হয় (সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, হিন্দুত্ববাদীদের দাবী শতাধিক)। মন্দির প্রাঙ্গনে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ‘ঘর ওয়াপসি’ (ঘরে ফেরা) কার্যক্রমের অংশ হিসাবে এই অনুষ্ঠান। যাগযজ্ঞ ও পূজানুষ্ঠানের পুরোহিত হিসাবে উপস্থিত থাকেন খড়মাডাঙ্গার অধিবাসী ধনপতি হাঁসদা। ধনপতি হাঁসদা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আঞ্চলিক সংগঠক। ধর্মান্তরকরণের বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিশ্বহিন্দু পরিষদের জেলা সংযোগ প্রধান চুকরা টুডু বলেন, “আমাদের সমাজের কিছু মানুষকে ভুল বুঝিয়ে খ্রিষ্টান করা হয়েছিল, তাদের আমরা শুদ্ধকরণ করে স্বধর্মে ফিরিয়ে এনেছি। এতে এত হৈ চৈ কিসের?’

পার্শ্ববর্তী ভাটিনা, নুরিপাহাড়ি, হরিনাথপুর গ্রাম থেকে খ্রিষ্টানদের আনা হয়েছিল। কয়েকজন এসেছিলেন ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা জেলা থেকেও। রামপুরহাট থানার পুলিশের উপস্থিতি এবং খড়মাডাঙ্গার কিছু অধিবাসীর বক্তব্য অনুসারে রামপুরহাট পৌরসভার জলের গাড়ির মাধ্যমে জল সরবরাহ, এদিনের ঘটনাকে অন্য মাত্রা দেয়। প্রসঙ্গত বলা যায়, ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন গ্রামগুলিতে খ্রিষ্টান আদিবাসীদের সংখ্যা অনেক। বিশ্বহিন্দু পরিষদের লক্ষ্য এবং প্রকল্প তাদের নিয়েই।

গত ২২-২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫; ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’-এর উদ্যোগে আদিবাসী এই গ্রামগুলিতে যাওয়া হয়, উদ্দেশ্য তথ্য অনুসন্ধান। এই পর্যায়ে আমরা কথা বলি, গ্রামের সাধারণ সাঁওতাল পরিবারগুলির সাথে। কথা হয় ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগকারী উকিল মারডি এবং তার পরিবারের অন্যদের সাথে। কথা হয় গ্রামের মহিলাদের সাথে। খ্রীষ্টান পরিবারগুলির সাথে কথা হয় তাদের বাড়িতে, তাদের পাড়ায়। কথা হয় একজন শিক্ষকের সঙ্গে। আমরা রামপুরহাটে স্থানীয় পত্র পত্রিকার সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে কথা বলি। স্থানীয়ভাবে যারা ধর্মান্তরকরণের মূল হোতা তারা কথা বলতে চাননি আমাদের সাথে। যেমন ধনপতি হাঁসদা। চুকরা টুডুর সাথে কথা হয় টেলিফোন মারফৎ। কথা হয়েছে রামপুরহাট তথা বীরভূমে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংঘ পরিবারের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। জানা গেছে ধর্মপ্রসারের উদ্দেশ্যে পাকাপাকি মন্দির নির্মাণ এবং পরিকল্পনার কথা। এফআইআর এবং তদন্তের বিষয়ে জানতে আমরা কথা বলি পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের সাথে।

হুমকি এবং প্রচন্ড চাপের মধ্যে থাকা গ্রামের মানুষগুলি মুখ খুলতে চাননি। বিশেষত অভিযোগকারী, খ্রীষ্টান পরিবারগুলি, ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তাদের আকুতি ও আর্তি স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা প্রথমে প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। আমাদের কয়েক পর্যায়ের প্রচেষ্টায় কিছুটা সফলতা এসেছে। অসফল থেকেছি সমাজ ও সমাজ মননের পরিস্থিতি ও পরিবর্তনের সবটুকু বুঝতে। পাথর খাদান ও ক্রাশার মেশিন এখানে জনজীবনকে করেছে ধ্বস্ত পর্যুদস্ত। গাছের পাতা, সযত্নে নিকানো সাঁওতাল বাড়িগুলির প্রাচীর, প্রাঙ্গণ সর্বত্র ধুলোর আস্তরণ। ধুলো ফুসফুসে। আমরা পারিনি সে ক্ষতির নিরূপণ করতে। আমাদের বিধেয় ছিল, ধর্মান্তকরণের স্বরূপ সন্ধান। ভূ-রাজনৈতিক এবং ধর্ম-রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার এখানের বিস্তীর্ণ আদিবাসী জনপদ। এই প্রতিবেদনে তারই ভগ্নাংশ; একটি সচেতন প্রয়াস। বক্তাদের বক্তব্য অপরিবর্তিত রেখে এখানে স্থানীয় ভাষা ও বাচনভঙ্গি পরিবর্তিত হয়েছে।

খড়মাডাঙ্গা মন্দির

২৮ জানুয়ারি, ২০১৫ খড়মাডাঙ্গা গ্রামের শিব মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মান্তকরণ অনুষ্ঠান হয়। গ্রাম থেকে চাল-ডাল-সব্জি, টাকা তোলা হয়। সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে রেখে প্রস্তুতি চলে ‘বড়’ কিছু লক্ষ্যের জন্য। গণমাধ্যমে ‘শতাধিক’ স্থানীয় মানুষের বয়ানে, ‘অত হবে না’- এই দ্বিমত জানা গেছে ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানের সংখ্যা নিয়ে।

নাম প্রকাশ করতে চাননি এমন কয়েকজন গ্রামবাসী জানিয়েছেন, মন্দিরটিতে নিয়মিত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিটিং হত। এলাকাটি প্রত্যন্ত বলে অনেক গুপ্তসভা হত এখানে। সেই সভায় পার্শ্ববর্তী ঝাড়খণ্ড থেকেও নেতারা আসতো। ভাটিনার মন্দির দুমকা সড়কের কাছাকাছি হওয়াতে ওখানে ইদানীংকালে সভা কম হত।

সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের সরসংঘ চালক মোহন ভাগবতের সভা হয়। সভায় এলাকা থেকে কতজন যাবে, রামপুরহাট থেকে কোন ট্রেন ধরা হবে ইত্যাদি আলোচনা হয় খড়মাডাঙ্গায়। সব আলোচনা অবশ্যই মন্দিরে হত না। ধনপতি হাঁসদার বাড়ি ছিল অন্যতম আলোচনার স্থান।

খড়মাডাঙ্গার মন্দিরটি আকারে বড়সড় কিছু নয়। অতি সাধারণ টিনের চাল। মন্দিরের সামনে বিশাল মাঠ। ২৮ তারিখ এই মাঠেই লোকজনদের খাওয়ানো হয়েছিল। আমরা যখন সেখানে যাই তখন ভাঙা মাটির উনোন এবং এঁটো শুকনো শালপাতা দেখতে পাই। মন্দিরের ভিতরে শিবলিঙ্গ, দরজা বন্ধ থাকায় আমরা অবশ্য দেখতে পাইনি।

মন্দিরের সামনে ৫ বিঘা বিশাল মাঠ। ২৮ জানুয়ারি সেখানে একটি প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। ধর্মপ্রসার সেবা ট্রাস্ট্রের মাধ্যমে এখানে ছাত্রাবাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সংস্কার কেন্দ্র তৈরী করা হবে।

ওই মাঠেই আরএসএস-এর সাময়িক শিবির হবার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ধর্মান্তরকরণের পরে গণমাধ্যমে হৈ চৈ শুরু হওয়ায় সেই পরিকল্পনা স্থগিত থাকে। জানা গেছে রাত্রে বাইরে থেকে লোকজনের আনাগোনা বাড়ে। গাড়ির রাস্তা ব্যবহার না করে সেক্ষেত্রে ভাটিনা জঙ্গল হয়ে, সুড়কির খাদ বরাবর পথ ব্যবহার করা হয়। আপাততঃ স্থগিত থাকলেও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় এলাকার সমস্ত খ্রীষ্টান পরিবারগুলিই লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে সংঘপরিবারের সকল শাখা কাজ করছে। খড়মাডাঙ্গা থেকে সে কাজের শুরু।

আমাদের তথ্যায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে খড়মাডাঙ্গার কয়েক জনের সাথে যে কথোপকথন হয় তা রাখা হল এখানে —

উকিল মারডি, খড়মাডাঙ্গা

উকিল মারডি, সাহসে ভর করে যিনি ধর্মান্তরকরণের ঘটনার প্রেক্ষিতে অভিযোগ জানিয়েছিলেন রামপুরহাট থানায়। খড়মাডাঙ্গায় আমরা প্রথমে তাঁর সাথে দেখা করি। আমরা যখন তাঁর বাড়ির উঠোনে তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যাচ চলছিল। উঠোনের পাশের একচালায় চলছিল টিভি। বাড়িতে হঠাৎ কিছু অচেনা, অজানা মানুষ প্রবেশ করলে যে বিস্মিতভাব চোখে ফুটে ওঠে তা ছিল না কারো মধ্যে। কিন্তু চোখে ছিল উদ্বেগ। বিশেষত উলিক মারডির। বাইরের লোক, মিডিয়ার গাড়ি এখানে এসেছে অনেকবার। তাই উধাও হয়েছে অবাক হওয়ার প্রাথমিক ভাব। এসেছে শঙ্কা, উৎকন্ঠা। আমরা মিডিয়া সুলভ প্রশ্ন-পদ্ধতি ব্যবহার করিনি। সহজ হতে চেষ্টা করেছিলাম, মিশে যেতে চেয়েছিলাম পরিবারটির নিজস্ব সময়ের সাথে।

অল্প সময়ই আমাদের সঙ্গে ছিলেন উকিল মারডি। আমরা ইতিমধ্যে জল খেয়েছি, শেয়ার করেছি, ক্রিকেট ম্যাচের কিছু মুহুর্ত একজন মানুষ প্রচণ্ড চাপে থাকলে যে রকম অভিব্যক্তির প্রকাশ হয় সেরকমই ছিল তাঁর উক্তি, নিরুক্তি এবং স্বগতোক্তি। সেখানে ছিলেন উকিলবাবুর বাবা জেঠা মারডি, ছিলেন প্রতিবেশী এবং আত্মীয় শীতল সোরেন। এখানে টুকরো টুকরো কয়েকটি কথার উল্লেখ রাখা হল — একটানা কোন শাখাৎকার এটি নয়, তা বলা বাহুল্য।

“আমরা এসেছি এখানে, জঙ্গলে ঘেরা একটা গ্রাম এই খড়মাডাঙ্গা, আমাদের এখানে ঘুরতে ভালো লাগছে”। উত্তরে জেঠা মারডি বলেন, “এ গ্রাম আদিবাসীদের গ্রাম, তোমাদের কি ভালো লাগবে?” “খুব ভালো লাগছে আমাদের, লাল সুরকি, শাল গাছ …। এখানে কোন ইশকুল নেই কাকা?

“আমাদের গ্রামে নাই, তবে ভাটিনায় আছে।”

“আপনার ছেলেমেয়েরাও কি সেই ইস্কুলে পড়েছে?”

“হ্যাঁ, উকিল পড়েছে। বাকি দুই ছেলে এক মেয়ে তারাও অল্প অল্প পড়েছে।”

“উকিলের খুব সাহস যাই বলুন।”

“হ্যাঁ, ও তো বরাবরই সাহসী। কোন অন্যায় হলে মুখ বুজে থাকতে পারে না।”

“সে তো ঠিকই।” (এরপর উকিল বাবুর দিকে তাকিয়ে কথা শুরু করি, তিনি তখন টিভিতে খেলা দেখছিলেন) “ম্যাচ তো ভালোই জমেছে দেখছি।”

(মৃদু হেসে) “হুম।”

“টিভি তো ইলেকট্রিকেই চলছে। এখানে লোডশেডিং সে রকম হয়না না?” 

“না সকলের নেই, বেশীরভাগ হুকিং।”

“বিদ্যুৎবিভাগের লোক আসে না? পুলিস এসে বাধা দেয় না?”

“না, সেরকম আসে কোথায়।”

“সেই ঘটনার পর পুলিশ এসেছিল?”

“হ্যাঁ এসেছিল।”

“আপনি অভিযোগ করেছিলেন কেন?”

“ধর্মান্তরকরণের জন্যে।”

“কোন ওসি ছিলেন তখন রামপুরহাট থানায়?”

“সেটা ঠিক বলতে পারবো না।”

“আপনাকে কি এর জন্য হুমকি বা ভয় দেখানো হচ্ছে?”

(কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) “হুঁ হচ্ছে।”

এরবেশী কথা হয়নি উকিল মারডির সঙ্গে। আমরা পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ জানতে পারি শিতল সোরেনের কাছ থেকে।

শীতল সোরেন, খড়মাডাঙ্গা

উকিল মারডির প্রতিবেশী শীতল সোরেন। তার সাথে কথা হয় উকিল মারডির বাড়িতে। ধর্মান্তকরণের আগের ও পরের ঘটনাগুলি তিনি বিবৃত করেন আমাদের সামনে। এখানে তাঁর কথা রাখা হল —

“এখানের চাষবাস ভালো নয়। দু একঘর ছাড়া সকলেই খুব গরীব। জন খাটতে যায় দূরে দূরে। ক্রাশার মেশিনে কাজ করে দৈনিক মজুরীর ভিত্তিতে। অনেকে সুরকির খাদে কাজ করে। ‘১০০ দিনের কাজ’ এখানে তেমন হয়নি। মজুরি খুব কম ১২০-১৩০ টাকা।”

“এখানে ক্রাশার মেশিনের ধুলো ধোঁয়া নিয়ে আমরা আছি। গ্রামে ঢুকতে যে জঙ্গল দেখলেন তা সরকারের লাগানো গাছ। এখানে শিকারের জন্তু পাওয়া যায় না। পানীয় জল মানে কুয়োর জল। গ্রাম ঢুকতে একটা কুয়ো দেখলেন, ওখান থেকে জল আনি আমরা।”

“সরস্বতী পূজোর বিসর্জনের একদিন বাদে ধর্মান্তরকরণের ঘটনা। ওরা গ্রামের লোককে কি হবে কিছু জানায়নি। আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। ওরা সরস্বতীপূজোর পরের দিন বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল ডাল তুলেছিল। সবাই ভেবেছে সরস্বতী পূজোর জন্যে দিতে হবে।”

“এখানে ক্লাবে সরস্বতী পূজো হয়। যখন চালডাল তোলে তখনও গ্রামের লোক জানে না কি হবে, কোথায় হবে!”

“অন্য গ্রাম থেকে, ঝাড়খণ্ড থেকে লোক এসেছিল প্রচুর। ধর্মান্তরকরণে এই গ্রামের কেউ নেই। খাওয়া দাওয়া হয়েছিল, গ্রামের লোক খেয়েছে।”

“গ্রামে মাঝে মধ্যেই হিন্দু পরিষদের লোকজন আসতো। ভাটিনার মন্দির বিশ্বহিন্দু পরিষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই গ্রামের যেখানে ধর্মান্তরকরণের যজ্ঞ হয় সেখানেও ওদের ওঠা-বসা। গ্রামের মধ্যে ধনপতি হাঁসদা বিশ্বহিন্দু পরিষদ করে। এখানের মন্দিরের দায়িত্বে ধনপতি।”

“যেদিনের ঘটনা (ধর্মান্তরকরণে)-র পর আর কোন মিটিং হয়নি এখানে। পুলিশ রাত্রের দিকে এসেছিল, লোকজন ভয়ে পালিয়ে যায়।”

“রাত্রের দিকে লোকজন ঢুকছে গ্রামে। রাত্রি ১১টা -১২ টার সময় এসে হুলাচ্ছে। আমার বাড়িতে গিয়েছিল। আমার দরজা বন্ধ ছিল, ওরা বাইরে থেকে বলতে লাগলো, ইচ্ছে করে দরজা খুলছেনা, জেগে আছে। খুবই ভয়ের ব্যাপার। আমরা ক’ঘর ধর্মান্তরকরণ মেনে নিতে পারিনি বলে হুমকি শুনছি।”

“আমরা হিন্দু। তবু এর প্রতিবাদ করছি।”

“ওই একজন (ধনপতি হাঁসদা) এখানের মাথা, ওর সাথে অনেকেই আছে। দিনের বেলায় আপনারা গেলেদেখা পাবেন না। রাত্রে ওদেরই রাজত্ব।”

“পুলিশ একবার এলে কি হবে? পুলিশ আসার খবর ওরা আগে থাকতেই পেয়ে যায়। সব জায়গায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোকজন আছে।”

“ধর্মান্তরকরণের দিন রামপুরহাট থানার পুলিশ ছিল এখানে। কই কোন বাধাতো তারা দেয়নি। রামপুরহাট মিউনিসিপালিটির জলের গাড়িও এসেছিল।”

“আমাদের গ্রামে নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি খুব একটা হয় না। বহুদিন আগে গ্রামে একবার মারামারি হয়েছিল। কিন্তু এবারের ঘটনা গ্রামকে ভাগ করে দিলো।”

আমরা জিজ্ঞেস করি এর ফলে কি গ্রামের মধ্যে পরস্পরকে অবিশ্বাস, সন্দেহ বৃদ্ধি পেয়েছে? উত্তরে শীতল সোরেন বলেন, “খুব বেড়েছে। উকিল মারডি পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছে, আমরা ওকে সমর্থন করেছি, আমরা তাই একঘরে।”

“একঘরে মানে কি, অন্যদের সাথে কথাবার্তা, যোগাযোগ বন্ধ?”

“না তা ঠিক নয়, কিন্তু বুঝতে পারি, কেন আমরা থানায় গেলাম, গ্রামের ব্যাপার বাইরে নিয়ে গেলাম তা বলছে অনেকে। কিন্তু ওরাই তো বাইরের লোক আনলো। গ্রামকে অন্ধকারে রেখে এত বড় ঘটনা ঘটালো।”

“এই ঘটনা ঘটলো, গোটা দেশ জেনে গেল, এটি কি ভালো লাগছে। আপনাদের?”

“আমরা যদি আগে জানতাম এ ঘটনা ঘটতে দিতাম না।”

“এই ঘটনার পর ধনপতি বাবুর (উকিল মারডির বাড়ির প্রায় বিপরীত দিকে ওনার বাড়ি) সাথে কি কথাবার্তা হয়েছিল?”

“কথাবার্তা বন্ধ হয় নি। কিন্তু আমরা প্রতিবাদ করে অন্যায় করেছি সে কথা ওনারা বলেন।”

“আপনারা কি জিজ্ঞেস করেছেন কেন এসব (ধর্মান্তকরণ) ঘটনা করালেন?”

“না, তা বলা হয়নি।”

বিরজু মুর্মু, খড়মাডাঙ্গা

খড়মাডাঙ্গা গ্রামের গুটিকয় স্বচ্ছ্বল পরিবারের অন্যতম বিরজু মুর্মুর পরিবার। বিরজু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসর প্রাপ্ত। ঠাকুরপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শালতোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। আমরা তাঁর বাড়িতে প্রধানত তার সাথে এবং কিছু সময় পরিবারের অন্যান্যদের সাথে কথা বলি। আলাপে ও আলোচনায় সাঁওতাল সমাজ, খড়মাডাঙ্গার সমাজ-সংস্কৃতিক অবস্থান এবং সমাজ পরিবর্তন, ধর্মান্তরকরণ, এফআইআর ইত্যাদি বিষয় উঠে আসে। তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল ধর্মান্তরকরণের প্রতি।

তিনি বলেন, “এখানে সেরকম ঘটনা ঘটেনি। আমাদের গ্রামের সবাই ওখানে ছিল। রেডিও, টিভিতে বলা হল ১০০ জনকে ধর্মান্তরকরণ করা হয়েছে, তা ঠিক নয়।”

আমরা প্রশ্ন করি, “সঠিক সংখ্যা ঠিক কত?”

“সেটা ঠিক বলা মুশকিল। তবে লোকজন এসেছিল। বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতারা এসেছিল। আমিও ওখানে ছিলাম।”

“ধনপতি হাঁসদা ছিলেন?”

“হ্যাঁ, তিনি তো ছিলেনই, তিনি বিশ্বহিন্দু পরিষদের লোক। ধনপতির বাবা, মোড়ল হাঁসদা, তার আমলেই গ্রামের প্রান্তে ওই মন্দির স্থাপিত হয়।”

“সেদিন কি রামপুরহাটে বিশ্বহিন্দু পরিষদের মিটিং ছিল?”

“হ্যাঁ, ছিল। বললাম না এখানেও বিশ্বহিন্দু পরিষদের নেতারা উপস্থিত হয়। খাওয়া দাওয়ার পরে এখানে মিটিং শেষ হয়।”

“এখানে পুলিশ এসেছিল, শুনেছি রামপুরহাট পৌরসভা থেকে জলের গাড়িও এসেছিল?”

“পুলিশ ছিল, এক গাড়ি পুলিশ এসেছিল, আমার সাথে অবশ্য তাদের কোন কথা হয়নি। জলের ব্যবস্থার জন্য জলের ট্যাঙ্কি এসেছিল। রামপুরহাট থেকে এসেছিল।”

“আপনাদের গ্রামের কেউ কি ধর্ম পরিবর্তন করেছেন?”

“এখানের কেউ করেনি। এখানে সবাই হিন্দু।”

“পাশের গ্রাম ভাটিনা থেকে কিছু খ্রীষ্টান আদিবাসী হিন্দু হয়েছেন বলে খবর।”

“সেটা বলতে পারবো না।”

“আর নুরিপাহাড়ি, হরিনাথপুর গ্রাম থেকে খ্রীষ্টান আদিবাসী এসেছিলেন, তারা?”

“তাদের কথা কি করে বলবো। তাদের আমি চিনিও না। নুরিপাহাড়ি ঝাড়খণ্ডে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসেছিল বৈকি।”

“আপনার মনে হয়নি, কেন পুলিশ এলো? এর আগেও তো এখানে পূজোআচ্চা হয়েছে তখন কি পুলিশ এসেছিল?”

“না, ওপর মহল থেকে এসব করা হয়েছে আমার জানা নেই।”

“মন্দিরে কি নিয়মিত বসা হয়?”

“হ্যাঁ, ধনপতি বসে। বাইরের লোক আসে। ওরা গ্রামে গ্রামে হ্যান্ডবিল বিলি করেছিল।”

“হ্যান্ডবিলে কি বলা হয়েছিল?”

“এই, এখানে যজ্ঞ হবে, পূজো হবে।”

“আগে কখনও এরকম হ্যান্ডবিল বিলি করা হয়েছিল?”

“না।”

“সেই হ্যান্ডবিল আছে, আপনার কাছে?”

“না” (একটু থেমে)।

“আপনার গ্রামের উকিল মারডি ধর্মান্তকরণের বিরুদ্ধে রামপুরহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করে। পুলিশ এফআইআর হিসাবে তা গ্রহণ করে।”

“উকিল মারডি কি করছে তা আমার জানা আছে। আমি তো ওখানে ছিলাম, আমি কিছু জানিনা আর উকিল জেনে গেলো? ওখানে সাধু সন্তদের যজ্ঞ হচ্ছিল। এফআইআর করে উকিল ভালো কাজ করেনি।”

“কি বলছেন, গ্রামে এতবড় কাণ্ড হল, চারিদিকে হৈ চৈ! ও শুধু ওর প্রতিবাদ জানিয়েছে।”

“বললাম তো ভালো কাজ করেনি।”

“উকিল মারডি খুব ভয়ের মধ্যে আছে, শোনা যাচ্ছে রাত্রে লোকজন আসছে, হুমকি দিচ্ছে ...”

“সে সব আমি কিছু জানি না।”

“ধনপতি হাঁসদা তো বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আঞ্চলিক সংগঠক, উনি কেমন লোক?”

“ধনপতিকে সবাই মানে। নিয়মিত মন্দিরে বসে।”

“মন্দিরটি কত বছরের?”

“ওই ১০-১২ বছর হবে?”

“ওখানে কি মূর্তি আছে? শিব বা অন্য কোন দেবতা?”

“শিবের মূর্তি আছে। অন্য কোন মূর্তি নাই।”

“ওখানে আপনাদের সাঁওতাল সমাজের নিজস্ব পরব কি কি হয়?”

“বাদনা হয়, ছোট বাদনা হয়। ওখানে মন্দিরে হয় না, হয় থানে। তবে হোলি হলেও আবির-টাবির দেওয়া হয় না।”

“এই গ্রামে বা এই অঞ্চলে তো বেশীরভাগ মানুষই সাঁওতাল, তাই না?”

“হ্যাঁ, সাঁওতাল সকলেই। বাঙালি কিছু আছে কয়েকটি গ্রামে। সাঁওতালদের ১২টি ভাগ, বা ১২ প্রকারের পদবি। যেমন সোরেন, টুডু, বাস্কে, হেম, মারডি, মুর্মু, চোঁরে ইত্যাদি। এখানে সকলে আছে তা নয়।”

“যারা খ্রীষ্টান তাদেরও পদবি কি একই রকম?”

“সাঁওতাল মাত্র একই পদবি হবে। তবে ওরা খ্রীষ্টান নাম রাখে।”

“এই যে গ্রামে ক্লাব থেকে সরস্বতি পূজো হচ্ছে, গ্রামের উপকণ্ঠে মন্দিরে যাগযজ্ঞ হচ্ছে এসব কি কখনও হত? এসব তো পরে এসেছে।”

(কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে) “আগে হতো না ঠিকই। আগে তো আদিবাসী মেয়েরা শাঁখা সিঁদুর পরতো না। এখন আমাদের মোড়ল বলো বা পুরোহিত সকলেই দেবদেবী পুজো করছে। একই সাথে সাঁওতাল পরব হচ্ছে, হিন্দু পূজো আচ্চা হচ্ছে।”

“এসব কি এখনই শুরু হয়েছে।”

“না বহুদিন ধরে। আমার মা-ঠাকুমাদের সময়ে অবশ্য এসব ছিল না।”

“এসব মানে?”

“এই বাঙালিদের মত শাঁখা সিঁদুর, পূজো আর কি!”

“কিন্তু এই যাগযজ্ঞ, ধর্মপরিবর্তন এসব কবে থেকে শুরু হল?”

“এসব বহুদিনের ঘটনা নয়। ২০০৫ সালে ভাটিনার মন্দিরে হয়েছিল।”

“আর এবারে এখানে।”

“এখানে সে রকম বড় কিছু হয়েছে বলে জানি না। প্রচার হয়েছে খুব। আমরা তো বুঝতে পারিনি।”

“বড় না হলেও ধর্মান্তরকরণের ঘটনা তো হয়েছে?”

এবার বিরজুবাবু মৌন থাকলেন, উত্তর দিলেন না।

সরস্বতী টুডু, মাধবি হেমব্রম এবং অন্যান্যরা

খড়মাডাঙ্গার মহিলামহল। তারা বসেছিলেন সরস্বতি টুডুর দাওয়াতে। গেলাসে ভরা হাঁড়িয়া। খিলখিল হাসি আর গানের কলি ভেসে আসছিল। আমরা আলাপ শুরু করি, এইভাবে গান গাইতে কলকাতায় যাবেন? তারা বলে যাবো, আমরা গান গাইবো, কিন্তু গান করলে পয়সা পাবো তো? তারপর আবার হাসি, একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়া। শুরু হয় আলাপন, অফার আসে হাঁড়িয়ার।।

“এখানে বাঁদনা হয়, বড় বাঁদনা, ছোট বাঁদনা। আমরা নাচ করি, গান গাই। তবে এখন কোন গানের দল নেই আমাদের। তোমরা মাষ্টারকে (বিরজু মুর্মু) বলো, ওর ফোন নাম্বার নিয়ে ফোন করো, আমরা গান গাইতে যাবো।”

“এখানে সরস্বতী পুজো হয়। আগে হতো না, এখন কয়েক বছর ধরে হয়। ছেলে মেয়েরা এসব ইস্কুলে পড়তে যায়, ইস্কুলে যে পুজো হয়। ওরা শিখে আসে। এখানে ক্লাবে সরস্বতী পুজো হয়।”

“এখানে হোলি হয়, তবে রঙ নয় জল দিয়ে হয়। আমরা রঙ পরে মাখবো। আমরা আদিবাসী তো! আগে আমরা রঙ নিই না। আগে জল। তুমি হয়তো আমার দেওর হলে, আমাকে জল ঢাললে, আমিও তুমাকে ঢালবো। আইবুড়ো মেয়েদের রঙ মাখতে নেই।”

“ওই মন্দিরে (যেখানে ধর্মান্তকরণ হয়েছে) শিব আছে। ভিতরে পাথর আছে। ওই মন্দিরটা আমরা করিনি। হিন্দু পরিষদ করেছে।”

“আমাদের থান ওই আগে (যেখানে বাঁদনা পরব হয়)। মোত্তাগিন যেখানে পুজো করে। মোত্তাগিন মানে মোড়ল। ওটা আমদের গ্রামের পুজোর থান। ওই মাষ্টার আমাদের মোড়ল।” … কথাগুলি বলেন আড্ডার সময় আরও অন্যান্য কথার মধ্যে।

“যেদিন (ধর্মান্তকরণের দিন, ২৮ জানুয়ারি) ওরা খিচুড়ি খাইয়েছিল। যজ্ঞ হয়েছিল। আমি হাত দিয়েছিলাম,” বলেন সরস্বতী টুডু।

তিনি আরও বলেন, “অনেক দূর থেকে লোকজন এসেছিল। আমরা সবাইকে চিনি না। বাংলাতে আর হিন্দিতে কথা হচ্ছিল। মাইক বাজছিল। পুলিশ এসেছিল, কিন্তু কেন এসেছিল বলতে পারব না।”

অন্তরঙ্গ এই আড্ডা এক সময় শেষ হয়। আমাদের নাম জানতে চাওয়া হয়। আমাদের নাম জেনে তারা বলেন, … তোমাদের কি নিজের গাড়ি নাই? আমরা অবাক, জিজ্ঞেস করি কেন? তাহলে ওই লোকটাকে এনেছিস কেন? আমাদের গাড়ীর চালক ছিলেন স্থানীয় মানুষ, তাঁকে মুসলমান বলে সহজে চেনা যায়। আমরা জানতে চাই কেন একথা বলছো, তারা চুপ থাকে। এখানে সাঁওতালদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক এখনও কতটা সন্দেহ ও অবিশ্বাসের অন্ধকারে, নিমেষে জানা যায় তা। নিমেষে স্পষ্ট হয় হিন্দুয়ানী ও হিন্দুত্বের প্রভাব ও প্রেক্ষিত। আমাদের সঙ্গী জাকারিয়া রহমান স্থানীয় মানুষ, রামপুরহাটে বাড়ি। এই সাঁওতাল গ্রামগুলিতে আসতে প্রথমে ইতস্তত করছিলে তিনি।

লক্ষ্য বস্তু

ভাটিনা, নুরিপাহাড়ি, হরিনাথপুর, ইত্যাদি গ্রামগুলি থেকে এমনকি ঝাড়খণ্ড থেকে আদিবাসী খ্রিষ্টানরা এসেছিলেন। বিশ্বহিন্দু পরিষদের স্থানীয় কর্তা ব্যক্তিরা এদের নিয়ে আসে খড়মাডাঙ্গার উপকণ্ঠে, মন্দির প্রাঙ্গণে। এখানেই ধর্মান্তকরনের যজ্ঞ হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বর্তমান ফতোয়ার ফলে এদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে আসতে চাইছে না। কয়েকজন খ্রিষ্টান পরিবারকে (যারা ধর্মান্তরিত হয়েছেন) স্থানান্তরিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। আমরা কয়েকজন ব্যক্তির সাথে কথা বলি একান্তে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে গোষ্ঠীর মধ্যে।

বেশীরভাগ মানুষ নিজেদের নাম প্রকাশ্যে আনতে চাননি। আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যারা চাননি তাদের নাম এখানে প্রকাশিত হচ্ছে না। ধর্মান্তরিত ব্যক্তি, প্রতিবেশী খ্রীষ্টান পরিবারগুলির সাথে কথা বলেছি আমরা। এখানে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপের অংশ রাখছি —

ধর্মান্তরিত একজন, হরিনাথপুর

“আমাদের গ্রামে বিশ্বহিন্দু পরিষদের লোকজন আসে কয়েক বছর ধরে। তারা বলে খ্রিষ্টান থাকলে কোন সুবিধা তোমরা পাবে না। দুমকা থেকে বিজেপি নেতা এসেছে কয়েকবার (কারো নাম বলতে চান নি তিনি)। এখানে পাথর খাদান বা ক্রেশার মেশিন প্রচুর। সাঁওতালদের সাথে মুসলমানদের ঝগড়া। হিন্দু পরিষদের লোকজন এসে আমাদের সুরক্ষার গ্যারান্টি দেয়। তখন থেকেই ওদের আনাগোনা।”

“ওরা এসে আমাদের বললো খড়মাডাঙ্গায় বড় পুজো হবে। সাঁওতালরা সবাই থাকবে। তোমাদের শুদ্ধ করে নেওয়া হবে। বড় ভোজ হবে সেখানে। আমাদের সবাইকে বললো। আমি গিয়েছিলাম। না কোন জোর করে নি।”

“যারা সেদিন যায় নি, তারা আমারই আত্মীয়। এবারে বড়দিন সবাই একসাথে করেছি। জানিনা এরপরে বড়দিন করতে পারব কিনা। আমার আত্মীয়রা আমাকে সন্দেহ করে। ভয় পায় কিনা জানি না।”

“ওরা এমনিতে ভয়েই আছে। মুখ খুলবে না। ওদের যেন কোন বিপদ না হয়। আমরা সব সাঁওতালরা একসাথে থাকি। পরব একসাথে করি, নাচি, গান গাই।”

মাইকেল হেমব্রম, ভাটিনা

“আমরা দাদুর আমল থেকে খ্রিষ্টান। ভাটিনা গ্রামে প্রায় ১৬-১৭ ঘর খ্রিষ্টান আছে। এখানে কোন গীর্জা অবশ্য নেই। বড়পাহাড়ী (ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলা)-তে গীর্জা আছে। আমাদের পরিবারে কেউ হিন্দু হয়নি। গ্রামে অন্য কেউ খ্রিষ্টান থেকে হিন্দু হয়ে থাকতে পারে (কিছুটা থেমে) আমাদের জানা নেই।”

“পেপারে যে খবর হচ্ছে এতজন সাঁওতাল খ্রিষ্টান থেকে হিন্দু হল, এর ফলে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এও একধরনের প্রচার। মুখোমুখি বললে তো দাঙ্গা বেঁধে যাবে। তাই ওরা মিথ্যা প্রচার করছে, লোভ দেখাচ্ছে যে খ্রিষ্টান থেকে দলে দলে হিন্দু হয়ে যাচ্ছে।”

“আমাক বদের গ্রামেও মাইকে প্রচার হয়েছিল। বলা, হয়েছিল খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। মিজী আসবে। বলেছিল নেআমাতা আসবে। এবারে কি নেতা, আশ্রমের নেতা না দলের নেতা কি করে বুঝবো?”

“ওরা ঝাড়খণ্ড থেকে কিছু সাঁওতাল খ্রীষ্টানকে এনেছিলো। আমাদের গ্রামের কেউ যদি হয়েও থাকে তারা এখন চুপচাপ আছে। মুখ খুলছে না।”

“আমরা এখানে সব আদিবাসীরা একসাথে আছি। কোন ঝামেলা এতদিন হয়নি। বছর দশ আগে এখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আনাগোনা হয়। ওরা ভাটিনা ঢোকার মুখে একটা বড় মন্দির স্থাপন করে। ২০০৫ সালে ওই মন্দিরে প্রায় ৫ হাজার মানুষের সমাবেশ হয়। সেবারও কিছু সাঁওতালকে ওরা হিন্দু করে।”

“এখন চারিদিকে খুব ভয় আর সন্দেহ। কে কখন কি বেশে আসছে কি বুঝবো? আমাদের সাবধানে কথা বলতে হয়।”

“ক্রাশার মেশিন চলছে, গাছপালা, শস্য সব নষ্ট তো হচ্ছেই। তবে পার্টি, মেশিন মালিক সব একদিকে আছে। আমার তো মনে হয় এই যে যজ্ঞ হচ্ছে, পুজো হচ্ছে, মন্দির বানাচ্ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এসবে মালিকদেরও হাত আছে। রামপুরহাটের বড় বড় ব্যবসায়ীরাও আছে।”

“কয়েক বছর আগে ক্রাশার দূষণ নিয়ে রামপুরহাটের মহকুমা শাসককে জানানো হয়েছিল। গাঁওতা থেকে জানানো হয়েছিল। কিছুই হয়নি। এখানের পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় তৃণমূল কংগ্রেস। প্রধান বোগাই মুর্মু। কিন্তু কেউ কোন ব্যবস্থা নেয় নি।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন, ভাটিনা

“বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোকেরা গ্রামে গ্রামে ঘুরছে। প্রচার করে বলছে ভোজ খাওয়াবো। নেতারা চলে আসছে, সাঁওতাল নেতা, বাঙালি নেতা, বিহারী নেতা। ওরা মুখে বলছে না খ্রিষ্ট ধর্ম নষ্ট করবো। ওরা শুধু বলছে মন্দিরে চলো ওখানে ভোজ খাওয়ানো হবে। নেতারা আসছে ওদের কথা শোনো।”

“আমরা যারা খ্রীষ্টান তারা সাঁওতালও। আমরা বাঁদনা, ছোট বাঁদনা সহ সব আদিবাসী পরব পালন করি। এতদিন একসাথে করে এসেছি, কোন অসুবিধা নেই। পৃথিবীতে ঝগড়া করে শান্তি নেই। আমরা কতদিন বাঁচবো!”

“বিশ্বহিন্দু পরিষদের লোকেরা ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন করছে, খ্রীষ্টধর্ম তোমাদের কি দিলো। আমাদের বক্তব্য কি দেবে? ধর্ম কি দেয়?”

“কেউ কেউ ভদ্র ভাষায় কথা শুরু করে। বয়সে ছোট হলে বলে কাকা, বড় হলে ডাকে ভাইপো বলে। তারপর শুরু করে ধর্ম নিয়ে নানান প্রশ্ন।”

“আমাদের এখানে রাস্তা নাই। সরকারের প্রতি আমাদের প্রশ্ন আমাদের বাড়ির সামনে এসে ঢালাই-এর রাস্তা শেষ হল কেন (আমাদের অর্ধ সমাপ্ত রাস্তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়)? বাঙালি পাড়াতে প্রতিটি রাস্তা ঢালাই হয়েছে। কিন্তু আদিবাসী গ্রামে এই রকম অবস্থা কেন? আর আমরা খ্রীষ্টান বলে আমাদের পাড়াতো সব থেকে বঞ্চিত।”

“এই সব প্রশ্ন করলেই প্রলোভন দেখাচ্ছে। বলছে হিন্দু হয়ে যাও, সব পাবে। এ ব্যাপারে সব পার্টিই এক।”

বিবিধ

ধনপতি হাঁসদার সাক্ষাৎ আমরা পাইনি। ওনার পরিবারের মহিলা সদস্য আমাদের দরজা থেকে বিদায় দেন। জানান তিনি পাশের গ্রামে গেছেন। গ্রামের নাম অবশ্য তিনি জানান না। কখন ফিরবেন জানতে চাইলে বলেন বিকেল হতে পারে বা সন্ধ্যে।

সাঁওতালদের বাড়ির দেওয়াল যেমন পরিপাটি করে নিকানো থাকে তা ছিল। কোথাও আঁকা ছিল গাছ কোথাও ফুল ইত্যাদি। অনেক দরজায় হিন্দু বাঙালির মতো সিঁদুরের চিহ্ন ছিল। চিহ্নগুলি ছিল স্বস্তিকা, ওম্‌ এবং মাঙ্গলিক। খ্রীষ্টান বাড়িগুলিতে ক্রসের চিহ্ন। খ্রীষ্টান যুবক, নাবালকের গলায় ক্রস ঝোলানো হার দেখেছি।

খড়মাডাঙ্গা কান্ড এবং সংঘ পরিবার

রাজনৈতিক হিন্দুধর্মের বিজ্ঞাপিত প্রকল্প এই ‘ঘর ওয়াপসি' বা ঘরে ফেরা। অর্থাৎ কিনা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের ভাষায় ‘এক সময় হিন্দু থাকা পরিবারগুলিকে পুনরায় হিন্দুত্বে ফিরিয়ে আনা’। এক সময়ের সংঘের স্বেচ্ছাসেবক এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশের মতো বীরভূমেও আরএসএস কর্মীরা নেমেছিল বিজেপি প্রার্থীকে জেতাতে। ভোটের পর সারাদেশ জুড়েই হিন্দুত্বের প্রচার শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ধর্মান্তরকরণের খবর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে। কোথাও মুসলমান, কোথাও খ্রীষ্টান। রামপুরহাটে ধর্মান্তরকরণ করা হল আদিবাসী খ্রিষ্টানদের। ধর্মান্তরকরণের পশ্চিমবঙ্গীয় পর্যায়। শুরু হল বীরভূম থেকে।

রামপুরহাট থেকে দুমকা যাবার পথে ধরমপাহাড়ি মোড়। যেখান থেকে বাঁদিকে ভাটিনা যাবার পথ। দুপাশে ক্রাসার মেশিনের আওয়াজ এবং সর্বগ্রাসী ধুলো। ভাটিনার জঙ্গল পার হয়ে খড়মাডাঙ্গা যেতে হয়। জঙ্গলের আগে পরে সুড়কির খাদান। অবিশ্রান্ত তৎপরতার সঙ্গে ট্রাকে লোড হয়ে যাচ্ছে জেলা ও রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।

ভাটিনা মোড়েই বিশ্বহিন্দু পরিষদ স্থাপিত সিংহবাহিনী মন্দির। ২০০৫ সালে এখানে শতাধিক খ্রীষ্টানকে হিন্দুকরা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষরা। সেবারে আয়োজন আরও বড় হয়েছিল বলে আমাদের জানালেন চুকরা টুডু, বিশ্বহিন্দু পরিষদের জেলা সংযোগ প্রধান। আদিবাসী খ্রীষ্টানদের ধর্মান্তরকরণে ভাটিনা মন্দিরের ভূমিকা ছিল মুখ্য। বাস্তবে এলাকায় ধর্মবিস্তারে এবং রাজনৈতিক হিন্দুত্ব প্রচারে ভাটিনা মন্দির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এখানে নিয়মিত বৈঠকে বসেন স্থানীয় আদিবাসী নেতৃত্ব যারা হিন্দু পরিষদের সদস্য এবনহ পদাধিকারী। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের ‘লক্ষ্য বীরভূম’ প্রকল্পে বনহাট গ্রাম পঞ্চায়েত গুরুত্বপূর্ণ। পাশেই ঝাড়খণ্ড, গ্রামগুলি প্রত্যন্ত, বেশীরভাগ গ্রামেই পরিবহন যোগ্য রাস্তা নেই। এসব কারণগুলি এই অঞ্চলকে সংঘ পরিবারের রণকৌশলগত কেন্দ্রে পরিণত করেছে। আপাতত খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু করা হলেও মুসলমানরাও যে তাদের অন্যতম লক্ষ্য তা পরিষ্কার প্রবীণ তোগাড়িয়ার ভাষণে। ওই দিনই (২৮ জানুয়ারি, ২০১৫) রামপুরহাটের গান্ধী ময়দানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটা সভা ডাকে। যেখানে পরিষদের আন্তরাষ্ট্রীয় কার্যকরী সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়া বলেন, ‘হিন্দুদের জনসংখ্যা ক্রমশই কমছে। এভাবে যদি বেশীদিন চলতে থাকে তাহলে যেভাবে ঢাকা থেকে হিন্দুদের পালিয়ে আসতে হয়েছিল, সেভাবেই পশ্চিমবাংলা থেকেও হিন্দুদের পালাতে হবে। রাজ্য সরকারকে এখনই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বাংলাদেশী মুসলমানদের তাড়াতে হবে। এরপর সরাসরি উপস্থিত জনতার প্রতি তার আহ্বান, বাংলাদেশী মুসলমানদের তাড়িয়ে দিন। একজন বাংলাদেশী মুসলিমকেও ঘর ভাড়া দেবেন না। এদের কোন কাজ দেবেন না।”

শাসকদলের গোষ্ঠীকোন্দল এবং জেলা নেতৃত্বের প্রকাশ্য আস্ফালন সাধারণ মানুষকে বিমুখ করেছে তাদের থেকে। বীরভূমে ভারতীয় জনতা পার্টি লোকসভা ভোটের পর থেকে তার শক্তি বাড়িয়েছে। এক সময় আরএসএস-এর প্রচারক দুধকুমার মণ্ডল এখন জেলা সভাপতি। পাড়ুই, সাত্তোর, লাভপুরের মতো এক সময়ের তৃণমূল কংগ্রেস অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে একেরপর এক গ্রাম দখল করে চলেছে বিজেপি। রামপুরহাটে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন দীপক দাসের মতো স্থানীয় নেতা। ঢল না নামলেও তলে তলে বিজেপিকে সমর্থনের চোরাস্রোত রয়েছে পুরভোটের প্রাক্কালে। সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক মঞ্চ হল বিজেপি। বীরভূমে এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। বিজেপির জেলা সম্পাদক স্বরূপ রতন সিংহ। ২৮ জানুয়ারি ধর্মান্তকরনের বিষতে তাঁর অভিমত, “ওরা তো লোভের বশে খ্রীষ্টান হয়েছিল, তাই ওদের ইচ্ছায় ওরা আবার হিন্দু হয়েছে।” ক্যামেরার সামনে কোন বক্তব্য রাখতে চাননি দুধকুমার মণ্ডল। কিন্তু তিনিও একই রকম বক্তব্য রেখেছেন। প্রবীণ তোগাড়িয়ার ভাষায় কথা বলেছেন রামপুরহাটের ছোট বড় বিজেপি নেতারা। যেমন, “যদি কেউ হিন্দু হতে চায় তাহলে আমরা কি করতে পারি? আমরা কেন আটকাবো?”

বিশ্বহিন্দু পরিষদের জাতীয় সম্পাদক যুগোল্কিশোর একইভাবে বলেন, আমরা কাউকে জোর করিনি। মিডিয়া এটাকে ধর্মান্তকরণ বলছে। ২৮ জানুয়ারিতে উপস্থিত ছিলেন তিনি। রামপুরহাটের সভায় প্রবীণ তোগাড়িয়া বলেন, “এই সভা হল হিন্দুদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সুরক্ষার জন্য। যারা ‘ঘর ওয়াপসি’ (ধর্মান্তকরণ)-তে হিন্দুধর্মে ফিরছেন তাদের সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি করা হবে।”

৮ মার্চ, ২০১৫ শিউড়ইতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ চিন্তক সভা হয়। সেখানে আমন্ত্রিত হন বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরের সাধু সন্তরা। উপস্থিত থাকে ভারত সেবাশ্রম সংঘ। ফেব্রুয়ারিতে জেলা ভিত্তিক বার্ষিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়। খড়মাডাঙ্গার ‘সাফল্য’ সংঘ পরিবারকে আরও তৎপর করে তুলেছে। আরএসএসের দক্ষিণবঙ্গের প্রচার প্রমুখ জিষ্ণু বসু যেমন বলেন, “ফেব্রুয়ারির বৈঠকে আমরা পর্যালোচনা করেছি আমাদের কাজের, সাফল্যের। এও ঠিক করেছি সংঘের ওপর আক্রমণ কিভাবে মোকাবিলা করা হবে। প্রয়োজনে প্রতিরোধে নামব আমরা।” সংঘের পূর্বক্ষেত্র প্রচারক অদ্বৈতচরণ দও বলেন, “সংঘ মার খেয়ে পিছু হটবে না।” বলেন, “লাগাতার জেলায় জেলায় সভা করবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও আর.এস.এস.।”

আমরা কথা বলেছিলাম বি.জে.পি.-র বীরভূম জেলা সহ সভাপতি শুভাশিষ চৌধুরীর সাথে। তিনি বলেন, “ওরা আগে হিন্দু ছিল। মাঝে অন্য ধর্ম নেয়, এখন আবার হিন্দু হয়েছে। এতে আশ্চর্য হবার কি আছে?”

আমরা কথা বলি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বীরভূম জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক দেবাশীষ চ্যাটার্জির সাথে। ধর্মান্তকরণের ‘সফল’ আয়োজনে স্থানীয়ভাবে যাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য দেবাশীষ বাবু তাদের অন্যতম। ওনার সরাসরি বক্তব্য, “আমরা যা কিছু করেছি অন্যায় কিছু করিনি। মিডিয়া, বিরোধী শক্তি এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে। স্বেচ্ছায় মানুষ এসেছিল আমাদের অনুষ্ঠানে (২৮ জানুয়ারি, ২০১৫)।”

আমরা প্রশ্ন করি, “ভূমি পূজা হয়েছিল ওখানে? কিছু নির্মানের পরিকল্পনা আছে?” দেবাশিষ চ্যাটার্জী বলেন, “খড়মাডাঙ্গার মন্দিরের সামনে ৫ বিঘা প্লট আছে। জমিটি পার্শ্ববর্তী গ্রামের অশোক ঘোষের। ওনার পিতা স্বর্গীয় রঞ্জিত ঘোষের নামেই প্লটটি ছিল। অশোক ঘোষ জমিটি আমাদের দান করেন।”

“আপনাদের মানে কাদের?”

“দান করেন ধর্মপ্রসার সেবা ট্রাস্টকে। ওখানে ধর্ম প্রসারের উদ্দেশ্যে বড় মন্দির হবে। ছাত্রাবাস, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সংস্কার কেন্দ্রও তৈরী করা হবে এখানে।”

“নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে ট্রাস্টের উদ্দেশ্য। ধর্মপ্রসার মানে কি এই ধর্মান্তকরণ?”

“ধর্মান্তকরণ আমরা বলি না, বলি ঘর ওয়াপসি বা ঘরে ফেরা।”

“কতজন মানুষ সেদিন ঘরে ফেরে? সঠিক সংখ্যায় কতজন?

“প্রায় একশো জন।”

“কোন গ্রাম থেকে এসেছিলেন ওঁরা?”

(কিছুক্ষণ থেমে), ‘সে বলা যাবে না।”

“শোনা যাচ্ছে ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টানদের লুকিয়ে রাখা হচ্ছে, কথা বল দেওয়া হচ্ছে না।”

(কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে), ‘না, কিছু বলতে পারব না।”

“আগ্রা বা অন্যান্য কয়েকটি স্থানে মুসলমানদের হিন্দু করা হয়েছে রামপুরহাটে খ্রীষ্টান দিয়ে শুরু হল। এর পরের টার্গেট কি মুসলমানেরা?”

“দেখুন, ভারতে বেশিরভাগ মুসলমান বা খ্রীষ্টান কয়েক পুরুষ আগে হিন্দু ছিল। তারা যদি তাদের পূর্বপুরুষের ধর্মে আবার ফিরতে চায় খারাপ কি?”

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ স্থাপিত ভাটিনা মন্দির

প্রশাসন, রামপুরহাট থানা, এফআইআর এবং বর্তমান অবস্থা

২২ ফেব্রুয়ারি আমরা যোগাযোগ করি রামপুর হাট থানায়। জানতে চাই এফআইআর-এ কার নাম আছে এবং কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা? কিন্তু আমাদের জানানো হয় রামপুরহাট থানার আই সি আবু সালাম বর্তমানে থানায় নেই, তাই অন্যদের পক্ষে কিছু জানানো সম্ভব নয়। গত ৭ই মার্চ ফোন করা হয় আবু সালেমকে। প্রথমে তিনি বলেন ডিপার্টমেন্ট থেকে নির্দেশ আছে যা বলার পুলিশ সুপার বলবেন, আমার মুখ খোলা বারণ। কার নির্দেশ জানতে চাইলে তিনি নিরুত্তর থাকেন। কার কার নামে এফআইআর হয়েছে জানতে চাইলে তিনি জানান প্রবীন তোগাড়িয়া, যুগোল কিশোর এবং অন্যান্যদের নামে। এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলেও তিনি জানান। বিশ্বহিন্দু পরিষদের জেলা সংযোগ প্রধান চুকরাটুডু এবং খড়মাডাঙ্গার বাসিন্দা ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের আঞ্চলিক সংগঠক ধনপতি হাঁসদার নাম এফআইআর-এ আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে সালাম সাহেব বলেন — বলা যাবে না। প্রসঙ্গত বলা যায়, ধনপতি হাঁসদা গত ২৮ জানুয়ারী তারিখে ধর্মান্তরকরণ উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞ ও পূজার পুরোহিত ছিলেন। ৮ মার্চ রবিবার সিউড়িতে বিশ্বহিন্দু পরিষদের চিন্তকসভা অনুষ্ঠিত হয়। রামপুরহাটে প্রবীণ তোগাড়িয়ার পর এখানে আসেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিনায়করাও দেশপান্ডে। সঙ্গী আরএসএস। আমন্ত্রিত বিভিন্ন মঠ ও মন্দিরের সাধুরাও। বীরভূমকে টার্গেট করেছে সংঘ পরিবার। অংশগ্রহণ করেছে ‘সেবা’-র আড়ালে রাজনৈতিক হিন্দুত্বের পরিষেবায় রত ভারত সেবাশ্রম সংঘ। প্রয়োজনে মারের বদলে মারের পথে নামতে হবে এরকমই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। উত্তপ্ত রামপুরহাট ও সংলগ্ন আদিবাসী গ্রামগুলি। গ্রামগুলিতে হিন্দু পরিষদের কর্মীদের আনাগোনা, রাত্রে এসে এফআইআর-এর জন্যে দরখাস্তকারী উকিল মারডি সহ প্রতিবাদীদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে রামপুরহাট থানা শান্তি রক্ষায় কি ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাওয়া হয়। এক্ষেত্রেও তিনি মুখ খুলতে অস্বীকার করেন। আই সি জানান ঘটনার পর পুলিশ সেখানে যায়।

সর্বসাকুল্যে দু’একবার পুলিশের টহলের কথা আমাদের জানান খড়মাডাঙ্গার বাসিন্দারা। কিন্তু হুমকি এবং ধর্মান্তকরনের ফলে প্রায় বিভক্ত গ্রাম্য সমাজে যে কোনদিন অশান্তিকর পরিস্থিতি আসতে পারে। সেক্ষেত্রে কেন এখানে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হলো না? উত্তর পাওয়া যায় নি। ৮ মার্চ, আই সি আবু সালাম ফোন করেন, ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’কে। জানতে চান কোন মিডিয়া থেকে আমরা সেখানে গিয়েছি, আমাদের উদ্দেশ্য কি? উত্তরে তাঁকে জানানো হয়, ধর্মান্তকরণের বাস্তবতা বুঝতে এবং প্রশাসনের ভূমিকা কতটা তা জানতে আমাদের এই যাত্রা।

ধর্মান্তরিত করার জন্য বা হওয়ার জন্য মহকুমা শাসকের দফতরে হলফনামা দিয়ে নথিভুক্ত করাতে হয়, যা আজ পর্যন্ত হয় নি। আমরা কথা বলেছিলাম রামপুরহাটের মহকুমা শাসক উমাশঙ্কর এস’র সাথে। এরকম কোন হলফনামার খবর তাঁর কাছে নেই বলে তিনি জানান। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে ধর্মান্তকরনের কোন আইনি বৈধতা নেই, তা বলা বাহুল্য।

আমরা রামপুরহাট মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান অশ্বিনী তেওয়ারির সাথেও কথা বলার চেষ্টা করি টেলিফোনের মাধ্যমে। তাঁর একাধিক নম্বরে ফোন করেও বিজিটোন আসে। তার কোনো মন্তব্য (জলের গাড়ির প্রেক্ষিতে) পাওয়া যায়নি।

পাথর খাদান ও ক্রাশার মেশিন এখানে জনজীবনকে করেছে ধ্বস্ত পর্যুদস্ত।

আলোকচিত্র ও সংবাদে খড়মাডাঙ্গা ও ভাটিনা গ্রাম

ভাটিনা গ্রামে একটি খ্রীষ্টান ঘর

ভাটিনা গ্রামে একটি খ্রীষ্টান সমাধিস্থল

খড়মাডাঙ্গা গ্রামের পুজোর থান (যেখানে বাঁদনা পরব হয়)

ভাটিনা সিংহবাহিনী মন্দির

সিংহবাহিনী মন্দিরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নামফলক

ভাটিনার জঙ্গল পার হয়ে যেতে হয় খড়মাদাঙ্গা

About author
Generic placeholder image
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.
Do you want to get informed about new articles?

Most Viewed
0 Comments
Leave a reply