দেওচা: বাতাসে বিষের গন্ধ

কেন দেওচা-পাচামিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করা দরকার? কেন এই প্রকল্প একই সাথে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার বিরুদ্ধে এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্র তা নিয়ে আলোচনার সময় এসেছে। বস্তুত ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’ (সংঘর্ষ ও সহাবস্থা সম্পর্কিত ক্ষেত্র গবেষণা গোষ্ঠী)-এর পক্ষ থেকে ২০১৯ সাল থেকে দেওচা-পাচামি নিয়ে সমীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে খোলামুখ কয়লা খনি এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উদ্দেশ্য সেখানের সামাজিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত ও পরিবেশগত ক্ষতির স্বরূপ নিরূপণ। যাতে ইতিমধ্যে পাথর খাদান ও ক্রেসার মেশিনের ফলে দূষিত দেওচা-পাচামির কতটা ক্ষতি হতে চলেছে তা বোঝা যায়। আমাদের সমীক্ষা এখনও চলছে। এই লেখায় আমরা সামসাময়িক কয়েকটি গবেষণা ও সমীক্ষার সাহায্য নিয়েছি। এই রিপোর্টটিতে স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে এবং পরিবেশের নিরিখে খোলামুখ কয়লাখনি কত বড় বিপদ তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই রিপোর্ট তৈরিতে সাংগঠনিক ও গবেষণালব্ধ তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তাঁরা হলেন।

১। ডঃ মনন গাঙ্গুলি

২। পিপুলস ফার্স্ট কালেক্টিভ ইন্ডিয়া

৩। প্রজেক্ট এফেক্টেড পিপুলস অ্যাসোসিয়েশান

৪। ল্যান্ড কনফ্লিক্ট ওয়াচ  

‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’

একটু ইতিহাসে ফেরা যাক। আমরা যে তথ্য পাচ্ছি তা হল, ১৭৭৮ সালে প্রথম খনন শুরু হয় রানীগঞ্জ-ঝরিয়া অঞ্চলে। প্রায় আড়াইশো বছর আগের সেইসময়ে না ছিল পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য কোন আইন না ছিল শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোন আইন। ইংরেজ শাসনের সেই সময়ে বেশিরভাগ ভূগর্ভস্থ খনিতেই অগভীর খননকার্য হওয়ার পর সেই খনিগুলি এখন মিথেন গ্যাসে পরিপূর্ণ, পরিত্যক্ত ও জলমগ্ন হয়ে ছোট ছোট পিলারের ওপরে দাঁড়ানো। পিলারগুলি বয়সের ভারে দুর্বল ও ভঙ্গুর, ফলত প্রতিনিয়ত ধ্বসের সম্মুখীন। মিথেন গ্যাস থেকে খনিতে আগুন লেগে, বিপদ বেড়েছে কয়েক গুণ। ৪৭-এ ইংরেজ শাসনের অবসানের পর মালিকানার বদল হয়, কয়লা খনিগুলি ব্রিটিশ কোম্পানিদের হাত থেকে বিভিন্ন দেশীয় পুঁজিপতিদের মালিকানায় বদল হয়। শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন এই লক্ষ্য ব্রিটিশ বা ভারতীয় সকল কোম্পানিই বজায় রাখে।

১৯৭৩ সালের ১ মে Coal Mines (Nationalization Act), 1973, এই আইন বলে বেসরকারি বাণিজ্যিক খননের একচেটিয়া রাজত্ব খতম করে কয়লা খনিগুলির জাতীয়করণ করা হয়। ১ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ সরকারি কোম্পানি কোল ইন্ডিয়া (Coal India)স্থাপিত হয়। এর অধীনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পূর্বতন কয়লা কোম্পানিগুলিকে নিবন্ধিত করা হয়। কোল ইন্ডিয়ার অধীনে থাকে ভারত কোকিং কোল লিমিটেড, ইস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন কোল ফিল্ড লিমিটেড ইত্যাদি সংস্থাগুলি। কিন্তু নয়ের দশকে ভারতে নয়া-উদারবাদী নীতি গ্রহণ করা হয়, বলা যেতে পারে নতুন করে ‘কোম্পানি রাজ’-এর শুরু হয় সেই সময়। খনিগুলি থেকে আরও মুনাফার লক্ষ্যে বেসরকারি খোলামুখ কয়লা খনির অনুমতি দেয় কয়লা মন্ত্রক। সুড়ঙ্গ কেটে নয়, ডিনামাইট ফাটিয়ে খোলামুখ খনি থেকে কয়লা তোলার ফলে তাদের খরচ কমে, কিন্তু ব্যাপক ক্ষতি হতে থাকে পরিবেশের। ধ্বস, গ্যাস, আগুন সঙ্গী হয় কয়লাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষের।

খোলামুখ খনন এবং অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বেআইনি খননের ফলে পরিত্যক্ত পুরনো খনিতে, যেখানে আগে থেকে মিথেন গ্যাস রয়েছে, সেখানে আগুন লেগে ধ্বসের ঘটনা ঘটছে। ICML, Bengal Emta ইত্যাদি বেসরকারি, এমনকি সরকারি ECL –এর খনিগুলিতে যে কেউ গেলেই দেখতে পাবেন, খনিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ঝাড়খণ্ডের ঝড়িয়া এলাকায় বিস্তীর্ণ এলাকা এভাবেই জ্বলছে। অত্যধিক তাপমাত্রার ফলে আশেপাশের গাছপালা গেছে শুকিয়ে। ঝড়িয়া শহর তো বহুদিন থেকেই সম্ভাব্য ধস নামার জন্য খালি করে দেওয়ার কথা, পুরো শহরটাই যেকোন দিন খাদে তলিয়ে যেতে পারে। এসবের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে আশেপাশের মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তুদের ওপর। প্রতিদিন হাওয়ায় মিশছে বিষাক্ত গ্যাস, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে বহু বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। এছাড়াও অতিগভীর খোলামুখ কয়লাখনির কারণে জলস্তর নেমে যাচ্ছে উদ্বেগজনকভাবে। মানুষ জলকষ্টে ভুগছেন।

কোল ইন্ডিয়া হোক বা রাজ্যসরকার, এসব জানা নেই, তা নয়। পরিত্যক্ত কয়লা খনি থেকে কয়লা চুরি এই অঞ্চলের ‘অর্থনীতি’-র বড় ‘শরিক’। তার ‘মধু’ পানে সক্রিয় রাজনৈতিক মদতপুষ্ট কয়লা-মাফিয়ারা। কয়লা-মাফিয়ারা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতারও শরিক। রাজ্যের শাসক দলের নেতাদের পকেটে হোক বা দলীয় ফাণ্ডে, কয়লা চুরির টাকা এই আমলের দুর্নীতির অন্যতম বড় দিক। বিগত ১০ বছরে কয়লা চুরি পশ্চিমবঙ্গের এই প্রান্তে প্রায় ‘বৃহৎ শিল্প’-এ পরিণত। তবে মাফিয়া-নেতার আঁতাতের ক্ষেত্রে আজকের দিনে বলা যায়, এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসক দলদুটির আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিনের আলোর মত পরিষ্কার। এসবের প্রতিকার চেয়ে আন্দোলন হয়েছে বহুবার, আসানসোল-রানীগঞ্জ এলাকায়, বহু স্থানে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ও মাফিয়াদের গুন্ডাবাহিনীর অত্যাচার, মিথ্যা মামলা দায়ের, নিরবচ্ছিন্ন সন্ত্রাস চালাচ্ছে প্রান্তিক মানুষদের ওপর। পশ্চাৎপট এই। এখন দেখা যাক কয়েকটি সমীক্ষার নির্যাস।

খোলামুখ কয়লাখনি এলাকা: দুটি সমীক্ষা

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এর দুপুর ১ টা। আমরা যায় পশ্চিম বর্ধমান জেলার বারাবনি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন কাশিডাঙ্গার নুনিয়াপাড়া। ধসে ইতিমধ্যে ফাটল দেখা গিয়েছে বেশ কিছু বাড়িতে। আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে সারা পাড়া। ৫৫ বছরের সাগর নুনিয়া। বাড়িতে বড় ফাটল। জলের জন্য পাম্প বসাতে গেলে তা তলিয়ে যায় মাটির নিচে। পেশায় দিন মজুর। শুরু হয় কথোপকথন-

সাগর- আমার দাদুরা ভাগচাষী ছিলেন। এখানে কায়স্তদের জমি চাষ করতো। এখানে আমরা যারা নুনিয়া তাঁদের অধিকাংশ ভুমিহীন। রায়দের, কায়স্তদের জমি চাষ করতো। যদিও আমরা এই অঞ্চলে এসেছিলাম শ্রমিক হিসাবে।

আমরা- আপনারা কি কাজ করতে এসেছিলেন?

সাগর- কোলিয়ারির শ্রমিক হিসাবে এসেছিল আমাদের পূর্বপুরুষ।

আমরা- কোথায় আপনাদের আদি বাসিন্দা?

সাগর- গ্রামের নাম নওাদি কাওাকার, হাসুয়া নওাদা, বিহার। বিহার উত্তরপ্রদেশ ঝাড়খণ্ড থেকে বহু গরিব মানুষ এখানে কয়লা আবিষ্কারের পর আসে। রোজগারের আশায়। সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা হবে।

আমরা- এখানে আপনারা পরবর্তীকালে কৃষিকাজেও যুক্ত হন?

সাগর- এই এলাকা তখন এমন ছিল না। সবুজ ছিল, চাষ হত। আমরা মুলত কৃষিজীবী শ্রেণি। তাই এখানেও অনেকে চাষের কাজে যুক্ত হই।

আমরা- শ্রমিক হিসাবে কি কাজ করতেন?

সাগর- কয়লা কাটা, ওয়াগেন লোডিং ইত্যাদি।

আমরা- এখানে কি সবই এখন খোলামুখ কয়লা খনি?

সাগর- এখন সবই। ভানোরা কোলিয়ারি এখন বন্ধ, তবে ওর পশ্চিম ব্লক এখনও চলছে। এখান থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে খোলামুখ কোলিয়ারি, সরিষাতলি কোলিয়ারি। গোয়েঙ্কাদের। আপনাদের কলকাতার সি ই এস ই-র কোলিয়ারি।

আমরা- আপনার বাড়ি ঢুকতেই বিশাল ফাটল, কিভাবে হল? কবে হল?

সাগর- খুব সম্প্রতি। শুধু ওখানে নয় বাড়িতেও ফাট ধরেছে। ওপরে মাটি দেখছেন, ভিতরে ফাঁকা। যেকোন সময় আমাদের বাড়ি, আস্ত পাড়াটাই মাটির তলায় চলে যেতে পারে।

আমরা- এই বাড়িটা আপনার পৈত্রিক?

সাগর- এখানে বেশিরভাগ জমি ই সি এল-এর। অর্থাৎ সরকারি কোলিয়ারি সংস্থার। তবে এই বাড়ির দুটি দাগ, ১৭০৫ ও ১৭০৬। প্রথমটি ই সি এল-এর। দ্বিতীয়টি পাট্টা।

আমরা- সরকারের কাছ থেকে এই ফাটলের জন্য কোন ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন?

সাগর- না না। ই সি এল বলছে তোমরা আমাদের জমিতে বসে আছ কেন। উঠে যাও। আমরা যায় কোথায় বলুন তো? কোন উপায় থাকলে আমরা এখানে থাকি? যেকোন সময় আমাদের পাড়া ধসে যেতে পারে। তারপরে কয়লার ধুলো, ইটভাটার ধুলো। ছোট ছোট বাচ্চারা জন্ম নিচ্ছে ধুলো আর ধোঁয়া নিয়ে।

আমরা- প্রধান তিনটি অসুখ যা এখানের প্রায় সবাই ভোগেন, কি কি যদি একটু বলেন।

সাগর- টিবি বা যক্ষ্মা, দমা কাশি আর ক্যানসার। আমার জামাইবাবু শিবু চৌহান ২০১১ সালে মারা গেলেন ক্যানসারে। আমার দাদা জিপু নুনিয়া এই ২০১৭ সালে মারা গেলেন যক্ষ্মায়। আমার পেটে আলসার। এখানে ঘরে ঘরে এইসব রোগ।

আমরা- এখানে টিবি হাসপাতাল কোথায়?

সাগর- জানা নেই। কাছেপিঠেও নেই।

তুলসি নুনিয়া (৫৮ বছর)

বছর দেড়েক ধরে আমার হাত পা কাঁপে। হাইড্রোসিল হয়েছে, শিরা মোটা হয়েছে। বেঙ্গলএমটার কোলিয়ারিতে আমি কয়লা ভাঙ্গার কাজ করতাম। এটা WBPTCL –এর যৌথ উদ্যোগ। আমরা কন্ট্রাক্ট লেবার ছিলাম। কিছুই পায়নি।

আমরা- কোম্পানিকে লিখিত কিছু দাবি জানিয়েছিলেন?

তুলসি- আমাদের কোন দাবিই ওরা নেয়না। এখন তো কোম্পানি বন্ধ আছে। ১৯৯৬ সালে কোম্পানি এসেছিল, ২০১৪ সালের শেষ মাস পর্যন্ত ছিল। কোম্পানিই নেই, তো আমাদের দাবি, পাওনা।

আমরা- এইরকম ঠিকাদারের অধীনে কি এখানের অধিকাংশ শ্রমিক ছিলেন?

তুলসি- শ্রমিক মানেই ঠিকা শ্রমিক। সাপ্তাহিক মজুরি ছাড়া কিছু বরাদ্দ নেই। ওপেন কাস্ট মাইনিং-এর ধুলো-ধোঁয়া ফ্রি।

আমরা- বাকিরা?

তুলসি- বাকিরা ইটভাঁটা। কেউ কেউ ডাম্পার থেকে কয়লা পরে গেলে তা তুলে জমা করে বিক্রি করে। অবৈধ কয়লা পাচার এখানের জীবিকা।

দ্বিতীয় যে লোকেশানে আমরা যায় সেটি হল, হরিজন পাড়া বা মাহারা পাড়া, বারাওনি, পশ্চিম বর্ধমান। ছোট্ট এই পাড়াটির এক পাশে কয়লা লোডিং-এর ডিপো, এখানে মালগাড়িতে কয়লা লোডিং হচ্ছে। অন্য পাশে ইটভাঁটা। প্রতি শ্বাসে কার্বন, খাবারে, পানীয় জলে মৃত্যুর কোটি কোটি অনু। শুকনো চুল, শুকনো ত্বক, আরও শুকনো চোখ নিয়ে যারা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন, তাঁদের বয়ান যেন কয়লার থেকেও শুকনো। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া কয়লা।

ভগত হরিজন (১৮ বছর)-

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল ভগত। বাবার নাম দিলিপ হরিজন। ইটভাঁটায় কাজ করে সে। দৈনিক ১৫০ টাকা মজুরি। হপ্তায় হপ্তায় পেমেন্ট হয়।

এক মাস হল হাতে দাগ হয়েছে। (ছবি নেওয়া হয়েছে)। কোন ডাক্তার দেখানো হয়নি।

অজয় মাহারা (৩০ বছর)

সারা দেহে গুটি গুটি বেড়িয়েছে। প্রায় দেড় বছর। কোন চিকিৎসা করাননি। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। এক ছেলে, এক মেয়ে।

‘লোকে বলছে পেটে পারা চলে গেছে। এখানের জলে, মাটিতে আছে।’। ‘ঝাড়খণ্ডে গিয়েছিলাম সেখানেই শ্বশুরঘর, টোটকা দিয়েছিল। কাজ হয়নি।’ ‘কেউ কাজে নিচ্ছে না। চেহারা দেখে তাড়িয়ে দিচ্ছে।’ ‘চুলকানি হয়।’

এলাকার অধিবাসি শান্তিরাম হরিজন জানান, অজয়ের স্ত্রীর শরীরেও অল্প অল্প গুটি দেখা গ্যাছে।

নুনিয়া পাড়া এবং হরিজন বস্তি মিলে প্রায় ২৫ জনের স্বাস্থ্য ও দূষণ সংক্রান্ত তথ্যায়ন হয়। ভয়ঙ্কর এক চিত্র উঠে আসে। চর্ম রোগ, যক্ষা, ক্যান্সার, নিঃশ্বাসের কষ্ট, হাঁপানি, পেটের অসুখ প্রায় ঘরে ঘরে। এই পর্বে ‘আমরা এক সচেতন প্রয়াস’ –এর তথ্যায়ন এখনও জাড়ি আছে। এর পাশাপাশি অন্য একটি সমীক্ষায় চোখ রাখা যাক।

‘পিপলস কালেকটিভ ইন্ডিয়া’ একটি সমীক্ষা চালায় ঝাড়খণ্ডের একটি খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায়। ফেব্রুয়ারি, ২০২১-এ সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক ও গবেষকদের দল সমীক্ষা করেন কয়লা এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের ৩ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে চারহী, দুরুকাস্মার, তাপিন, দুধমাটিয়া-  রামগড় জেলার এই প্রত্যন্ত চারটি গ্রামে। এই রামগড়েই আছে সেন্ট্রাল কোলফিল্ড এবং টাটা ষ্টীলের কোলিয়ারি। সবই খোলামুখ।

তাদের সর্বমোট ২৩৫৩ টি সমীক্ষিত স্বাস্থ্য তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান দশটি রোগের কথা। সেগুলি হল, ব্রঙ্কাইটিস (হাঁপানি সহ); সিওপিডি/ কার্ডিওভাসকুলার (নিশ্বাসের সমস্যা); যক্ষা; ত্বক(কালো/সাদা দাগ, চুলকানি, আলসার); চুল (পতন/হ্রাস, বিবর্ণ); চোখ (জল পড়া ও লাল)পা/পায়ের পাতা(ফাটা, আলসার); কোমরে ব্যাথা, বাত এবং পেটের অসুখ। এই এলাকার বায়ু, জল, মাটি আর পলি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে মারাত্মক দূষণ, বিভিন্ন বিষাক্ত ভারী ধাতু। বায়ু দূষণ (পিএম ২.৫) যা ভারতীয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকার সীমা অতিক্রম করেছে। বাতাসে যে পরিমাণ ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল ও সিলিকন পাওয়া গেছে তা স্বাস্থ্য নির্দেশিকার নির্দিষ্ট মাত্রার অতিরিক্ত। মাটিতে ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, আর্সেনিক, ক্যাডিয়াম পাওয়া গেছে, যা পরিবেশ রক্ষায় নির্দেশিত কানাডীয় মৃত্তিকা নির্দেশিকার মাত্রা অতিক্রম করেছে। বিষাক্ত ক্রোমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে পলিতে, ফলে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে। অ্যালুমিনিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ পাওয়া গেছে জলে, যা ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশিত মাত্রার বাইরে।  

 আবার জীবাশ্ম জ্বালানি  

আবার একটু তথ্য ও ইতিহাসে চোখ রাখা যাক। আমরা জানি, জলবায়ুর বর্তমান আপৎকালীন অবস্থার প্রধান কারণ জীবাশ্ম জ্বালানী। সেই শিল্পবিপ্লবের কাল থেকে কার্বন নিঃসরণের ৮০ শতাংশ উৎস হল কয়লা, পেট্রলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস। কয়লা উত্তোলন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজ খনন, ওয়াশিং থেকে পরিবহণ, শিল্পে ব্যবহার অর্থাৎ কয়লার দহন ক্রিয়া বায়ুমণ্ডলে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন করে। বিশেষত খোলামুখ কয়লা খনি হল এক বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ পদ্ধতি। খোলা মুখ খনি মানেই মাটির ভিতরের বর্জ্যর পাহাড়। শুধু ধ্বস নয়, এর ফলে স্থলজ ও জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয় ব্যাপক। এর ফলে শুধু ওই এলাকার নয় এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিজ-বনজ উৎপাদন ও পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হয়। আসানসোল থেকে কোলকাতা ২১৩ কিমি আর মুহম্মদ বাজার থেকে ২০৯। অদূরেই শান্তিনিকেতন, দূষণের শিকার কিন্তু সকলেই।    

ভারত সহ কয়লা উৎপাদক দেশগুলির ওপর সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, বিষাক্ত দূষক যা কয়লা থেকে নির্গত হয় তা হল, ভারী ধাতুর মধ্যে কঠিন বর্জ্য হিসাবে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, সীসা, পারদ এবং বায়ুমণ্ডলীয় কণার মধ্যে সালফার ডাইওক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং গ্যাসীয় নির্গমনের মধ্যে ওজোন।     

সত্যি আজ বড় বিপদ। দুনিয়া জুড়ে ৪৩২ টি নতুন কয়লা প্রকল্প (২,২৭৭ মিলিয়ন টন প্রতি বর্ষে)অনুমোদিত হয়েছে। এর বেশিরভাগ অংশ এই চারটি দেশে- চিন (৬০৯), আস্ট্রেলিয়া (৪৬৬), ভারত (৩৭৬) ও রাশিয়ায় (২৯৯)। আবার ভারতের প্রকল্পগুলির বেশিরভাগ ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও ছত্রিশগড়ে, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার কয়লার ৭৭ শতাংশ।

দেশের আদিবাসী জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশের বসবাস এই চারটি রাজ্যে। আমাদের দেশে বিগত দশকগুলিতে ৬ কোটি আদিবাসীর মধ্যে ৪০% মানুষ উৎখাত হয়েছেন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে। কোল ইন্ডিয়া জানাচ্ছে আগামী পাঁচ বছরে তারা ৫৫ টি নতুন খনি খুলতে চলেছে যা তাদের উত্তোলন ক্ষমতা ১৯৩% বৃদ্ধি করবে। ‘ল্যান্ড কনফ্লিক্ট ওয়াচ’ জানাচ্ছে সারা দেশে ৭০৩ টি জমি নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে যা ৬৫ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত করেছে। উন্নয়ন মানে শুধু আদিবাসী উচ্ছেদ এবং জীবাশ্ম জ্বালানীর প্রকল্প।

দেওচা-পাচামিঃ আবার বিষ, আবার উচ্ছেদ

এই প্রেক্ষিতে আসা যাক, দেওচা-পচামি প্রসঙ্গে। আমরা জানি, বীরভূমের মুহম্মদবাজার ব্লকের ১১.২২২ একর এলাকা জুড়ে এই কয়লা ব্লক। যার পরিমাণ বলা হচ্ছে ২.২ বিলিয়ন টন। প্রথমে ইস্টার্ন কোলফিল্ডকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু তারা কোন উদ্যোগ নেয় না। ২০১৪ সালে কেন্দ্র সরকার পশ্চিমবঙ্গ সহ ছয়টি রাজ্যে এটি নেবার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসে না। ২০১৮ তে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে এই খনি দেয়। 

ইতিমধ্যে যে এলাকা পাথর খাদানের দূষণে দূষিত। পাথর খাদান তাঁদের জীবনে কোন আর্থিক উন্নতি ঘটায়নি। উপরন্তু ক্ষতি করেছে তাঁদের চাষবাস। তাঁদের সংস্কৃতি। প্রশাসন মানেনি আইন। যেমন, খনিজ ছাড় সুবিধা আইন, ১৯৬০ এবং খনিজ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন ১৯৮৮-এর ২০০৩ সালের সংশোধনী অনুসারে খাদান বুজিয়ে ফেলা সংক্রান্ত বিধি এখনও অবধি দেওচা-পচামিতে মানা হয়নি। খনন-উত্তর জমি, জলের মান উন্নয়ন, বায়ুর মান উন্নয়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৃত্তিকার উপরিভাগ বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সংক্রান্ত নির্দেশিকা পালন করা হয়নি। এখানে অতি গভীর খাদান ও অন্যদিকে বর্জ্য ও ধুলোর পাহাড়গুলো পড়ে আছে বহুদিন। সেখানকার রাস্তা মানেই চার পাঁচ ইঞ্চির ধুলো যা মানুষের শরীর ও প্রকৃতির ক্ষতি করে আসছে কয়েক দশক। চারিদিকে সবুজহীন ধূসর প্রান্তর ।এই সবুজহীনতা আর ধুলোও কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি পরিচ্ছন্নতার পরিপন্থী, যা এদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ‘এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা ব্লক’ থেকে কয়লা উত্তোলনের আস্ফালন।

এলাকাটি আদিবাসী অধিকাররক্ষাকারী সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ট তপসিলের অধীনে নেই। অথচ বীরভূমের এই এলাকায় আদিবাসীদের গ্রাম আছে। ঝাড়খণ্ডে সাঁওতাল পরগণা এবং ছোটনাগপুর এলাকায় আদিবাসীদের জমির রক্ষাকবচ হিসাবে যথাক্রমে সাঁওতাল পরগণা টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯ এবং ছোটনাগপুর টিনেন্সি অ্যাক্ট, ১৯০৮ আছে। এই আইন বলে আদিবাসীদের জমি অআদিবাসীদের বিক্রি করা যায় না। প্রতিবাদী মিটিঙে বহুবার এই দাবি উঠেছে, এলাকাটি যাতে সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ট তপসিলভুক্ত হয় বা উক্ত দুটি আইনের ন্যায় নির্দিষ্ট কোন আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু কোন আমলেই তা করা হয়নি। জমি হাঙররা এর সুযোগ নেবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।    

দেওচা-পচামিতে যেন এক অঘোষিত কার্ফু জাড়ি করা হয়েছে। লকডাউনে ত্রাণ দেওয়ার অছিলায় কয়েকজন ‘বুদ্ধিজীবী’ অবশ্য নেমেছিলেন মাঠে। বলাবাহুল্য শাসক দল ও প্রশাসন ‘কোভিড বিধি’ ভঙ্গের অজুহাতে আটকায়নি তাদের। অথচ সমীক্ষক দল হোক বা অন্যদের প্রবেশ ছিল ‘নিষিদ্ধ’। প্রতিবাদীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি চলছে নির্দেশ অনুসারে।

জীবন আর কতটা দুর্বিষহ করলে থামবে রাষ্ট্র? জানতে চাইছেন তাঁরা। ভয় দেখিয়ে, প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের বশে আনতে পারেনি সরকার। শাসক দলের গুণ্ডারা পথে নেমেছে বহুদিন। তা সত্ত্বেও বশ্যতা মানেনি সাধারণ গ্রামবাসী। তাঁদের জীবন-জীবিকা-সংস্কৃতির ওপর আঘাত তাঁরা চাননা, জানালো ছোট্ট জমায়েত। পাথর খাদানের ধুলো আমরা খেয়েছি, আর ধুলো খাবোনা, বললেন অনিল সোরেন (নাম পরিবর্তিত)। প্রতিরোধে সাঁওতাল।  

ইতিমধ্যে চিত্রনাট্য অনুযায়ীই সেই বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে অবশ্য কমিটি করা হয়ে গেছে আদিবাসীদের বোঝাতে। তাঁরা শুরুও করেছেন ‘কাজ’। নবান্ন থেকে ঘোষিত হয়েছে প্যাকেজ। শুরু হয়েছে ঢক্কানিনাদ, ভূভারতে এমন প্যাকেজ আর নেই। এদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বৃহদাংশ চুপ, ‘চুপ উন্নয়ন চলছে’। ততোধিক চুপ নাগরিক সমাজ। সর্বাধিক প্রচারিত সংবাদপত্রে হুমকি, ‘দরকার হইলে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করিতে হইবে।" শুরু হয়েছে শাসক দলের বাইক মিছিল। এলাকার মাথাদের ভয়ে, প্রলোভনে বশ্যতা মানানো হচ্ছে। হাতে শাসক দলের পতাকা, ‘আদিবাসীদের ভালোর জন্যই দলে যোগদান’-এই বুলি। প্রথমে কেন্দ্রের শাসক দলে, এখন রাজ্যের শাসক দলে। সাঁওতালদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ এখন হাতেগোনা কয়েকদিন মাত্র। ইউএপিএ, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ আইন’ চাপানো সময়ের অপেক্ষা। ‘সংঘর্ষ মৃত্যু’ও ওঁত পেতে বসে আছে।

১৮৯৫ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল ‘উলগুলান’, আদিবাসীদের সর্বাত্মক বিদ্রোহ। পাতা জোরা বিজ্ঞাপনে হুল, উলগুলান নিয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে বাণী দেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। দিতেই পারেন। দেওচায় এই সব শব্দাবলী অবশ্য উচ্চারণ করা যাবে না, করলে ‘মাওবাদী’, ‘নক্সাল’ ইত্যাদি প্রভৃতি। উদ্ধত বুদ্ধের পতন দেখেছে পশ্চিমবঙ্গ। ফ্যাসিস্ট মোদী এই সেদিন করজোড়ে, ‘কৃষি আইন প্রত্যাহার’, দেখল দেশ, বিশ্ব। ভারতের সংবিধান, বনাধিকার আইন, ২০০৬ আদিবাসীদের জমি রক্ষার গ্যারান্টি দিয়েছে। দেওচাকে সবুজ থাকতে দিন। আদিবাসী উচ্ছেদ বন্ধ হোক। মাননীয়া, শুনছেন?

About author
Generic placeholder image
Subha Protim Roy Chowdhury
Conflict and Peace Research
Do you want to get informed about new articles?

Most Viewed
0 Comments
Leave a reply