পশ্চিমবঙ্গ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৭ বসিরহাট, বাদুরিয়া
বছর সতেরোর এক কিশোরের করা ফেসবুক পোস্ট, আর সেই পোস্টে থাকা ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অশালীন এক কার্টুন, মুহুর্তের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশে ঘনীভূত করে দিল ক্ষোভের কালো মেঘ। শুরু হয়ে গেল উত্তর ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চল (বাদুড়িয়া, বসিরহাট ইত্যাদি) জুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অবরোধ। উঠে আসল গণহত্যার অভিযোগ। এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অসহিষ্ণু মানসিকতার কোন স্তরে অবস্থান আমাদের।
Conflict Area Study-7
Paschimbanga: Sampradayik Danga, 2017
West Bengal: Communal Riot, 2017
(Basirhat, Baduria-A Factfinding report)
Published on: 30 January, 2018
Documentation- Amitava Sengupta, Anupam Das Adhikary, Faruq Ul Islam, Ipsita Chokroborty, Mohit Ranadip, Mohor Ali Mondal, Samindra Sarkar, Subha Protim Roy Chowdhury, Subhas Das, Suman Nath, Sushmita Roy Chowdhury.
DTP, Page seeting, Cover designed by- Anupam Das Adhikary
Edited by- Subha Protim Roy Chowdhury.
Published by- Mohit Ranadip
Aamra Ek Sachetan Prayas, 393, Survey Park, Kolkata-700075
Phone Number-8017954126, 9038530690, 9433367386, 8820852054, 9830919951
e-mail- aamrasachetan@gmail.com
পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা : ২০১৭
বসিরহাট, বাদুড়িয়া
একটি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন
তথ্যায়ন- অমিতাভ সেনগুপ্ত, অনুপম দাস অধিকারী, ফারুক উল ইসলাম, ইপ্সিতা চক্রবর্তী, মোহিত রণদীপ, মোহর আলী মণ্ডল, শমীন্দ্র সরকার, শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী, সুভাষ দাস, সুমন নাথ, সুস্মিতা রায় চৌধুরী।
অক্ষর বিন্যাস, প্রচ্ছদ- অনুপম দাস অধিকারী
সম্পাদনা- শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী
প্রকাশনা- মোহিত রণদীপ
আমরা এক সচেতন প্রয়াস,
৩৯৩ সার্ভে পার্ক, কলকাতা-৭০০০৭৫
সচেতন প্রয়াস
বেদ কোরান না বলো মিথ্যা, মিথ্যুক যে না বিচারে।
যদি সব একই খোদা তবে কেন মুরগী মারে।।
মোল্লা বলিস খোদার ন্যায়। তোর মনের না ভ্রম যায়।।
জীবকে ধরে দেহ বিনাশিস কষ্ট দিস তুই মাটিকে।
জ্যোতি স্বরূপ আত্মা বলিস, তবে কেন বধলি তাকে?
কি হবে ওজু করে, মুখ ধুয়ে, মসজিদে মাথা নুইয়ে?
যখন কপট নমাজ পড়িস, কি হবে হজ করতে কাবায় গিয়ে?
অপবিত তুই, দেখিস নি পূত, মর্ম না তার জানিস।
কহিছে কবীর স্বর্গ না তোর নরকেই মন মানিস।।
-কবীর
২০১৭র ২রা জুলাই। সতেরো বছরের এক কিশোরের ফেসবুক পোস্ট, সেই পোস্ট-এ ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অশালীন একটি কার্টুন, ছড়িয়ে পড়লো তা দ্রুত। প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি অংশে ঘনীভূত হয় ক্ষোভ। শুরু হয়ে যায় উত্তর ২৪ পরগণার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অবরোধ। সেই কিশোরের প্রকাশ্য ফাঁসির দাবিতে অনেক জায়গায় বিক্ষোভ উগ্র রূপ নেয়। কমবয়সী কিশোর-যুবকদের অংশগ্রহণে বেশ কিছু জায়গায় শুরু হয় হিংসাত্মক কিছু ঘটনা। ভাঙচুর হয় হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত অনেকের দোকান। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গাড়িতে। আক্রান্ত হয় থানা। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়ানো হতে থাকে নানা গুজব। মন্দির ভাঙা, মসজিদ ভাঙা, ধর্মগ্রন্থে প্রস্রাব, সশস্ত্র হামলা-গণহত্যা...নানা গুজবে লাগামহীন হতে থাকে বিদ্বেষ-ঘৃণা-প্রতিহিংসার মনোভাব।
বাদুরিয়ায় সেই কিশোরের বাড়ি আক্রমণ দিয়ে যে তাণ্ডবের শুরু, তা সেই কিশোর গ্রেফতার হওয়ার পরেও থামেনি। ক্রমশ তা ব্যাপক রূপ নেয়। প্রশাসন-পুলিশ কার্যত দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই পর্বে। এর চরম পরিণতি ঘটে যায় গত পাঁচ জুলাই বসিরহাটের উপকণ্ঠে ট্যাটড়া গ্রামের বৃদ্ধ কার্ত্তিক ঘোষ নিহত হন পাশের গ্রাম পাইকপাড়ার ওপর দিয়ে ফেরার সময়।
‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ থেকে আমরা স্থির করি নিবিড় অনুসন্ধানের। বসিরহাট এবং সংলগ্ন এলাকার মানুষজনের কথায়, এর আগে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন উত্তেজনা, এমন হানাহানি, আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁদের জীবৎকালে কখনও তাঁরা দেখেননি। সাময়িক কিছু উত্তেজনার পরিস্থিতি বিক্ষিপ্তভাবে কখনও সখনও ঘটে থাকলেও এই আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়নি আগে।
আপাত সদ্ভাবের এই জনপদে, বসিরহাট, বাদুরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোন প্রেক্ষাপটে কীভাবে ছড়িয়ে পড়লো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিদ্বেষ, এই অবিশ্বাস আর হানাহানি? কাদের কী কী ভূমিকা ছিল? কী অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেলেন ঐ অঞ্চলের মানুষ? কী পেলেন তাঁরা? কী-ই বা হারালেন? কোথাও কি ধর্মের বেড়া ডিঙ্গনো মানবিক বোধ উঁকি দিয়েছিল এই আত্মহনন পর্বে? এর পর কী? কী ভাবছেন স্থানীয় মানুষজন?
এই সব প্রশ্ন ভিড় করছিল আমাদের মনে। এই প্রশ্নগুলোই গত ১৫ জুলাই সকালে আমরা’র তথ্যানুসন্ধানকারী দলের সদস্যদের নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো বসিরহাটের মাটিতে। শুরু হয় বসিরহাট দাঙ্গার মৃত ব্যক্তি কার্ত্তিক ঘোষের বাড়ি দিয়ে। তার পর একাধিক সময়, একাধিক মুখের সামনে দাঁড়িয়েছি আমরা। দাঁড়িয়েছি নিস্পাপ কয়েকটি শিশুর সামনে, দাঙ্গা যদি সবথেকে বেশি কোথাও ক্ষতি করে থাকে তবে তা হল শিশু মনের। আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেছি তাদের সামনে। কথা বলেছি ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের সঙ্গে, পুরোহিত, ইমাম, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্তাসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে। মুখ ও মুখোশের ধারাবাহিক বর্ণনে আমরা খুঁজতে চেয়েছি সূত্র, খুঁজতে চেয়েছি স্থূল ও সূক্ষ্ম সমগ্রকে। গত ৭ মাসে পাঁচবার গিয়েছি আমরা। প্রতিবার ফিরে এসে বসেছি আহরণের বিশ্লেষণে। তর্ক, প্রতর্ক থেকে মূর্ত হয়েছে ঘটনার এবং ঘটনার পিছনের প্রেক্ষিত। বলা যেতে পারে বসিরহাট মহকুমার এই দাঙ্গা, সংঘর্ষ-সমীক্ষায় ব্যতিক্রমী পর্ব হয়ে থাকবে। দাঙ্গার বিতত মানচিত্রে কোথাও মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা মাত্র একটি। কয়েকটি ব্যতিক্রম সহ ভিন্নধর্মীদের দোকান, উপাসনাস্থল আক্রান্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্রুদ্ধ জনতার আক্রমণের লক্ষ্য ছিল প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ভিন্নধর্মীর শবদেহ আটকে দেওয়া হয় যে অবরোধে, সেখানে কতটা ‘স্বতস্ফূর্ত’ এবং কতটা ‘সংগঠিত’ এই ‘প্রতিবাদ’ তা বুঝতে বিলম্ব হয়না। একইভাবে বসিরহাট শহরের ‘স্বতস্ফূর্ত’ মিছিলের পিছনের সংগঠিত উদ্যোগ গুপ্ত থাকেনা। তবে মানুষ যখন অন্য সব পরিচয় এক পাশে ঠেলে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য করে পথে নামে তখন নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনে। সারা রাজ্যেই রাজ্যবাসীর আরও বেশি হিন্দু বা মুসলিম হয়ে যাওয়ার ‘যাত্রা’য় বসিরহাট, বাদুরিয়া, তেঁতুলিয়া অবশ্যই এক ইতিহাস হয়ে থাকবে। যে ইতিহাস হয়ত আমরা ভুলতে চাইবো। সব কালে, সব দেশে সাদাত হোসেন মান্টো থাকে কতিপয়, এখানেও আছে। তাঁদের খুঁজে বের করা আমাদের কাজ। আমাদের খোঁজা এখনও জারি আছে।
শুভ প্রতিম
আমরা’র পক্ষে
গ্রেপ্তার হওয়া একদাশ শ্রেণীর ছাত্র শৌভিক সরকার
বাদুড়িয়া থানার সামনে অগ্নিদগ্ধ পুলিশের গাড়ি
বসিরহাট, বাদুরিয়া দাঙ্গা
একাধিকবার যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট এলাকাগুলিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ আমরা বিভিন্ন মানুষের মুখে কোথাও একইভাবে, কোথাও ভিন্নভাবে, কখনও একজন মানুষের মুখে বিভিন্নভাবে পেয়েছি। মানুষ যখন গোষ্ঠীর মধ্যে, তখন তাঁর ভাষা গোষ্ঠীয় বক্তব্যের সমতুল। যখন একাকী তখন যেন অনেক বেশি ‘মানবিক’। আবার দাঙ্গা কয়েকদিন বাদে প্রদেয় বয়ান আর দাঙ্গার একমাস পর বা দুই-তিন মাস পর দেওয়া বয়ানে পার্থক্য নজরে এসেছে। সমাজবিজ্ঞানের এবং মনোবিজ্ঞানের নিরিখে আমরা সমগ্রকে এনেছি যৌক্তিক খাতে, যাতে সম্পূর্ণতার ও বাস্তবতার নিকটে রাখা যায় এই প্রতিবেদন।
বসিরহাট মহকুমায় দাঙ্গার মানচিত্রে যে কয়েকটি এলাকায় ব্যাপক হিংসা হয় আমাদের তথ্যানুসন্ধান দল সেই এলাকাগুলিতে যায় কয়েকবার। এখানে এলাকা-নির্দিষ্ট বর্ণনে আমরা দাঙ্গার স্বরূপ ও প্রেক্ষিত ধরতে চেষ্টা করবো।
ঘটনার বিবরণ-
সাধারণভাবে দেখলে দাঙ্গার সূত্রপাত একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার বাদুরিয়া থানার অধীনে মাগুরখালি গ্রাম (বাস্তবে এটি বাদুরিয়া পৌরসভার অধীনে একটি ওয়ার্ড)-এর শৌভিক সরকার একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র। মা মারা গেছেন সে যখন ছোট ছিল। বাবা ক্ষেত মজুর। শৌভিক জেঠুর বাড়িতে মানুষ। জেঠু পুলিশে চাকরি করেন। ফেসবুকের যে পোস্টটি শৌভিকের অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট হয় তা একটি অশ্লীল কার্টুন। কার্টুনে কাবা শরীফে আল্লাহ এবং নবী মুহম্মদকে অশালীন অবস্থায় দেখানো হয়। পোস্টটি ঘিরে মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ ও ক্রোধের সঞ্চার হয়। মোবাইল ফোনের সৌজন্যে নিমেষেই বহু মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় পোস্টটি।
বাদুরিয়া পুরসভা এলাকায় ফেসবুক পোস্ট-পরবর্তী পর্বে তিনটি মুখ্য ঘটনা ঘটে। প্রথমটি ৩০ জুন, ২০১৭ বাদুরিয়া দিলিপ হাই স্কুলের মাঠে শৌভিককে গ্রেফতারের দাবিতে মুসলিমদের সমাবেশ এবং পথ অবরোধ। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে পরের দিন। মুসলিম জনতার মাগুরখালি গ্রামে শৌভিকের জেঠু বাবলু সরকারের বাড়ি আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ। সেইরাত্রেই শৌভিক গ্রেফতার হয়। এরপরের দিন উল্টোরথের দিন ২ জুলাই, ২০১৭। ওইদিন বিকেলে ঘটে তৃতীয় ঘটনা। বাকি দুদিনের তুলনায় সংখ্যায় অনেক বেশি মুসলিম জনতার মিছিল আক্রমণ করে বাদুরিয়া থানা। দাবি করে শৌভিককে তাদের হাতে তুলে দিতে হবে, তারাই তার উপযুক্ত শাস্তি দেবে। পুলিশের গাড়ি জ্বালানো হয়। ওঠে ধর্মীয় শ্লোগান। কোন দোকান ভাঙচুর হয়নি। থানার অদূরে বিশাল মন্দির অক্ষত থাকে। তিনটি ঘটনাতেই বহিরাগত মানুষ বেশি ছিল বলে জানা গেছে।
দাঙ্গার দ্বিতীয় ভূগোল বসিরহাট শহর। উল্টোরথের দিন শহরের ত্রিমোহিনী (একটি তেমাথার মোড়, এখান থেকে বাদুরিয়া ইত্যাদি এলাকায় যাওয়া যায়) এলাকায় মুসলিমরা জমায়েত করে, পথ অবরোধ করে। বিতর্কিত পোস্টটি ঘিরে উত্তেজনা চরমে ওঠে। ফেসবুকারের কুশপুতুল দাহ করা হয়। ধর্মীয় শ্লোগান ওঠে। হিন্দুদের দোকান আক্রান্ত হয়। চায়ের দোকান, মুদির দোকান ইত্যাদি। লুঠ হয় সামগ্রি, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর হিন্দুরা ত্রিমোহিনীর নিকটে ফাল্গুনী সিনেমা হলের আশপাশে মুসলিম দোকান আক্রমণ করে। আক্রান্ত হয় মুসলিম মালিকের ওষুধের দোকান, অটোমোবাইলের শোরুম ইত্যাদি।
টাকি রোডে ‘মায়ের ইচ্ছে’ মন্দির আক্রান্ত হয়, ৪ জুলাই, মঙ্গলবার। ৬০-৬৫ বছরের পুরাতন এই মন্দিরের বিগ্রহে আঘাত করা হয়। এই রাস্তার অদূরে গোডাউন পাড়ার লাগোয়া স্থানে হিন্দু মুসলিম মুখোমুখি বোমাবাজি করে।
৫ জুলাই, ২০১৭ বসিরহাটের পাইকপাড়া, দাঙ্গা মানচিত্রে নব সংযোজন। সকাল ১১ টার সময় পাইকপাড়ার মুসলিমরা হিন্দুদের দোকান ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে। ওইদিন দুপুর বেলায় দাঙ্গায় প্রথম বলি (এখনও পর্যন্ত একজনের মৃত্যুর ঘটনাই তথ্যায়িত হয়েছে) হন বৃদ্ধ কার্তিক চন্দ্র ঘোষ। দাঙ্গাবাজরা তাঁর মাথায় অস্ত্রের আঘাত করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় আনা হয়, কিন্তু বাঁচানো যায় না।
বসিরহাটে নারী পুরুষ নির্বিশেষে হিন্দুদের বিশাল মিছিল হয়। আক্রান্ত হয় বিধায়ক দীপেন্দু (দিব্যেন্দু) বিশ্বাসের বাড়ি। শাসক দলের পার্টি অফিস। কোর্টের মসজিদ।
দাঙ্গা মানচিত্রের অন্য জনপদ হল স্বরূপনগর থানার বেশ কয়েকটি এলাকা, যেমন রামচন্দ্রপুর। ৩ জুলাই শ্মশানের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া একটি মৃতদেহকে আটকানো হয় এখানে। তখন অবরোধ চলছিল মুসলিমদের। শবদেহ ফিরিয়ে আনা হয় তেঁতুলিয়াতে। অনুরোধ সত্ত্বেও স্বরূপনগর থানার সহযোগিতা পাওয়া যায়না। ওইদিন রাত ৯টা থেকে ৯ -৩০ নাগাদ তেঁতুলিয়াতে সন্ত্রাস, লুঠ, অগ্নি সংযোগ এবং ৩০ – ৩৫টি দোকান ভাঙচুর হয়।
বসিরহাট মহকুমার আরও কয়েকটি জনপদে দাঙ্গার বিস্তৃতি আমাদের নজরে আসে। আমাদের তথ্যানুসন্ধানের দল সকল স্থানে পৌঁছোতে পারেনি। অনেক স্থানে মানুষ মুখ খুলতে চায়নি। আবার কোথাও ব্যক্তির বয়ানে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা স্পষ্ট হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য ( কোনও কোনও ক্ষেত্রে যার সূত্র প্রকাশ ব্যক্তি নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে), বয়ান এবং ‘আমরা’-র ক্ষেত্র-গবেষণা দলের সামগ্রিক বিশ্লেষণ নির্ভর এই রিপোর্ট বা প্রতিবেদন। বলা বাহুল্য আমাদের আগের প্রকাশিত প্রতিবেদনের ন্যায় এবারেও যেসব ব্যক্তি তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চাননি, প্রতিশ্রুতি মত তাঁদের নাম রাখা হচ্ছে না। তাঁদের বক্তব্য অক্ষত থাকছে। এখানে দাঙ্গা বা সাম্প্রদায়িক হিংসা বিধ্বস্ত জনপদগুলিকে শিরোনাম করে, কথোপকথনকে সূত্র এবং ঘটনা প্রকাশের মাধ্যম করে আমাদের প্রতিবেদন রাখা হল।
মানচিত্র: বাদুরিয়া
বাদুরিয়া, যেখানে সূত্রপাত-
কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসনের স্থানীয় মুখ, ইমাম ইত্যাদির সঙ্গে। বিভিন্ন মুখ থেকে একই ঘটনার বর্ণনের ভিন্নতা বা অভিন্নতা আমাদের সামনে একটি চিত্র নির্মাণ করে।
বাদুরিয়া থানার আশপাশ-
থানার সামনে পুড়ে যাওয়া পুলিশের গাড়ির অবশেষ দেখা যায়। থানার মধ্যে এবং সংলগ্ন রাস্তায় যা রাখা ছিল। থানা সংলগ্ন একটি মিষ্টির দোকান (দিলিপ দে, লক্ষ্মী সুইটস) এবং একটি চায়ের দোকানে (সৌমেন সরকার) বিক্রেতার সঙ্গে আমরা কথা বলি। রথের দিন বিকেলে যেদিন ১০-১২ হাজার (তাদের বয়ান মোতাবেক) মুসলিম জনতার থানা ঘেরাও ও গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয় তখন তাদের দোকান বন্ধ ছিল। অদূরেই একটি বড় মন্দির দেখা যায়, যার ওপর কোন আক্রমণ হয়নি।
দিলিপ দে জানান, হাজার হাজার মানুষের মিছিল আসছে দেখেই দোকান বন্ধ করি আমরা। কী করবো বলুন, এ-তো পার্টির মিছিল নয় বা বন্ধের মিছিল! সবাই ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিচ্ছিল। আমরা দোতলা থেকে উঁকিঝুঁকি মারতেই হুমকি আসে, এই বন্ধ কর। কয়েকজন দোকানের দরজায় ভাঙা ইট মারে। যদি কোন রাগ প্রশাসনের বিরুদ্ধে থেকেও থাকে তা বলে এইভাবে থানা আক্রমণ করতে হবে।! আর, আমরা কি দোষ করলাম?
সৌমেন সরকার (চা দোকানের মালিক) বল্লেন, উল্টোরথের দিন সোমবার। সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেলো। সেদিন মিছিল করে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়েছিল। থানা অভিমুখে মিছিল। আমি এত লোক দেখে দূরে থেকেই চলে যাই। দোকান আর খুলিনি। যারা থানার ভিতর ঢুকে গিয়ে হুজ্জতি করেছিল তাদের সিসিটিভিতে ছবি উঠেছে। ওসব ছবি দেখে ভেরিফিকেসন হবে, এনকোয়ারি হবে। বিকেল বেলা, ধরুন সারে তিনটে-চারটে থেকে শুরু হয়ে লাগাতার চলেছে রাত ১০ টা ১১ টা পর্যন্ত। সব লুঙ্গি পরা, মহামেডান, হাতে মেশিনও ছিল। হিন্দুরাও তেড়ে এসেছিল, কিন্তু হলে কি হবে এধারে হিন্দু সংখ্যায় কম তো, আর আগে থাকতে পরিকল্পনা জানা থাকলে কিছু ব্যবস্থা করা যেতো। এখানকার থেকে বসিরহাটে বেশী হয়েছে শুনেছি। মন্দির ভেঙেছে, হিন্দুদের ঘর বাড়ি ভেঙেছে। তখন হিন্দুরা আবার একজোট হয়ে পাল্টা দিয়েছে। এখানকার মুসলিমদের জমায়েতের বেশীরভাগ বাইরের লোকজন, বেশীরভাগ কমবয়সী। এলাকায় ওদের দেখিনি। চেনা মুখ না। এখানে এস পি সাহেবের গাড়ি ভাঙচুর হয়। থানার ভ্যান, জিপ সব ভেঙে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তারপর রাত্রে ওরা গেছে। ওইসব দেখে দোকান খুলবো কি? পার্টির কথা বললে, বিজেপির এখানে তেমন সংগঠন নেই। দিপেন্দু বিশ্বাস বসিরহাটের এম এল এ। শোনা কথা ওই নাকি শেল্টার দিয়েছে, ওই সব করিয়েছে। হিন্দুর ছেলে হলে হবে কি, পার্টির ব্যাপার সব। খুব খারাপ জিনিষ এসব। বাদুরিয়ায় কখনও জন্মে এইসব দেখিনি। বসিরহাটে যদিও ঝামেলাটা বেশী হয়েছে। রুদ্রপুরের ছেলেটার (ফেসবুকার) বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আত্মীয়রা সব পলাতক। যদিও এর পিছনে রহস্য আছে। হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলমানের ধর্মের গায়ে হাত দেবে এত সাহস পাবে কোথায়? পিছন থেকে ওকে বলেছে কেউ, তুমি কর আমরা বুঝে নেবো। এখন সিসিটিভি দেখে তুলছে। ফোর্স রাত্রে রেইড করতে বেরুচ্ছে। তুলছে একটা একটা করে। লোকাল সোর্স হিসাবে সিভিক পুলিশতো আছেই। পেপারে দিয়েছে তো ৬১ জন ধরা পড়েছে এ পর্যন্ত। এখানে রাখেনি, সব কলকাতায় চালান দিচ্ছে। এর আগে যা ঝামেলা হয়েছে ছোটখাট, মিটে গেছে। কিন্তু এবার অনেক পরিকল্পিত। আসলে আমাদের হিন্দুদের মধ্যে একটা কাজ করতে গেলে পাঁচ বার ভেবে করি, কিন্তু ওদের তা না। হুট বলতে একেবারে থানায় জ্বালিয়ে দেবে। রুদ্রপুরের মসজিদ থেকে কিছু ঘোষণাও দিয়েছে। এখন ফোর্স আছে, কিন্তু ফোর্স চলে গেলে কি হবে কে জানে? এখনও তপ্ত এলাকা। দুই সম্প্রদায় এমনিতে শান্তিতেই থাকে, কিন্তু পরিস্থতিতে পড়লে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখছি তো! থানায় বসে পুলিশ মার খাচ্ছে, মমতা অর্ডার দিচ্ছে না। সেন্ট্রাল ফোর্স আসাতে তবে শান্তি। ১৪৪ জারি করে দিয়েছিল। এখনও ঘুরছে, একসাথে তিন-চার জন দাড়িয়ে গল্প করলেই ধরছে। আমাদের দোকান দুই-তি%E37qͤ6িন বন্ধ ছিল। বসিরহাটে হিন্দুদের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। মন্দির ভেঙেছে। হাসনাবাদ বারাসাত পর্যন্ত ঝামেলা ছড়িয়ে গিয়েছে। মোবাইলে আজকাল সব ছড়িয়ে যায়।
আমাদের মুসলিম বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলে বলে, হাঙ্গামায় কে কোথা থেকে এসেছিল তার খবর রাখিনা। তা বললে তো হবেনা। স্থানীয় লোকে কেউ না থাকলে এত বড় ঝামেলা হয়? এলাকার খবর, শেল্টার কিছু নিশ্চয় দিয়েছে। সব ম্যাটাডর, টেম্পু ভর্তি করে লোকজন এসেছে। কীভাবে এত লোক এল?
বিশ্বজিৎ পাল, সভাপতি, বিজেপি, বাদুরিয়া পৌর মণ্ডল
কথা হয় ওনার বাড়িতে। উনি আয়ুর্বেদিক ওষুধ কেনাবেচার সঙ্গে যুক্ত। আমরা যখন সেখানে গেলাম, তখন কলকাতা থেকে এক জন এসেছিলেন ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে। উনি কথা শুরু করেন, ক্যামেরার সামনে কোনও মতামত দেওয়া, মুখ দেখানো পার্টির ওপর তলা থেকে বারণ। ছেলেটি (ফেসবুকার) নির্দোষ, ওর মোবাইলটাই চুরি হয়ে গেছিল। ওর ফোনে উর্দুতে লেখা পাওয়া গেছে। শৌভিকের বাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে যখন তখন আমি পুলিশকে ফোন করি, পুলিশ যায়। কিন্তু ব্যাপক মবকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ছেলেটিকে বাড়িতে না পেয়ে উত্তেজিত জনতা রুদ্রপুর স্কুল মাঠে জমায়েত হয়। একটি মন্দির ও বিজেপি পার্টি অফিস লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে। কেউ কেউ বিজেপির ফ্ল্যাগ ছিঁড়তে থাকে। অনেকে এর মধ্যে রাজনীতি না জড়াতে চেয়ে আক্রমক অংশকে ঠেকাতে থাকে। পুলিশ সক্রিয়তা দেখালে পক্ষপাত হতে পারে, এই আশঙ্কা ছিল।
যাইহোক, জমায়েতে বসিরহাটের এস ডি পি ও, বাদুরিয়ার ও সি, পুরসভার টি এম সি’র চেয়ারম্যান, তুষার সিং ও এক মৌলানা, মতিন সাহেব যান। প্রতিশ্রুতি দেন, ফেসবুকার শৌভিককে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা হবে। এবং সত্যি তাকে ৭-৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করার পরেও পরের দিন সকাল থেকে বসিরহাট ও বাদুরিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে বাদুরিয়া থানা ঘেরাও করে। বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুর, রাস্তা অবরোধ, টায়ার জ্বালানো, পুলিশের মারধোর, গাড়ি জালানোর খবর আসতে থাকে। ‘নাড়া এ তকবীর, আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে থাকে। এতকিছুর পরেও (মোবাইলে ভিডিও দেখাতে দেখাতে) আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ‘এই ছবিগুলি এই রাজ্যের নয়, সব গুজরাটের ঘটনা’। এই যে দেখুন, লাশের ওপর আঁধলা ইট দিয়ে মারছে। লাশের পা ধরে টেনে নামিয়ে দিচ্ছে এ্যাম্বুলেন্স থেকে। তেঁতুলিয়ার ঘটনা। যার বাবা মারা গেছে, সেই বিবরণ দিচ্ছে এই ভিডিওতে। অ্যাম্বুলেন্সের কাঁচে ঢিল মেরেছে। ড্রাইভারের হাত ভেঙে দিয়েছে। বাচ্চাদের ইট লেগে মাথা ফেটেছে।
বনমালীপুরে এস পির গাড়ি আটকাল, যে এস পি ট্রান্সফার হয়ে গেলেন, ভাস্কর ব্যানার্জি, তিনি। সেখানেও তাঁকে ক্ষমা চাইয়েছে। এনায়েতপুরে রাস্তা কেটেছে। বোমা ফাটিয়েছে। তবে বাদুরিয়া দিলিপ হাই স্কুলের মাঠে ওদের জমায়েতটা ছিল থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে। এদিকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের খবর বেশি আসেনি। থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার আর ছেলেটাকে মেরে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল। বেশিরভাগ মাদ্রাসা থেকে বের হওয়া ২০-২৫ বছরের ছেলেদের ভিড়। নদীর ওপারে কিছু মসজিদে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, ‘মুসলিম ভাইরা একজায়গায় হও, মুসলিমদের ওপর অ্যাটাক চলছে’। হিন্দুদের রাত্রে আতঙ্কে ঘুম হয়নি। মোড়ে মোড়ে বোমা পড়ছে, জমায়েতে হুঙ্কার, আমি আমার ৩৫ বছরের জীবনে এসব দেখিনি।
আমাদের কাছে খবর ২০০০ লোকের নাম পুলিশের তালিকায় তুলেছে। অন্তত ১২ থেকে ১৫ টা গাড়ি পুড়েছে। থানার সামনে এস পি’র গাড়ি পুড়েছে। নবান্নে বসে যিনি রাজ্য চালাচ্ছেন তিনি বলছেন, শান্তিপূর্ণ এলাকা। আর আমরা দিলীপ ঘোষকে ফোন করে জানাতে উনি প্রেসার দিতে তবে বি এস এফ নামে। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসে। রাজ্যপাল চাপ দিতে তবে বি এস এফ রুট মার্চ করে, তবে শান্তি ফেরে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা বাদে।
আমাদের গায়ে তো বিশাল গন্ধ। রথের দিন, সামান্য রথ টানতে গেছি আমরা, বলে বিজেপি রাজনীতি করতে এসেছে। আমাদের ওপর তলা বলেছে, বেশি লাফাবে না। যা হচ্ছে হতে দাও। যে লাফাবে সে মরবে। যদিও আমরা যেখানে আমাদের সংগঠন আছে বলেছি, কোন উস্কানিমূলক কথা বলবেন না, কিছু করবেন না। তবে পাড়ার মধ্যে আর জি পার্টি তৈরি করে নিজেদের সেফটির জন্য ব্যবস্থা নিন। আমাদের সংগঠনের কিছু মুসলিম ছেলেকে ওইদিন ফোন করি, জানতে চাই তারা কোন রাস্তা অবরোধ করছে? পরিষ্কার বলল, পার্টি পরে, এসব ধর্মের ব্যাপার। বলুন তো এইসব কেউ সহ্য করবে, এত অত্যাচার?
একটা ব্যাপার, ছেলেটা কি পোস্ট করলো, আদৌ ও করেছে কিনা তার ঠিক নেই! আসলে একটা বড় রাজনীতি আছে এর পিছনে। না হলে পুলিশ এমনি ভাবে পড়ে পড়ে মার খায়?
আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে আমরা বিজেপি সরকারের সাফল্য তুলে ধরতে বাড়ি বাড়ি প্রচার চালাচ্ছি। এই তো সেদিন ১৩ নং ওয়ার্ডের একজন তৃণমূল (সৌরভ ভট্টাচার্য)থেকে আমাদের পার্টিতে যোগ দিয়েছে। এই অপরাধে তার বাড়ি পুড়িয়ে দিল। রামনবমীতে রুদ্রপুর ইস্কুল মাঠ থেকে বাদুরিয়ায় মিছিল করেছি, এই বার প্রথম। আর এস এস আর বিজেপি মিলে। পাবলিকও ছিল। সুশৃঙ্খল ভাবে। পুলিশ প্রোটেকশন নিয়ে। আমাদের তো বিজেপি করি বলে জড়িয়ে দিতে পারে। এদিকে আমাদের এখানের মাটু হাজি বলে এক তৃণমূল নেতা রিপাবলিক চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে বলে ফেলেছে, চেয়ারম্যান তুষার সিং চাইলে দাঙ্গা থামাতে পারতো, কিন্তু উনি তো গরু পাচারকারী। স্মাগলার।
এখন আপাতত পরিস্থিতি শান্ত। কিন্তু ওদের বাচ্চা বাচ্চা ছেলেদের যা অ্যাটিচুড, তাতে বি এস এফ চলে গেলে কী হবে কেউ জানেনা। হিন্দুরা তো এখানে চুপ ছিল। পরে আক্রান্ত হতে হতে আত্মরক্ষার জন্য রাস্তায় নামে। দীপেন্দু বিশ্বাস যখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দু ছেলেদের অ্যারেস্ট করাচ্ছিল, পরে ছেলেরা ক্ষেপে গিয়ে ওর ওপর চড়াও হয়। এখানে হিন্দুদের বাড়ি থেকে মহিলারা চলে গেছে আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি। ২০০০ সালের বন্যার পর এই ভয়াবহ ঘটনা দেখলাম। ‘ওরা’ আসলে খুব উগ্র, আগে মারবে, তারপর কথা শুনবে।
৩ নং ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর-
আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় ওনার বাড়িতে তখন ওনার স্ত্রী এবং দুই ছেলে উপস্থিত ছিলেন। উনি বলেন, ওরা প্রচুর লোক। দলে দলে আসছে। আমরা কজন মাত্র। তাও বৃষ্টি নামলো বলে বিশাল ওই জমায়েতটা ভেস্তে গেলো। আমাদের লাইফে এমন দেখিনি। ঝামেলা হলে তো আর পাশে কেউ থাকেনা। ওরা পুলিশকেও তো মানেনি।
এই ওয়ার্ডে ৩৪০০ ভোটারের মধ্যে প্রায় ১০০০ মুসলিম। এই পাড়ায় মাত্র দুই ঘর মুসলিম। একবার তাই গরু কাটার প্রতিবাদ করাতে বাইরে থেকে লোক এসেছিল। এখন তো রাস্তার সাইডে সাইডে সব উঠে এসেছে। আগে একটু ভিতরের দিকে কাটতো। বাদুরিয়া বিধানসভায় ভাগটা হল ৬৭% হিন্দু, ৩৩% মুসলিম। বসিরহাট লোকসভা ধরলে আমরা ৫২%, ওরা ৪৮%। বাদুরিয়া বিধানসভায় বিজেপি থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন দেবিকা মুখার্জি, সিনেমা আর্টিস্ট। ভোটের সময় আমাদের বাড়িতে একমাস ছিলেন। হেরে গেলেন। আমাদের এদিকের লোকে ভোট দিয়েছে, কিন্তু চণ্ডীপুর সাইডের লোকে বেইমানি করেছে। সব টাকায় ভোট বিক্রি হয়েছে। রাজনাথ সিং মিটিং করে গেছেন এই মাঠে। এখানে বিজেপির কোন প্রোগ্রাম নেওয়া হলে প্রশাসন অনুমতি দেয় না। বাবুল সুপ্রিয়র মিটিঙেও পুলিশ অনুমতি দেয়নি। আমাদের এই তিন নম্বর ওয়ার্ডের ছেলেদের নিয়েই বাদুরিয়ায় বিজেপির জোর।
আমি তো দাঁড়াতে চাইনি ভোটে, ছেলেরা জোর করে দাঁড়িয়ে দিল। ফেসবুকে না এলে বাদুরিয়ার ঘটনা চেপে যেত। কিন্তু যারা ঝামেলা করেছে, টায়ার পোড়াচ্ছে তারাও ফেসবুকে ছবি তুলে ছেড়ে দিচ্ছে। সব বলছে গুঁড়িয়ে দে। ভারত পাকিস্তানের খেলা হয়েছে, পাকিস্তানের হয়ে বাজি ফাটিয়েছে, ইদের সময় ৩-৪ জায়গায় পাকিস্তানের চাঁদ তারা পতাকা টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। সেন্ট্রালে বিজেপি না থাকলে ফোর্সও নামতো না, আমরা সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতাম। এম পি ইদ্রিস আলি আবার মুসলিমদের বলেছেন, আপনারা আন্দোলন করছেন, মমতার সরকার কি আপনাদের গায়ে হাত দিয়েছে? দেগঙ্গায় বেড়াচাঁপা মোড়ে দাঁড়িয়ে বলছেন। একটা মহারাজাকে এনেছিল রামকৃষ্ণ মিশনের, সর্বধর্ম সমন্বয়ের জন্য। মুসলিমরা তাঁকে গালিগালাজ করে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছে। এখানে কংগ্রেস সিপিএম জোট করে এম এল এ সিট পেয়েছে। এখন যা পরিস্থিতি, এখন ভোট হলে পুরসভায় ক্ষমতায় চলে আসবো আমরা বিজেপি। এখন সব ভোল পাল্টে গিয়েছে।
মাগুরখালি-
আমরা প্রথম দফায় যখন মাগুরখালি যাই, ফেসবুক কাণ্ডে অভিযুক্ত শৌভিকের বাড়ির ছবি নিই, সামনে ও পিছন থেকে। বাড়িতে কেউ নেই, ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগের চিহ্ন বর্তমান। প্রতিবেশী মাস্টার সইদুল ইসলামের বাড়ি যাই কথা বলতে। উনি কথা বলতে চাননি। আমাদের দরজা থেকেই ফিরিয়ে দেন। আমাদের সঙ্গে ছিলেন সালাউদ্দিন, কাছেই ওনার ফার্নিচারের দোকান। উনি বলেন, যেদিন ফেসবুকারের জেঠুর বাড়ি আক্রান্ত হয় সেদিন গ্রামের কেউ এই কাজে যুক্ত ছিল না। সব বাইরের লোক।
সুভাষ মণ্ডল-
অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী। উনি বলেন ঘটনার সময়েই তাঁরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। কয়েকদিন দিনে ফিরে এলেও রাত্রে গ্রামে থাকার রিস্ক নিতে পারেননি। দুইদিন হল তাঁরা গ্রামে থাকছেন। শৌভিক প্রসঙ্গে ওনার বক্তব্য, ‘ছেলেটা এই কাজ করতে পারে বলে মনে হয়না। ছোটবেলায় মা’কে হারিয়েছে, ওর বাবা খেতমজুর, জ্যাঠার বাড়িতে থাকে, পড়াশুনা করার জন্য। ওর জ্যেঠা আর কাকা (এস আই)পুলিশে চাকরি করে।
সুভাষবাবু বলেন, সেদিনের আক্রমণে গ্রামের কারুর মদত থাকতে পারে। কেননা সবাই বাইরের হলে কে বাবলু সরকারের বাড়ি চিনিয়ে দিল? আগে কখনও এই রকম হয়নি। তবে দিন দিন মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে। ঐ মসজিদটা আমাদের দাদুর জমির ওপরে। আমার মামারা এখনও খাজনা দিয়ে যাচ্ছে। সেদিন এবং পরে ক্লাবের ছেলেরা রেসকিউ করেছে। ক্লাবটি বাঙালি হিন্দুদের ক্লাব। বাঙাল পাড়ার লোকেরা বদলা নেবার প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝামেলা আর হয়না।
দেবদাস, মুদির দোকান, মাগুরখালি
আমরা যখন কথা বলি তখন প্রায় সন্ধ্যা। বৃদ্ধ মানুষটি কথা শুরু করেন, দোকান বন্ধই রেখেছিলাম। ওরে বাবা, শাসিয়ে গেলো, কী করবো? আমাকে বলছে তুমি বসে বসে রঙ্গ করছো? আমি একটা পাল্লা কোন রকমে খুলে রেখেছিলাম। সব অচেনা মুখ। চল্লিশ-পঞ্চাশ জন হবে। ৮ টা সাড়ে ৮ টার সময় হামলা করতে করতে সব গেলো। রবিবারে হল তো এটা সোমবারের ঘটনা। ওই হল্লা, বাচ্চাটাকে চাই। ছেলেটাকে চিনি, খুব ভালো ছেলে। সাতে নেই পাঁচে নেই, সবে এগারো ক্লাসে উঠেছে। আমার বয়স হয়েছে, ওইসব ঝামেলায় কে যাবে।
আমি ৩৫ বছর এখানে এসেছি। এইরকম ঘটনা আগে দেখিনি। এর আগে আমার বাড়ি ছিল বসিরহাটের খোলাপোতায়।
এই গ্রামের ভিতরপানে বেশিরভাগ লোক বাঙাল। ওই ছেলেটা মাতৃহারা। ওর যখন তিন-চার মাস তখন ওর মা মারা যায়। ওর ওই জ্যাঠামশাই ওকে কোনরকমে মানুষ করেছেন। জ্যাঠামশাইয়ের কপালে যত ঝামেলা। বাবা জন মজুরি খাটে। জ্যাঠামশাই সার্ভিস করেন। বাবা তো দুদিন কাজ পায় তো দুইদিন পায়না। ছেলেটা সত্যি খুব ভালো। সপ্তাহ-খানেক আগে ছেলেটির মোবাইল হারিয়ে যায়। থানায় ডায়েরি করেও রেখেছিল। ও একাজ করেনি। এর পিছনে লোক আছে।
মাগুরখালি মিলন মসজিদের ইমাম-
ইমাম মৌলনা ইয়াসিন সাহেবের সঙ্গে কথা হয়। ওনার সম্মতিতে কিছু ভিডিও নেওয়া হয়। মসজিদটি বাবলু সরকারের বাড়ির গায়েই। ইমাম সাহেব জানান, তিনি নিজে এই উগ্র ও বিক্ষুব্ধ মুসলিমদের থামতে বলেন। উনি বোঝান, অভিযুক্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। তিনি বিক্ষোভকারীদের এও বলেন যে, “আমরা অভিযুক্তের নিন্দা করছি।’ তবুও বিক্ষোভকারীরা তাঁর কথা না শুনে বলতে থাকে, হিন্দুদের দোকানপাট ভেঙে দেবে। ইমাম সাহেব জানান, বহিরাগতরা এসে এই ভাঙচুর করেছে। তিনি জানান, ৬০-৬৫ বছরের প্রবীণ একজন মুসলিম তাঁর কাছে জানতে চান বাবলু সরকারের বাড়ি কোনটি। তিনি ভাল মনে দেখিয়ে দেন, তারপর কিছু ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি গিয়ে দেখেন সেই প্রবীন ব্যক্তিই যিনি পাঁচবার নামাজ পড়েন, তিনিই বাবলু সরকারের বাড়ির জানলার কাঁচে ইট ছুড়ে ভাঙছেন। ইমাম সাহেব প্রতিবাদ করায় তিনি হটে যান। আমরা ইমাম সাহেবকে প্রশ্ন করি, উনি কীভাবে জানলেন ওই ব্যক্তি পাঁচবার নামাজ পড়েন, উনি কি তাঁকে চেনেন? উনি বলেন, না ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা, ওনার লেবাস দেখে তাই মনে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বুঝেছি যে, এই ঘটনার সু্যোগ নিতে চাইছে একদল সমাজ বিরোধী যাদের মূল লক্ষ্য লুঠতরাজ।
উনি বলেন, মাগুরখালির ঘটনার আগের দিন, যেদিন রাস্তা অবরোধ করে মুসলিম জনতা, সেদিন কারও কথায় অবরোধকারীরা কর্ণপাত করেনি। পুলিশ সুপার এসেও হিন্দু ছেলেটির হয়ে ক্ষমা চান। বলেন, আমি হিন্দু পরিবারের ছেলে হয়ে ঐ ছেলেটির কাজের জন্য ক্ষমা চাইছি। শেষ পর্যন্ত মীযান পত্রিকার সম্পাদক এসে জনতাকে শান্ত করেন। উনি বলেন, আমি সাংসদের (ইদ্রিস আলি) সঙ্গে কথা বলেছি, আজ রাত্রের মধ্যেই ছেলেটি গ্রেফতার হবে, আপনারা আমার কথা মত চলে যান, অবরোধ উঠিয়ে নিন। তা না হলে আপনারা যা চান তাই হবে।
সেই রাত্রেই শৌভিক গ্রেফতার হয়। পুলিশ ওর জেঠুকে তুলে নিয়ে আসে, পরে শৌভিককে। শৌভিককে ছোট থেকে দেখছি। খুব মুখচোরা ছেলে। কেউ ওকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে বলেই মনে হয়। আমাকে দেখলে মাথা নিচু করেই যায়। পুলিশের উচিত পিছনের মাথা কে বা কারা ছিল তা তদন্ত করে দেখা। এই ঘটনার পর আমি তিনদিন চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে যেতে পারিনি। সকলেই বলছিলেন, কেন আসেননি? কী বলি বলুন, এতদিন আমরা একসাথে আছি, কোনদিন কিছু হয়নি।
সব বাইরের লোকজন এসেছিল। কেউ চেনা মুখ নয়। তবে বাংলাদেশ থেকে এসেছিল কিনা বলতে পারবো না। এখানের বাঙাল পাড়াতে বদলা নেবার কথা শুনেছিলাম, সেরকম হলে পরিস্থিতি ভয়ানক হতে পারতো। হিন্দুদের ধন্যবাদ দিতে হয় তারা ক্ষোভ সম্বরণ করে।
স্থানীয় প্রশাসন-
বাদুরিয়া থানার অফিসার ইন চার্জ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর অক্ষমতা জানান। আমরা জানতে চাই বাদুরিয়া দাঙ্গায় কতজন গ্রেফতার হয়েছেন। থানা আক্রমণের সময় থানার ভূমিকা কী ছিল। যা বলবার জেলার পুলিশ সুপার বা মহকুমা পুলিশ অফিসার বলবেন, এই উত্তর আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন সিভিক পুলিশ বলেন, চরম আতঙ্কে ছিলাম আমরা। আমরা এখন যেকোন ঘটনা-দুর্ঘটনার প্রথম টার্গেট। কিছু ঘটনা ঘটলে বলা হয়, আমরা কিছু করিনি কেন। এই যেদিন ফুটবল মাঠে জমায়েত হল, রাস্তা অবরোধ হল, আমরা জানালাম থানায়। আমরা আর কী করতাম?
আমরা- ফোর্স এলো?
সিভিক পুলিশ- এলো, অন্য থানা থেকেও এলো। কিন্তু কী করবে, ওপর থেকে যদি বারণ করা থাকে?
আমরা- বারণ করা মানে কি অ্যাকশন না করা?
সিভিক পুলিশ- অ্যাকশন! ওদের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে! না হলে স্বয়ং পুলিশ সুপার এসে ক্ষমা চেয়েও কিছু হেলাতে পারলেন?
আমরা- ক্ষমা চাইলেন কেন?
সিভিক পুলিশ- যেহেতু উনি হিন্দু। আর ফেসবুক করা ছেলেটাও হিন্দু কিনা।
আমরা- এই ঝামেলার সময় আপনাদের মানসিক অবস্থা বুঝতে চাই।
সিভিক পুলিশ- ভয়ে ছিলাম আমরা। হাতে না আছে অস্ত্র, না আছে পাওয়ার। আর ওদের সবার হাতেই অস্ত্র।
আমরা- কী অস্ত্র ছিল?
সিভিক পুলিশ- সবরকম অস্ত্রই ছিল। দা, তলোয়ার, মেশিন কি নেই? সবাই তো ওই বড় জোর ১৩-১৫ বছরের ছেলে।
আমরা- আপনারা বিভিন্ন গ্রাম বা এলাকা থেকে সিভিক পুলিশে চাকরি পেয়েছেন, চিনতে পেরেছেন?
সিভিক পুলিশ- না চিনলে ধরা পড়ছে কী করে?
আমরা- সেতো সিসিটিভি দেখে শুনেছি।
সিভিক পুলিশ- ঠিক, কিন্তু কে কোথায় থাকে বুঝবে কী করে?
আমরা- অত কম বয়সের ছেলেরা কেন?
সিভিক পুলিশ- বেশিরভাগ মাদ্রাসার ছেলে। ক্লাব-করা ছেলে।
আমরা- ‘ক্লাব-করা’ মানে?
সিভিক পুলিশ- এখন তো সব গ্রামেই দুই-তিনখানা ক্লাব। কাজ কি আছে? টিভি দেখা, তাস ক্যারাম খেলা ছাড়া। আর ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করা। এদের খ্যাপানো সহজ।
আমরা- রোজগার?
সিভিক পুলিশ- এখানের বেশীরভাগ গ্রামে কমবয়সের ছেলেরা কাজ করতে গুজরাত দিল্লী কেরালা মহারাষ্ট্র যায়। হাতে কাঁচা পয়সা। সত্যি বলতে কি এইসব বাইরে যাওয়া ছেলে আর মাদ্রাসার ছেলেরাই বেশি ছিল মিছিলে। মাঝবয়সী কয়েকজন ছিল, তাই নাহলে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারতো। ওরা ক্ষেপে ছিল। বলছিল শৌভিকের মুণ্ডু চাই।
আমরা- কারা ক্ষেপিয়েছিল বলে মনে হয়।
সিভিক পুলিশ- অনেক মসজিদে ইমামরা ফেসবুক পোস্ট নিয়ে নামাজীদের অবগত করায়। মসজিদে মসজিদে যোগ আছে। সবাই জেনে যায়। জলসায় যেসব মেহমান আসে তারাও বলে, নবীর অপমান কোন মুসলমান সইবে না। আমরা ডিউটি দিতে গিয়ে শুনেছি কতবার।
আমরা- জলসায় তো অনেক কেষ্টবিষ্টু আসেন।
সিভিক পুলিশ- আসেনতো। ‘পিস টি ভি-খ্যাত বক্তা’ এইসব পোস্টার লাগানো হত। আর ওই কী সব খবরকাগজের লোকজন। মুসলমানদের কাগজ আছে-না? বাদুরিয়ায় প্রথমদিন এমনই একজন আসাতে সবাই শান্ত হল। না-হলে তৃণমূলের নেতাই হোক আর এস পি, মুসলমানরা কারও কথাই শুনছিল না।
আমরা- কিন্তু শৌভিকের গ্রামের ইমাম সাহেব, খুব সজ্জন ব্যক্তি বলে মনে হয়।
সিভিক পুলিশ- সবাই কি একরকম হয়। ওই মিছিলেও কয়েকজন ভালো লোক ছিল, না হলে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারতো।
মহকুমা পুলিশ প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আধিকারিক, বসিরহাট
প্রথম আলাপেই বোঝা গেলো, বেশ কর্মঠ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী অফিসার উনি। বছর সাইত্রিশের এই অফিসারের সঙ্গে যখন কথা বলি, উনি তখন স্থানীয় এক ইস্কুলের শিক্ষকের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট এলাকার ইস্কুলগুলোতে জাতীয় সংহতি ও জাতীয় সুরক্ষা এইরকম কিছু বিষয়ে জোর দিয়ে কুইজ কম্পিটিশান বা তাৎক্ষণিক বক্তৃতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করাতে ব্যস্ত ছিলেন। এই ধরনের উদ্যোগে তার পরিচিতি বাড়বে এবং পেশাগত জায়গায় উপরে উঠতে সুবিধা হবে, স্পষ্টতই সেইরকম ইঙ্গিত দিলেন।
প্রথমেই বারে বারে বুঝিয়ে দেন, আমাদের পরিচয় ভালোভাবে বুঝে না নিয়ে উনি কথা বলবেন না। আমাদের কি আর এস এস-এর সঙ্গে কোন যোগাযোগ আছে? আমরা কি প্রো বা অ্যান্টি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করি, উনি বিশেষভাবে এই দু’টি প্রশ্ন রাখেন। ধুলাগড় বা চন্দননগরে আমরা কাজ করেছি শুনে জানতে চাইলেন ওখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের ফাইন্ডিংস। এটাও বললেন যে কাজ করার সময় ওনার জুরিসডিক্সানে কোনও অসুবিধায় পড়লে আমাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যও আমাদের আইডেন্টিটি জানা দরকার। কেন এই সাম্প্রদায়িক হিংসা এই এলাকায় ঘটল তার উত্তরে বলেন, স্পনটেনিউয়াস ঘটনা। ফেসবুকের একটা পোস্টকে ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়। এর বেশি কেন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, সেটা বোঝা, খুঁজে বের করা কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের ইন্টেলিজেন্স-এর কাজ। হোয়াই দে আর ফেইল্ড? আমি ইউনিফর্মড পুলিশ অফিসার. আমার কাজ ঘটনা ঘটলে বা ঘটে যাওয়ার পর তা সামলানো। আমাকে ফিল্ডে দাঁড়িয়ে ইট খেতে হবে, বোমা খেতে হবে। খেয়েওছি। বুকে ইট লেগেছে। কিন্তু উত্তেজনা থামিয়েছি। কেন ঘটেছে সেটা গল্পের খাতিরেই আপনাদের আমি বলবো কেন, যতক্ষণ না আমরা কোনও ফাইন্যাল কনক্লুসন- এ আসতে পারছি?
চাকরি জীবনে এই রকম ঘটনা সামলেছি। মহরমের দুদিন আগে থেকে আমাদের রাত জাগতে হতো। কসমোপলিটন এলাকা, টেনশন থাকে খুব। তবে এখানে ব্যপকতা ছিল অনেক বেশি।
আমরা- এই এলাকায় জনসংখ্যায় হিন্দু মুসলমান অনুপাত কি রকম?
পুলিশ আধিকারিক- বসিরহাট শহর হিন্দু প্রধান। আশপাশ মুসলিম অধ্যুষিত। টাকির ক্ষেত্রেও তাই। তবে সকলেই বাঙালি মুসলমান।
আমরা- ‘বহিরাগতরা’ যুক্ত এমন খবর শুনছি, কিছু কি বলতে পারেন?
পুলিশ আধিকারিক- ওটা আমি বলবনা, ওটা আই বি’র কাজ খুঁজে বের করা।
আমরা- কোন পজিটিভ উদাহরণ, যেখানে মানুষ এগিয়ে এসে দাঙ্গা থামানোর উদ্যোগ নিয়েছে?
পুলিশ আধিকারিক- আমি নিজেই ‘মায়ের আশীর্বাদ’ না কি যেন একটা মন্দিরে ভাঙচুরের পর, মেরামতের উদ্যোগ নিয়েছি। ওটা আমার দায়িত্ব বলে মনে করেছি, তাই করেছি। তারপর বসিরহাটের একটা মুসলিম পাড়া গার্ড দিয়ে রেখেছিল হিন্দুরা। এমন কিছু ঘটনা শুনেছি। দেখুন শান্তি শান্তি করে চেঁচালেই তো নরমালসি ফিরে আসবে না। সাধারণ মানুষের বেশিরভাগ ঝুটঝামেলা চায়না। তারা রেগুলার লাইফ, কাজ কর্ম করতে থাকলেই নরমালসি ফিরে আসবে। আমরা প্রশাসনিকভাবেও কিছু টেকনিক্যাল স্টেপ নিয়েছি। সবতো আপনাদের কাছে ডিসক্লোজ করতে পারবো না। যেমন, প্রথমেই ভিসুয়াল এফেক্ট আছে যার, রাস্তায় টায়ার পোরানো বা ভাঙচুরের চিহ্ন, এগুলি চোখের সামনে থাকলে উত্তেজনা জিইয়ে থাকবে, তাই এগুলি আগে সরাতে হয়। লোকাল থানা, মিউনিসিপ্যালিটিকে কাজে লাগিয়েছি। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। ১০০র বেশি গ্রেফতার করা হয়েছে। ভীড় খালি করা হয়েছে। যারা অ্যাকশনে সরাসরি আইডেন্টিফাইয়েড তাদের এখনই জামিন পাওয়া অসম্ভব। পোস্ট ইন্সিডেন্ট পর্যায়ে দাঙ্গাবাজদেরকে আইডেন্টিফাই করে বেছে বেছে আমরা এখনও ধরপাকড় চালাচ্ছি।
আমরা- আর বহিরাগত’রা বাংলাদেশ থেকে এসে দাঙ্গা করে গেছে যেটা মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন।
পুলিশ আধিকারিক- ওটা ওনার কাছে আই বি রিপোর্ট আছে বলেই বলেছেন, ওটা আমার বলার বিষয় নয়। আমি বরং যে বিষয়টাই আপনাদের নজর দিতে বলবো বা তুলে ধরতে বলব সেটা হচ্ছে, এখানে এই এতটা এলাকা জুড়ে খোলা বর্ডার। ৪৭-এর পর আজও এখানে বর্ডার সুরক্ষিত হলনা, এটাই সব সমস্যার কারণ। প্লিজ আমাকে কোট করবেননা। আমার অসুবিধা হয়ে যাবে। আমি এমনই বলছি। এস ডি পি ও হিসাবে বলছিনা। ইনফিলট্রেশান তো আছেই। হয়তো লোকাল গুন্ডা মস্তানরা ইনভল্ভড হচ্ছে অ্যাকশনে। কিন্তু কারা করাচ্ছে। এখানে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত। এখানে লোকের কালচার নেই, টাকা আছে। অনেক ইজি মানি ছড়ানো হচ্ছে। কারা টাকা ছড়ায়? এত ইজি মানি আসছে কোথা থেকে। সেই বর্ডার প্রশ্ন জড়িত। এখানে কিন্তু জুয়া, সাট্টা থেকে টাকা ওড়েনা। একটা মৌলবাদী অ্যাকশন সংগঠিত করার জন্য লুম্পেনদের জড়ো করা, বোমা অস্ত্র জোগানো-এসবের টাকা কোত্থেকে আসছে? সবাই ভুল দিকে দৌড়চ্ছে। শুধু কমিউন্যাল অ্যাঙ্গেল ধরে ভাববেন না। বর্ডার সমস্যটাকেও আপনারা এজেন্ডা করুন। জাতীয় নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। এখানে হিন্দু-মুসলিম মব মুখোমুখি দাঙ্গা হয়েছে কোথাও দেখান দেখি? বসিরহাট-বাদুরিয়ায় হয়নি, যা হয়েছে তা প্রশাসনের সঙ্গে। ওই দিনের ঘটনা, পিপা থেকে যে মব আসছিল, কার্তিক ঘোষের ঘটনা যখন হল, ফজলুল বলে একজনের দাড়ি উড়ে গেলো- তখনওতো প্রশাসনের সঙ্গেই কমব্যাট হয়েছে। বাদুরিয়া-কেওটশার দিকেও তাই। হিন্দুদের সঙ্গে ট্যাসেল হয়েছে, যা হয়েছে তা প্রশাসনের সঙ্গে। স্বরূপনগরের একটি জায়গায় দুপক্ষ মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। তাও প্রশাসন সামলে দিয়েছে। ওখানে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেলে সবচেয়ে বেশি ম্যাসাকার হতে পারতো। বলুন তো এখানে কটা প্রাণহানি হয়েছে? পুলিশ কিন্তু অনেক আহত হয়েছে। আমি নিজে বুকে ইট খেয়েছি। তিনটে ইঞ্জেক্সান নিয়ে আবার ফিল্ডে নেমে গেছি।
আমরা- আপনাদের দিক থেকে ফারদার কি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে?
পুলিশ আধিকারিক- এলাকায় এলাকায় এখনও ৭-১০ টা ক্যাম্প আছে। কিন্তু আমরা কোথাও শান্তি মিছিল-টিছিল করাইনি। কোনও রাখী বন্ধন অনুষ্ঠানে যাইনি। এই কারণেই পরিনি যে আজ আমাকে রাখী পড়াবে, কাল সোর্স মারফৎ খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করতে গেলে সে সুযোগ নেবে। যে দাঙ্গায় পারটিসিপেট করেছে সেও এসে শান্তি মিছিলে হাঁটবে, হেঁটেছে। আমরা আমাদের তদন্তের কাজ করেছি। দোষীরা ধরা পড়বেই। আমার নাম আপনারা কোথাও কোট করবেন না।
আমি নিজে অন্যজেলায় পোস্ট থাকার সময় একটা রিসার্চের কথা ভেবেছিলাম। পরে অন্য কারণে আর এগুইনি। আমার একদিকে মনে হয়, রিসার্চের দরকার আছে, এই ধরনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, আবার অন্য দিকে মনে হয় এই যে সব আকাদেমিক রিসার্চ হয়, এসব করে কিছু লাভ হয়না। তবে আমার কাছে যা শুনলেন, সরাসরি সেটা না বলে ঘুরিয়ে বললে ভালো, যে পুলিশি সুত্রে খবর পেয়েছি।
আমরা- আর কোনও রেফারেন্সে যারা দাঙ্গা থামাতে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
পুলিশ আধিকারিক- আপনারা ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অসিত মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে আমি রেফার করেছি বলবেন না। দেখুন, আপনাদের একটু বলি, বসিরহাটে ৪/৫ তারিখে মূলত মুসলিম ফোর্স আক্রমণ করে, ৬ তারিখ হিন্দুরা নামে, কিন্তু মুখোমুখি হয়নি। ত্রিমোহনীতে একজনের সাথে কথা বলতে পারেন, যে আগ্রেসিভ মবকে সরাতে, রাস্তা থেকে ঘরে ঢোকাতে সাহায্য করেছে। সেই সময় লোকাল এম এল এ’র ভূমিকা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। যদিও উনি এর আগে আমাদের সঙ্গে বেশ সহযোগিতা করেছেন। আর ওনার বাড়ি ভাঙচুরের ব্যাপারটা হয়তো কিছু পুরানো রাগ মেটানোর জন্য হতে পারে।
আমরা- কী মনে হয় আপনার, নতুন করে আবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে?
পুলিশ আধিকারিক- মনে হয় না, কিন্তু গ্যারান্টি দিতে পারবো না। তবে একটা দিক আমি আপনাদের খুঁজে দেখতে বলবো, যে দুইদিন কেন মুসলিমরা রাস্তায় নামলো? ভাঙচুর আগুন লাগানো এসব চললো? তারপরের দুদিন আবার হিন্দুরা নামলো পথে। কেন দুইদিন পরে নামলো? তবে আবারও আমি বর্ডার সমস্যাকে জোর দিতে বলবো। যদি ‘বহিরাগত’ ব্যাপারটা সত্যি হয়ে থাকে তাহলেও তো বর্ডার ছিল বলেই ঢুকতে পেরেছে। তাইনা? কাঁটাতার না থাকলে কি করবে বি এস এফ? আর বি এস এফ কি ধোয়া তুলসি পাতা? এখানে তো বি এস এফরা চাকরির একটা টার্ম রিওয়ার্ড পোস্টিং হিসাবে পায়। প্রায় ২০০ কিমি দীর্ঘ বর্ডার এখানে অরক্ষিত। যাইহোক আমাকে কিন্তু কোথাও কোট করবেননা, আবারও বললাম।
মানচিত্র: বসিরহাট
ত্রিমোহনী
ত্রিমোহিনীতে একজন মুসলিম যুবকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। সামনেই ক্ষতিগ্রস্ত মুদির দোকান, স্বপন পালের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি বলেন, দুইদিন ভাঙচুর হয়েছে। পরের দিন ময়লাখোলা, ট্যাঁটরা দিক থেকে মুসলিম যুবকেরা বড় জমায়েত নিয়ে আসে। ওরা ভাঙচুর করেনি। ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিতে দিতে আসে। আমরা বলি তোমরা তোমাদের এলাকায় চলে যাও। ওরা চলে যায়। ওরা একটা কুশপুতুল পোড়ায়, ছেলেটার ফাঁসি দাবি করে। আমাদের জিজ্ঞেস করে, তোমাদের এলাকায় কাল রাত্রে ঝামেলা হয়েছে, আমরা কি থাকবো? আমরা বলি, না না, রাত্রের ঝামেলা রাত্রেই মিটে গেছে, তোমরা চলে যাও। ওরা যাওয়ার সময় মাদ্রাসার ওখানে একটি হিন্দুর দোকান ভাঙতে চাইলে স্থানীয় লোকেরা ভাঙতে দেয়নি। তার কিছু পরে, আশেপাশের হিন্দুরা আবার ভাঙচুর শুরু করলো। দশটা এগারটা থেকে বিকেল সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ভাঙচুর চালালো। এটা রথের পরের দিন। এলাকার কিছু হিন্দু লোকের মদত না থাকলে এটা হতোনা। এই পাশের ‘ত্বহা কার ওয়ার্ল্ড’ দোকানটা ভাঙচুর করলো। একটা পুরনো ন্যানো গাড়ি ভাঙচুর করলো। দুটো আই টোয়েন্টি গাড়িতে আগুন লাগালো। আমরা প্রতিরোধ করাতে আমাদের দিকে পাথর ছুড়তে লাগলো। দুই পক্ষেরই কিছু মানুষ আহত হল। আমাদের পাড়ার কিছু মানুষও আহত হয়েছে, যদিও এখন এই গণ্ডগোলের সময় বলা মুস্কিল কারা কারা আহত হয়েছে। তখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত সবাই। দুদিন এমন ছিল কী বলবো! এত বিভীষিকা, এত লোক যে পুলিশ থেকেও ভয় পাচ্ছিল! আগুনের গোলা ছুড়তে লাগলো, আনোয়ার হোসেনের গাড়িতে আগুন লাগলো। টিভিএস-এর শোরুমে ভাঙচুর হোল। ওটার মালিক হাজি নুরুল ইসলাম। ওরা (হিন্দুরা) ন্যাপলা, তলোয়ার, টাঙ্গি এসব অস্ত্র নিয়ে এসেছিল। পুলিশ পাশে দাঁড়িয়ে, কিন্তু ভয়ে কিছুই করছেনা। মেশিনও শো করছিল। যদিও গুলি চালায়নি। শেষে বাড়ির মহিলারা এসে পুলিশকে গালাগালি করাতে পুলিশ একটু এগিয়ে এলো। তাও আমাদের পিছনে। আমরা সামনে এগুচ্ছি, পুলিশ পিছনে।
এরপর আমরা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওদের কালীবাড়ি পার করে দিয়ে আসলাম। আমরা জানি, আশেপাশের হিন্দুরা আমাদের ভয় করে। কেননা ওরা পুলিশকে সাথে নিয়ে বরাবরই আমাদের ওপর অত্যাচার করে এসেছে। কোন থানা কোন অফিসার সব আমরা নাম করে বলে দিতে পারি, যারা এইসবে মদত দিয়েছে। এই তো ভট্টাচার্য বলে একটা অফিসার, এইভাবে দুইহাত দিয়ে আমাদের আটকে রেখেছিল। ‘তোরা কিচ্ছু বলিস না’। প্রায় ১৫-২০ বছর আগের একটি ঘটনা। তারপর থেকে আর সেইরকম ঘটেনি। আস্তে আস্তে এলাকা শান্তিপূর্ণ হয়ে গেছে। সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গেছে, কেননা ব্যবসায়িক স্থান তো? সবাইকে পাশাপাশি করে খেতে হয়। এই তো পাম্পের সামনের পাড়ার সঙ্গে আগে কতবার ঝামেলা হয়েছে, কিন্তু এখন এখানের মানুষ কাজ, ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝেনা।
স্বপন পাল, এলাকার পুরাতন মুদির দোকান। উল্টোরথের দিন ত্রিমোহিনী এলাকায় যতগুলি দোকান আক্রান্ত হয় ওনার দোকান তার অন্যতম। ওনার কথায় অভিমান ঝড়ে পড়ে। আমরা যে সময় কথা বলি সেইসময় তিনি দোকান মেরামত করছিলেন। আমরা যখন একমাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় বার তাঁর সঙ্গে দেখা করি তখন দোকান মেরামত করে তিনি আবার ব্যবসা শুরু করেছেন। ঘটনার রাত্রিতে তিনি বাড়িতে ছিলেন, বাড়ি থেকেই উনি দোকান ভাঙচুরের আওয়াজ পান। উনি বলেন, একজন মুসলিম মৎস্য ব্যবসায়ী দাঙ্গার পর দোকান বসাতে খরচ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি নিতে অস্বীকার করি।উনি আরও বলেন, আমি আর আমার স্ত্রী, এই হল আমাদের ছোট পরিবার। সে এক দিন গেছে সেদিন। কোথা থেকে যে হাজার হাজার মুসলিম জমায়েত হল!
আমরা কথোপকথন শুরু করি।
আমরা- আপনি তো স্পটে ছিলেন না, জমায়েতে কি অধিকাংশ বাইরের মুখ?
স্বপন পাল- স্পটে থাকবো কী করে, ওই উত্তেজিত জনতার সামনে পড়লে আমার অবস্থাও কার্তিক ঘোষ (দাঙ্গায় নিহত)-এর মত হত। তবে সব বাইরের মুখ নয়। স্থানীয় না থাকলে আমার বা অন্য হিন্দুদের দোকান চিনবে কি করে?
আমরা- আপনার সামনের বাড়ির এক ব্যক্তি বললেন, হিন্দুরাও প্রতিআক্রমণ করেছে। ত্রিমোহিনী এলাকায় মুসলিমদের ক্ষতি হয়েছে কি?
স্বপন পাল- না এখানে বাকি যে দোকানগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলি হিন্দুদেরই। তবে ফাল্গুনী সিনেমা হলের আশেপাশে মুসলিম দোকান আক্রান্ত হয়।
আমরা- এর আগে কখনও কি এইরকম পরিস্থিতি হয়েছে?
স্বপন পাল- না এইরকম কখনও হয়নি। তবে এবারের ঘটনার পর আমার আস্থা চলে গেছে। আমার দোকানের খদ্দের বেশিরভাগ মুসলিম, কেননা এই এলাকাটা মুসলিম বহুল। আমাকে দাদা বলে, কাকা বলে। কিন্তু বাস্তবতা হল এদের অনেকেই দোকান লুঠে বাধা দেয়নি। আমাকে যারা দাঙ্গার পর সাহায্য করতে এসেছে তাঁদের বলেছি, সেদিন যদি সকলে মিলে প্রতিরোধ করতে তাহলে আমাকে সাহায্যের কথা বলতে হত না। আমার কয়েক লক্ষ টাকার সামগ্রী লুঠ হতনা। তোমাদের সাহায্য আমার চাইনা।
আমরা- প্রশাসনের কোন সাহায্য কি এসেছে?
এর উত্তরে আমাদের প্রথম সফরে স্বপনবাবু বলেন, প্রশাসনের কেউ এখনও আসেনি। কিন্তু দ্বিতীয় বারের সাক্ষাতে ওনার কথায় প্রশাসনের এবং বিধায়কের আর্থিক সাহায্য বা ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতির বিষয় উঠে আসে। বলেন, বিধায়কের সঙ্গে ওনার সাক্ষাতের কথা। দেখি বিধায়ক কী করেন, এই ছিল তাঁর উক্তি।
মাছের পাইকারি আড়ত-
বসিরহাট ত্রিমোহিনী মোড় থেকে সামান্য দক্ষিণ দিকে এগোলেই চোখে পড়বে মাছের পাইকারি আড়ত। আড়তের উল্টোদিকের ফুটপাতে বসে আছে দুই যুবক, আলাপ হল,নাম তালাউদ্দিন ও কালু শেখ। কয়েক দিন আগের ঝামেলা নিয়ে কথা তুলতেই ওরা নি:সংকোচে বলতে শুরু করলো। বলল যার যার ধর্ম তো তার কাছে বড়, সেই নিয়ে ঝামেলা করার কী কারণ?
ওরা ওই আড়তে ২০০ লোক কাজ করে তার মধ্যে ৩০/৩৫ জন হিন্দু বাকি সকলেই মুসলমান। কোনদিন কোনো ব্যাপারে ধর্মীয় গোলোযোগ বাধে নি,এমনকি এই বারের সমস্যার সময়ও ওদের সহকর্মীদের সাথে কোনোরকম বৈরিতার সূত্রপাত পর্যন্ত হয় নি।
তালাউদ্দিন বলল ওদের এলাকায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদ যে কোনো সমস্যা তৈরি করতে পারে তা এই প্রথম টের পেলো। একসঙ্গে ওঠা বসা,খেলা ধুলা এমনকি এক ঠোঙা থেকে চপ মুড়ি খাওয়া রোজকার অভ্যাস। ওরা একযোগে আরো বলল,আমরা এভাবে একসাথে থাকলে বোধহয় রাজনৈতিক নেতাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে, সেইকারণে বাইরে থেকে লোক এনে আমাদের এই শান্ত এলাকায় ঝামেলা তৈরি করলো।মানুষ এখন বুঝতে পেরে গেছে আর এসব করতে দেবে না।ওদের মালিক মুসলমান তিনি এই রাস্তায় ভেঙ্গে দেওয়া স্বপন পালের দোকান মেরামতির খরচ ও বহন করতে চেয়েছেন।ওরাই বলল রাস্তার ওপরের বেছে বেছে হিন্দুদের দোকানগুলোর উপরেই হামলা হয়েছে।স্বপন দার দোকানের পাশেই রামকৃষ্ণ সেবা নামের চশমার দোকান ও চোখের ডাক্তার খানাটা একেবারে চুরমার করে দিয়েছে আক্রমণকারীরা। সেটিও হিন্দু ব্যবসায়ীর।
ত্রিমোহনী জামে মসজিদ
মসজিদের ইমাম শামসুর রহমান এবং একজন নামাজী, সাদেক আলির সঙ্গে কথোপকথন। ইমাম সাহেবের গ্রামের বাড়ি এই জেলারই হাসনাবাদ থানার এক গ্রামে। স্থানীয় মানুষ, সাদেক আলিই কথা শুরু করেন।
আমরা তিন পুরুষে বাস করছি এখানে, কখনও এইরকম ঝামেলা দেখিনি। দেশভাগের আগে থাকতে এইরকমই চলে আসছে বসিরহাটের বুকে। ঐ ফেসবুক-কাণ্ডের পর আমাদের বাচ্চারা প্রতিবাদ-স্বরূপ পথে মিছিল করছিল। নবীকে নিয়ে অসম্মানের প্রতিবাদে সকলেই এসেছে। ত্রিমোহিনীতে অবরোধ হল। যে যাই রাজনীতি করিনা কেন সকল মুসলিম তাতে এসেছে, আসবেই। ওরা উল্টো ধরে নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করলো। আমরা রথের দিন সকালবেলায় যৎসামান্য বিক্ষোভ জানিয়ে চলে এসেছি। আমি নিজেও ছিলাম বিক্ষোভে। রথ তো ওদের বিকেলে। এর পিছনে এক ষড়যন্ত্র আছে, বড় বড় মাথা আছে। আমাদের উত্তর ২৪ পরগণায় কোথাও ২ ঘর মুসলিম ২০ ঘর হিন্দু আবার কোথাও ১০ ঘর হিন্দু ২০ ঘর মুসলমান আছে। মিলেমিশে আছে। আলাদা করা মুশকিল।
সাদেক আলির মতে, বিজেপি আর এস এস-এর সঙ্গে মিলে অল্প কিছু লোক বসিরহাটে এই গণ্ডগোলের সূত্রপাত ঘটায়। বি এস এফ ময়দানে আর এস এস –এর প্রশিক্ষণ হয়। আমাদের সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ গরীব মানুষ, কাঁচামাল বা মাছের ব্যবসায় বেশি যুক্ত। সকাল হলেই সব কাজে চলে যায়। ওরা দু-একটা ক্লাবের ছেলে জড়ো করে আমদের চাপে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছে। তাঁর কথায়, কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে যারা বিজেপি হয়েছে প্রথমে তারা আমাদের ওপরে আক্রমণ করল। ফাল্গুনী সিনেমা হলের কাছে এম এন মেডিসিন নামে আমাদের একটি দোকানে আগুন দিল। ওটি আমার ভাইয়ের দোকান। (উল্লেখ্য আমাদের তথ্যানুসন্ধান দল মেডিসিন দোকানে কথা বললে, কিন্তু তারা কিছু বলতে অসম্মতি জানায়)। পুলিশ আমাদের তাড়িয়ে পাড়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু ওরা পুলিশকে পিছন দিক থেকে ইট ছুঁড়ছে। বাচ্চাদের মাথা ফেটেছে। গ্যারেজটাই ভাঙচুর করলো। ওরা নিজেরাই ভাঙচুর করে আমাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। স্থানীয় কিছু আর বাইরের কিছু। নিজেরাই মুসলমানদের দোকান ভাঙার পর আমাদের ওপর দোষ চাপানোর জন্য একখানা হিন্দুর দোকান ভেঙ্গেছে। ওরাই আমাদের আওয়াজ নিজেরাই দিয়েছে, ‘আল্লাহু আকবর’ বলেছে। আমরা ওদের চক্রান্তে পা না দিয়ে পিছিয়ে এসেছি। একটা আধটা প্রাণহানির খবরও আসছে। মানে নিখোঁজ আর কি? ওরা দোকান-ব্যবসা-সম্পত্তির ক্ষতি করেছে বেশি।
আমরা- হিন্দুরা ‘আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়েছে? কিন্তু যে অবরোধের সময় আপনিও ছিলেন বলে দাবি করছেন, সেই সময়ে স্বপন পালের দোকান আক্রান্ত হয়। সেই অবরোধেও কি হিন্দুরা ছিল বলে আপনি মনে করেন?
সাদেক আলি- (প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে) তবে ওঁর দোকান সারিয়ে দিতে মুসলিম মৎস্য ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসে, উনি নেননি। কিন্তু চায়ের দোকানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারা নিয়েছে সাহায্য।
ইমাম সাহেব ঘটনার দিন ছিলেন না। তিনি বললেন, প্রশাসনের ভুমিকায় খুশি। দুই সম্প্রদায়ের উদ্যোগে শান্তি মিছিল হয়েছে। ইমাম জানান কলম পত্রিকায় শান্তির আবেদনের প্রচার ছাপা হয়েছে। উনি জানান ওই দিন চারেক টেনশন ছিল, তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কমবয়সী মুসলিম ছেলেদের বেশি দেখা গেছে মিছিলে, ভাঙচুরে। পালেদের দোকান সারানোর ক্ষতিপূরণ দিতে চেয়েছে মুসলিমরা। ছোট ছোট দুটি হিন্দু-চায়ের দোকান মেরামত করে দিয়েছে আমাদের লোকেরা। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে চাঁদা দিয়েছি। একটাই স্বার্থ, শান্তি বজায় রাখা। বাপ ঠাকুরদার আমল থেকে কিছু অনুষ্ঠান হলেই ৫০টা মুসলমান যদি আসে তবে ২০টা হিন্দুও আসে। ওদের কোন অনুষ্ঠান হলে আমাদের ডাকে। প্রশাসন যে শান্তির প্রচার করছে মসজিদেও আমরা সেই কথাই বলছি। আসলে দু-দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যেসব বাঙালরা এসেছে তারাই স্থানীয় কিছু মানুষকে মদত নিয়ে এই হামলাটা চালিয়েছে। আবার এই সুযোগে তৃণমূলের যে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব আছে তাতেও দুই গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়েছে। হালে যেসব কট্টর হিন্দু, যারা বিজেপি বা আর এস এস-এর শেল্টার নিচ্ছে তাদেরই এই সব কীর্তি। আমাদের এই মসজিদ ফুরফুরা শরীফের সিলসিলা। (মসজিদ গাত্রে খোদাই করা লিপিতে পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকির নাম)। মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসার সময় দেখা গেলো পাশেই হিন্দু পরিবারের বাড়ি, একটি কমন দেওয়াল।
আমরা- এখানে মুসলিম সমাজের মধ্যে ফুরফুরা শরীফের প্রভাব কেমন?
ইমাম শামসুর রহমান- ব্যাপক। বসিরহাট থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ উরসে শামিল হয়।
আমরা- বসিরহাট মহকুমায় আপনাদের মসজিদের মত আর কটা মসজিদ আছে এই সিলসিলায়?
ইমাম শামসুর রহমান- সে কটা বলতে পারবো না। মাদ্রাসাও অনেক আছে।
আমরা- জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ, কেমন আছে, কতটা আছে?
ইমাম শামসুর রহমান- সিদ্দিকুল্লা সাহেব? আছেন তাঁরাও।
আমরা- আর জামাতে ইসলামে হিন্দ?
ইমাম শামসুর রহমান- ওরাই এখন বর্ধিষ্ণু।
আমরা- কোথাও কি রেষারেষি, প্রতিযোগিতা আছে এদের মধ্যে?
ইমাম শামসুর রহমান- সাধারণ মানুষ জানেনা, কিন্তু আছে।
আমরা- এই যেমন হিন্দুদের মধ্যে আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা কে বেশি হিন্দুত্বের দিকে, সেই রকম কি?
ইমাম শামসুর রহমান- (কিছু ক্ষণ ভেবে) তার থেকেও ভয়ঙ্কর। এখানে তো ওদের (হিন্দুত্বওলাদের) রেষারেষি ততটা দেখিনা। কিন্তু এদের আছে। আছে শক্তিপ্রদর্শন।
আমরা- এই দাঙ্গায় কি এইরকম কিছু শক্তি প্রদর্শন হল?
ইমাম শামসুর রহমান- (অনেকক্ষণ চুপ থেকে) এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
কালী বাড়ি মোড়
ত্রিমোহিনীর অনতিদূরে এই কালী বাড়ি মোড়। বসিরহাটের প্রসিদ্ধ কালী মন্দির এখানেই। এর পিছনে বর্ধিষ্ণু হিন্দু পাড়া, যার লাগোয়া নিকারী পাড়া। বসিরহাটের বাইরে অনেক মানুষের মুখে এই মন্দির আক্রান্ত হয়েছে বলে গুজব ছড়ায়। উল্লেখ্য বসিরহাটের পৌরসভা এলাকায় যে মন্দির এবং বিগ্রহ আক্রান্ত হয় সেটি অন্য স্থানে, টাকি রোডে। আমাদের প্রতিবেদনে তার উল্লেখ থাকবে।কালী বাড়ি মোড়ে ছোট এক জটলায় কিছু কথা হয়, এখানে তার সারমর্ম। বলা বাহুল্য, জটলায় সকলেই হিন্দু ছিলেন।
রথের পরের দিন ওরা (মুসলিমরা) নিজেরাই ঝামেলা শুরু করে। নিজেরাই তিন/চারশো লোক অস্ত্র নিয়ে মিছিল বার করে, পুলিশকেও মারে। আমরা প্রথমে ভয় পেয়ে যাই। পরে পাড়া থেকে একজোট হই। ওরা ‘আল্লাহু আকবর’, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দিচ্ছিল। মোড়ের মাথায় কিছু ছেলেকে মারধোর করলো। ট্যাঁটরা পাইকপাড়ায় বেশি গণ্ডগোল করেছে। আগে একবার এরকম দুর্গা ঠাকুরের হাত ভেঙে দিয়েছিল। আমাদের বসিরহাটে রামনবমী খুব জোরদার হয়েছে এই বছর। যদিও আমাদের পাড়ায় করিনি, করতাম কিন্তু ওদের ঝামেলার ভয়ে করিনি। ওরা প্রায় দিনই টুকটাক অত্যাচার, মারধোর করে। আগে আমরা ভয় পেতাম, এখন আর ওদের ভয় পাইনা। ঐ কলেজের থেকে জোড়া পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত ওদের দৌরাত্ম্য। এদিকে এখন আমরাও জবাব দিয়ে দেবো। হিন্দুদের কোন একটা অনুষ্ঠান হলেই ওরা ভণ্ডুল করে দিত ঝামেলা করে। আমাদের এই মন্দির পাঁচশো বছরের পুরনো। আগে ঠাকুরের কেউ কোন ক্ষতি করলে এই পুকুরের জল লাল হয়ে যেতো। এখন বারো রাজ্যের লোক ঢুকে সব নষ্ট হয়ে গেছে। ভগ্নপ্রায় মন্দির ছিল এটি, আবার নতুন করে গড়া হয়েছে। বক্তাদের একজন পরিচয় দিলেন, কালীপদ বিশ্বাস।
পুরোহিত, প্রদীপ চক্রবর্তী- কালি মন্দিরের পুরোহিত। তখন পুজার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। বলেন এখানে আগে কখনও এইরকম বড় কিছু হয়নি। এবারের ঘটনা অবাক করে। খারাপ লাগে মানুষ ক্রমে আরও বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
আমরা- বিষ ছড়াচ্ছে বলে মনে হয়?
প্রদীপ চক্রবর্তী- সব পক্ষেই। ঘটনার আগে না-হোক পরে এসেছে ঘোলা জলে মাছ ধরতে।
আমরা- বাইরের না ঘরের?
প্রদীপ চক্রবর্তী- সব দিকেরই। এখানে বিধানসভায় পশ্চিমবঙ্গের প্রথম বিজেপির বিধায়ক নির্বাচিত হয় জানেন তো? আর তৃণমূল করলেও মনে মনে বিজেপি এই রকম বহু মানুষ আছে।
আমরা- সংগঠিত উদ্যোগে চলছে কি?
প্রদীপ চক্রবর্তী- ক্লাবগুলি এইসব আলোচনার জায়গা, কাঁচা মাথাগুলি কী করবে কাজ নেই? প্রকাশ্যে কেউ হয়ত আর এস এস নয়।
ডাক্তার কাসেম আলি, নিকারী পাড়া
নিকারী পাড়া, বসিরহাট পৌরসভার মুসলিম অধ্যুষিত একটি পাড়া। বেশিরভাগ মানুষ মাছের পাইকারি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। ৮০ ঊর্ধ্ব ডাঃ কাসেম আলি এন আর এস-এর প্রথম দিকের ব্যাচ। যখন কথা হয় তখন নিকারী পাড়ায় তাঁর চেম্বারে ভিড় ছিলনা। প্রাজ্ঞ মানুষটি প্রথমে বাইরের মানুষের সামনে মুখ খুলতে স্বাভাবিক নির্লিপ্তি দেখান। কিন্তু, কথোপকথনে উঠে আসে কিছু তথ্য যা নির্দিষ্ট করে রাজনীতি আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মেলবন্ধনকে। ফাঁকা চেম্বারে কম্পাউন্ডার ছাড়া ওনার পাশে বসে ছিলেন একজন, বসিরহাট পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের এক সময়ের ওয়ার্ড কমিশনার, বাবর আলি। বর্তমানে অবশ্য ওনার স্ত্রী আছেন ওই পদে।
আমরা- এখন পরিস্থিতি কেমন মনে হচ্ছে ডাক্তারবাবু?
ডাঃ আলি- এখনতো ঠিক আছে মনে হয়। তবে কখন আবার কী হয়, বলা যায় না! (আর চোখে একবার তাকালেন বাবর আলির দিকে)
আমরা- আপনি বহুদিনের মানুষ, চিকিৎসক। কখনও কি মনে হয়েছিল এইরকম কিছু আপনার বসিরহাটে হতে পারে?
ডাঃ আলি- না হয়নি। এখনও মনে হয়না যে এখানে এইরকম কিছু ঘটতে পারে। এইতো আমার কম্পাউন্ডার, রতন, ওতো হিন্দু। আমরা আগেও একসাথে কাজ করেছি, এখনও করছি। সমস্যা আমাদের নিয়ে নয়।
আমরা- কারা এইসব করলো, কীভাবেই বা এত মানুষকে পথে নামানো গেলো?
ডাঃ আলি- কীভাবে আবার, ওই রাজনীতি! ফেসবুকের পোস্ট নাকি একটা হয়েছে, তাতে অত লোক ক্ষেপবে কেন? (বাবর আলির দিকে তাকিয়ে) কী তাইতো?
আমরা- আপনি কিছু বলুন (বাবর আলিকে)
বাবর আলি- আমরা এখানে শান্তি মিছিল করেছি, এখন সব শান্ত আছে।
ডাঃ আলি- কিন্তু, সেদিন তোমরা পথ অবরোধ করেছিলে কেন? সেই থেকেইতো অশান্তির সূত্রপাত।
বাবর আলি- (অপ্রস্তুত হয়ে সামলে নেন) সে তো নবীকে অপমানের প্রতিবাদ করতে আমরা জমায়েত করেছিলাম। আমাদের মিছিলে কোন অশান্তি হয়নি।
আমরা- যেদিন ত্রিমোহিনীতে প্রথম জমায়েত হয়?
বাবর আলি- হ্যাঁ।
আমরা- সেদিনই ত্রিমোহিনীতে অনেক দোকানে আগুন লাগানো হয়। বলা যায় বসিরহাট শহরের দাঙ্গার শুরু সেইদিন, তাইতো?
ডাঃ আলি- হ্যাঁ, সেদিনই। এই কাজ তোমরা ঠিক করনি বাপু।
বাবর আলি- আমরা শুধু রাস্তা অবরোধ করি, ধর্মে আঘাত করলে মুসলমানরা তো প্রতিবাদ করবেই। যাইহোক, চারদিকে অশান্তি ছড়িয়ে পড়লে আমি এখানে শান্তি মিছিলের উদ্যোগ নিই। আমাদের পার্টি থেকে শান্তি ফেরানোর আহ্বান রাখা হয়। আমাদের বলা হয় শান্তি কমিটি করতে। আমরা করি।
ডাঃ আলি- (খুব হতাশগ্রস্ত কণ্ঠে) বদনাম হয়ে গেলো। এই কয়েকজন লোকের জন্য। আমার লজ্জা হয়।
বিমল দে (নাম পরিবর্তিত), বাসন বিক্রেতা, নিকারীপাড়া-
উল্টোরথের দিন এখানে ঝামেলা শুরু হয়। গাড়ি গাড়ি মানুষ আসতে থাকে, ঐ ‘নাড়া এ তকবীর’ শ্লোগান। আমাদের দোকান ভয়ে বন্ধ করে দিই। সামনের দিকে ভাঙচুর হয়।
আমরা- স্থানীয় মানুষ ছিল? না সকলেই বাইরের?
বিমল দে- স্থানীয় ছিল বৈকি। এই নিকারীপাড়া হল মুসলিম এলাকা। ওদের দাপট বেশি। তবে এখন দাঙ্গা হয়ে যাবার পর সকলেই চুপচাপ। কয়েকজনকে দেখে মনে হয় এই সব কাণ্ডর জন্য তারা অনুতপ্ত।
আমরা- এখানে শান্তি মিছিল হয়েছে শুনলাম। বাবর আলি বলছিলেন, শান্তি মিছিল করেছি।
বিমল দে- শান্তি মিছিল, বাবর আলি? ঐ তো এখানের অবরোধ-আয়োজনের হোতা। ঘণ্টাখানেক ধরে অবরোধ চলে। এদিকে তৃণমূলের কাউন্সিলর। অবশ্য অফিসিয়ালি ওর স্ত্রী কাউন্সিলর, কিন্তু বকলমে ঐ চালায়।
আমরা- উনিই এখানে অশান্তির মূলে?
বিমল দে- অবশ্যই। নবীকে অপমান করা হয়েছে বলে, ঐ লোকটিই এখানের মানুষকে ক্ষেপায়। এখানে আর ত্রিমোহিনী একালায় ১০-১২ টি দোকান ভাঙচুর হয়। এখন ওই শান্তিমিছিল করছে!
আমরা- কেন করছে বলে আপনার মনে হয়?
বিমল দে- ওরা (মুসলমানরা) যখন দেখল আর উপায় নেই। গাড়ি গাড়ি মাছ আটকে দিচ্ছে, কোন মাল আসতে দিচ্ছে না, তখন এইসব মিছিল টিছিল করা শুরু হল।
আমরা- কারা আটকে দিচ্ছিল?
বিমল দে- কেন, হিন্দুরা।
আমরা-বাবর আলিকে প্রশাসনের কেউ ধরেনি?
বিমল দে- না। কি করে ধরবে, তৃণমূল করে যে?
ট্যাঁটরা
মৃত কার্তিক ঘোষ-এর পরিবার-
দেবাশিস ঘোষ, মৃত কার্ত্তিক ঘোষের বড় ছেলে, বয়স ৪০ হবে। কার্তিক ঘোষ, বসিরহাট দাঙ্গার এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী একমাত্র মৃত ব্যক্তি।
তিনি বলেন, গত পাঁচ তারিখ (জুলাই, ২০১৭) বেলা ১১ টা নাগাদ পাইকপাড়ার দিক থেকে কিছু মানুষ এসে হিন্দুদের দোকানপাট-ঘরবাড়ি ভাঙচুর করতে শুরু করে। ওইদিনই দুপুরে আমার বাবা, শ্রী কার্ত্তিক চন্দ্র ঘোষ, বয়স পঁয়ষট্টি বছর, ন’পাড়া থেকে ফিরছিলেন। পাইকপাড়ার কাছে তাঁর ওপর মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু লোক হামলা করে। তাঁর মাথায় তিনটি কোপ মারে। দুপুর দুটোর পর আমরা খবর পাই বাবা আহত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছেন। কিন্তু, ওখানে তখন যাওয়ার পরিস্থিতি ছিলনা। কোনও রকমে পুলিশের সাহায্যে অ্যাম্বুলেন্সে বাবাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা হয়। বসিরহাট জেলা হাসপাতালে নিয়ে আসার পর ওখানে প্রাথমিক চিকিৎসা করে ডাক্তার কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঐ অ্যাম্বুলেন্সেই নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিই। সেই সময় আমাদের কাছে অনুরোধ আসে আর একজন আহত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। সেই মানুষটির নাম, ফজলুর সরদার। তিনিও বয়স্ক মানুষ। বি এস এফ-এর ছোঁড়া রবার বুলেটে ঐ পাইকপাড়া অঞ্চলেই তাঁর মুখের চোয়াল ভেঙে গেছে। আমি ও আমার ভাই রাজি হয়ে যাই তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। একই অ্যাম্বুলেন্সে দুই পাশে দুইজন আহত মানুষকে নিয়ে, দুই হাতে দুটো স্যালাইনের বোতল ধরে রওয়ানা হয়ে যাই কোলকাতার উদ্দেশ্যে। ৬ জুলাই সকালে বাবা মারা যান।
আমরা- কারা মেরেছিল তা কি জানা গেছে? কোনও এফ এই আর করা হয়েছে কারো নামে?
দেবাশিস- কারা হামলা করেছিল জানা যায়নি। এফ এই আর সম্পর্কে আমি কিছু জানিনা। ভাই জানতে পারে।
আমরা- এর আগে কখনও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে গোলমাল কিছু হয়েছে?
দেবাশিস- বড়সড় কিছু হয়নি কখনও। এখানে আমরা একসঙ্গেই সকলে বসবাস করেছি।
আমরা- ফজলুর সরদার, যাকে আপনি আপনার বাবার সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে গেলেন, তাঁর কী পরিস্থিতি?
দেবাশিস- তিনি এখন ভালো আছেন। ফোন করেছিলেন তিনি। বাবার কথা শুনে খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন।
আমরা- এই দোকান ছাড়া আপনাদের আর কোন আয়ের উপায় রয়েছে?
দেবাশিস- দোকানে আমি বসি। কিন্তু তাতে সংসার চলেনা। বাবাই আমাদের সংসার চালাতেন। ভেড়িতে মাছের খাবার যোগান দেওয়া তাঁর কাজ ছিল। একেবারে নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। ওঁর ওপর এমন আঘাত আসবে আমরা কখনও ভাবতেই পারিনি! আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।
আমরা- পুলিশ বা প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণের জন্য কেউ যোগাযোগ করেছেন?
দেবাশিস- না। এখনও পর্যন্ত কেউ আসেনি বা কিছু বলেওনি।
আমরা- এই অঞ্চলে আপনার বাড়ির আশেপাশে মুসলমান পরিবার রয়েছে?
দেবাশিস- কাছেই থাকে বেশ কয়েক ঘর মুসলমান।
আমরা- ঘটনার পর তাদের ওপর কোন প্রভাব পড়েছে?
দেবাশিস- তারা খুব চুপ হয়ে গেছে। কোনও হামলা হয়নি এখানে তাদের ওপর। তবে তারা বাইরে খুব একটা বেরোচ্ছে না।
আমরা- কোনও রাজনৈতিক দলের কেউ এসেছিলেন?
দেবাশিস- না, আজ অব্দি কোনও দলের কেউ আসেনি।
প্রথমবারের সফরে দেবাশিসের ছোট ভাই প্রভাশিস ঘোষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি আমাদের। বাড়ির সকলেই মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত ছিলেন। কোন ঝুটঝামেলায় না থাকা, নির্বিরোধী, ন’জনের পরিবারে মূল উপার্জনশীল মানুষটির এভাবে মৃত্যু তাঁরা মেনে নিতে পারেননি কেউই। কিন্তু, বিদ্বেষের, ঘৃণার এই আবহের মধ্যেই কার্ত্তিক ঘোষের দুই পুত্র তাঁদের বাবার সঙ্গে একই অ্যাম্বুলেন্সে আহত ফজলুর সরদারকে যেভাবে নিয়ে গেলেন আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে- তা আশার আলো দেখায়। ধর্মের বেড়া ডিঙ্গিয়ে মানবিক বোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে এই সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত। কিন্তু, দ্বিতীয় বার (২ অক্টোবর, ২০১৭) যখন এই পরিবারের সঙ্গে মিলিত হই, তখন চিন্তনের স্তরে তারতম্য নজরে আসে। এবারে কথা হয় প্রভাশিসের সঙ্গে।
প্রভাশিসের গুছিয়ে বলার ধরন দেখে আমাদের মনে হয় তিনি এক’ই কথা বারবার অনেক কে বলে বলে ঘটনার একটা স্বাভাবিক প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলেছেন, এবং এরকম হওয়া খুবই স্বাভাবিক, বলে আমাদের মনে হয়। কার্ত্তিকবাবুর মৃত্যু’র দিনের ঘটনার মধ্যে মূল দুটি বিষয় উল্লেখ্য, প্রথমত কার্ত্তিক বাবুর মৃত্যু এমন একটা পরিস্থিতি’তে ঘটেছে যা প্রভাশিসের মতে ভুল সময় ভুল জায়গায় উপস্থিতি’ই একমাত্র কারণ, তাঁদের কারোর সাথে কোন শত্রুতা নেই। দ্বিতীয়ত খুব সম্প্রতি যে সকল ব্যাক্তি গ্রেফতার হয়েছেন তাঁরা স্থানীয়। এই দুইটি বিষয় এক করলে একটা সমস্যা স্ববিরোধী বিষয় উঠে আসে, হয় আমাদের ধরে নিতে হবে কার্ত্তিক বাবুর প্রতি মানুষের কোন না কোন ক্ষোভ ছিল, কিংবা কার্ত্তিকবাবু ঝামেলার মধ্যে ছিলেন, অথবা মানুষের মধ্যে ঐদিন এমন কোন আবেগ ভর করেছিল যা তাঁদের দীর্ঘদিনের একসঙ্গে বসবাস করা’র ঐতিহ্য’কে ছাপিয়ে গেছে। এধরনের কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়েই আমরা প্রভাশিসের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাই।
আমরা- কী এমন ঘটল, আপনাদের তো দীর্ঘদিনের সহাবস্থান?
প্রভাশিস- মুলত অশিক্ষা আর আমার মনে হয় সাধারণ স্কুলের শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া উচিৎ মানুষের কোন ধার্মিক প্রতিষ্ঠানে নয়। তবে এর মধ্যেও অনেকেই আছেন শিক্ষিত লোকজন, যারা সরাসরি না-থাকলেও উৎসাহিত করেছেন। তাঁরা কিন্তু জেনেরেল শিক্ষায় শিক্ষিত। ধর্মের অন্ধ বিশ্বাস ধরে রেখে জীবন চালালে হবে না, এটা পরিষ্কার কথা। ধর্মকে রেস্পেক্ট করতেই হবে। ধর্মের মধ্যে ভাল-খারাপ থাকবেই, মানুষকে ধর্ম যা বলবে বা ধর্মীয় নেতা যা বলবে তাই যদি মানুষ সঠিক মনে করে, কোন প্রশ্ন না করে, তা হলে তো এরকম ঘটনা ঘটেই চলবে।
আমরা- আপনি বাবাকে নিয়ে যখন যাচ্ছেন তখন কী হল?
প্রভাশিস- প্রথমত, ঐদিন কোন অ্যামবুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে প্রশাসনের সাহায্যে আমি একটা অ্যামবুলেন্স পাই। তখন একজন মুসলিম ব্যক্তি’র চোয়ালে টিয়ার শেলের টুকরো লেগে গুরুতর আহত ছিলেন। র্যাফ বলল, আমি ওনাকে নিয়ে যাব কিনা? আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে যাই।
আমরা- আপনি খুবই বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন।
প্রভাশিস- আমার মনে হয় এটা অন্য কেউ হলেও করত। আমি এতদিন বিশ্বাস করতাম যে, এটা কোন মুসলমান ভাই হলেও করতেন কিন্তু, আজ আমার এই বিশ্বাস নড়ে গেছে। (প্রভাশিস অন্যমনস্ক হয়ে অন্য দিকে তাকায়)
আমরা- কেন?
প্রভাশিস- না, আসলে যদি মাথা দিয়ে বলতে বলেন তা হলে আমি আজও একই কথা বলব যে এটা ওঁরা (মুসলমানেরা) হলেও করত, কিন্তু, যদি অন্তরের কথা বলেন, তা হলে আমার মনে হয়, ওঁরা করত না।
আমরা- কিন্তু কেন? এরকম হঠাৎ মনে হচ্ছে কেন?
প্রভাশিস-আজ তিনমাসেরও বেশি হয়ে গেল ঐ লোক আমাকে একটা ফোন করে খোঁজ নেয় নি যে আমি কেমন আছি, আমার পরিবার কেমন আছে। যে লোকটা বেঁচে গেল সে একটা যোগাযোগ করল না !
আর, এই ঘটনা ঘটার জন্য আমি প্রশাসনকে দায়ী করব। কী জানেন, যখন আমি খবর পেলাম বাবা পাইকপাড়া আর আমাদের পাড়ার মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে রয়েছে তখন আমার প্রথম মনে হল, যাব কী করে? আমার বন্ধু কোন ভাবে থানার আই সি সাহেবের কাছে যায়। গিয়ে বলে আরও লোক পাঠাতে। আই সি বলেন, ঐ এলাকাতো পিসফুল এলাকা। পুলিশ আগের দিন ফিরে যাবার পরে যদি পিকেটিং বসাত তাহলে হয়ত আমার বাবাকে হারাতে হত না। তবে আমি এস ডি পি ও সাহেব এবং হাসপাতালের সুপারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আমরা- আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনাদের দুই সপ্রদায়ের মধ্যে আদান প্রদান, ভাব বিনিময়, একে অপরের অনুষ্ঠানে যাওয়া এসব ছিল না?
প্রভাশিস-হ্যাঁ ছিল তো! আমার বাবাও তো মুসলিমদের যারা বাবার সাথে ব্যবসায়িক ভাবে যুক্ত তাঁদের ঈদে উপহার দিত। (কার্ত্তিকবাবু হাইব্রিড মৎস্য পালনে যে কাটা মুরগির অবশেষ ব্যবহৃত হয়, তার যোগান দিতেন) এখন তো অনেকেই আফসোস করছেন, কিন্তু সে সময় তো কেউ রুখে দাঁড়ায় নি। যারা মেরেছে, তারা কিন্তু আমার পরিচিত। তারা আমার বাড়িতে খেয়ে পর্যন্ত গেছে। তাদের অনেকেই আমাদের অনেকটা জায়গা আছে বলে এখানে বিচলির গাদা বানিয়ে রাখত। এই যায়গাটা ওঁরা ব্যবহার করতেন। আসলে অনেকটাই আদান-প্রদান ছিল। এই লোকেরাই এরকম করবে কেউ ভাবতে পারে নি। আসলে ধার্মিক হিংসা এত প্রবল এখানে যে সব কিছুকেই তা ছাপিয়ে যায়।
আমরা- আচ্ছা, এখানে কি বাংলাদেশের জামাতিদের প্রভাব আছে?
প্রভাশিস- কে জানে, আমার সত্যি জানা নেই। আছে নিশ্চয়ই তবে কে কী রূপে কিভাবে থাকে তা তো আর বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আমরা সবাই বিশ্বাসে থাকি যে সবাই ভাল। কোনোদিন জানার দরকার পড়ে নি। তবে, এখন মনে হচ্ছে জানতে হবে, না জানলে দেশের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
আমরা- এখানে আপনাদের, মানে হিন্দুদের সংগঠিত করার জন্য কোনও উদ্যোগ হয়েছে?
প্রভাশিস- না আলাদা ভাবে কোন সংগঠিত হওয়া এরকম নয়, তবে হিন্দুরাও এখন সতর্ক। রাস্তায় যে মিছিল নেমেছিল, তাতে বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত বেরিয়ে এসেছে। কী করবে, মেয়েদের জীবন তো আরও বিপন্ন, তারাও তো আর সুরক্ষিত নন। ওরা যে এরকম আর করবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে?
আমরা- বাইরে থেকে আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা যে এবছর (পুজো-মহরমে) কিছু একটা হতে পারে, তবে সেরকম কিছু হয়নি তো দেখলাম।
প্রভাশিস-আমাদের মনে হয়েছিল এবছর কিছু হবে না। দেখুন সত্যি বলতে পূজা তো সবথেকে বড় উৎসব, আর এখানে বছরের পর বছর মহরম হয়েছে কোনদিনই সেটা নিয়ে কোনরকম অশান্তি হয়নি। আর বসিরহাটে মহরম খুব বড় হয় না। এনিয়ে এত বেশী ভাবনারও কিছু নেই।
আমরা- আমরা জানি যে এই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়েই হিন্দু মুসলিম একসাথে থেকেছেন বছরের পর বছর, এটা একটা খারাপ লাগারও জায়গা যে এরকম হল এখানে।
প্রভাশিস- আমরাও তো তাই জেনে এসেছি। আমার তো অনেক মুসলিম বন্ধুও আছে। কোনোদিন বন্ধুত্ব করার আগে সে হিন্দু না মুসলিম এসব তো আর দেখিনি, ভাবিও নি।
আমরা- দাঙ্গা প্রতিহত করার জন্য হিন্দুদের মধ্যে কোন সংগঠন তৈরি হয় নি বলছেন?
প্রভাশিস- দেখুন আমি আসলে খুব বেশি এসবের মধ্যে আর থাকতে চাই না। এসব আর ভাল লাগে না। সরকার বলেছে আমাদের দুই ভাইকে দুটো চাকরি দেবে। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর ক্ষতিপূরণ হিসেবে দু’লাখ টাকা’ও দিয়েছে। এখন চাকরি কবে দেয় দেখি, শুনেছি, প্রসেসিং চলছে।
উল্লেখ্য গত ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ‘কারওয়াঁ এ মুহব্বত’ দল (হর্ষ মান্দার, জন দয়াল প্রমুখ বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা)-এর সঙ্গে শামিল হয়ে আমরা বসিরহাট আসি, কথা বলি কার্তিক ঘোষের বিধবা স্ত্রীএবং প্রথম পুত্র দেবাশিসের সঙ্গে। প্রসঙ্গত জানাই যে ‘কারওয়াঁ এ মুহব্বত’ দলটি সারা ভারত জুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সদ্ভাবনা প্রচারের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হিংসার শিকার মানুষের সঙ্গে বা তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করছে, কথা বলছে। পশ্চিমবঙ্গ পর্যায়ে তাদের সফর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা হলে আমরা বসিরহাট আসার প্রস্তাব রাখি। দলটির পক্ষে জানতে চাওয়া হয় দাঙ্গার পর কয়েকমাস অতিক্রান্ত, মুসলিম প্রতিবেশীরা এসেছিল কোন দিন? দেবাশিস বাবু জানান না আসেনি। তাঁর মা জানান, স্থানীয় মুসলিম মহিলারা কথা বলে, খোঁজ খবর নেয়। জানতে চাওয়া হয়, ফজলুর সর্দার বা তাঁর পরিবারের কেউ এসেছেন বা ফোন করেছেন কি? উত্তর আসে, না আসেননি। এবারেও জানতে চাওয়া হয় তিনি বা তাঁর ভাই কি গিয়েছিলেন কখনও আহত ব্যক্তিটির কাছে, যাকে বাঁচিয়েছে তাঁদের মানবিক সাহায্য। দেবাশিস বাবু জানান, গেছিলেন কিন্তু খুঁজে পাননি তাঁর হদিস।
তাপস ঘোষ
দেবাশিস বাবুর সঙ্গে প্রথম দিনে কথোপকথনের সময় ঐ দোকানেই উপস্থিত ছিলেন শ্রী তাপস ঘোষ। পাইকপাড়া অঞ্চলে তাঁর মিষ্টির দোকান। ৫ জুলাই ভাঙচুর হয় তাঁর দোকানে। লুঠপাটও চলে। বিস্তর ক্ষতি হয় হয় তাঁর।
তাপস ঘোষ- আগে এই অঞ্চলের মানুষ সম্প্রীতির সঙ্গেই বাস করেছেন। কিন্তু, গত কুড়ি পঁচিশ বছর ধরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে টেনশন তৈরি হচ্ছিল। গত পাঁচ-ছয় বছরে তা আরও বেড়েছে। সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলেও তা ধর্মের বিরোধের চেহারা নিয়ে নেয়। পাঁচ তারিখে আক্রান্ত হওয়ার পর হাজারখানেক হিন্দু জড়ো হয়ে যায়। অন্যদিকে তখন মসজিদ থেকে ঘোষণা হচ্ছে, ‘মসজিদ-মক্তব আক্রান্ত’। এই ঘোষণায় প্রায় পাঁচ হাজার মুসলমান জড়ো হয়ে যায়। পরে যখন দেখে ঐ ঘোষণা ঠিক নয়, তখন সরে যায়।
আমরা- আপনার কী মনে হয়, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রাখতে চাইছে কেউ বা কারা?
তাপস- দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই এমন লোকজন আছে।
আমার- আর কেউ? রাজনৈতিক দল? শাসক?
তাপস- এ আর আমি কী বলব? আপনারা বুঝে নিন।
আমরা- ভোট ব্যাঙ্কের কোন গল্প আছে কি?
তাপস- সেতো আছেই। (বলেই হাসি)
আমরা- কাদের ভোট ব্যাঙ্ক? আপনার কী মনে হয়?
তাপস- আমি কী বলবো? আমার মনে হয় শাসক সরকারের।
আমরা- শাসকের এতে কী লাভ?
তাপস- (হাসি)
আমরা- কীভাবে শান্তি ফিরবে?
তাপস- শান্তি মানে তো কম্প্রোমাইজ করতে হবে। দুই পক্ষের আন্তরিকতা তৈরি না হলে তো হবে না।
আমরা- প্রশাসন-পুলিশের ভুমিকা কী ছিল? ঘটনার দিনগুলোতে?
তাপস- ৩ জুলাই থেকে একটা ছেলের মুসলিম-বিরোধী ফেসবুক কী একটা দিয়েছিল তা নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। ছেলেটাকে ফাঁসি দেওয়ার দাবি ওঠে। অবরোধ শুরু হয়। পুলিশ প্রথম ক’দিন নিষ্ক্রিয় ছিল। আই সি নাসিম আখতার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে শুনেছি। কেন্দ্রীয় বাহিনী আসে ৭ জুলাই।
আমরা- এখানে বিজেপি আর তৃণমূলের সম্পর্ক কেমন?
তাপস- ভালো সম্পর্ক।
আমরা- প্রকাশ্যে না গোপনে?
তাপস- প্রকাশ্যেই।
পাইকপাড়া
ব্যবসা বাণিজ্যে সম্পন্ন অঞ্চল। মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৩ জুলাই এখানে রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তা আটকে শুরু হয়েছিল রাস্তা অবরোধ। ভাঙচুর হয় হিন্দুদের বেশ কয়েকটি দোকানপাট। লুঠপাট আর আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগও ওঠে। এর পাল্টা হিসেবে ট্যাঁটরার দিক থেকে হিন্দুদের একটি জমায়েত হামলা চালায় পাইকপাড়ার কয়েকটি মুসলিমদের দোকানে। দু’পক্ষেই ক্ষয় ক্ষতি হয়। আগস্টের মাঝামাঝি আমরা প্রথম সেখানে যাই, তখনও পুলিশ পিকেট রয়েছে। রয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-এর পোস্ট সম্পর্কে সতর্ক থাকার আর গুজবে কান না দেওয়ার প্রচার। আমাদের মোবাইল ফোনগুলি তখন কাজ করছিল না।
গ্রুপ মিটিং (পাইকপাড়া ব্যবসায়ী সমিতি এবং আরও কয়েকজন)
সত্যেন বিশ্বাস (সভাপতি, পাইকপাড়া ব্যবসায়ী সমিতি এবং আর জি পার্টি) বলেন, যা ঘটেছে ওইসময় তা গুজব থেকে করা হয়েছে। বাইরের লোকজন, আশেপাশের গ্রামের লোকজন এসে এইসব গোলমাল করেছে। শ্বেতপুর, তাজপুর, রামনগর থকে লোকজন এসেছিল। কমবয়সীদের সংখ্যা বেশি ছিল। প্রশাসন যদি একদিন আগে আসতো, এই ঘটনা ঘটত না।বহুকাল ধরে আমরা এখানে সদ্ভাবের সঙ্গে বসবাস করছি, আগে কখনও এমন ঘটনার কথা শুনিনি।
আমরা- যারা গোলমাল করেছে তাদের কি চেনা গেছে?
সত্যেন বিশ্বাস- না চিনতে পারিনি।
আমরা- স্থানীয় কেউ ছিল না?
সত্যেন- থাকলেও কমবয়সী কিছু ছেলে হয়তো ছিল।
সুরজ গাজী- ৫ জুলাই সকালের দিকে বাইরের কিছু লোক হুজ্জতি করতে এসেছিল। আমরা দলবেঁধে ঠেকাই। দুপুরে যখন আমরা দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ি চলে আসি, তখন আবার ফিরে এসে হামলা করে।
পাইকপাড়া ব্যবসায়ী সমিতি এই দফায় দফায় হামলার পর সিদ্ধান্ত নেয়, যত দিন না ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হচ্ছে, ততদিন তাঁরা দোকানপাট বন্ধ রাখবেন। তাঁরা চাঁদা তুলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাহায্যের চেষ্টা করেন।
এই পাইকপাড়াতেই একটা ঘটনা ঘটে যা বিশেষভাবে উল্লেখ করা জরুরি। প্রথম যেদিন রাস্তায় টায়ারের আগুন জ্বালিয়ে পথ অবরোধ শুরু হয়, সেদিন স্থানীয় হাজি আবদুল কাদের সরদার নামে এক ব্যক্তি রুখে দাঁড়ান। অবরোধে আপত্তি জানান। টায়ারের জ্বলন্ত আগুন জল দিয়ে নিভিয়ে দেন। তাঁর সঙ্গে অবরোধকারীদের বচসা হয়। পরবর্তীকালে যখন ঐ অঞ্চলে প্রশাসনের উদ্যোগে শান্তি কমিটি তৈরি হয়, সেই শান্তি কমিটির সম্পাদক হন হাজি সাহেব। সভাপতি হন পরিমল তপাদার।
পাইকপাড়াতেই রয়েছে ছিদ্দিকিয়া উন্নয়ন পর্ষদ পরিচালিত একটি এতিমখানা বা অনাথালয় ও মাদ্রাসা। এই এতিমখানায় শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত ওহিদুল হক-এর সঙ্গে কথা হল।
ওহিদুল হক- এতিমখানায় ১৩০ জন বাচ্চা রয়েছে। গোলমালের দিনগুলোতে ওরা এখানে ছিল না। ছুটিতে ছিল। অশিক্ষিত বাইরের লোকজনই এই অঞ্চলে গোলমাল করেছে।
মাদ্রাসার অন্য এক শিক্ষক আরেফিল মোড়ল জানালেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধির কথা।
আরেফিল- শিক্ষিত বেকারদের দেখে শিক্ষা সম্পর্কে ছেলেদের অনীহা তৈরি হয়েছে। মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে। ছেলেদের মধ্যে আগ্রহ দ্রুত কমছে।
কথা চলাকালীন উপস্থিত হন ছিদ্দিকিয়া উন্নয়ন পরিষদের সম্পাদক আবদুল লতিফ। অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারী। আমাদের জানালেন এই এতিমখানা এবং মাদ্রাসার সম্পর্কে।
আবদুল লতিফ
ফুরফুরা শরীফের সিদ্দিকি পরিবারের সঙ্গে এই ছিদ্দিকিয়া উন্নয়ন পর্ষদের সংযোগ প্রথম থেকেই। মানুষ মানুষকে ঘৃণা ক’রে ধর্ম হয়না। অবোধ বালক ভুল করেছিল। তাকে বোঝানো দরকার ছিল। মুহম্মদও ক্ষমা করতে শিখিয়েছেন। আমরা এখানে পরস্পরের সহযোগিতায় বসবাস করে আসছি বহুকাল ধরে। আমার প্রাক্তন সহকর্মী নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস তাঁর মেয়ের বিয়েতে এতিমখানার শিশুদের খওয়ানোর উদ্যোগ নিলেন। সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এদেশে হিন্দু-মুসলমান সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে থাকবে। আমরা সবাই ভারতবাসী। দেশভাগের সময় সব মুসলমান পাকিস্তান চায়নি। দেশভাগের পর তারা বেশীরভাগ থেকে গেছে এই দেশেই। এদেশের সংবিধানকে আমরা শ্রদ্ধা করি। আমাদের ভারতের সংবিধান সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারকে, ধর্মীয় আচরণের দিকগুলিকে যেভাবে নিশ্চিত করেছে তা আর কোন দেশে দেবে? দাঙ্গা-হাঙ্গামার পর আমাদের এই ছিদ্দিকিয়া উন্নয়ন পর্ষদের পক্ষ থেকে পাইকপাড়ার ক্ষতিগ্রস্ত দোকানীদের ধর্ম নির্বিশেষে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সাধ্যমত। শান্তি কমিটির উদ্যোগে এখানে মিছিল হয়েছে। আমরা চাই, হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলেমিশে থাকুক।
আমরা- এই দাঙ্গা হাঙ্গামার পিছনে কারা আছে বলে মনে হয় আপনার?
আবদুল লতিফ- কমবয়সী ছেলেপুলেরা, যারা শিক্ষা পায়নি-তারাই এসব হাঙ্গামায় জড়িয়েছে।
আমরা- কোন শিক্ষা? ধর্মীয় শিক্ষা? না প্রকৃত শিক্ষা?
আবদুল লতিফ- প্রকৃত শিক্ষা।
এর পর ছিদ্দিকিয়া উন্নয়ন পর্ষদ থেকে বেরিয়ে আমরা ঐ অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত দোকানগুলি দেখতে দেখতে প্রদীপ বাবুর সঙ্গে পৌঁছে গেলাম পিফা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য আবু বক্কর গাজীর বাড়ি। দারিদ্র্যের ছাপ এখানে প্রকট।
আবু বক্কর গাজী- ধর্মীয় মানুষেরা নয়, ধর্ম যারা বোঝে না, তারাই এসব গোলমাল করছে। চারপাশে নানা গুজব রটেছে ওইসময়। এই গুজব থেকেই ট্যাঁটরা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পাইকপাড়ায় এসে ভাঙচুর চালায়। এর পাল্টা মুসলমানদের তরফ থেকে আক্রমণ শুরু হয়।
পুলিশকে সেরকমভাবে প্রথম দিকে ব্যবহার করা হয়নি। প্রথমেই যদি পুলিশ ব্যবস্থা নিত তাহলে কার্ত্তিক ঘোষের প্রাণ যেত না। এম এল এ দিব্যেন্দু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, হিন্দু ছেলেদের ধরিয়ে দিয়েছেন পুলিশকে বলে। ওনার বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। দেড় দিন ধরে ছেলেপুলেরা যখন গোলমাল চালিয়ে গেলো তখনই পুলিশ তাদের সরিয়ে দিতে পারতো। দেড় দিন পর রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রী তরজা হল। তারপর ফোর্স এল। লোকে বলছে সরকার মুসলমানের হয়ে গেছে।
আবু বক্কর গাজীর পরিবারের মহিলারা শিশুদের নিয়ে পিছনের ধানক্ষেত দিয়ে ছুটেছিলেন ট্যাঁটরার দিক থেকে আসা হিন্দুদের আক্রমণের সময়। তাঁদের কথাবার্তায় আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল। বাচ্চারা প্রবল কান্নাকাটি জুড়েছিল। পঁয়ষট্টি বছরের জাহানারা বিবিও ওইসময় বাচ্চাদের নিয়ে ছুটেছিলেন।
কাছেই বাড়ি তাবিজুল মণ্ডল-তারিবুল মণ্ডলদের। তাঁদের বাড়িতে রাজমিস্ত্রি কাজ করছিলেন। রাজমিস্ত্রি রাব্বান গাজী পালিয়েছিলেন ওইদিনের হামলার সময়। চার-পাঁচ দিন বন্ধ থেকেছে কাজ। বঞ্চিত থেকেছেন দৈনিক উপার্জন থেকে। ইটের খোয়া জড়ো করা ছিল। হামলা হয় ওদের বাড়িতেও। বৃদ্ধ অথর্ব বাবাকে কাঁধে করে নিয়ে পালান তাঁরা। শিশুরা প্রবল কান্নাকাটি করেছে কয়দিন। পরে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে এলেও ঢুকতে চায়নি তারা। খেতে চাইছেনা। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস-এর শিকার তারা। আমরা দাঙ্গার বীভৎসতার শিকার শিশুদের সঙ্গে কথা বলি নিভৃতে। এই প্রতিবেদনের পরবর্তী অংশে শিশুদের সঙ্গে কথার বিবরণ রাখা হয়েছে। কথা হয় বৃদ্ধ তারিবুলের পুত্র কলকাতায় বেসরকারি ব্যাঙ্কে কর্মরত হাফিজুল মণ্ডলের সঙ্গে।
হাফিজুল মণ্ডল
আমাদের বাড়ি যেদিন ভাঙচুর হল সেদিন দশজনের মধ্যে পাঁচজন বলছিল, এঁদের বাড়ি ভাঙছিস কেন, এরা তো কিছু করে নি। কিন্তু আর পাঁচজন বলছে না মুসলমান বাড়ি ভাঙ – এই হচ্ছে কথা। হিন্দু আর মুসলিম এই হচ্ছে কথা। আমরা যে একসাথে খেলা করলাম, বড় হলাম সেকথা ভুলে গেল সবাই। বাইরের লোক তো সাথে ছিল, কিন্তু পাড়ার লোক তো দেখিয়েছে যে এটা মুসলিম বাড়ি।
এই সময় ওনার ছোট ছেলে সেখানে উপস্থিত ছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করার পরেই সে কেঁদে ফেলে। সেদিনের ঘটনা যে কতখানি ট্রমাটিক তা সহজেই অনুমেয়। আমরা নিজেরাই খুব বিহ্বল হয়ে যাই। এরপর বেশ খানিকক্ষণ ধরে ওনার বাবা নিজে কোন কোন বিল্ডিং বানিয়েছেন, কোন কোন মন্দির গড়েছেন সেকথা বলছিলেন ।
আমরা- চাচা, এতদিন তো দেখলেন, কী মনে হয় এরপরে ভাল হবে কি সময়?
বাবা- ভালোর দিকে মোটামুটি এসে গেছে বলেই তো মনে হচ্ছে। যাই হোক ছেলেরা বারন করলেও আমি শুনিনা, আমি ট্যাঁটরা অবধি যাই। ওদের সাথে গল্প করি, চা খাই। ঐ সব নিয়ে আর আলোচনা করি না। এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে গেছে।
হাফিজুল মণ্ডল- তোমার না থাকতে পারে, আমার আছে। যে ধাক্কা লেগেছে, তাতে যে বন্ধুত্ব ছিল, সে সব নষ্ট হয়ে গেছে। সে আর নেই। সেই সম্পর্ক আর নেই। আমার ভাই বন্ধু হয়ে তারা যদি আমার বাড়িতে ইট মারতে পারে তাহলে কী করে বিশ্বাস করব? যার দোকানের মাল খাই সেও এসে একটা ইট মেরে গেছে। আমি যে ঘরে ছিলাম তার একটা জানালা খোলা ছিল, আমি তো সব দেখেছি। ভিডিও করার চেষ্টা করেছিলাম, সেটা হয়নি, আর ভয়ও লাগছিল।
বাবা- আমি তো আসলে কিছু দেখিনি। আমার দরজা বন্ধ ছিল।
হাফিজুল মণ্ডল- যাদের সাথে খেলা করেছি, তারাও ইট মেরেছে। আর ওদের মুখে ছিল, জয় শ্রীরাম।
আমরা- কী মনে হয়, বিজেপি’র কোন প্রভাব আছে এখানে?
হাফিজুল মণ্ডল- নতুন নতুন আসছে বলেই তো মনে হয়। কিছু লোক আছে।
আমরা- আর এস এস আছে?
হাফিজুল মণ্ডল- বসিরহাটে তো নেই জানি। ‘জয় শ্রীরাম’ কারা বলে? আমাদের এলাকার হিন্দুরা কিন্তু ‘জয় শ্রীরাম’ বলে না।
আমরা- আচ্ছা, যারা ছিল, তাদের সাথে পরে কথা হয়েছে? তারা কি বলছেন?
হাফিজুল মণ্ডল- অনেকের সাথে আমি আর কথা বলি না, অনেকের সাথে বলি। হ্যাঁ ওরা অনেকে বলছে ভুল একটা হয়েছে। বলছে, বাইরের লোকেরাই বেশি করেছে। কিন্তু দেখুন এখানে মুসলিমরা যখন এল পাইকপাড়ার একজনও কিন্তু ছিল না! সব বাইরের লোক। কিন্তু ওঁদের দিক থেকে যখন লোক এল তখন তো ট্যাঁটরা’র লোক ছিল। আর বাইরের লোক ইত্যাদি সবাই মিলে কী যে একটা পরিস্থিতি কি বলব আপনাদের।
আমরা- আপনার মনে হয় না, স্থানীয়রা যদি একজোট হয়ে বাঁধা দিতেন তা হলে এরকম হত না?
হাফিজুল মণ্ডল- আমি প্রশাসনের দোষ দেব। যখন শুরু হচ্ছে তখন সচেতন হলে, বা আমরা হিন্দুমুসলিম একসাথে বেরিয়ে আসলে তো এরকম হত না। বড় কিছু হবার আগে কেউ বাইরে বেরোয় নি। র্যাফের পেছন পেছন হিন্দুরা ভাঙচুর করতে করতে এল। তার আগে মুসলিমরা দোকানে গিয়ে হামলা করেছে তার ফলে এই। তাও আমি গিয়ে দেখেছি, ঐ দোকানের চালের বেরিয়ে থাকা অংশগুলো ভেঙেছে। একটা ছেলে অন্যায় করেছে, আমরা গিয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন করতে পারি যে গ্রেফতার কর, কিন্তু তা বলে কোন বুদ্ধিমান মানুষ এরকম করবে? যে সব ছেলেপুলে এসেছে তাঁদের দেখলে আপনাদের এমনিতেই রাগ ধরবে। বারো চোদ্দ বছর বয়েস সব, হাতে চটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আমরা তো মুসলিম, আমরা তো যাইনি, আমাদের কি গায়ে জ্বালা ধরে না?
আমরা- আপনার ভাই কি গ্রেফতার হয়েছেন?
হাফিজুল মণ্ডল- না। তার সাথে তো দুমাস কথাই হয়নি। তিনমাস না-হলে জামিনও হবে না। পুলিশ আসেও নি। পুলিস জানে এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। আরে স্কুল মাস্টারের নামেও তো অভিযোগ করেছে। এরা কিছু করেনি, এঁদের নামে অভিযোগ।
আমরা- কার্ত্তিক ঘোষ এর মৃত্যু কী করে হল?
হাফিজুল মণ্ডল- আমি তো ওনাকে চিনতাম, নাম জানতাম না। যখন গণ্ডগোল হচ্ছে, তখন শুনলাম কে নাকি পরে আছে, পরে জানলাম উনি কার্ত্তিক ঘোষ।
আমরা- উনি কি মারপিট করতে গেছিলেন?
হাফিজুল মণ্ডল- দেখুন দাঙ্গা হচ্ছে, সবাই জানে, সে সময় ওঁর বাড়ি তো সেই কতদূর তো উনি এতদুরে এলেন কী কারণে? আরে ওদের সাথে বৃদ্ধারাও এসেছে। সবাই অস্ত্র হাতে।
আমরা- কীরকম অস্ত্র? মানে বাড়িতে যেগুলো রোজ ব্যবহার হয় সেগুলো?
বাবা ও হাফিজুল মণ্ডল- হ্যাঁ, ঐ আপনাদের যেমন খাঁড়া আছে সেরকম।
আমরা- খাঁড়া তো প্রত্যেকের বাড়িতে থাকে না।
বাবা ও হাফিজুল মণ্ডল- কিন্তু ঐরকম খাঁড়া ছিল। একটা বুড়ি এসেছে, তার হাতেও ঐরকম। আমাদের বাড়িতে তো খুব বেশি কিছু থাকেই না। ঐ একটা দা আছে, তাতে ডাব পর্যন্ত ভালভাবে কাটে না। যাই হোক, আমারও এই ৪১ বছর বয়েস হয়ে গেল, বাবার ৭০ আমরা তো এই দেখলাম এই গণ্ডগোল, আমার ছেলে এত ছোট বয়েসেই এই দাঙ্গা দেখে ফেলল। আমি ফোন করছি আমার হিন্দু বন্ধুদের, ওরা বলছে, কী করব বল, তুই পারলে আমাদের বাড়িতে চলে আয়। এবারে দেখুন, ওদেরও বাইরের লোক ছিল আমাদেরও বাইরের লোক ছিল। মুসলমানদের দোষ বলব আমি। ওঁরা বারে বারে গিয়ে ঝামেলা করেছে। আগের দিন রাত্রে ঐখানে গিয়ে একটা বোমও মেরেছে জানেন। এবারে হিন্দুরাও রেগে গেছে। আমি একটা ছেলেকে বললাম তোরা এইটুকু ছেলে তোরা লাঠি নিয়ে কী করছিস। আমাকে বলল, তুমিও তো মুসলমান, তুমিও চল, তোমার কী লাগবে বল। আমার মিসেস বলল, তুমি চলে এস। ওরা একটা ভ্যানওয়ালা কে ধরেছিল, আমরা তাকে সাহায্য করি। ওকে জিজ্ঞেস করে ওরা, তুই হিন্দু না মুসলিম? তো ভ্যানওয়ালা মুসলিম বলে ছেড়ে দিল, জানেন। কী বলব আর!
আমরা- শান্তি কমিটি হয়েছে শুনলাম।
হাফিজুল মণ্ডল- হ্যাঁ শুনেছি। আমি যাইনি। কী যাব? আমি তো জানি, আমার পরিচিত লোকেরাই ভেঙেছে। শান্তি কমিটি কী শান্তি আনবে, গণ্ডগোলের সময়েই বেরোয় নি এখন কমিটি করে কী হবে? আমরা উভয় মিলেই যদি বেরোতাম, এই ঘটনা ঘটত? তখন তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। হিন্দুরা বার বার বলেছে তাদের বাড়িতে যেতে। আমাদের এলাকা এরকম ছিল না, এখনও নয়, কিন্তু কী যে একটা হয়ে গেল! তবে এখন পরিস্থিতি আগের থেকে ভাল।
পরিমল তপাদার
পরিমল তপাদার একজন অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন তাঁত ব্যবসায়ী। বয়স আনুমানিক ৭০ ছুঁইছুঁই। সুঠাম দেহের গঠন, কথায় আত্মবিশ্বাসের পরিষ্কার বহিঃপ্রকাশ প্রভাবিত করবে। বর্তমানে ওনার বেশ কয়েকটি পাওয়ার লুমে হাসপাতালের প্রয়োজনীয় ব্যান্ডেজ তৈরি হয়। উনি বললেন ওনার তিনটে তাঁতে উৎপাদন হচ্ছে, তবে ওনার স্ত্রী কর্মরত অবস্থায় হেসে বললেন, আমাদের প্রায় পনেরটা তাঁত চলে। বাইরে বেশ কয়েকটি তাঁত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলে উত্তর এল, লোক পেলেই ব্যবহার করা যায়, এখন তো মুসলমানরা এবাড়িতে কাজ করতে চায় না। ওরা ছাড়া মেশিন চালাবে কে? এমনিতে বাজারে কাপড়ের চাহিদা প্রচুর, আমরা জোগান দিতে পারছি না।
আমরা- আমাদের বন্ধুরা আগে এসে আপনার সাথে কথা বলে গেছে। এখন শুনলাম কার্ত্তিক বাবুর খুনিরা ধরা পড়েছে?
তপাদার- হ্যাঁ। তিনজন’কে ধরেছিল তার মধ্যে একজনকে ছেড়ে দিয়েছে। আর যাদের খুঁজছে তারা এখানে থাকে না। আর এখন পাইকপাড়া স্কুলে সবসময়ই পুলিশ থাকে ফলে সব শান্ত আছে। ঐ দুজনের মধ্যে একজন হাইস্কুলের শিক্ষক আর একজন প্রাইমারী’র। ওরা ফোন করে লোক জড় করেছেন। শিক্ষিত মানুষ তো সামনে থাকে নি।
আমরা-এদের কি সাংগঠনিক কোন ভিত্তি আছে? মানে এরা কী কোন সংগঠনের হয়ে কাজ করেন?
তপাদার- হ্যাঁ। ওরা যুক্ত। জামাতে ইসলামের সংগঠন আছে। এখানে শুনি সৌদি আরব থেকে টাকা আসে, আর সে টাকায় মসজিদ তৈরি হয়। আগে তো এত মসজিদ ছিল না। আপনারা যেখানে নামলেন (বড় রাস্তার ওপরে) সেখানেও একটা শুরু হয়েছিল, তবে এখানে যে এতিমখানা আছে, তারা বাধা দেয়, বলে এত কাছাকাছি এগুলো হয় না, তাই সেই মসজিদ তৈরির কাজ এখন বন্ধ আছে।
আমরা- কটা মসজিদ আছে?
তপাদার- আপনি দেখলে অবাক হবেন। পাড়ায় পাড়ায়। সব সৌদি আরব থেকে টাকা আসছে। তারপর ঐ যে ঈদ-এর সময়। কুরবানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আগে তো এত ছিল না। ওরা সব দান করে দিচ্ছে। এ তো গরীব এলাকা, এখানে মানুষের এত টাকা কোথায়। আর একটা সমস্যা আছে জানেন। আগে আমরা যখন ছোট, বুঝলেন তখন এত খোলাখুলিভাবে গো-মাংস বিক্রি হত না। এখন দেখি যেখানে খুশি সেখানে মাংস বিক্রি করছে ওঁরা।
আমরা- একটু যদি পরিবর্তনের ইতিহাসটা বলেন।
তপাদার- ধরুন চল্লিশ বছর আগেও ছিল না, আর এইটা বেশি শুরু হয়েছে গত দশ’বারো বছরে। আগে বেশ অনেকটা দূরে একমাত্র মুরারিকা বলে একটা চৌমাথা আছে, একমাত্র সেখানেই গো-মাংস বিক্রি হত। এখন একটু এগোলেই দেখতে পাবেন। এখানে তো হিন্দুরা সংখ্যালঘু। এটা মোটামুটি ২০০০ এর পর বেড়েছে।
আমরা- আগে মসজিদ কটা ছিল?
তপাদার- এইতো পাইকপাড়ায় একটা, বোকনায় একটা, আর ব্যাঙপুকুরে একটা ছিল। এখন তো প্রচুর। দুদিন পর পর ওদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় আর ওরা বলে নাহ, আর তোদের সাথে নামাজ পড়ব না, ব্যাস! আবার নতুন মসজিদ তৈরি হয়। আর ঐ যে জামাতি ইসলামী, ওরা টাকা জোগাড় করে দেয়। অন্যরাও আছে।
আমরা- এখানে টাকা কাদের দেয়?
তপাদার- নানা যোগাযোগ আছে।
আমরা- আপনার শ্রমিক তো মুসলমান আছেন?
তপাদার- হ্যাঁ। সবই তো মুসলিম।
আমরা- তা, ওঁদের থেকে খবর পান না, ওঁদের সমাজের ভেতরে কি চলছে?
তপাদার- (হেসে) না, ওঁরা বলে না।
আমরা- ঘটনার সময় তো, মনে হয় কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল।
তপাদার- হ্যাঁ, তাতো ছিলই। আপনাদের বন্ধুরা যখন এলেন তখনও বন্ধ ছিল। ঐ ওঁরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, হিন্দুবাড়িতে কাজ করবি না। মানে, আমরা কাজ না করলে ওঁরা কি করবে।
আমরা- ঘটনার সময়ে আপনাদের মনে ভয় কাজ করে নি?
তপাদার- হ্যাঁ। ওঁরা তো আমাদের বাড়ির সামনের মন্দির’টা ভাঙতে এসেছিল। ঐ যে রাস্তার ধারের মন্দিরটা দেখলেন, সেটা। ওটা কালীমন্দির। আবার কিছু লোক বলল, ঐ চল চল, ওঁদের খেয়ে পড়ে মানুষ আমরা, মন্দির, ভাঙিস না। যেদিন পাইকপাড়ার ঘটনা ঘটে, সেদিন ওদিক থেকে হাজার হাজার মুসলিম হাতে লাঠি-সোটা নিয়ে এসে হাজির হয়। ওঁদের সাথে পেট্রোল এর বোতল, শাবল, দা, এমনকি স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী’র চেরাই করা কাঠ, সবকিছু ওঁরা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। পাইকপাড়া’র বাজারে একটাও হিন্দু দোকান ছিল না। এখন আবার নতুন করে তৈরি করেছে। আপনারা ফেরার সময় একবার কথা বলে দেখতে পারেন। দোকান গুলো বন্ধ ছিল অনেকদিন।
হঠাৎ আমাদের দলের এক মহিলা সদস্যর দিকে তাকিয়ে তপাদার জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?
আমরা- উনি আমাদের দলের সদস্য।
তপাদার-না মানে, উনি হিন্দু না মুসলিম?
‘আমার নাম, ইপ্সিতা চক্রবর্তী’ – ‘চক্রবর্তী’ শব্দটি’তে জোর দেন ইপ্সিতা।
তপাদার- না মানে, ওঁদের সম্পর্কে অনেককিছু খোলাখুলি বলছি তো, তাই। আসলে পরিস্থিতি তো সুবিধের নয়।
আরে, এবছর তো পুজাতেও বড্ড বাড়াবাড়ি হয়েছে। সেই চতুর্থী থেকে শুরু হয়েছে। আসলে, কী জানেন এখন ওপরে ওপরে আমরা তৃণমূল, এখন মনে হচ্ছে, আর করা যাবে না। আমাদের এখানে বেশ কিছু, কৃষি সমবায় ব্যাঙ্ক আছে। আমি দু একবার প্রেসিডেন্ট’ও হয়েছি। সবসময়ই সিলেকশন পদ্ধতিতে এই নির্বাচনগুলো হয়, কিন্তু এবারে আর সিলেকশন হচ্ছে না। এবার থেকে ইলেকশন হবে। কেন জানেন, তৃণমূলের মধ্যেই নানান রকম মতবিরোধ তৈরি হচ্ছে।
ওরা কত ভয়ঙ্কর জানেন? ঘটনার দিন শুরুতে পাঁচ-ছটা গাড়িতে করে আধাসেনা [র্যাফ] এল। ওদের এলাকা থেকে এমন আক্রমণ করল যে, ওদের গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে গেল অনেকেই আহত হল ও ওরা পিছু হটল। পরে ওরা আরও অনেকগুলি গাড়িতে করে এল, এবং ঐ এলাকায় বেশ ভালোরকম অভিযান চালাল।
আমরা-প্রশাসনিক তৎপরতা তো থাকবে না, আজ নয় কাল চলে যাবে। এর পর?
তপাদার- আমরা এতবছর এখানে থেকেছি, কাজ করেছি, এরপর হয়ত এখান থেকেই আমাদের চলে যেতে হবে। ওরা সংখায় এত বেড়ে যাচ্ছে। ওদের প্রোডাকশনের হার খুব বেশি। শিক্ষা নেই আর খুব হুইমজিক্যাল। এরা যে কোন কিছুতেই দুম করে ঝাপিয়ে পড়ে, তার ফলাফল কী হতে পারে সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে না। আপনারা ঐ চেহারা না দেখলে বুঝতে পারবেন না।
আমরা- এখানে তো উভয় সম্প্রদায়েরই কিছু লোক আছেন, যারা এসব পছন্দ করেন না। তেমন কে কে আছেন এখানে?
তপাদার- হ্যাঁ আছেন। একজন আছেন লতিফ হাজী উনি এতিম খানার সেক্রেটারি। উনি শান্তি কমিটির সাথে যুক্ত হন। এক ভ্যান চালককে ওরা আক্রমণ করে। লতিফ হাজী কিন্তু ওঁদের ৫০০ টাকা দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু জানেন, এতিম খনা থেকে মাইকে করে আসলে ঘোষণা হয় “ভাইয়েরা তোমরা যার কাছে যা আছে তা নিয়ে বেরিয়ে পড়” এটা যে কেন করল বুঝলাম না।
আমরা- এই অঞ্চলে হিন্দুরাও ধর্মের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছে, তা জানতে পারছি আমরা। সেক্ষেত্রে বিজেপি কোন সাহায্য করছে কি?
তপাদার বাবুর ছেলে- আসলে যা হবে সবকিছুই চুপিচুপি হবে। কেউ ঝাণ্ডা হাতে বেরোবে না। শমিক ভটচাজ যদি যদি একটু সংগঠনটা দেখত, এতদিনে তৈরি হয়ে যেত। কিন্তু দীপেন্দু যেভাবে খেটেছে তার ধারে কাছেও কেউ ছিল না।
আমরা- এই ঘটনার পর, বসিরহাট শহরে একটা বেশ বড় মিছিল বেরোয়, এবং প্রচুর তৃণমূল পার্টিঅফিস ভাঙচুর হয়। এটা কি বিজেপি করেছে?
তপাদার- হ্যাঁ হয়। তবে ঐ দীপেন্দু বেছে বেছে হিন্দুদের গ্রেফতার করানোর জন্যই এটা হয়েছে। গোডাউন পাড়ায় পুলিশ রেইড করে, দীপেন্দুর নির্দেশে, ওখানে হিন্দুরা থাকত, অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে রেইড হয়েছিল ফলে রাগ’টা গিয়ে তৃণমূলের ওপরে পড়ে।
মজার কথা হল, কথোপকথনের শেষে উনি খলাখুলি বলেন, বিজেপিকে একটু দেখুন।
হাজী আব্দুল কাদের সর্দার
আব্দুল কাদের সর্দার শান্তি কমিটির সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার ফলে শুরুতেই শান্তি কমিটি’র সাফল্য হিসেবে দাঙ্গা-পীড়িত যে স্থানে স্থানীয় দুর্গাপূজা করা হয়েছিল সেটি আমাদের দেখান। তাঁর মতে ঐ পরিস্থিতিকে ওনারাই আয়ত্তে আনেন এবং সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত ওনারা খুবই ভাল আছেন।
আমরা- একটা সময় আমরা শুনেছিলাম শান্তি কমিটি ধারাবাহিকভাবে কাজ করবে, সেটার কি হল?
আব্দুল- আসলে যে উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, আর তাই এখন আমাদের মধ্যে যে পরিবেশ আছে তাতে শান্তি কমিটির আর খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নেই। এই দাঙ্গায় যে ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু ভাইয়েদের বেশি হয়েছে, ওঁদের দোকান ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, তাতে ওঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া গেছে।
আমরা- আপনার মনে হয়, এ ঘটনা আর ঘটবে না? আর, এত সহজে এই ঘটনা সামাল দিয়ে দেওয়া যাবে?
আব্দুল- দেখুন, যারা এ ঘটনা ঘটায় তারা যে ধর্মের লোক হোক না কেন, তারা কিন্তু মূলত ধান্দাবাজ লোক। যে ঘটনা ধরুন হয়েছে, আমার সাথেই ধরুন যতটুকু হয়েছে, আমি কি সবকিছু মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছি? একটু সময় লাগবে বৈকি! আজকে যে কার্ত্তিকদা মারা গেলেন, শ্বেতপুরে একটা ছেলের গায়ে শেল লাগলো এগুলো কি সবাই ভুলে গেছে? এগুলো কাটাতে হবে পারস্পরিক মেলামেশার মাধ্যমে।
আমরা- মেলামেশা’র পরিবেশ কি তৈরি হয়েছে?
আব্দুল- হ্যাঁ, অবশ্যই।
আমরা- দূরত্ব তো হঠাৎ তৈরি হয়নি, নিশ্চয়ই অনেক দিন ধরেই কিছু সমস্যা আছে। একটা ফেসবুক পোস্ট থেকে এই ঘটনা তো ঘটার কথা নয়।
আব্দুল- না, আমার এলাকায় কিন্তু আর কোন ইস্যু কাজ করে নি।
আমরা- সত্যিই কি যারা হামলা করেছিলেন তাঁরা সবাই পাইকপাড়া’র মানুষ? নাকি বাইরের লোকও ছিল?
আব্দুল- বাইরেরই বেশি ছিল।
আমরা- বাইরে থেকে যারা এসেছে, তারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়ে এসেছে?
আব্দুল- পোস্টটা হবার পরে মুসলমান সমাজের মনে লেগেছে, ধর্মে আঘাত লেগেছে। তো রাগ’টা আর কোথায় যাবে, হিন্দুভাইদের ওপরে গিয়ে পড়েছে। এখন ওরা দোকানপাট ভেঙেছে। হিন্দুভাইদেরও তো ধৈর্যের সীমা আছে। ওরাও প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আর ফলে এরা প্রত্যেকে মুখমুখি হয়ে গেছে। যার ফলাফল হল কার্ত্তিক’দা চলে গেলেন। পুলিশ, র্যাফ আসার পরে আমরা নামলাম। যা হয়েছে হয়েছে কিন্তু আর যাতে কিছু না হয় তার জন্য। হিন্দু ভাইয়েরা ভয় পাচ্ছে, আমরা তাঁদের বাড়িতে সময় কাটাতে শুরু করলাম। আমাদের এই পাড়াটা মুসলমান পাড়া। এখানে দু এক ঘর হিন্দু ভাই থাকেন। তাদের আমি বললাম ভয় না পেতে, আর বেশি ভয় করলে আমাদের বাড়িতে চলে আসতে। এইরকমভাবে জিনিসটা আয়ত্তে এসেছে। তবে একটা কথা বলব, এখানকার এস পি শ্যামল সামন্ত চলে গেছেন, ট্র্যান্সফার হয়েছেন, উনি খুব চেষ্টা করেছেন।
আমরা- দেখুন কোন অঞ্চলে দীর্ঘদিনের মেলামেশা থাকলে এরকম কিন্তু হবার কথা নয়। এই ঘটনার কোন ইতিহাস নেই, এটা বলছেন?
আব্দুল- ঘটনার দিন পাইকপাড়ায় রাস্তা অবরোধ হয়েছিল। আমি সেখানে গেছি। অবরোধ তুলতে পুলিশ এসেছেন, এস ডি পি ও, আই সি, সকলে। অন্য একটা পাড়া থেকে পুলিশ এসেছে শুনে হাজারে হাজারে লোক আসতে শুরু করল, ঐ পাড়ার নাম বলাটা অপরাধ হবে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বললাম, স্যার আপনারা চলে যান, এরা বাইরের লোক আসছে, আমরা অবরোধ তুলে দিচ্ছি। আমরা অবরোধ তুলে দিলাম। তারপর এদিক থেকে বেশ কিছু মানুষ শহরের দিকে গেল তাদের প্রতিরোধ করতে গেল হিন্দুরা আর এই প্রতিরোধের ফল হল কিন্তু কার্ত্তিক দা চলে গেলেন। এরপর শান্তি কমিটির নেতৃত্বে সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল সবাইকে নিয়ে তার সাথে আই সি, এস ডি পি ও কে নিয়ে শান্তিসভা করলাম। সেখানে ওঁদের বললাম, এখন তো আর নির্বাচন নয়। এখন সবাই মিলে শান্তির কথা বলুন, পরে নির্বাচনের সময়ে আবার ইস্তেহারের কথা বলবেন।
আমরা- এই যে ধরুন হঠাৎ করে হাজার হাজার মানুষ ছুটে এল, এর কারণ কী?
আব্দুল- ওদের মনে হয়েছে যে আমার ধর্মের নামে এসব কথা বলেছে আর পুলিশ তুমি আমাকেই তুলতে এসেছো! অথচ দেখুন পুলিশ কিন্তু তাকে (শৌভিক) অ্যারেস্ট করেছে, তাকে কোর্ট-এ চালান করেছে। এই যে মানে সব অশিক্ষিত মানুষ, জ্ঞানের অভাব।
আমরা- কিন্তু শুনলাম দুজন শিক্ষিত ব্যাক্তি পলাতক যাদের মধ্যে একজন প্রাইমারী স্কুল ও একজন হাইস্কুল শিক্ষক।
আব্দুল- এঁদের সম্পর্কে শুনেছি, যে কার্ত্তিকদা’র খুনে অভিযুক্ত। আমিরুল ও আব্দুল আজিজ। এরা কিন্তু মোটেই যুক্ত না। কোনভাবেই যুক্ত নন।
আমরা- যারা অ্যারেস্ট হয়েছেন?
আব্দুল- তাঁরা এই গ্রামের নন।
আমরা- দেখুন আমাদের একটা ধারণা হচ্ছে যে কোথাও একটা দুরত্ব তৈরি হয়েছে দু সম্প্রদায়ের মধ্যে। আমাদের মনে হচ্ছে যে পরিস্থিতি বেশ বিপজ্জনক। দাঙ্গা এবং পরবর্তী মেরুকরণকে ব্যবহার করছে রাজনীতির স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
আব্দুল- আপনারা এটা ধারণা করছেন, তাই তো? সেটা আমাদের এই পাইকপাড়া অঞ্চলে কিন্তু নেই। যদি থাকেও সেটা খুবই অন্তর্নিহিত অবস্থায় আছে, তার বহিঃপ্রকাশ নেই।
আমরা- এই যে, অন্তর্নিহিত যে স্রোত আপনি বলছেন, সেটা না চিনতে পারলে দাঙ্গা আবার হবে। এই চোরা স্রোত’টা কীভাবে কাজ করছে সেটা জানা দরকার। এই যে হিন্দুরা বা মুসলমান রা দলে দলে আসছেন, তার পেছনে কোন সংগঠন কাজ করছে না এটা বিশ্বাস করা দুষ্কর।
আব্দুল- তবে এই যে লোকজন বেরিয়েছে না, এটা কিন্তু স্বতস্ফূর্ত। অনেক বিক্ষিপ্ত ঘটনা হয়েছে, সেগুলো কেউ পেছন থেকে নির্দেশ দিয়েছে এমনটা মনে হয় না।
আব্দুল হাজীর ছেলে- আমি একটু বলি শুনুন। এই যে বসিরহাট শহরে তৃণমূল-এর পার্টি অফিস ভাঙচুর হয়েছে সেটা কিন্তু দিব্যেন্দুদার (দীপেন্দু বিশ্বাস) জন্যই হয়েছে। যারা বসিরহাট শহরে দাঙ্গা করেছে তারা গোডাউন পাড়ায় আশ্রয় নেয়। দিব্যেন্দুদা ওদের ধরতে যায় প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে। ফলে ওখানে একটা রাজনীতির রঙ লাগে। দিব্যেন্দুদার ওপরে সব রাগ গিয়ে পড়ে, ফলে রাজনীতির বিষয় উঠে আসে। হিন্দুদের মনে হল এই দেখ তৃণমূল আমাদের ধরতে আসছে আগে, কিন্তু যদি আপনি অ্যারেস্টে’র সংখ্যা দেখেন মুসলমান দেখবেন ৯০ শতাংশ।
আমরা- আচ্ছা কার্ত্তিক বাবু কীভাবে মারা গেলেন?
আব্দুল- প্রথমদিন ১২-১৪ বছরের মুসলিম ছেলেরা ট্যাঁটরা পর্যন্ত গেছিল। কার্ত্তিকবাবুরা ওদের তাড়া করে পেছনে পেছনে ছুটছিল। তখন মনে হয় দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে টড়ে কিছু একটা হয়েছে, ঐ লোক তো ড্রিঙ্ক করেছিল।
গণ্ডগোলের দিন আমি শিশিরদাকে ফোন করলাম, খবর পেলাম যে পাইকপাড়ায় তোলপাড় চলছে। শিশিরদা বলছে ভয় পাচ্ছে বেরোতে পারছে না। আমি গিয়ে দেখি র্যাফ এসেছে টিয়ার শেল ফাটাচ্ছে। আমি তখন সামনে গেলাম। তখন অবধি জানিনা যে কার্ত্তিক’দা পড়ে আছে। তখন র্যাফের পাশে দাঁড়িয়ে শিশিরদাকে ফোন করে ডাকলাম যে তুমি এসো। কে পড়ে আছেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে জানলাম যে ও কার্ত্তিক ঘোষ ছিল। আমি কার্ত্তিক ঘোষকে দীর্ঘদিন চিনি। ও আমাদের বাড়ি থেকে ধান কিনে বাজারে বিক্রি করত। গরীব ছিল। আমাকে খুব সমীহ করত। ওর বাড়ি গেলে চা খাওয়াত। আমরা চেষ্টা করেছি অনেক।
আমরা- কিন্তু শান্তি কমিটি’র ধারাবাহিকতা তো দরকার।
আব্দুল- শান্তি কমিটি অত সক্রিয় না হলেও আমরা তৈরি আছি, প্রয়োজন হলেই বেরিয়ে পড়ব। আমি, শিশির ঘোষ, পরিমল দা, জিয়াত ভাই এরা সবাই আছি।
আমরা- আচ্ছা, এই মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে অনেক সময় অনেক কিছু শোনা যায়, এটা কি সত্যি?
আব্দুল- না, লোক সংখ্যা বেড়েছে ফলে মসজিদের সংখ্যাও বাড়ছে, এটা এমন কিছু বড় বিষয় নয় বলেই মনে হয়।
গোডাউন পাড়া
স্টেশনের কাছে হিন্দু অধ্যুষিত, গোডাউন পাড়া। দাঙ্গায় এই পাড়ার ভূমিকা ছিল বলে আমরা জানতে পারি। স্থানীয় দু’একজন এলাকাটি সমাজবিরোধীদের আখড়া, আমাদের না যাওয়াই ভালো বলে সাবধান করে। গোডাউন পাড়ায় আমরা কয়েকজন যুবকের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। এক যুবক বলেন, কোনও রাজনৈতিক নেতা আসেননি। প্রশাসন ঢুকতে দেয়নি। আমরা চাইনা পার্টি ঢুকুক। এটা সিপিএম পাড়া, লাইনের ওপারে মুসলিমরা থাকে, ওটা তৃণমূল পাড়া। বিজেপির প্রভাব সামান্য। যখন মুসলিম যুবকরা আক্রমণ করল, তখন আমরাও জবাব দিলাম। ‘জয় শ্রীরাম’ বলে লোক জড়ো করলাম। ইটের জবাব পাথরে দিতে হয়।
আমরা- এই ‘জয় শ্রীরাম’ আগে কখনও বলেছেন?
যুবকবৃন্দ- না বলিনি। এটাই ওইসময় মাথায় এসেছিল। ময়লাখোলায় টাকি রোডের ওপর ‘মায়ের ইচ্ছা মন্দির’ দেখে আসুন। কীভাবে কালি মূর্তিকে আঘাত করা হয়েছে। আমরা পাড়া পাহারা দিয়েছি। সি আর পি এফ, বি এস এফ আসায় বেঁচে গেছি। ওরাই মেরে তাড়ালো। হিন্দুরা যাতে এগিয়ে আসে তার জন্য ‘আমরা জয় শ্রীরাম’ ডাক দেই। এখন প্রশাসন নজর রাখছে। এখানে একজনের বাড়িতে পুলিশ ঢুকেছে।
আমরা- কাদের সঙ্গে আপনাদের সংঘাত হল?
যুবকবৃন্দ- একটু গেলেই মুসলিম বসতি। তারা কিন্তু বের হয়নি। ৫০-১০০ বাড়ি। ওরা কিছু করেনি। এলো প্রায় আড়াই হাজার লোক। অল্প বয়সী ছেলেরা, পাজামা, মাথায় টুপি। এখানে কেউ মারা যায়নি। আমরা রেল লাইনের পাথর ছুড়ে পাল্টা আক্রমণ করি। ওরা বোমা ছুঁড়েছে। কিছু কিছু মুখ ঢাকা ছিল। আমরা আতঙ্কে সারা রাত জেগেছি। বোতলে কেরোসিন ভরে সলতে জ্বালিয়ে বাড়িতে ছুঁড়েছে ওরা। পরদিন সকাল ১০.৩০-এ এই তল্লাটে সিগন্যাল পাড়া থেকে ২৫০০ লোক আসে। আমরা ছেলেরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে জড়ো হলাম।
আমরা- বোমের উত্তরে পাথরে কাজ হয়েছে?
জনৈক যুবক- আমরাও পাল্টা দিয়েছি। বল্লাম তো, যে রোগের যে ওষুধ।
গোবিন্দ ঘোষ
ট্রেন লাইন সংলগ্ন এলাকা থেকে আমরা টাকি রোডের দিকে এগিয়ে গেলাম। রাস্তার মোড়ে একটি মিষ্টির দোকান। দোকানটি আক্রান্ত হয়েছিল। তখনও আলমারির কাঁচ ভাঙা ছিল। ভেঙে ফেলা ঘরের একাংশ সারাই হয়েছে। দোকানের মালিক গোবিন্দ ঘোষ। তিনি বললেন, কুড়ুল দিয়ে দরজা ভেঙেছে। মাথায় ফেট্টি। হাতে দা, কুড়ুল, লাঠি। ছেলেদের বয়স ১৫-২০ বছর হবে। ৭০ সালে এখানে এসেছি। ৪৭ বছর মুসলমানদের সঙ্গে থেকেছি। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে মানুষ হয়েছি। আগে কখনও এরকম হয়নি। এখন হিন্দু মুসলমান পরস্পর মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে পুকুরে স্নান করতে এসে।
প্রশাসন এসেছে বৃহস্পতিবার, ঘটনা হয়েছে মঙ্গলবার। বুধবারও আসেনি। গোডাউন পাড়ার ছেলেরা এসে বাঁচিয়েছে আমাদের। আমাদের দোকানে আক্রমণে এলাকার মুসলিম ছেলেরাও ছিল। বোমার শব্দ শুনে গোডাউন পাড়ার ছেলেরা এসে পাল্টা বোমা চার্জ করল। বোতল ছোড়া হচ্ছে। দু’দলই ভারি হচ্ছে। একবার এরা এগুচ্ছে, একবার ওরা। ১ ঘণ্টা ধরে চলে এই সংঘর্ষ।
পারস্পরিক সন্দেহের একটি দৃষ্টান্ত
আমরা যখন কথা বলছি, বছর বিশেকের সফিকুল মণ্ডল, আইসক্রিম বিক্রেতা, অভ্যাস মত আইসক্রিম বিক্রি করতে করতে এসেছিলেন গোবিন্দ ঘোষের মিষ্টির দোকানে। একটু জিরিয়ে নিতে, মিষ্টি-জল খেতে। সফিকুল বলেন, আগে কখনও এই রকম হয়নি। পাইকপাড়াতে মুসলিম এলাকায় প্রচুর হিন্দুর দোকান ভাঙচুর হয়েছে। আমি ছোট ব্যবসায়ী, দিনের ব্যবসা, মিলেমিশে থাকতে চাই, নাহলে খাবো কী?
কিন্তু বাস্তবতা হল দোকানদার গোবিন্দ ঘোষ এবং তাঁর স্ত্রী, এই আইসক্রিম বিক্রেতার উপস্থিতিতে সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। ‘আপনারা এসেছেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন, ও (সফিকুল) ঠিক নিজের এলাকায় গিয়ে বলবে এখানে কী কথা হচ্ছে। সব রিপোর্ট করবে। উত্তরে সফিকুল বলেন, কী বলছেন কাকা, আমি তো ওই কয়দিন ছাড়া প্রতিদিনই আপনাদের পাড়ায় আসি আইসক্রিম বেচতে। আপনার দোকানেই খাই। ক্রুদ্ধ গোবিন্দ ঘোষ বলেন, তোদের বিশ্বাস নেই। না হলে কোথাও কিছু নেই, আমার দোকান ভাঙচুর হবে কেন? নিরুপায় সফিকুল বলেন, মুসলিমদের দোকানওতো ভেঙেছে কাকা। তাছাড়া আমাদেরতো ব্যবসা করেই খেতে হবে। আপনি আমি ঝগড়া করবো কেন? নাছোড় গোবিন্দ ঘোষ বলেন, পয়সা মিটিয়ে তুমি কেটে পড় বাছা। এর পর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, সব জায়গায় গণ্ডগোল হলেও বসিরহাটে হবেনা। আমি বলছি, গণ্ডগোল করেছে এখানের স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে আশেপাশের গ্রামের ছেলেরা, বাংলাদেশ থেকে কেউ আসেনি। মুসলিম প্রধান তেঁতুলতলা থেকে র্যাফ অনেক লোককে তুলেছে।
দিলীপ মণ্ডল
মাঝ বয়সী, চায়ের দোকান, গোবিন্দ ঘোষের মিষ্টির দোকানের পাশে। মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা। আমার দোকানে বেশি কিছু হয়নি। ওদের মধ্যে একটা ছেলে বলল, দিলীপদার দোকানে হাত দিচ্ছিস কেন? মনে হয় এলাকার অর্ধেক লোক আর বাইরের অর্ধেক লোক সেই মিছিলে ছিল। আমি তখন বিকেলে দোকান খুলবো বলে ওপর থেকে নেমেছি। না, বাংলাদেশ থেকে কেউ আসেনি। মাদ্রাসার ছেলেই বেশি। বয়স্কদের মুখ (৫০ বছর বয়স্ক হবে) ঢাকা ছিল। প্রায় ৫০০ লোক বড়, এবং ২০০/৩০০ ওই ২০-২৫ বছরের মুসলিম যুবক হবে। বাকি সব ১২-১৬ বছরের ছোকরা। সঙ্গে অস্ত্র- কুড়ুল, দা, হেঁসো, কাঁচের বোতল এবং বোমা। সি আর পি এফ নামলো। মঙ্গলবার রাত্রে নামলো র্যাফ। বুধবার সি আর পি এফ ছিল। সামনে দুটি মন্দিরে ভাংচুর হয়েছে। এসবের পিছনে বড় মাথা আছে।
মায়ের ইচ্ছা মন্দির, টাকি রোড
৬০-৬৫ বছরের পুরনো এই মন্দির। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত। বর্তমানে তাঁর স্ত্রী এই মন্দির দেখাশোনা করেন, সংলগ্ন ঘরে থাকেন। কাছেই বাড়ি, সেখানে পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি থাকেন। দুটো গ্রিলের দরজার তালা ভেঙে কালির বিগ্রহের মাথাও ভাঙা হয়েছে, আমরা দেখলাম।
পুরোহিতের বিধবা- এখানে বোমা পড়েছে। অস্ত্র নিয়ে মানুষ ছুটছে দেখলাম। দুটো হিন্দুর দোকান ভেঙেছে। পরে হিন্দুরা মুসলমানদের দোকান ভাঙে। প্রশাসন বিগ্রহ ও মন্দির ঠিক করতে চেয়েছে। কিন্তু পাড়ার ছেলেরা বলেছে, ওরাই চাঁদা তুলে মেরামত করে দেবে। আসলে এর নাম করে প্রচুর টাকা আসবে। লক্ষ লক্ষ টাকা উঠবে। ইটভাটা থেকে, বিভিন্ন মহল থেকে টাকা তুলে হয়তো তাদের লাভ হবে। এখানে সব টাকার জন্য হাঁ করে বসে আছে। পাড়ার মুসলিমরাও এই মন্দির ঠিক করতে এগিয়ে আসে। আমরা হিন্দু, ওই মুসলমানদের দেওয়া টাকায় মন্দির মেরামত করব কেন? এলাকার যুবকেরা (হিন্দু) রাজি হয়নি। কীভাবে এড়াবো এদের কথা, এদের সঙ্গেই তো থাকতে হয়। এস ডি পি ও এসেছিলেন, বলেছিলেন সারিয়ে দেবেন, কিন্তু যুবকেরা নারাজ। (আমাদের কথা চলার সময় দুই জন ব্যক্তি এসে উঁকি দিয়ে যায়। বৃদ্ধা জানান এঁরাই সেই দাদা। আমরা পরে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। )
আমরা জানতে পারি, মন্দির ভাঙচুরের জন্য এখানের হাটের মুসলিম হাটুরেদের হিন্দুরা বসতে দিচ্ছিল না। অভিযোগ এরা গণ্ডগোল করেছে। ভুল বুঝতে পেরে ওরা ক্ষমা চেয়েছে। এলাকার সেই দাদাদের কাছে অনুরোধ করেছে, হাটে বসতে না পেলে মারা যাবো। কয়েকজনকে ধরাধরি করে এখন হাটে বসছে। আমরা অবশ্য তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, কেননা তারা তখন ছিলেন না। মন্দিরের অনতিদূরে মোড়ের চায়ের দোকানে এই খবর আমরা পাই। চায়ের দোকানের মালিক বলেন, যারা আক্রমণ করলো তাদের কিছুই হবে না আর। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী যে এখন মমতাজ বেগম।
বসিরহাট কোর্ট মসজিদ
মসজিদটি আক্রান্ত হয়। মনে করা হয় যেদিন কয়েক হাজার হিন্দু পথে নামে সেদিন রাত্রেই মসজিদটিতে আক্রমণ করা হয়। আমরা কথা বলি বসিরহাট কোর্ট মসজিদের সেক্রেটারি, রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। উনি পেশায় একজন আইনজীবী। মসজিদে উপস্থিত অন্যান্যরা তাঁর সঙ্গেই কথা বলতে বলেন।
রফিকুল ইসলাম, সেক্রেটারি, বসিরহাট কোর্ট মসজিদ
দন্ডিরহাটে মুসলিম নেতারা শান্তির জন্যে ডাক দিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা আছে। এসব ড্রাগ ও অ্যালকোহলের প্রভাব। ধর্মীয় সুরসুরিতে মানুষ গরম হয়ে যায়। কম বয়সী ছেলেরা-অনুশাসন নেই। যে ক্ষিপ্ত হয়েছে, সে ধর্ম বোঝেনা। আমরা ধর্মীয় নেতা। রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষে যতটা করা সম্ভব আমরা ততটা করতে পারিনা। সকলের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। যুব সমাজ যাতে প্রকৃত ধর্ম বোঝে তার চেষ্টা করছি আমরা।
এই মসজিদ থেকে কিছু ঘোষণা করা হয়নি। মিথ্যা অপপ্রচার হয়েছে। অধিক রাত্রে এই মসজিদের কিছু কাঁচ ভাঙা হয়েছে। ফ্যানের ব্লেড বাঁকিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরদিন সকালেই কংগ্রেস নেতা অমিত মজুমদার সারিয়ে দিয়েছেন। রটনা হয়েছিল এই মসজিদ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু লোকজন এসেছিল। আমরা বলেছি চলে যেতে। তেমন কিছু হয়নি। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, গণ্ডগোল শুরু হওয়ার পাঁচদিন আগে, ফেসবুকে ছবি পোস্ট করার প্রেক্ষিতে সাবধান থাকতে তাঁরা প্রশাসনকে জানাননি কেন? উত্তরে তিনি বলেন, এসব অন্যেরা জানায়, যারা এবিষয়ে দায়িত্বে আছেন। আমাদের জানানোটা ঠিক হত না।
আমাদের কথা হয় মসজিদের মধ্যেই। প্রথমে ইমাম সাহেব ছিলেন না, পরে আসেন। কিন্তু তিনি কিছু বলতে তার অক্ষমতা জানান।
বসিরহাট মহকুমা আদালত
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উকিল
বসিরহাটের আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর হামলা চলতে থাকে। পুলিশ চুপ করে বসেছিল। সংখ্যালঘু ভোট খোওয়া যাবার ভয়ে শাসক দল পুলিশকে ব্যবহার করেনি। পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। বসিরহাট শহরে মন্দিরে কালী বিগ্রহ ভেঙে দেওয়া হয়। মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা করা হয়, হাতের কাছে যা আছে তাই নিয়ে মুসলমান ভাইরা জড়ো হও মসজিদের সামনে। এসবের পর বসিরহাটবাসী হিন্দুরা দলমত নির্বিশেষে, নারী-পুরুষ সকলে প্রায় ষাট হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ভাঙচুর চলে এম এল এ’র বাড়ি। পুলিশের এসকর্ট নিয়ে তিনি এখান থেকে পালান। ভাঙচুর হয় শাসক দলের সব অফিসে। শাসক দলের প্রধান নেত্রী, আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর টাঙানো বড় বড় ফ্লেক্স ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এসব কিছুই ঘটত না যদি প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে কাজের সুযোগ দেওয়া হত। প্রসঙ্গত বলা যায় উকিলবাবুর বক্তব্যে মসজিদের ঘোষণার সমর্থনে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
শুভ্রজিত ভট্টাচার্য, বিজেপি যুব সভাপতি, বসিরহাট শহর, পেশায় আইনজীবী
ফেসবুকের ঘটনা অন্যায়। ছেলেটি নাবালক, তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাকে কেন্দ্র করে বাদুরিয়ায় রথের ওপর হামলা। ওই অঞ্চলে হিন্দুদের দোকান গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যে গণ্ডগোল নেই, বহিরাগতরা করেছে। প্রথম দিন, দ্বিতীয় দিন লাগাতার আক্রমণ। প্রত্যাঘাত ৫ তারিখে হয়েছে। তারপর ৬ তারিখ, বৃহস্পতিবার স্বাভাবিক। সোমবার শাসকদলের প্ররোচনায় পুলিশের অত্যাচার বসিরহাটে। শুক্রবার ৭ তারিখ পরিস্থিতি স্বাভাবিক। ১৫ টা কেস চলছে। যারা আক্রান্ত তাঁদের কাছ থেকে পুলিশ স্টেটমেন্ট নেয়নি।
প্রথম রাতে অ্যাকশন নিলে এমন হত না। যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামত করা যায় না। গুজব দু তরফে। প্রথমে মিথ্যা মসজিদ ভাঙা। মিথ্যা মন্দির ভাঙা। হিন্দু-মুসলমান মন্দির পাহারা দিয়েছে। পুলিশ যদি উল্টোরথের দিন পদক্ষেপ নিত তাহলে এমন অবস্থা হত না। বাংলাদেশ বর্ডার। পাচারকারীদের মদত। একজন খুন। দুজন অ্যারেস্ট। এখনও আতঙ্ক রয়েছে। গরুপাচার কমেছে এখন। পাঞ্জাব থেকে গরু আসছে, কিন্তু বর্ডারে এসে চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। পাকা মাথা আছে এখানে। নইলে বাইরের লোক আসলো কেন? জামাতের লোক আছে। বর্ডারের মাদ্রাসায় সাম্প্রদায়িক প্রচার হয়। কার্তিক ঘোষের কেসে ১১ জন আসামী। বসিরহাট হরিশপুর থেকে কলেজপাড়া অব্দি বেশির ভাগ গরিব লোকের বাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। তারা সাহায্য নিতে চাইছে না। গোডাউন পাড়ায় চারদিন ধরে সংঘর্ষ হয়েছে। আহত এখানে কম। কিন্তু বম্বিং প্রচুর হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের যোগ নেই।
৬ তারিখ বৃহস্পতিবার শাসকদলের উস্কানিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে আক্রমণ করে পুলিশ। তাই তৃণমূলের অফিস ভেঙেছে। তৃণমূলই তৃণমূলের অফিস ভেঙেছে। শমিক ভট্টাচার্য চার রাত কোলকাতার বিজেপি অফিসে ছিলেন। কেননা পুলিশ নেতাদের ঢুকতে দেয়নি। আমরা চাইনা এই ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত হোক। সেন্সেটিভ জায়গা এখন বসিরহাট। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ নেই। রাজ্য সরকার আরও আগে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইলে ভালো হত। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে অনেক জায়গায় বসিয়ে রাখা হয়েছে।
উদয় ভট্টাচার্য, আইনজীবী, তৃণমূল ল সেল-এর প্রেসিডেন্ট
আমি আদি তৃণমূল। ১৯৯৭ সালে যুব কংগ্রেস করতাম। কেবলমাত্র দিদির (মুখ্যমন্ত্রী) জন্য আমরা এখানে এসেছি। দলের হয়ে যা বলার জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এবং মুখ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন।
বি এস এফ কাদের? মুখ্যমন্ত্রী জোর দিয়েছেন বলে গরু পাচার বন্ধ হয়েছে।
বাইরের মদত ছিল। বসিরহাটের স্থানীয় মদত কম। বসিরহাট মহকুমার সংগ্রামপুরে মসজিদ ও মন্দির পাশাপাশি। এখানে তৃণমূলের পার্টি অফিস ভাঙা হল। চক্রান্ত। বসিরহাটের এই যে এত উন্নয়ন, এই উন্নয়ন করেছেন দিদি। দীপেন্দু এখানের এম এল এ, খুব খাটে ছেলাটা। ডাকনাম মিঠু। আদৌ দীপেন্দু ওখানে, গোডাউনপাড়ায় পুলিশি রেইডের সময় যাননি। এস ডি ও অফিসে ছিলেন।
প্রশাসন কখনও নীরব ছিল না। প্রশাসন অবসারভ করছিল। গুলি করলে অনেক লোক মারা যেত।
আমরা- প্রশাসন দেরিতে গ্রেফতার করেছে ফেসবুকে পোস্ট করা ছেলেটিকে। পোস্ট করার ৫ম দিনে। বাদুরিয়ায় ইসলামি গোষ্ঠীগুলির বড় জমায়েত হয়। এস পি এসে সেই জমায়েতে ক্ষমা চান। তারপরদিন ফেসবুকারের বাড়ি আক্রান্ত হয়। পরের দিন থানা আক্রমণ করা হয়, পুলিশের গাড়ি পোড়ানো হয়। পুলিশের ভূমিকা এখানে পরিষ্কার, নীরব দর্শক ছিল তারা।
উদয় ভট্টাচার্য- পুলিশ মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করেছে। বাইরের মদত এবং আমাদের বিরোধী কংগ্রেস-বিজেপি-আর এস এস-এর মদত ছিল। নিজেদের তৈরি পার্টি অফিস নিজেরা ভাঙতে পারে? বাম রাম হয়েছে। কত কষ্ট করে পার্টি অফিস করেছি। বসিরহাটে ফাটল নেই দুই সম্প্রদায়ে। আমরা নিজেদের টাকায় পার্টি অফিস চালাই। মানুষের থেকে টাকা নিইনা। একটি শ্রেণি ক্ষতিপূরণ নিতে চাইছে না। শান্তি কমিটি হয়েছে। শান্তি মিছিল হয়েছে। গণ্ডগোলের মাথা কে আমি জানিনা। কিন্তু প্রশাসন ধৈর্য ধরে মানুষের পাশে থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য কাজ করেছে। এস ডি ও অফিসে বার বার গিয়ে দেখেছি।
আমরা- নাগরিক উদ্যোগ?
উদয় ভট্টাচার্য- অরাজনৈতিক উদ্যোগ কতটা আছে জানিনা। প্রশাসনের দিক থেকে আমরা ঠিক পথ নিয়েছি।
আমরা- তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যুক্ত আছে, এই অভিযোগ আছে।
উদয় ভট্টাচার্য- আমাদের জানা নেই। হলে পার্টি ব্যবস্থা নেবে।
অমিত মজুমদার, আইনজীবী, কংগ্রেস নেতা
আমি বসিরহাটের সর্বকনিষ্ঠ কাউন্সিলর ছিলাম। আমার স্ত্রী বর্তমানে কাউন্সিলর। এখানে যা হয়েছে তার ৮০ % গুজব থেকে হয়েছে। এই কোর্ট পাড়ায় মসজিদের পাশে দুটি হিন্দু-মুসলিম দোকানে ভাঙচুর হয়েছে। মসজিদে কাঁচ ভেঙেছে। ফ্যানের ব্লেড বাঁকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বড় কিছু হয়নি। আমি তাড়াতাড়ি ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এনে লাইট ও ফ্যান চালু করে দিই। গুজবে অনেকে জড়ো হয়েছিল। আমি মুসলিম লইয়ারদের ডাকলাম। বললাম, ওদের বলতে যে কিছু হয়নি। ইমাম সহযোগিতা করেছেন। তিনি সব ইমামকে ফোন করেন, মসজিদের মাইকে সকলকে জানান। বলেন শান্ত থাকতে। থানায় ফোন করলাম। দুদিন ধরে গুজব বাড়ছিল। যেমন- ওখানে গুলি করা হয়েছে, এখানে মেরে ফেলেছে ইত্যাদি। দু পক্ষেই মদত ছিল। এফ আই আর হয়েছে ৮৬ জনের নামে। তারমধ্যে ৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে নিরপরাধ লোকও আছে। পরে প্রশাসন আলোচনা করে তাদের ছেড়ে দিয়েছে।
প্রশাসন এক দিন পরে তৎপর হয়। রবিবার উল্টোরথ। সোমবার বিকেলে এস ডি ও ডাকলেন। আমার জুনিয়র গেলো। আমরা বললাম, আপনি নেট বন্ধ করুন। ১৪৪ ধারা আগেই জারি করা উচিত ছিল। ৮০ জন পুলিশের মধ্যে ৫০ জন সিভিক পুলিশ। তাদের হাতে লাঠি ছাড়া অন্য কিছু নেই। পরবর্তী এস ডি ও খুব পরিশ্রম করেছেন। গোয়েন্দা বিভাগ ব্যর্থ। আমরাই খবর দিয়েছি। বাইরের লোক, দেশের বাইরের লোক নয়। জামাত, হাসনাবাদের লোক। বসিরহাটে সচেতন মানুষের সংখ্যা বেশি। হিন্দুদের অধ্যুষিত বাজার। মাছের বাজারে মুসলিমরা প্রধান বিক্রেতা। কেউ কেউ চেষ্টা করেছে ওদের জায়গাটা নেওয়ার। একইরকম চেষ্টা মুসলিম প্রধান জায়গায় হয়েছে। সেটা হয়নি। কিছু মানুষ সব বিষয়ে রাজনীতি চায়। এখানে সবাই মিলে চেষ্টা করেছে উন্নতির জন্য। শুধু আমি নই। মুসলিম ব্যক্তি আমার সঙ্গে বেরিয়েছে। রাজনীতির প্রমাণ না থাকলেও মনে হয় রাজনীতি আছে। শান্তি কমিটি প্রশাসন থেকে হয়নি। এম এল এ ছিলেন না। এম পি গতকাল এসেছেন। এম এল এ ছিলেন না, অথচ এসেই আইডেন্টিফাই করতে শুরু করল, একে ধর, ওকে ধর। আমাদের চারজন কাউন্সিলর। একটা গ্রাম পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের। কংগ্রেস আছে, অস্তিত্ব আছে। শুয়ে পড়েনি। বাদুরিয়ার এম এল এ আমাদের। বামপন্থীরা বিজেপির দিকে কিছুটা ঝুঁকেছে। ব্যাখ্যা দেবনা। কংগ্রেসের আমি সভাপতি।
অজয় চক্রবর্তী, প্রাক্তন সংসদ
বসিরহাট লোকসভা থেকে দুইবার নির্বাচিত, বর্তমানে প্রাক্তন সাংসদ, সি পি আই দলের নেতা। তাঁর বৈঠকখানার ঘরে গিয়েই প্রথমে একটু তাজ্জব বনে যাই আমরা। টেবিলের ওপর কাঁচের টপ। তার নিচেই কমরেড অজয় চক্রবর্তীকে কাস্তে ধানের শিস চিহ্নে ভোট দেওয়ার আহবানের প্রচারপত্র, তার পাশেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের নেতা দিনদয়াল উপাধ্যায়ের ছবি। পরে জেনেছিলাম ওনার পুত্র বিজেপির সঙ্গে প্রতক্ষ্যভাবে যুক্ত। স্বল্প কথা হয়েছিল তাঁর সাথেও। তিনি বসিরহাট অঞ্চলের চোরাচালানকারীদের বিশেষত গরু পাচারকারীদের দৌরাত্ম এবং রাজ্যের শাসক দলের প্রশ্রয়ের কথা বলেন। এর সঙ্গে বললেন বাম দলগুলির প্রতিরোধহীন আত্মসমর্পণের কথা।
অজয়বাবু অবশ্য পুত্রের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। তবে স্বীকার করেছেন, বামপন্থী দলগুলির সেইরকম প্রভাব বর্তমানে নেই যে দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়। সর্বদলীয় সভায় দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি জানানো হয়েছে, কিন্তু মিছিলের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত শৈশব ও শিশুমন
এই অংশে শিশু সহ একটি মহিলার সঙ্গে কথোপকথনও রাখা হল। ট্যাঁটরা, বসিরহাট শহরের হিন্দু অধ্যুষিত একটি পাড়া। এখানে আমরা দাঙ্গার প্রতক্ষ্যদর্শী শিশুদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছিল, বড়দের মুখ থেকে শোনা কথাগুলো নিজেদের মত করে বলছিল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কথোপকথন এবং প্রসঙ্গ।
দীপময় ঘোষ(দাঙ্গায় নিহত কার্ত্তিক ঘোষের নাতি)-
আমরা- পুজো কেমন কাটিয়েছো?
দীপময়- ভালো কাটেনি।
আমরা- স্কুলে যাচ্ছো?
দীপময়- না, এখন তো ছুটি।
আমরা- স্কুলে বন্ধু আছে?
দীপময়- হ্যাঁ।
আমরা- কয়জন?
দীপময়- চার জন।
আমরা- তোমার ক্লাসে যারা তোমার বন্ধু, তারা কি সকলেই হিন্দু পরিবারের না মুসলিম পরিবারেরও আছে?
দীপময়- আছে, মুসলিম পরিবারও আছে।
আমরা- ওদের সাথে তোমার কেমন সম্পর্ক?
দীপময়- ভালো।
আমরা- তোমার কয়জন মুসলিম বন্ধু আছে?
দীপময়- তেমন নেই।
আমরা- তোমাদের ক্লাসে মুসলিম বন্ধুরা পড়ে তো?
দীপময়- হ্যাঁ পড়ে, কিন্তু সেরকম কথা বলিনা।
আমরা- কখনই বলতে না?
দীপময়- আগে বলতাম, এখন টুকটাক বলি।
আমরা- একই ক্লাসে পাশাপাশি বসো, অথচ কম কথা বল?
দীপময়- পাশাপাশি বসি না, এখন আমাদের বেঞ্চ আলাদা।
দীপময়ের সঙ্গে কথা বলার সময় দুইজন মহিলাকে দেখতে পাই, কথা বলতে যাই তাঁদের সঙ্গে। প্রথম মহিলা কথা বলতে চাইছিলেন না। তিনি বার বার তাঁর জা’কে কথা বলতে এগিয়ে দিচ্ছিলেন, বলছিলেন, আমি সেদিন ছিলাম না। কথা বলতে বলতে চলেও যান তিনি। কথা হয় দ্বিতীয় মহিলা রিয়া’র সঙ্গে। আমরা-র পক্ষে এই পর্যায়ে কথাবার্তা চালান মূলত দলের মহিলা সদস্য।
আমরা- এবারে পুজো কেমন কাটলো?
রিয়া- একরকম।
আমরা- কোন ঝামেলা, কোন কিছু?
রিয়া- না।
আমরা- আপনাদের এখানে কী আগে কোন সমস্যা ছিল?
রিয়া- না, কখনও ছিল না।
আমরা- তাহলে আপনার কী মনে হয়, কী কারণে এই দাঙ্গা হল?
রিয়া- আমি কী করে বোলব, কী করে হয়েছে জানিনা।
আমরা- আপনাদের নিজেদের মধ্যে, যেমন জায়ে জায়ে কিছু কথা হয়নি? আপনার কী মনে হয় সেটা বলুন।
রিয়া- ওসব জানিনা, তবে যা হয়েছে খুব খারাপ হয়েছে। মনে একটা ভয় ধরে গেছে। তবে একথা ঠিক, আগের থেকে এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে।
আমরা- আগের মত সম্পর্ক আবার হবে?
রিয়া- কি করে বোলব না হওয়া পর্যন্ত।
আমরা- আপনার ছেলে মেয়ে কটি?
রিয়া- একটি ছেলে।
আমরা- বাচ্চাদের ওপর ঘটনার প্রভাব পড়েছে?
রিয়া- হ্যাঁ পড়েছে। ওরা ভয়ের মধ্যে আছে।
আমরা- পড়াশুনার ওপর প্রভাব পড়েছে, পড়াশুনা করতে অসুবিধা হচ্ছে?
রিয়া- পড়াশুনা করতে এখন অসুবিধা হচ্ছেনা। তবে পরীক্ষার আগে ঘটনাটি ঘটার ফলে পরীক্ষার পড়া তখন ঠিক মতন করতে পারেনি। সেভাবে নাম্বার তুলতে পারেনি।
আমরা- রাত্রিবেলা কেঁদে ওঠে?
রিয়া- হ্যাঁ (এবং বেশ জোর দিয়ে আবারও) হ্যাঁ।
আমরা- কিভাবে ভয় ভাঙাচ্ছেন?
রিয়া- কিভাবে আর ভাঙাবো? ওরা ছোট বাচ্চা, বুকে চেপে ধরে থাকি। ওরা তো সবই জানে। আতঙ্কটা থেকে গেছে। ওই পুজোর সময় কোথাও একটু ঝামেলা হলে, চিল্লামিল্লি হলে, মানে ওইসময় মদ খেয়ে তো অনেকেই মাতলামো করে, সে সব শুনলে ওরা ভয় পায়, মনে করে সেই অশান্তি আবার হচ্ছে।
এখন তো সন্ধ্যার পর আমরা সেরকম আর বাইরে বের হইনা, ভয় লাগে। আমরা মহিলা, আমাদের কেউ টন্ট করলে, আমাদের স্বামীরা তো আর ছেড়ে দেবেনা। সেখান থেকে যদি আবার অশান্তি শুরু হয়!
আমরা- মহিলাদের ওপর আলাদা করে কোন আক্রমণ হয়েছে?
রিয়া- না না, সেসব কিছু হয়নি, আমাদের তো রাস্তার ধারে ঘর, পাকা বাড়িও না, কিন্তু না সেরকম কিছু হয়নি।
এরপর হাইস্কুলে পাঠরত দুইটি শিশুর সঙ্গে আমাদের কথা হয়। একজন ক্লাস সেভেনের, অন্যজন ক্লাস নাইনের। মূলত গল্প হয় এদের সঙ্গে, এখানে সেই গল্পগুজবের নির্যাস রাখা হল। উল্লেখ্য এই হাইস্কুলে কাদের হাজির পুত্রবধূ রেহানা শিক্ষকতা করেন।
আমরা- ইস্কুলে তোমাদের ক্লাসে মুসলিম বন্ধু আছে?
শিশু- হ্যাঁ আছে, ওদের সাথে ভালো মিশিনা।
আমরা- কথা বলো?
শিশু- মোটামুটি কথা বলি।
আমরা- আগেও কি মোটামুটি কথা বলতে?
শিশু- না এখন।
আমরা- ওরা কথা বলতে আসে?
শিশু- হ্যাঁ বলতে আসে।
আমরা- ওদের নিয়ে তোমরা কি মজা করো, বা রাগাও ওদের?
শিশু- এমনিতে ওরা জিতে গেলে আমরা ঝগড়া করি।
আমরা- বাঃ রে, তোমরা হেরে গিয়ে ঝগড়া করো, হেরে তো যেতেই পারো, কী তাইনা?
শিশু- (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) আগে হতনা, এখন হয়। (ওরা স্কুলে লুডো খেলে)
আমরা- তোমাদের অন্য বন্ধুরা বলছিল, তোমরা আর সেভাবে মুসলিম সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা করোনা। তোমরা কি নিজে থেকে বন্ধ করেছ, নাকি বাবা-মা নিষেধ করেছে?
শিশু- না নিজে থেকেই মিশিনা। ভয় লাগে, কথা বলতে গিয়ে যদি কোনও একটা কথা বেরিয়ে যায়, ওরা যদি বাবা মাকে গিয়ে বলে দেয়, তখন যদি আবার ঝামেলা হয়।
আমরা- এই ভয়টা কি শুধু তোমরাই পাচ্ছো না ওরাও পাচ্ছে?
শিশু- না শুধু আমরাই পাচ্ছি, ওরা তত পাচ্ছে না। ওরা কথা বলতে আসছে।
আমরা- তাহলে কথা বলছো না কেন? ওরা কি তোমাদের সঙ্গে কোন খারাপ কথা বলছে?
শিশু- হ্যাঁ। আমাদের ঠাকুর নিয়ে টানাটানি করছে। আমাদের পরিবার নিয়ে টানাটানি করছে। বলে কি, তোদের ঠাকুরকে তো আমরা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছি। আমরা কোন উত্তর দিইনা। যদি বলি, যদি ওদের লোকেদের বলে দেয়, ঝামেলা বাড়ে।
জানো আমাদের এখানে একটা কালী ঠাকুরের মূর্তি ছিল, ঝামেলার সময় সেটা ভেঙে তার মাথা নিয়ে বল খেলতে খেলতে গেছে।
আমরা- তোমরা সেই সময় এখানেই ছিলে?
শিশু- যখন মারপিট হয়? (কথা থামিয়ে উঁচু ক্লাসের বাচ্চাটি প্রশ্নকর্তাকে জিজ্ঞেস করে) তুমি কি হিন্দু?
আমরা- হ্যাঁ। বল, যখন মারপিট শুরু হয় তখন কোথায় ছিলে?
শিশু- যখন মারপিট শুরু হয়, ওরা অস্ত্র নিয়ে আসছিল, বাবা তাড়াতাড়ি বাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। আমাদের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তারপর বাবারা দা, কুড়ুল নিয়েও সাহস পায়না বের হতে। পরে আমাদের নিয়ে পিসির বাড়ি রেখে এসেছিল।
কথোপকথনের সময় পাশের রাস্তা দিয়ে যখন কোন মুসলিম ব্যক্তি হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন তা দেখে বড়দের তুলনায় বাচ্চারা বেশি সচেতন হয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে চুপ করে যাচ্ছিল। পথযাত্রীরাও কখনও নির্বিকার মুখে, কখনও আড়চোখে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিলেন।
শিশুদের সঙ্গে কথা বলার এই পর্যায়ে আমরা কথা বলি তারিবুল মণ্ডলের পৌত্র হাবিবুল্লার সঙ্গে। তাদের বাড়িতে কথা হচ্ছিল বড়দের সঙ্গে, তাঁরা জানাচ্ছিলেন কীভাবে হিন্দুরা প্রায় কয়েকশোজন তাঁদের বাড়ি আক্রমণ করে, কীভাবে বৃদ্ধ, অক্ষম বাবাকে নিয়ে পালিয়ে যান তাঁরা। (প্রতিবেদনে ইতিপূর্বে হাফিজুল মণ্ডলের উপশিরোনামে ঘটনার বর্ণনা আছে)। আমাদের কথা বলার সময় বছর পাঁচেকের হাবিবুল্লার অস্বস্তি নজরে আসে। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তোমার কি কিছু মনে পড়ছে? উত্তর দিতে পারেনা, কেঁদে ফেলে বাচ্চাটি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। বাইরের বারান্দা থেকে তাকে তার মা, কাকিমার সঙ্গে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার মা বলেন, মাঝে মধ্যেই রাত্রে কেঁদে ওঠে, ঘুমোতে চায়না। আমাদের মহিলা সদস্য ঘরে গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেন। হাবিবুল্লা জানায় সে হিন্দুদের ভয় পায়, খুব রাগ হয় ওদের দেখলে। তবে তার মায়েদের সঙ্গে কথা বলতে বলে একটু সহজ হয় সে।
আমাদের ক্ষেত্র সমীক্ষক আড়ষ্টতা ভাঙতে জিজ্ঞেস করেন,তুমি কেমন করে চিনবে কে হিন্দু কে মুসলিম? আমায় তো প্রথম দেখলে,(মাথায় ওড়না টেনে নিয়ে) বলোতো আমি কী? (আবার মাথা থেকে ঢাকা সরিয়ে) আর এবার, কী লাগছে আমাকে তোমাদের মত না হিন্দু? তার মা'ও একবার পাশে এসে দাঁড়ায় ,দুজনেই হেসে ফেলে,হবিবুল্লা বলে ফেলে, তোমায় মুসলিম লাগছে,কিন্তু তুমি হিন্দু। মজার ছলে সমীক্ষক জিজ্ঞেস করে, রাগ হচ্ছে নাকি আমার উপর? সরাসরি উত্তর দেয়না হাবিবুল্লা ,তবে মুচকি হেসে জানায় সে মজাটা বোঝে।
তেঁতুলিয়া
যখন মৃতদেহও নিষ্কৃতি পায়না
৩ তারিখ স্বরূপনগর থানার অন্তর্গত মালংগপাড়া গ্রামে বিশ্বজিৎ ঘোষের পিতা মারা যান। বেলা সাড়ে দশটা থেকে এগারটা নাগাদ তাঁর পিতার অন্ত্যষ্টি ক্রিয়ার জন্য গাড়িতে করে গঙ্গায় যাচ্ছিলেন। তখন রামচন্দ্রপুরে মুসলিমদের অবরোধ চলছে। শব গাড়ি রামচন্দ্রপুর পৌঁছানো মাত্র বিক্ষোভকারীরা ক্ষেপে ওঠে। কোনো অবস্থায় তারা এই বিষয়টি শুনতে চায় না। তারা বলেন, গাড়ি এখান থেকে আর যাবে না। তখন তাঁরা অনুরোধ করেন বিক্ষোভকারীদের কাছে এবং ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়। তাঁরা শব গাড়ি নিয়ে তেতুলিয়াতে ফেরত আসেন এবং স্বরূপনগর থানার পুলিশের কাছে সহযোগিতা চান। কিন্তু থানার পুলিশ জানায়, ‘আমরা স্বরূপনগর থানার দায়িত্ব নেব, অন্য থানার দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না।’ পুলিশের এই নিস্ক্রিয় ভূমিকায় তেতুলিয়া খালধারের কায়পুত্র সম্প্রদায় ও অন্যান্য হিন্দুরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩ তারিখ রাত ৯টা থেকে ৯ -৩০টা নাগাদ তেঁতুলিয়াতে সন্ত্রাস, লুঠ, অগ্নি সংযোগ এবং ৩০ – ৩৫টি দোকান ভাঙচুর চলে। ঘটনাস্থল থেকে স্বরূপনগর থানার দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। স্থানীয় ব্যবসায়ী কমিটির অভিযোগ, পুলিশ কোনওভাবেই প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করেনি। জনৈক গ্রামবাসী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, প্রথমে হিন্দু ও কায়পুত্র সম্প্রদায়ের লোকজন শবদেহ নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে পুলিশ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিমদের দোকান ভাঙচুর করে। পরবর্তী সময়ে একই রাত্রে মুসলিমদের একটি অংশ হিন্দু কমিউনিটির মানুষের যে দোকান ছিল, সেই দোকানগুলি আক্রমণ করে এবং সম্পূর্ণরূপে ভাঙচুর করে।
জি এইচ টি নেতাজী বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির লোকজন বলেন, বাদুড়িয়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং শবদেহকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তাতে বাজারের ব্যবসায়ীগণ যুক্ত হতে চাননি। তখন আমরা জানতে চাই, আপনারা যদি ঘটনার সাথে কোনোভাবে যুক্তই না হন, তাহলে কেন আপনাদের দোকানগুলি ক্ষুব্ধ মানুষের লক্ষ্যস্থল হল? তার উত্তরে ধীরেন দাস (পিতা- রামপ্রীতি দাস), অজিত রায় (পিতা- কালিপদ রায়), গোপাল রায় সহ প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী জানান, এলাকার তোলাবাজ এবং সমাজবিরোধীরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে বাজারের কর্তৃত্ব হাতে নিতে, কিন্তু কোনোভাবেই তারা সফল হতে পারছে না। এই সমাজবিরোধীরা উদ্ভুত পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে।
বাজারের দোকানদার
তেঁতুলিয়া বাজারের দোকানদার তাপস ,পুরো নাম বলতে অস্বস্তি বোধ করায় জোর করা হয়নি,তবে এর পতঞ্জলি’র দোকান,এবং খানিকটা নেতৃত্বদায়ী অবস্থান থেকে আন্দাজ মিলেছিল এর স্থানীয় বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার।
তাপস- আপনাদের আগে মিডিয়া বা অন্য কোনো সংগঠনের কেউ এসে সেভাবে আমাদের সাথে কথা বলেনি এর আগে,সঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করেনি.ওই ফেসবুক পোস্ট আর থানায় বসে কথা বলেই রিপোর্ট করেছে বলে আমাদের মনে হয়, সংবাদপত্রে যা বেরিয়েছে তা পড়ে আমাদের এমনটাই মনে হয়েছে।
আমরা- বেশকিছুদিন ধরেই এই বসিরহাট-বাদুরিয়া এলাকায় আমরা তথ্য অনুসন্ধানের কাজ করছি,এই তেঁতুলিয়া বাজারে এসে দেখলাম রাস্তার দুপাশে এখনো অনেক দোকানপাট ভাঙা,বা ৫-৬টা দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট।
তাপস- ঘটনার সূচনা ওই ফেসবুক পোস্ট থেকেই,আপনারাও নিশ্চয়ই জানেন,তো আমাদের এখানে ওই খবর ছড়ানোর পরদিনই বাজারে এসে জানলাম চারদিকে অবরোধ চলছে,কীসের জন্য কী-আমরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি। তবে কিছুদিন আগে গোকুলপুর বলে কাছেই একটা জায়গায় এরকমই একটা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ঝামেলা হয়, গোকুলপুর এই তেঁতুলিয়া থেকে ধরুন দেড় কিলোমিটার। এটা ঘটে ওই যেদিন উত্তরপ্রদেশে যোগীর পক্ষে রেজাল্ট আউট হয় সেদিনকার ঘটনা। সেদিন প্রায় হাজার পাঁচেক মুসলিমরা জড়ো হয়ে ভাঙচুর শুরু করেছিল, যদিও প্রশাসন পুলিশ, র্যাফ দিয়ে কন্ট্রোল করে ফেলে,বাড়তে দেয়নি। অশোক ঘোষ বলে একজনের ছেলে...নামটা মনে পড়ছেনা, ছেলেটা কী একটা পোস্ট করেছিলো, ঝামেলা বাধে, ওদের বাড়ি, দুটো গাড়ি এসবও ভাঙচুর হয়। যাইহোক,এবারকার ঘটনা, এদিনও আমরা সকল থেকে শুনছি হুবলীগাঁ, ক্যাওটশা, রামচন্দ্রপুর বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ চলছে। আমরা প্রথমে অত গুরুত্ব দিইনি, ভেবেছি প্রশাসন আছে সামলে নেবে। আর হিন্দুরা তো জানেন চট করে কোনো কিছু নিয়ে অত এককাট্টা হয়না। তারপর বেলা বাড়তে মালঙ্গপাড়া থেকে একটা ডেডবডির গাড়ী আসছিলো, মুসলিমরা অবরোধ করে ছিলো, আটকে দেয় ডেডবডি। মৃতের পরিবার অনেক অনুরোধ করে। বলে, এই মরা মানুষটা কি দোষ করলো, এনাকে শ্মশানে যেতে দাও। কে শোনে কার কথা। শোনে তো নাই,বরং গাড়িতে হরি নাম সংকীর্তন হচ্ছিলো,বলে, বন্ধ কর শালা। ওদের তাড়া করে ছুটিয়ে দেয়, ড্রাইভারকে মেরে হাত ভেঙে দেয়। গাড়িতে বড় বড় পাথর মারতে শুরু করে দিয়েছিল, লাশের উপরেই, পরে আমরা মোবাইলে দেখেছি। ভাবুন একবার. বাড়ির লোক অনেক কাকুতি মিনতি করে যে,লোকটা গঙ্গা পাবে শেষ ইচ্ছা ছিল, যেতে দাও। আর যে মারা গেছে তার তো কোনো দোষ লাগেনা। ওরা শোনেনি, লাস্টে কোনোরকমে লাশের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে পালিয়ে বাড়ির লোক তেঁতুলিয়া বাজার অব্দি এসে পৌঁছোয়। এখানে আবার স্থানীয় হিন্দু ছেলেরা সব শুনে বলে, কী এতো বড় অন্যায়! ডেড বডি কী দোষ করেছে! গাড়ি ফেলে রাখো মাঝ-রাস্তায়, আগে প্রশাসন এর বিচার করবে, তারপর দাহ হবে। তারপর পুলিশ এসে যায়,কিন্তু সব শুনে ওরা প্রকাশ্যেই বলে, আমরা নিরুপায়, ‘ওদের' ওপর হাত তোলার উপায় নেই, নিষেধ আছে ওপর থেকে। বাজারের পাব্লিক বলে ঠিক আছে তাহলে আপনারা প্রোটেকশন দিয়ে বডিটাকে দাহ করার ব্যবস্থা করুন, পুলিশ তাতেও রাজি নয়, বলে ঝামেলা বাড়বে। তখন স্থানীয় ইয়ং ছেলেরা বলে, তাহলে লাশ এখানেই পড়ে থাক। এই করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে রাত। ভাবুন বেলা ১১টার দিকে ওরা বাড়ি থেকে বডি নিয়ে বেড়িয়েছিলো!
আমরা- কী বলছেন? এই ন'দশ ঘন্টা লাশ রাস্তার উপর আটকে?
তাপস- হ্যাঁ, পুলিশ কিছুই করছেনা, শুধু একপাশে দাঁড়িয়ে। আর বেশি জটলা জমায়েত দেখলে একটু ফাঁকা করে দিতে চাইছে...এই ভাবে চলতে চলতে আমরাও যখন ভাবছি দেখি কী করা যায়,রাত দশটা। লাশটা তো পচে উঠবে! সেটা তো অন্যায্য হবে। সব ভেবে পিছিয়েই যাওয়া দরকার। এর মধ্যে এলাকার স্থানীয় ক'জন মুসলিম লিডার,যারা পার্টিতেও আছে, আমি নাম নিচ্ছিনা, এসে দাঁড়িয়ে পুলিশ কে ডাইরেক্ট বলে, ‘এই লাশটা সরাতে তিন মিনিট লাগে। আপনারা একটু সরে যান আমরা দেখছি’। পুলিশতো ওই কটা মাত্র পুলিশ...বলতে বলতে কিছুক্ষনের মধ্যে প্রায় হাজার দুয়েক লোক মুখে ‘আল্লা হো আকবর' নাড়া দিয়ে এসে পড়লো বাজারে, তারপর দোকান ভাঙচুর,লুঠপাট। হিন্দুদের তো গোটা ৫০-৬০ টা ছেলে জড়ো হয়ে ছিল ওরাও রাত হয়েছে দেখে হঠে গেলো... আমাদের তো কিছুই দাবি ছিলোনা,শুধু প্রশাসন লাশটার ব্যবস্থা করুক, দাহ করার ব্যবস্থা করুক,এই...। তারপর ওরা ডেডবডির গাড়িটাও হটিয়ে দিলো, 'এই কার গাড়ি, বডি তোল এক্ষুণি, না হলে গাড়ি সমেত জ্বালিয়ে দেব', তখন যার গাড়ি সেও ভয় পেয়ে হঠে গেল, লাস্টে এই কাছের শ্মশানেই কোনোরকমে পোড়ানো হল ওই রাতেই।
নাঃ, ভাঙচুরটা তখন না,তখন ঐ জমায়েতটা একটু পরে চলে গেলো, ওরা পরে রাত্রে আবার ফিরে এসে দফায় দফায় রাত ২ টো পর্যন্ত ভাঙচুর, লুঠপাট চালালো। পুলিশ নীরব দর্শক, ওই যে ওদের সরে যেতে বলেছে কোথায় গিয়ে যে লুকালো, প্রশাসনের একটা কেউ এসে দাঁড়ায়নি। এই যে কাকাকে দেখছেন ওঁর দোকানটায় আগুন দিয়েছে, গলির মুখে রাজকুমার মন্ডলের মোবাইলের দোকানটা ভেঙেচুরে শেষ করে দিয়েছে,তখন নোটবন্দী চলছিলো না,কদিন কোম্পানির লোক টাকা কালেকশানে আসছিলোনা, দোকানে অনেক টাকাও ছিলো। সব গেছে।
আমরা- তা পরে কোনো ক্ষতিপূরণ বা শান্তিমিছিল হয়েছিল?
তাপস- না,ক্ষতিপূরণ এখনো কেউ কিছু পাইনি, প্রশাসন থেকে নামের লিস্ট করে নিয়ে গেছে...আর শান্তি মিছিল?...হ্যাঁ আমাদের বলতে এসেছিলো, আমরা বলেছি আমরা তো কোনও ঝামেলা করিনি,তোমরাই ভাঙচুর লুঠ করেছো...তো আমরা কেন শান্তি মিছিলে যাবো? ক্ষতি তো আমাদেরই হয়েছে।
আমরা- পরবর্তীতে শুনলাম কিছু মুসলিমদের দোকানও ভাঙচুর হয়েছে?
তাপস- না ওটা সত্যি না,ওরা নিজেরাই নিজেদের দোকান ভেঙে বলছে আমাদেরও ভাঙচুর হয়েছে,যা হয়েছে,তাও মুষ্টিমেয় ক'টা, ওদের দোকানে ভাঙচুর বলতে ওই সামনের দিকের শাটার-টাটার গুলো একটু ভেঙেছে, আরেকটা কথা হচ্ছে দ্বিতীয় বার যখন রাত্রে ওরা অ্যাটাক করে, তখন বাইরের লোক এনেছিলো সব, ওরা তো চিনতো না কোনটা হিন্দুর দোকান, কোনটা মুসলমানের, এন্তার একধার থেকে ভাঙতে ভাঙতে চলে গেছিলো। আর হিন্দুরা ভাঙবে কী করে,ওরা তো সংখ্যায় নগণ্য, রাত্রে যখন ওরা এসেছে ওদের হাতে অস্ত্র-সস্ত্র, তখনও মেরেকেটে এক দেড়শো হিন্দু লোক,বাধা দিতেও সাহস পায়নি।
আমরা- এখানে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত কী?
তাপস- ৫৫ মুসলিম ৪৫ হিন্দু, সরকারী হিসেবে মুসলিম বেশি হলেও বেসরকারি হিসেবে মনে হয় এখন হিন্দু বেশি,কারণ বাংলাদেশ থেকে বাস্তুহারা যারা এসেছে তাদের অনেকেরই ভোটার কার্ড হয়নি।(কথার মাঝে রাজকুমার মন্ডল আসেন,যার মোবাইল দোকান লুঠ হয়েছে)
আমরা- এর আগে এরকম ঘটনা ঘটেছে?
তাপস- না,এই মাপের না হলেও টুকটাক ঘটেছে,পরিস্থিতিটা বদলাচ্ছে কিছুদিন ধরেই,প্রতিমা বিসর্জন এর প্রশেসন বেরোলে পাশ থেকে নানা মন্ত্যব 'এই সব আর বেশিদিন চলবেনা,বন্ধ করে দেব', তারপর তেঁতুলিয়ায় বিজয়া দশমীতে একটা বিরাট মেলা বসে... শ'দুয়েক দোকানদার বসে দুই সম্প্রদায়েরই,বেলা দশটা থেকে জিলাপি টিলাপি ভাজা শুরু করে দেয়...ও বাবা এবার বিকেল চারটের সময় পুলিশ গিয়ে বলছে,পরিস্থিতি ভালো না,আজকে মেলা বসবেনা, কতো লস বলুন তো? রেগেমেগে হিন্দুরা অবরোধ টবরোধও করেছিলো, কিন্তু মেলা আর হয়ইনি।
আমরা- তো এই যে এত লোক হাজার হাজার মুসলিম জড়ো হয়ে ভাঙচুর করলো এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই করলো,মানে নিজের থেকেই? কেউ জমায়েত-এর ডাক দেয়নি?
তাপস- আমাদের পরিষ্কার মনে হয়েছে এটা পূর্ব পরিকল্পিত, যাহোক কিছু একটা ইস্যু করে গন্ডগোল বাধাবে, আর গোকুলপুর,উত্তরপাড়ার অত ইয়ং ছেলে হবেনা, বাইরে থেকেই লোক এনেছিলো। মানে আশেপাশের অঞ্চল থেকে।
আমরা- কানাঘুষো শুনছি বাংলাদেশ থেকে...।
তাপস- বাংলাদেশও তো ধরুন হাঁটা পথে মাঠে মাঠে ৫ কিলোমিটার হবে বড়জোর,আর বি এস এফের কথা বলবেননা, ওরাই তো পার করায়...তখন তো পাট লাগানোর সময় ছিলো, বর্ডার পার হওয়া কিছু ব্যাপার না, হাজার দেড় দুই খরচা করলে আপনাকে সকালে দিয়ে রাতে আবার নিয়ে চলে আসবো,... তাহলে লোক ঢোকা কি কিছু ব্যাপার?
আমরা- এই ‘বাইরে থেকে আসা' লোক ব্যাপারটা আমরা গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চাইছি।
তাপস- দেখুন গোটাটাই বাইরের লোক এটা হতে পারেনা,...প্রশাসন তো সিসি টিভির ছবিটবি দিয়ে কিছু লোককে চিনেছে বলে শুনেছি, হিন্দুদেরও কিছু ছবি উঠেছে, যারা সাহসী লোক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে তারাও জড়িয়ে গেছে। তবে আমাদের প্রশ্ন হলো প্রশাসন কিছু জানাচ্ছে না কেন স্পষ্ট করে...কারা যুক্ত, কেন কী ঘটলো...ওই যে রুদ্রপুরের ছেলেটা শৌভিক, আমরা এমনও শুনছি যে ওর ফোনটা চুরি হয়ে গেছিলো কদিন আগে ...ওইসব পোস্ট টোস্ট করার আগেই, এটা কি সত্যি না মিথ্যে? আমাদের তো ধরুন বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল,এখানে বেশিরভাগটাই হিন্দুদের দোকান, আমরা ১০ দিন প্রায় দোকান খুলতেই পারিনি ঐ রাতের পর।
(পাশ থেকে ওই দিন যার চা দোকান তা পুড়েছে বলতে থাকেন)
আর প্রশাসন...বলে কিছু লাভ নেই কাউকেই, ‘ওরা' সবার চোখের সামনে স্বরূপনগর থানার সেকেন্ড অফিসারকে মারতে যাচ্ছে, ধরে সরিয়ে নিলো সবাই ওনাকে...থানার বড়বাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে, মুখে কোনও কথা নেই,পরে সেই বড়বাবু বদলি হয়ে গেছে।
আমার- এখন কী অবস্থা?
চা দোকানী- এখন অবস্থা বলতে এক শ্রেণির মানুষ মার খেয়েছে আর একদল অত্যাচার করেছে...কোনো বিচার নেই।এখন রাতের অন্ধকারে কে মুখে কাপড় বেঁধে এসেছিলো কে চিনবে,ফলে বাজারে দোকানে কেউ যদি হাসি মুখে কথা বলে, হাসি মুখেই উত্তর করতে হচ্ছে...আর পাঁচটা আঙ্গুল তো সমান না, ওদেরই কেউ ছি ছি করছে যে উচিৎ হয়নি, কেউ চুপ, যারা চুপ করে আছে তাদের মনোভাব বুঝে নিতে হবে।
(রাজকুমার বাবু পাশ থেকে বলতে থাকেন)- প্রশাসন যদি শুরুতেই ব্যবস্থা নিতো, সিভিকগুলো তো ছিলো, ওরা দৌড়ে গিয়ে থানায় খবর দিয়ে ফোর্স আনলে, যেখানে যেখানে অবরোধ হলো শুরুতেই যদি জমায়েত ভেঙে দিতো তাহলে এই জায়গায় যেতোনা। স্থানীয় নেতারাও সব জানে...
আমরা- আপনার ক্ষয় ক্ষতি কী হয়েছে?
চা দোকানী- সবই তো শেষ, সামনের শাটার গেটটা ফেলে দিয়েছে রাস্তায়, দেওয়ালগুলো কুপিয়েছে, ড্রয়ার, শোকেসগুলো টুকরো করে দিয়েছে,খবর ছিল বোধহয় যে দোকানে ক্যাশ টাকা আছে...আর ওই পাড়ে ওই মন্ডল পুষ্প সম্ভার দোকানটা ওদের সব মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলো।
তাপস বলতে থাকেন আবার, তৃণমূল পার্টির উপরতলা থেকে নীচ তলা সব জানে সবাই...ওই তো ব্লক সভাপতি কিঙ্কর জানেনা? সব জানে...তাও ‘ওদের' মদত দিয়ে চলেছে।
(চা দোকানদার বলতে থাকেন) একটা অবৈধ কাজ, যেমন ধরুন একটা মেয়েছেলে তুলে আনা...ওরা (মুসলিমরা)যাই করুক কেউ কিছু বলবেনা।এই তেঁতুলিয়া বাজারে একশো দোকানদারের মধ্যে দশ বারোখানা মুসলিম দোকান,কিন্তু ওদের দেখবেন কাজকম্ম করে খাওয়ার মন নেই, উগ্রবাদী মনোভাব সবসময় একটা।
রাজ কুমার- কিছুদিন আগে আমাদের বাজার কমিটির একটা ঝামেলা হয়, ওদের স্থানীয় কিছু নেতা,যারা তৃণমূলেও আছে,বললো, বাজার কমিটির মধ্যে আদ্ধেক লোক আমাদের থাকবে, ১২ জন থাকলে ৬ জন আমাদের, আর একটা কথা তুললো বাজারের ভিতরে জায়গা আছে একটা মসজিদ করতে হবে, সবাই নমাজ পড়তে পারবে দোকান রেখে এসে, তো আমাদের দোকানদারদের দাবী ছিল যে না,ভিতরের জায়গায় আরো দোকানদারকে বসতে দিতে হবে, তো বাজার কমিটিও রাজি হয়নি ওদের কথায়, তো সেই রাগ দোকানদারদের উপরে...এই ফেসবুকের গন্ডগোলের ছুতোয় ওরা সেই রাগ মেটালো, না হলে দোকান ভাঙবে কেন? আশপাশের পাঁচটা গ্রামের মানুষ বাজারে আসে, কেউ হিন্দু কেউ মুসলিম... সবারই তো দরকার বাজারটা!
আমরা- ক্ষতিপূরণ এর কথাটা শেষ হলো না তখন...
তাপস- বিডিও অফিস, থানা সবাই এসে ছবি তুলে,বক্তব্য নিয়ে গেছে বাজার থেকে এই পর্যন্ত, পার্টি থেকে কেউ কিছু বলেনি এখনো। মাঝে মাঝে পুলিশ অফিসাররা এখনো আসছে কথা বলছে...তেঁতুলিয়া বাজারে কম দোকান আছে ভাঙচুর হয়নি, এখন গেলে সব দোকানেই দেখবেন ট্রেড লাইসেন্স, ভোটার কার্ড জেরক্স করে রাখা, কেউ যদি এসে কোনও কাগজ চায়, কিছু সাহায্য টাহায্য দেবে বলে...দোকানদারদের এই ক্ষতি কেন করলো আমরা কোনো কারণই খুঁজে পাচ্ছিনা, তেঁতুলিয়া স্ট্যান্ড এর প্রথম থেকে আমার দোকান কোনোদিন এই রকম দেখিনি...ওইদিন ওই সময় দোকানে থাকলে বোধহয় জানেই মারা পড়তাম, আমরা দোকানদাররা কোনো ঝুট ঝামেলায় যাইনা...একটা কথা জানবেন,এই যে পার্টির লোক এটাকে প্রশ্রয় দিলো এতে কিন্তু ওদের লাভ কিছুই হবেনা, মুসলমানরা মমতার থেকে সরে দাঁড়াবে, আপনারা হাজিনগরে আগে নিশ্চয়ই রিপোর্ট নিয়েছেন,কোথাওই ওরা মুসলিম ভোট আর পাবেনা, কিন্তু ওদের শিক্ষাও হচ্ছে না। লাশের উপর ইঁট মেরেছে,এ কি ধর্মে সইবে? যতই বন্ধ অবরোধ করুক ইমার্জেন্সি বলে তো ব্যাপার আছে...প্রসূতি গাড়ি বা মরার গাড়ী ছাড়বেনা এটা মানুষের কাজ?
রাজকুমার- তবে ওই ডেডবডির গাড়ীর বাড়ির লোক যদি তেঁতুলিয়া বাজারে এসে বডি না নামায় আর এখানে রাস্তা না আটকাতো তাহলে বাজারে এত বড় হামলাটা হয়না...ওরাই ঝামেলা বাড়ালো, লাশটা নিয়ে চলে যা তা না জেদ করছে।
আমরা- আবারও কি হতে পারে আপনারা আশঙ্কা করছেন?
তাপস- এখন এমনি শান্তিপূর্ণ, কিন্তু প্রশাসন যদি আগের থেকে ব্যবস্থা না নেয় কালও হতে পারে পরশুও হতে পারে আবার,একবার হয়েছে, কে বলতে পারে আর হবেনা?
উপলব্ধি, এই পর্বের
আমরা, এক সচেতন প্রয়াস (AAMRA – An Assemblage of Movement Research and Appraisal, Kolkata) - এর ক্ষেত্র সমীক্ষার ভিত্তিতে করা পর্যবেক্ষণ ও ভাবনার নির্যাস এখানে রাখা হল। রাখা হলো কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর আমাদের জানা নেই। প্রতিবেদনে নাম, নামহীন (যারা নাম প্রকাশ করতে চাননি, যাদের নাম জানা হয়নি), ছদ্ম নামে (যারা নাম প্রকাশে ভয় পেয়েছেন) কিছু বয়ান রাখা হয়েছে। একাধিকবার যাতায়াতের ফলে বিভিন্ন পর্যায়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেই কথোপকথনের বেশ কিছু অংশ প্রতিবেদনে রাখা হয়নি, একই কথার বা তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই সমস্ত কথাগুলি কোথাও না কোথাও আমাদের পর্যবেক্ষণকে তথ্যায়িত করেছে। তথ্যানুসন্ধান হয়ে উঠেছে ক্ষেত্র সমীক্ষা। পর্যবেক্ষণ পর্বে এই ক্ষেত্র সমীক্ষার ভূমিকা আছে।
পশ্চাদভূমি
বসিরহাট-বাদুড়িয়া-স্বরুপনগর দাঙ্গা কি শুধু কোন একটি ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া? না’কি সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ধর্মের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। না’কি প্রতিবেশে থাকা ভিন ধর্মের মানুষকে, তার ধর্ম, সংস্কৃতি, যাপন কথাকে না জানার বা না জানতে চাওয়ার হাতেনাতে পাওয়া ফল।
নেপথ্যে কে এবং কারা?
যে কিশোরের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে এই অশান্তির শুরু, সেই পোষ্টের বিষয় ও ছবি তারই নির্মাণ এটা মেনে নেওয়ার পক্ষে যুক্তি দুর্বল। তাহলে কে বা কারা ওই অশালীন পোস্টটির নেপথ্যে? নেপথ্যের রহস্য উদঘাটন করতে, নেপথ্যের কারিগরকে চিহ্নিত করতে সাইবার অপরাধ বিভাগ কি উদ্যোগ নিয়েছে? কেউ কি এই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো আমাদের অজানা।
অভিযুক্ত কিশোর (ফেসবুকার) গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও চলতে থাকে অবরোধ, কোথাও কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুঠতরাজ। সবটাই খুব স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা আমাদের মনে হয়নি। নেপথ্যের কারিগরদের চিহ্নিত করা জরুরী। না-হলে আবারো ভবিষ্যতে এইভাবে ফেসবুক পোস্ট বা এই ধরণের ঘটনার সুযোগ নেওয়ার কৌশল আটকানো যাবে না।
এ-কোন শিক্ষা!
ওই কিশোরের ফেসবুক পোস্টের পর যে দাঙ্গা হাঙ্গামা হয় তাতে অংশগ্রহণকারীদের একটি বড় অংশ হলো কমবয়সি কিশোররা। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সকলেই এই তথ্যটি জানিয়েছেন। শোনা গেছে, বিভিন্ন মাদ্রাসা-এতিমখানার শিশু-কিশোররা নানা অস্ত্র নিয়ে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছে হাঙ্গামায়। প্রশ্ন কারা এই শিশু-কিশোরদের সংগঠিত করল? বেশিরভাগ দরিদ্র পরিবার থেকে আসা এই নাবালকদের ব্যবহার করল কারা?
কাদের প্ররোচনায় বা নির্দেশে তারা এতিমখানা মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে এসে হাঙ্গামায় যুক্ত হয়ে পড়ল? হঠাৎ করে তারা সবাই হিন্দু বিদ্বেষী হয়ে গেল? না, তার প্রক্রিয়া চলছে আগে থেকেই? কি শিক্ষা দেওয়া হয় এইসব এতিমখানা-মাদ্রাসায়? এই প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবিয়েছে।
পরিযায়ী শ্রমিক, ক্লাব, পাচার অর্থনীতি
উঠে এসেছে বাইরে কাজ করতে যাওয়া লোকজনের কোঠা। এদের একটা অংশ দাঙ্গায় অংশ নিয়েছে। এদের উপার্জিত ‘কাঁচা পয়সা’ -র যোগানের দিকে ইঙ্গিত করছেন কেউ কেউ। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী ব্লকগুলোতে মাইগ্রেশন বা বিশেষভাবে বলতে গেলে ভিন রাজ্যে পরিযান এক বাস্তবতা। এমন পরিবার এখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে পরিবারে কোনো ব্যক্তি ভিন রাজ্যে যায়নি কাজের উদ্দেশ্যে। সারাদেশে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানে তাদের মনে বিপরীত মনোভাব আসার সম্ভাবনা উস্কে দেয়।
উঠে এসেছে এক একটি গ্রামে তিন চারটি করে ক্লাবের কথাও। এইসব ক্লাবের ছেলেদের দাঙ্গায় অংশগ্রহণের কথা শোনা গেছে একাধিকজনের বয়ানে। ক্লাবে ক্যারাম পেটা, টিভি ভিডিও দেখা, কোথাও কোথাও মদের ফোয়ারা ছোটার কথাও জেনেছি। এছাড়া পুজো, পরব, উৎসব আছে হরেকরকমের। যেগুলিতে এই ক্লাবগুলির ভূমিকা নজরকাড়া। স্থানীয়ভাবে শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকা এই ক্লাবগুলির সদস্যরা ভোট পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বাস্তবতা হল শাসক বদলালে বদলে যায় ক্লাবের আনুগত্যও, ধর্ম বদলানোর বিষয় নয়। এখন ক্রমশ যা একমুখী হয়ে উঠেছে।
সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে হিন্দু এবং মুসলিম ছেলেদের স্কুল ড্রপআউটের সংখ্যা বাড়ছে। তুলনামূলক বিচারে মুসলিমদের মধ্যে বৃদ্ধির হার অধিক। সাধারণ আলোচনায় উঠে আসে কিছু প্রশ্ন। ‘পড়াশোনা করে কি হবে?’ ‘কয় টাকায় বা রোজগার করতে পারছে পড়াশোনা করে?’ ‘চাকরি হবে?’ স্কুল ছুট কিশোরদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্ত হচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলের নানাবিধ পাচারের কারবারে। হাতে কাঁচা টাকা।
উল্লেখ করতে হয়, অসুরক্ষিত, নিয়ন্ত্রনহীন সীমান্ত, পাচার অর্থনীতি ও ‘অনুপ্রবেশ’। তাতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জড়িয়ে থাকা এবং দাঙ্গায় এই বিষয়গুলি প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে এই ইঙ্গিত মহকুমা পুলিশ আধিকারিক এর সঙ্গে কথোপকথনেও উঠে এসেছে।
‘কান নিয়ে গেল চিলে…’
দাঙ্গা পর্বে আমরা দেখেছি অসংখ্য উত্তেজক পোস্ট-মেসেজ-ভিডিও ক্লিপ ছেয়ে গেছে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে। এমনকি সিনেমার ক্লিপিংস ও বসিরহাটের ঘটনা হিসাবে চালানোর পরিকল্পিত চেষ্টা আমরা দেখেছি। ‘বসিরহাট-বাদুড়িয়া তে হিন্দুদের দলে দলে হত্যা করা হচ্ছে, একটিও মন্দির আস্ত নেই, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের ঘরবাড়ি — এমন মিথ্যা, অতিরঞ্জিত সংবাদে, গুজবে ছয়লাপ নেট বিশ্ব। এই গুজব এতটাই প্রবল যে বসিরহাট শহর থেকে অল্প দূরে স্বরূপনগরে হিন্দুরা জানে বসিরহাট শহরে বিখ্যাত কালীবাড়ি নাকি ধুলিস্যাৎ। অপপ্রচারে হিন্দুত্ববাদী ওয়েবসাইটগুলি প্রথম স্থানে। প্রশ্ন, ক’জনের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়েছে।
ভোট আর ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে
এ রাজ্যে দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা কে ধরে রাখার কিংবা ক্ষমতার মসনদ দখলের ধান্দায় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের তাস খেলছে। এই অভিযোগ আমরা শুনেছি বহুবার। অটোচালক থেকে ভ্যাবলা স্টেশন এর চায়ের দোকান। তেঁতুলিয়া ব্রিজের নিচে সবজি বিক্রেতা থেকে বিজ্ঞান আন্দোলনের স্থানীয় কর্মী। সকলেই একবাক্যে জানিয়েছেন, ভোট সমীকরণের লক্ষ্যে একটি দল হিন্দুদের, অন্য একটি দল মুসলিমদের উস্কানি দিয়ে চলেছে। রামনবমী, নবী দিবস পালন — অগ্রভাগে তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপির মাথা। বলাবাহুল্য এই চিত্র সারা রাজ্যের।
দাঙ্গা পর্বে ঘটনা পরম্পরা যেভাবে এগিয়েছে, তাতে দাঙ্গার চরম মাত্রা দেখেও প্রথমদিকে প্রশাসনের নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, ওপরের বক্তব্যকে আরো জোরালো করে। আমরা দেখেছি এই রাজ্য প্রশাসনেরই ‘সক্রিয়তা’ সাম্প্রতিক সময়ে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন দমনে।
ওপারের লোকজন!
মূলত হিন্দু এলাকায় আমরা বার বার শুনেছি, ‘প্রচুর বাইরের (বাংলাদেশ) লোক ছিল’। বাংলাদেশের অনেক জামাতী এখন পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছে। দিয়েছে শাসকদলের মুসলিম নেতারা। শৌভিক (ফেসবুকার) -এর সেই ফোন বাংলাদেশ থেকে অপারেট করা হয়েছিল এবং বিবিধ রটনা… যার উত্তর তদন্ত সাপেক্ষে স্পষ্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল প্রশাসনেরই। তারা উত্তর দেয়নি, ফলে ধোঁয়াশা কাটেনি। উল্টে রাজ্যের শাসক দল থেকেই বা প্রশাসনের বিশেষ মহল থেকে ‘বাংলাদেশ থেকে আগত দাঙ্গাবাজ’ এই তত্ত্ব রাখা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে আমাদের প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন মহকুমা পুলিশের জনৈক আধিকারিক।
শান্তি কমিটি
দাঙ্গা প্রতিরোধে শান্তি কমিটি কতটা কার্যকরী? এই প্রশ্নের উত্তর একইসাথে না-কারক এবং হ্যাঁ-কারক। কিন্তু এক সময়ে অবরোধ (যা থেকে দাঙ্গা ছড়ায়) – এ নেতৃত্বদানকারী শাসক দলের মুসলিম নেতা যদি পরবর্তীকালে শান্তি কমিটিতে থাকেন তাহলে ‘শান্তি’ আসার সম্ভাবনা কতটুকু? রাজ্য রাজনীতিতে বিজেপিতে পা বাড়িয়ে রাখা নেতা কমবেশি আছে বিভিন্ন জায়গায়। এখন তৃণমূলে আছেন, আছেন শান্তি কমিটিতেও। কিন্তু বিজেপি’র প্রতি (এক্ষেত্রে হিন্দুত্বের প্রতি) সহানুভূতি রাখা এমন ব্যক্তি শান্তি কমিটিতে থাকলে শান্তি আসবে? কোথাও কোথাও পাড়ার মানুষ নিজেরাই শান্তি কমিটি গঠন করেছেন, নেতাদের বাদ দিয়ে।
দাঙ্গার বহুমুখ
বসিরহাট মহকুমার এক পুলিশ আধিকারিক এর সঙ্গে কথোপকথনেই এ কথাও উঠে এসেছে যে এবারে দাঙ্গা-পরিস্থিতিতে সংগঠিতভাবে দুটি সম্প্রদায়ের মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা প্রায় নেই! বরং প্রশাসনের সঙ্গে গোলযোগের ঘটনাই বেশি। মুখোমুখি হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ একদম নেই তা নয়, কিন্তু সংখ্যায় সত্যিই কম। বসিরহাট শহরে মন্দির, মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি বাদুড়িয়ায় থানা আক্রমণের সময় অদূরের মন্দিরটি আক্রান্ত হয়নি। বলা যেতে পারে এই দাঙ্গার চরিত্রের যেমন বহুমুখ তেমনি নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রনহীন অবস্থার সমান্তরাল অবস্থান।
প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির সম্ভাবনা
সাম্প্রদায়িক আক্রমণের এবং প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের ওপর আক্রমণের সময় সম্প্রদায় ভিত্তিক জোটবদ্ধতা একটি স্বাভাবিক কৌম প্রক্রিয়া হিসাবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের অবরোধ, থানা আক্রমণ, শবদেহ আটকে রাখা, মিশ্র এলাকায় বেছে বেছে হিন্দুদের দোকান, সম্পত্তি আক্রমণ, মন্দির ও বিগ্রহ আক্রমণ ইত্যাদি এবং বসিরহাট শহরে হিন্দুদের বিশাল মিছিল, একইভাবে মিশ্র এলাকায় মুসলিমদের দোকান আক্রমণ, মসজিদে ক্ষতিসাধন ইত্যাদি শুধুমাত্র স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ, তা মনে হয় না। এর পিছনে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি থাকার ইঙ্গিত বেশ কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। প্রথমত এই বছর (২০১৭) প্রথমবার বাদুড়িয়ায় রামনবমীর মিছিল হওয়ার কথা আমরা জানতে পারি সেখানকার বিজেপির এক পদাধিকার এর কাছে। বসিরহাটে কালী বাড়ির কাছে যুবকদের মুখেও রামনবমী আয়োজনে সংবাদ জানা যায়। মহকুমা জুড়ে কোথাও-না-কোথাও ইসলামী জলসা আয়োজন এর আধিক্য যেকোনো সময় গেলে নজরে আসে। সম্প্রতি নবী দিবস পালনে অতি সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। আর এই সব আয়োজনগুলি প্রতিষ্ঠান অস্তিত্বকে জোরালো করে।
সংঘবদ্ধ হবার প্রবণতা
প্রাক দাঙ্গা, দাঙ্গা এবং দাঙ্গা পরবর্তী সময় গুলিতে আমরা দেখেছি সঙ্ঘবদ্ধ হবার প্রবণতা। এই সংঘবদ্ধতা মূলত ধর্মভিত্তিক এবং এক ধরনের মেরুকরণের প্রবণতাকেই নির্দেশিত করেছে। আমাদের তথ্যানুসন্ধানের প্রথমদিকে বারেবারে বিভিন্ন গ্রামের বিভিন্ন স্তরের মানুষ আমাদের জানান যে প্রথম তিন দিনের মধ্যে মুসলিম জনতার জমায়েত এর আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। বসিরহাট শহরে হিন্দুদের মিছিল হয় ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষে’ বহু মানুষ সমবেত হয়। মানুষের এই জমায়েত গুলির কলেবর বৃদ্ধি মূলত দু’টি ভাবে দেখা যেতে পারে। এক, মানুষের মধ্যে ‘আমরা আক্রান্ত, ওরা আক্রমনকারী’ এই মনোভাব কোন ভাবে বৃদ্ধি হয়েছে বা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবং দুই, মানুষকে একত্রিত করার কিছু সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক মঞ্চ তৈরি ছিল ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। উপদ্রুত হয়ে উঠেছে এক সময়ের শান্ত জনপদ গুলি।
‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’
সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় কে বেশি আগুয়ান এই নিয়ে প্রতিযোগিতা আছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রায় অভ্যাস হয়ে উঠেছে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সমাজে এখন রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও রাজনৈতিক ধর্মের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির প্রভাব ও প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। ফুরফুরা শরিফ, জমিয়ত এ ইলেমা এ হিন্দ, জামাত এ ইসলাম এবং স্থানীয় স্তরের বিভিন্ন সংগঠন। জনৈক ইমাম সাহেবের কথায়, ‘এখানে তো ওদের (হিন্দুত্বওলাদের) রেষারেষি ততটা দেখিনা। কিন্তু এদের (ইসলামী দলগুলি) আছে। আছে শক্তি প্রদর্শন’।
প্রাইমরডিয়াল আইডেন্টিটি বা ধর্ম সবার আগে
আর সবকিছু পরিচিতি ছাপিয়ে ধর্মীয় পরিচিতি যেখানে মুখ্য। যদিও সঙ্ঘবদ্ধ শক্তির আস্ফালন ছিল প্রথম থেকেই কিন্তু স্থানীয় মানুষের মতো পরিষ্কার দিনের আলোর মত। অর্থাৎ কিনা ধর্ম যখন আক্রান্ত (নবীকে অপমান, মন্দির আক্রমণ, মসজিদ আক্রমণ ইত্যাদি যার সূচক) তখন আর সব পরিচয় একপাশে রেখে ‘বহিরাগত’, স্থানীয় সকলে মিলে বিপথে।
দৃষ্টান্ত এক, যখন উত্তেজনা চরমে, অবরোধ চলছে, জনৈক রাজনৈতিক নেতা তাঁর দলেরই মুসলিম সমর্থককে ফোনে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় আছো, উত্তর আসে, ‘পার্টি পরে, এসব ধর্মের ব্যাপার’। দৃষ্টান্ত দুই, এক মধ্য বয়স্ক মুসলিম মানুষ বলেন, নবীকে নিয়ে অসম্মানের প্রতিবাদে সকলেই এসেছে। ত্রিমোহিনী তে অবরোধ হলো। যে যাই রাজনীতি করি না কেন সকল মুসলিম তাতে এসেছে। আসবেই। ওরা উল্টো ধরে নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করল। আমরা উল্টো রথের দিন সকাল বেলায় যৎসামান্য বিক্ষোভ জানিয়ে চলে এসেছি। আমি নিজেও ছিলাম বিক্ষোভ। ওদের রথ তো ছিল বিকেলে’। দৃষ্টান্ত তিন, আব্দুল হাজী, শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য বলেন, ‘ফেসবুক পোস্টটা হবার পরে মুসলিম সমাজের মনে আঘাত লেগেছে, ধর্মে আঘাত লেগেছে। তা রাগটা আর কোথায় যাবে, হিন্দু ভাইদের উপর গিয়ে পড়েছে। দোকানপাট ভেঙেছে। হিন্দু ভাইদের ওতো ধৈর্যের সীমা আছে। ওরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে’।
এই ধর্ম, ‘ধারণ করে’
ঘটা করে নবী দিবস পালন, মহরম এর সশস্ত্র মিছিল, ইসলামী জলসায় গলা চড়িয়ে উগ্রতা; ২০১৬-২০১৭ সাল থেকে রামনবমী, গণেশ পুজোর জমক, বিসর্জনে সশস্ত্র মিছিল, মোটরসাইকেল বাহিনীর তান্ডব এখন হালফিলের পশ্চিমবঙ্গের চিত্র। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছু জানালা খোলা থাকলেও দীর্ঘদিনের ও ব্যবহারে ধুলো জমেছে তাতে। বিশেষত ভারত বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। অবিশ্বাসের ফল্গু ধারা বহমান ছিল অনেকদিন ধরেই। এই সময়ে ধর্ম যাপনের প্রকট রূপ, ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন ক্রমে ক্রমে অবিশ্বাসের বাতাবরণ কে ঘনীভূত করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ধর্ম বিহীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলি ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে।
স্টিরিওটাইপিং বা ছাঁচের ফেলার প্রবণতা
বেশ কিছু শব্দ বন্ধ আমরা’র সমীক্ষা দলটি রেকর্ড করতে পেরেছে, যার মাধ্যমে ছাঁচের ফেলার একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া উঠে এসেছে। যেমন, ‘আসলে আমাদের হিন্দুদের মধ্যে একটা কাজ করতে গেলে পাঁচবার ভেবে করা হয়, কিন্তু ওদের তা না। হুট বলতে একেবারে থানা জ্বালিয়ে দেবে।’ ‘ওরা খুব উগ্র, আগে মারবে তারপর কথা শুনবে।’
মুসলিমদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনায় জেনেছি হিন্দুদের দুর্বল হিসাবে দেখার প্রবণতা। যেমন, ‘আমরা জানি, আশেপাশের হিন্দুরা আমাদের ভয় করে।’
ধর্মীয় স্লোগান এবং আবিষ্কৃত ঐতিহ্যের অভিসন্ধি মূলক ব্যবহার
স্টিরিও টাইপিং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক যুক্ত এমন একটি প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে যার মাধ্যমে ক্ষমতাশালী ধর্মীয় গোষ্ঠি কিছু কিছু আচার, আচরণ, বিধি ক্ষমতার বিকাশ ও বৈধকরণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। রামনবমীর মিছিল, বিশেষত অস্ত্রসহ মিছিল সেই আবিষ্কৃত ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। নবী দিবসের মিছিল এই পর্যায়ে ঐতিহ্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক কার্যক্রম। মিছিল থেকে, ভিন্নধর্মীদের আক্রমণ বা প্রতিরোধের সময়, ‘আল্লাহু আকবর’ বা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বিপরীত সম্প্রদায়ের মনে ভীতির সঞ্চার করে। একই সাথে স্বধর্মী দের সাহস দেয়, জানান দেয়, ভয় পেয়ো না, আমরা আছি। গোডাউন পাড়ার যুবকদের কথায়, যখন মুসলিমরা আক্রমণ করল, তখন আমরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলি লোক জড়ো করলাম। উল্লেখ্য এর আগে কখনো এই শ্লোগান ওরা দেয়নি।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত শৈশব, মন ও সহাবস্থানের অভ্যাস
বসিরহাট শহরের ত্রিমোহিনী মোড়ের স্বপন পালের দোকান মেরামতি সহ ক্ষতিপূরণের সহায়তা করতে চেয়ে ছিলেন স্থানীয় মুসলিম ব্যবসায়ী। দাঙ্গার অব্যবহিত পরে এবং মাস দুই বাদে আমাদের তথ্যানুসন্ধান দল যখন তার সাথে দেখা করি, দেখি সহায়তা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার তীব্র অনীহা। এবং একই সাথে অভিমান। যদিও এই দু মাসে সরকারের ভূমিকার প্রতি তার অবস্থানের বদল ঘটেছে।
মায়ের ইচ্ছে মন্দির। ক্ষত আরো গভীর। ক্ষত নিরাময়ের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে শলা। এখানে নিজেও ধর্মের দাঙ্গাবাজদের দ্বারা মন্দির ও বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কিছুটা ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় মুসলিম ব্যবসায়ীরা। কিন্তু না। মুসলিমদের কাছে সাহায্য নিয়ে মন্দির মেরামত করা যাবে না, বাধা দিচ্ছে স্থানীয় হিন্দু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বাধা দিচ্ছে প্রশাসনিক সাহায্য গ্রহনেও। আগ্রহ থাকলেও নিতে পারছেন কই মন্দিরের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক। ক্ষত যতদিন রাখা যায়, ততদিন তাদের লাভ।
দীর্ঘদিন একত্রে বসবাসের দরুন যে সহাবস্থানের অভ্যাস তৈরি হয়েছিল পা ভীষণভাবে ধাক্কা খেয়েছে এবং তৈরি হয়েছে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ট্রমা। একটি সাক্ষাৎকার চলাকালীন আমরা একটি মুসলিম পরিবারের তিন প্রজন্ম কে একসাথে পেয়েছিলাম। বয়স্ক মানুষটি হিন্দুপাড়ায় এখনো চা খেতে যান। এখন চলাফেরা করতে খুব একটা পারেন না, আগেই পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। ‘রোজ যাই, গল্প হয়, কিন্তু সেই কথা আর হয়না, জানেন।’ সকাতরে জানান বৃদ্ধ। ‘যদিও অশান্তি এখন নেই’, জানান তিনি। তার বছর চল্লিশের চাকুরীজীবী ছেলে বলেন, ‘যে ধাক্কা লেগেছে তাতে যে সম্পর্ক ছিল তা আর নেই।আমার ভাই বন্ধু হয়ে তারা যদি আমার বাড়িতে ইট মারতে পারে তাহলে কি ভাববো? যার দোকানে মাল খায় সে এসেও একটা ইট মেরে গেছে’। এই বাড়ির বছর পাঁচেকের বাচ্চা যার প্রথম অভিব্যক্তি ছিল ফুঁপিয়ে কান্না। তার সামনেই সেদিনের কথা বিবৃত হচ্ছিল যে। সত্যি, তার কাছে অপরাধী লাগছিল নিজেদের।
ক্ষত তৈরি হলো মনেও
যে কোন বিপর্যয়ই বেশকিছু সংবেদনশীল মনে তৈরি করে যায় ক্ষত, পাশে প্রাকৃতিক কারণে ঘটুক কিংবা মানুষের দ্বারা! সেই ক্ষত মানুষের মনে উদ্বেগ, আতঙ্ক, নিরাপত্তাহীনতা, অসহায়তা, অবিশ্বাস-সন্দেহ, অবসাদের বীজ বুনে দিয়ে যায়। শিশু-কিশোর, বয়স্ক মানুষের মনে এর তীব্রতা অনেক সময় প্রকট হয়ে ওঠে!
বসিরহাটের ঘটনা প্রবাহে আমরা দেখেছি পাইকপাড়া-ট্যাটরার মাঝখানে থাকা তরিবুলের সেই শিশু পুত্রের আতঙ্কিত মুখ ঘটনার প্রায় এক মাস পেরিয়ে যাবার পরেও। সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে দুচোখ জলে ভরে আশার সেই দৃশ্য আমরা ভুলতে পারিনি! পাইকপাড়া পঁয়ষট্টি পেরোনো বৃদ্ধার দৃষ্টিতে ফুটেওঠা অসহায়তা ও ভুলিনি আমরা! কার্তিক ঘোষের বিধবা যখন বলেন, ওকে কেউ মেরে ফেলবে, ভাবি নি কখনো। এখনো বিশ্বাস করতে যেন তার মন চায় না।
সাম্প্রতিক এই ঘটনায় দু’টি ভিন্ন ধর্মের মানুষের মনে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা, অবিশ্বাস আর সন্দেহ আরও অনেক তীব্র রূপ নিয়ে সামনে এসে দাড়ালো, যা আগে থাকলেও এতটা প্রকট রূপ নেয়নি।
আক্রান্ত শৈশব
শিশু-কিশোর মনকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রবল উদ্যমে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই তার সমান তালে চলছে। নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চলছে পরস্পর সম্পর্কে ঘৃণা আর সন্দেহের বীজ বোনা, দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা গুজব। শেখানো হচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীকে ঘৃণা আর সন্দেহ করতে! তুলে দেওয়া হচ্ছে শিশু-কিশোরদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। প্রকাশ্যে সশস্ত্র মিছিল, হিংসাত্মক স্লোগান, সামরিক প্রশিক্ষণ … সবই চলছে বেপরোয়াভাবে।
ধর্মীয় পরিচয় এর ওপর ভিত্তি করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে স্কুলের বেঞ্চ। বন্ধু তা থেমে যাচ্ছে, ‘কম কথা বলি মুসলিম সহপাঠীদের সঙ্গে’ এখন নিষ্ঠুর বাস্তব। ‘ক্ষত নিরাময়’ –এ জরুরী ভিত্তিতে সমাজের সংবেদনশীল মানুষের ভূমিকা নিতে হবে। শিশু-কিশোর মনে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, বন্ধুত্ব আর মানবিকতাবোধ, যুক্তিশীল মনন, বিজ্ঞান মনস্কতার বিকাশের উদ্যোগ আজ বড়ই সীমিত। ধর্মান্ধতার বিদ্বেষের মুখোমুখি হতে এই উদ্যোগ আজ খুব জরুরী!
বাড়ির পাশে আরশিনগর
হিন্দু আরো হিন্দু, মুসলিম আরো মুসলিম হতে নেমে পড়েছে। প্রতিবেশী থাকা পরিবারটির কাছে পৌঁছতে হবে। জরুরী আজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাপ-পরিচয় আত্মীয়তার দরজা জানলা খুলে দেওয়া! পরস্পরকে জানা-বোঝার মধ্যে দিয়েই সম্ভব ঘৃণা আর সন্দেহের বিদ্বেষ বিষকে নির্মূল করা। কথা বলা, আরো কথা বলা। কিছু উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পারছি। ‘এবং আলাপ’ নামের একটি সংস্থা মেটিয়াবুরুজের মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ সম্প্রতি নিয়েছে। আমরা’ও শামিল হয়েছি ‘ কারওয়া এ মুহব্বত ‘ দলের সঙ্গে। এমন আরও অনেক উদ্যোগ জরুরি। অবিশ্বাসের বাতাবরণে দূর করার উদ্যোগ শুরু হোক সর্বত্র। এই সমাজের মধ্যেই, এই সংস্কৃতির মধ্যেই আছে সাম্প্রদায়িকতা থামানোর রসদ। আমাদের ‘অস্ত্র’ হোক লালন, হাছন, দুদ্দু শাহ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের আদিগন্ত বাংলা।
স্বপন পালের দাঙ্গাগ্রস্ত দোকান
দাঙ্গাগ্রস্ত কোর্ট মসজিদের ইমাম
ভগ্ন বিগ্রহ, মায়ের ইচ্ছা মন্দির, টাকি রোড
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি, ত্রিমোহিনী, বসিরহাট
মৃত কার্তিক ঘোষের বড় ছেলে দেবাশিস ঘোষ
দাঙ্গাচিত্র
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.-
Rally to celebrate World Environment Day, Kolkata, 5 June, 2022
‘Environment Rights Movement’, a platform of different... -
কোভিড ১৯- একটি কথোপকথন
কথোপকথন দুইজনের। একজন... -
Farmer's Movement: Experience Sharing and Documentary Show, 16 January, 2021
AAMRA organised a program on contemporary farmer's movement... -
আর এস এস সদর দপ্তরে 'কামান দাগা'
আর এস এস-এর স্বরূপ কতটা...