তেলেনিপাড়া তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, ২০২০
আমরা এক সচেতন প্রয়াসের পক্ষ থেকে তেলিনিপাড়া দাঙ্গার তথ্যানুসন্ধান করা হয়। তুলে আনা হয় খবরের ভীরে হারিয়ে যাওয়া মানুষের হাহাকার।
Conflict Area Study-9
পশ্চিমবঙ্গঃ রামনবমী উত্তর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
সিরিজ-২
তেলেনিপাড়া তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন, ২০২০
প্রকাশঃ ২ অক্টোবর, ২০২০
তথ্যায়ন- অমিতাভ সেনগুপ্ত, ফারুক উল ইসলাম, ইপ্সিতা চক্রবর্তী, শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী, শুভঙ্কর সেনগুপ্ত, সৌরজিত প্রামাণিক, সৌমেন ঘোষ, রাজেশ নস্কর
সহযোগিতায়- শেখ আজমল, অভিষেক মুখার্জি, শুভঙ্কর চক্রবর্তী
সম্পাদনা- অমিতাভ সেনগুপ্ত, শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী
প্রকাশনা- মোহিত রণদীপ
আমরা এক সচেতন প্রয়াস,
৪০/১ এন সি ব্যানার্জি স্ট্রীট, হুগলী-৭১২২২২
ইমেল- aamrasachetan@gmail.com
ওয়েবসাইট- aamrabharatbarsha.com
ফোন নম্বর- 7044967575, 8697095776, 8820852054
সূচি
ভূমিকা ও প্রেক্ষিত
আগুন ও ছাই
কান্না ও কষ্টের মুখোমুখি
যারা আগুন লাগালো
যাদের হাতে জল ছিল
পুলিশ পলিটিক্স
যা হারালাম গঙ্গাপারে
সংযোজনী
ভূমিকা ও প্রেক্ষিত
আমরা, এক সচেতন প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিগত চার বছরে রামনবমী উত্তর পর্বে সাম্প্রদায়িক হিংসার স্বরূপ বুঝতে বিভিন্ন জনপদে তথ্যায়ন করা হচ্ছে। ২০১৮-২০২০ এই তিন বছর আমরা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ভাটপাড়ায় ক্ষেত্র গবেষণা চালিয়েছি, ইতিমধ্যে তার প্রতিবেদন প্রকাশিত। সেই ধারাবাহিকতায় তেলেনিপাড়া হোল দ্বিতীয় প্রতিবেদন।
হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বর শহর গঙ্গার পশ্চিম পারের এক উল্লেখযোগ্য শহর। ইতিহাসের বিভিন্ন আঙ্গিকে এটি একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ। ইতিহাসের পরতে পরতে- শিল্পে, সাহিত্যে, জনবিন্যাসে, সংস্কৃতিতে, পরাধীনতার ইতিহাসে, স্বাধীনতার সংগ্রামে। তেলেনিপাড়া এই শহরের একটি বড় এলাকা। এলাকাটি মিশ্র ও ঘন জনবসতি পূর্ণ। ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১লা এপ্রিল তারিখে ভদ্রেশ্বর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলার অন্যতম প্রাচীন এই পৌরসভা। ভদ্রেশ্বরে বৈদ্যুতিক আলো আসে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সুধীর কুমার মিত্র রচিত ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ-২ গ্রন্থে সেই সময়ের ভদ্রেশ্বরের কয়েকটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়, নিচে তা রাখা হোল-
ভদ্রেশ্বর মিউনিসিপ্যালিটি পাঁচটি ওয়ার্ডে বিভক্ত। এক নম্বর ওয়ার্ড ভদ্রেশ্বর, দুই নম্বর ওয়ার্ড গৌরহাটি, তিন নম্বর ওয়ার্ড তেলেনিপাড়া এবং চার ও পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড মানকুণ্ডু।
ভদ্রেশ্বরের মিল এলাকা ছাড়া অন্য স্থানগুলি খুব পরিস্কার রাখা হয় না বলিয়া মধ্যে মধ্যে অসুখের প্রাদুর্ভাব হয়। এই মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যে প্রধান রাস্তা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই রাস্তার গা দিয়া যে সব শাখা রাস্তাগুলি আছে, সেইগুলি অপ্রশস্ত ও ধূলিধূসরিত। এখানকার রাস্তার মাইলেজ ১৩.৬৭ মাইল। ইহার মধ্যে ৯.৮৫ মাইল হইতেছে কাঁচা রাস্তা। কাঁচা রাস্তাগুলি চলার উপযোগী ও সুসংস্কৃত করিলে পথচারীরা উপকৃত হইবেন। এই সব রাস্তার দুধারে গভীর কাঁচা অপরিষ্কার নর্দমা পৌরসভার কলঙ্ক। পরিমার্জনের অভাবে নর্দমা হইতে দুর্গন্ধ ও জল নিষ্কাশনের অব্যবস্থার জন্য পেটের অসুখের প্রাদুর্ভাব এই স্থানে প্রায়ই হয়।
পৌরসভার নিজস্ব ‘ওয়াটার-ওয়ার্কস’ নাই বলিয়া মিল এলাকা ছাড়া সর্বত্রই জলাভাব আছে। ৮০টি নলকূপের সাহায্যে জলদানের ব্যবস্থা অকিঞ্চিৎকর বলিয়া মনে হয়। তৃষ্ণা নিবারণের জন্য মিল কর্তৃপক্ষের পৌরসভাকে সহৃদয়তার সহিত সাহায্য করা কর্তব্য। পৌরসভার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা অনুসরণ করিলে এই প্রাচীন ঐতিহাসিক শিল্পসমৃদ্ধ শহরের ঐতিহ্য বজায় থাকিবে।
(পৃষ্ঠা-৫৮৫, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ-২, সুধীর কুমার মিত্র, ১৯৪৮)
হুগলী জেলা বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জীবিকার প্রয়োজনে মানুষের আনাগোনার পুরনো ইতিহাস আছে। আছে ইউরোপীয় উপনিবেশিকদের বাণিজ্য তথা সাম্রাজ্য স্থাপনের ইতিহাস। উক্ত গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি-
ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগিজগণ সর্বপ্রথম বাণিজ্য করিতে এই দেশে আসে। তৎপরে শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীবৃন্দ কর্তৃক এই জেলার গঙ্গাতীরস্থ স্থানগুলিই অধ্যুষিত ছিল। তন্মধ্যে ইংরেজদের প্রাধান্য হুগলীতে, পর্তুগিজদের ব্যন্ডেলে, গ্রিকদের রিষড়ায়, জার্মানিদের ভদ্রেশ্বরে, কোন্নগরে অস্ত্রেলিয়দের, চুঁচুড়ায় ওলন্দাজদের এবং শ্রীরামপুরে দিনেমারদের অধিষ্ঠান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
(পৃষ্ঠা-৬৪৫, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ-১, সুধীর কুমার মিত্র, ১৯৪৮)
চটকল ও অন্যান্য শিল্পে কাজ করতে আসা হিন্দি ও উর্দুভাষী মানুষ এসেছেন মূলত ব্রিটিশ শাসন কালে। তেলেনিপাড়ার মিশ্র জনবসতিতে উক্ত দুই ভাষাভাষী মানুষ আছেন বহুলাংশে। এছাড়া ভদ্রেশ্বর ম্যুনিসিপ্যালিটি এলাকায় উড়িয়া, তেলেগু ইত্যাদি ভাষার মানুষ আছেন।
তেলেনিপাড়ার সংলগ্ন চাঁপদানি শহর। এখানেও চটকল বা বিভিন্ন কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের বাস। হুগলী জেলার ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়, বিভিন্ন সময় দাঙ্গা হয়েছে এই দুটি জনপদে। ৯২-এ বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে দগ্ধ হয়েছে এখানের মানুষ। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই হিন্দিভাষী বনাম উর্দুভাষী এই সমীকরণ উঠে এসেছে। কিন্তু এবারের তেলেনিপাড়ার হিংসার বিশেষত্ব হোল দাঙ্গার বিস্তৃতি; এলাকা ও জনগোষ্ঠীর নিরিখে। বাংলাভাষীরাও সাম্প্রদায়িক হিংসায় (১২ মে’র হিংসায়) যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ সংগঠিত ও বহিরাগত দাঙ্গাবাজ এনে সুপরিকল্পিত ভাবে দাঙ্গা করানোর।
(ক)
গোন্দলপাড়া’র ঘটনা
হুগলী নদীর দুইপার (বিশেষত ব্যারাকপুর ও চন্দননগর মহকুমা এলাকা) সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রকাশিত রিপোর্ট, ‘সাম্প্রদায়িক হিংসা, ২০১৬: পশ্চিমবঙ্গ’-এ চন্দননগরে রামনবমী-উত্তর হিংসার উল্লেখ আছে। এবারেও চন্দননগর পৌরসভার উর্দিবাজার ২০১৬ সালের মত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ‘নিজামুদ্দিন-করোনা সংক্রমণ-মুসলিম হইতে সাবধান’-এই প্রচার এখানেও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ঘুরতে থাকে। ঠিক যেমন গঙ্গার ওপারে, বিশেষত ভাটপাড়ায় তা ব্যাপক আকার নেয়। ভদ্রেশ্বর পুরসভার ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ড এবং চন্দননগর পৌরসভার ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ২০২০-র এপ্রিলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার শুরু হয়। তখনও তেলেনিপাড়া দাঙ্গা (মে, ২০২০) ঘটে নি।
গত ১৯ এপ্রিল, ২০২০ গোন্দলপাড়া চটকল এলাকার বাসিন্দাদের ঘুম ভাঙে সম্ভাব্য দাঙ্গার উত্তাপে। রাত্রি ৩.৩০-এ কেউ মালাপাড়া মসজিদের তালা ভেঙে মসজিদে ঢোকে, তারপর মসজিদের আসবাব ভাঙে, কোরান ছিঁড়ে দেয়। স্থানীয় মানুষ তাকে ধরে ফেলে, তারপর মারধোর করে, পরে পুলিসের হাতে তুলে দেয়। ২০ এপ্রিল সেখানে র্যাপিড অ্যাকশান ফোর্স মোতায়েন করা হয়।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমরা কথা বলি, রাজেশ জয়সোয়ালের সঙ্গে। ফরওয়ার্ড ব্লক থেকে ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের (গোন্দলপাড়ার নিকটবর্তী) নির্বাচিত এই কাউন্সিলর নিজেই গোন্দলপাড়ার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, চন্দননগর পৌরসভা ডিসলভ করা হয়েছে। এখানে তৃণমূলের দাদাগিরি সব রকমের গণতান্ত্রিক পরিসরকে শেষ করে দিয়েছে। ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে থেকেই চুঁচুড়া, চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর-এর রাজনৈতিক চিত্র বদলাতে থাকে, ব্যাপক সেই বদল। প্রচার, মেরুকরণ এবং হিংসাকে কৌশল হিসাবে ব্যবহার করে বিজেপি নেতৃত্ব। তাদের লক্ষ্য তখন হুগলী লোকসভা কেন্দ্র। সেই শুরু, এখনও চলছে।’
গোন্দলপাড়া চটকল ২০১৮ সাল থেকে বন্ধ। ‘বেকার শ্রমিক বস্তীগুলো এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির আখড়া,’ জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রেডইউনিয়ন নেতা। ১৯ এপ্রিলের ঘটনা কোন বড় ষড়যন্ত্রের শুরু জানালেন তিনি। আমরা মসজিদের সংলগ্ন এলাকায় গেলে অনেকে জানান, ‘সেই রাত্রে কে মসজিদে এসেছিল তা জানিনা। তার নাম, পরিচয় কিছুই জানায়নি পুলিস।’ মসজিদের কাছেই বসেছিলেন মুবাসসর আলি, তিনি বলেন, ‘মানসিক গণ্ডগোল থাকতে পারে লোকটার। হয়ত এই কারনেই তাকে ব্যবহার করা হয়েছে।’
গোন্দলপাড়া মসজিদের
(খ)
করোনা নিয়ে সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং সোশ্যাল মিডিয়া
শতাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে ‘মুসলিমরা করোনা ছড়াচ্ছে’, ‘নিজামুদ্দিনের মারকাজ ফেরত বহু মুসলমান এখানে এই তেলেনিপাড়ায় আছে’, ‘চন্দননগরের উর্দিবাজারে মুসলিমদের করোনা ছেয়ে গেছে’, ‘ওরা নিয়ম মানছে না, করোনা ছড়াচ্ছে’- এই রকম কথা উঠে এসেছে বারংবার। এই গ্রুপগুলির বেশীরভাগ হিন্দুত্ব গ্রুপগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া হিন্দুত্ব মানসিকতার ‘স্বেচ্ছাসেবক’রা স্বেচ্ছায় ‘দায়িত্ব’ কাঁধে তুলে নিয়েছে, এইরকমও আছে। কয়েকটি গ্রুপের নাম এইরকম-
Corona se Bancho
Beware of Muslim
Ram ke nam lo
ফেসবুকের ক্ষেত্রে ‘গোপনীয়তা’ বজায় রাখা কম থাকায় এর ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। ব্যতিক্রম হুগলীর সাংসদ, লকেট চট্টোপধ্যায়। বিজেপি’র সাংসদ তাঁর ফেসবুক থেকে বিভিন্ন সময় যেসব কথা বলেছেন তার নির্যাস, ‘মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা’। তাঁর কথার সারাংশ-
ক) ১৩ মে, ২০২০ ফেসবুক পোস্ট- একটি বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সন্ত্রাস, ভাঙচুর, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, গুন্ডাগিরি করার সুযোগ করে দিচ্ছে পুলিশ।
খ) ১২ মে, ২০২০ ফেসবুক পোস্ট- পরশুদিন এক্সম্প্রদায়ের লোকজন এসে তলোয়ার নিয়ে, বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে এসে আক্রমণ করে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। দুটো সোনার দোকান লুঠ হয় এবং তার পর অনেক কিছু লুঠ হয়। ...আজ দুপুর ১১ টা থেকে আমার কাছে ফোন আসতে থাকে, চন্দননগর তেলেনিপাড়া দাওদাও করে জ্বলছে। আগুন বোমা আপনারা সবাই দেখেছেন, কিভাবে কালো ধোওয়া উঠেছে। চারিদিক থেকে ফোন আসতে থাকে হিন্দুদের ঘর লুঠপাট করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে। মহিলারা ফোন করছে, ‘দিদি আমরা বোধহয় আমাদের কিছু বাঁচাতে পারবো না। এই অবস্থা যদি আমি শুনি তবে আমার কিরকম লাগবে?
গ) ১২ মে, ২০২০ ফেসবুক পোস্ট- চারিদিকে ব্যারিকেড দেওয়া আছে, কিন্তু একটা ছোট জায়গাকে কনট্রোলে আনতে পারছে না কেন? পুলিশ এতো ভালো কাজ করছে এখানে কিছু করতে পারছে না কেন? কেননা ওপর থেকে নির্দেশ আছে, ‘পুলিশ, আমি যতক্ষণ না বলবো এদের গায়ে হাত পরবে না’। কেন বললাম এদের গায়ে? রিসেন্টলি চন্দননগরে করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে এদের অনেকের মধ্যে। আজমীঢ় থেকে অনেকে ফিরেছে, কাউন্সিলর আছেন টিএমসি’র সংখ্যালঘু এদের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। যেহেতু পাওয়া গেছে এদের আশেপাশের লোকজনকে কয়ারেন্টাইনে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা টেস্ট করবে না, তারা কয়ারেন্টাইনে যাবে না। তারা পুলিশের সঙ্গে ঝামেলা করলো। তারা কোথাও যাবে না, তারা শুধু ছড়িয়ে যাবে। করোনা নিয়ে যখন মানুষ লড়ছে, তখন এদের করোনা ছড়ানো উদ্দেশ্য। এই ছড়ানো আটকাতে পুলিশ প্রশাসন যখন ব্যারিকেড দিয়েছে, এলাকার মানুষ যখন ব্যারিকেড দিয়েছে, যেহেতু এই পাড়ায় করোনা বেশি, তখন তারা রাগ দেখাতে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর আক্রমণ করেছে।
১০ মে হিন্দুদের দোকান আক্রান্ত হোল, একটি সম্প্রদায় তা করলো, কিন্তু প্রশাসন কিছু করলো না। ওদের মাথায় তুলে রেখেছে তৃণমূল সরকার। এর ফল ওরা হাতেনাতে পাবে।
উল্লেখ্য এই সাংসদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার কথা উনি নিজেই জানিয়েছিলেন।
(গ)
দাঙ্গার পরেপরেই
১০ মে, ২০২০ তেলেনিপাড়ার ফেরি ঘাট স্ট্রিটের যেখানে হিন্দু মহল্লা শুরু হয় সেখানে অনেকগুলি দোকান আক্রান্ত হয়। প্রায় ২০ টা দোকানে লুঠ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ‘খবর’ হয়। তার প্রেক্ষিতে আমাদের প্রথম পর্বের তথ্যানুসন্ধান।
১১ মে, ২০২০ ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর তথ্যানুসন্ধান দল প্রথম তেলেনিপাড়া যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু চাঁপদানির পরেই পুলিশ আটকে দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু দোকানদারদের পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে চাঁপদানির পলতা ঘাটে আমাদের কথা হয়। চাঁপদানি হোল ভদ্রেশ্বরের পাশের ম্যুনিসিপ্যালিটি, যা দক্ষিণ দিকে।
১৯ মে, ২০২০ সাইকেল নিয়ে আমাদের এক সদস্য তেলেনিপাড়ার দাঙ্গাবিধস্ত এলাকায় যান। এফ জি (ফেরি ঘাট) স্ট্রিট এবং সংলগ্ন বাজারটিতে যথেষ্ট ভীর ছিল। আসন্ন ঈদের জন্য মানুষজন কেনাকাটায় মত্ত ছিলেন। আমরা’র সদস্যটির মত ‘বহিরাগত’কে নজরে রাখছিল মুসলিম যুবকেরা। বাজার শেষ হতেই, মোড়, সেখান থেকে হিন্দু এলাকা। একটু এগিয়ে তেলেনিপাড়া ফেরি ঘাট। র্যাপিড অ্যাকশান ফোর্সের জওয়ানরা কাউকেই সেদিকে যেতে দিচ্ছে না। মোড়ের একটু আগেই বামদিকে মুসলিম পাড়া, বস্তি সাদৃশ্য পর পর ঘরের সারি। একটি ছোট্ট ঘরের দাওায়ায় বসে ছিলেন বছর সত্তরের এক বৃদ্ধা। হামিদা বানু (নাম পরিবর্তিত)-র সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় হিন্দি বা উর্দুতে।
আমরা- আসসালাম আলেইকুম নানি।
হামিদা- সালাম বেটা।
আমরা- এই রাস্তাটা কি নেহেরু স্কুলের দিকে যাচ্ছে?
হামিদা- তুমি কোথায় যাবে?
আমরা- স্কুলে অবশ্যই যাবো না। তেলেনিপাড়া ঘাট যাবো, এইদিকে কি যাওয়া যাবে?
হামিদা- এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া মুশকিল। এফ জি স্ট্রিট দিয়ে যাও।
আমরা- ওইদিকে পুলিশ যেতে দিচ্ছে না।
হামিদা- কি জানি বেটা, পরিস্থিতি উত্তেজক।
আমরা- এখনও? প্রথম দিনের ঝামেলার পর এতদিন হয়ে গেলো?
হামিদা- পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে নেতাদের আসার পর।
আমরা- কাদের কথা বলছেন?
হামিদা- এই যেমন লকেট চ্যাটার্জি, আমাদের এম পি।
আমরা- কি হয়েছিল সেইদিন?
হামিদা- পরিস্থিতি রমজানের আগেই ঘোরালো হয়ে উঠেছিল। ওরা আমাদের করোনা ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করছিল।
আমরা- ওরা মানে হিন্দুরা?
হামিদা- সব হিন্দু নই, কয়েকজন বদমাশ।
আমরা- আর রমজান শুরু হওয়ার পর? রমজান তো শুরু হয়েছে ২৫ এপ্রিল থেকে।
হামিদা- ওহি বদমাশ উধার ভি হ্যায় অউর ইধার ভি হ্যায়।
ঠিক এই সময় কেউ একজন ভিতর থেকে আসে। কথোপকথন থেমে যায়। আমরা’র সদস্য তাঁকে সম্বোধন করে, কিন্তু সেই ব্যক্তি কোন জবাব দেন না। তিনি ‘নানি’র দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকান, নানি কিছুক্ষণের জন্য থেমে যান, তারপর শুরু করেন কিছুটা দ্বিধা নিয়ে। এই আলাপ তাঁকে সমস্যায় ফেলতে পারে এই ভেবে আমরা আর কথা বাড়ায় না।
আমরা- শুক্রিয়া নানি। আমাদের যেতে হবে। কি যে হয়ে গেলো, হিন্দু-মুসলমান একসাথে রয়েছে এখানে, কি হোল যে একে অন্যের দোকান, ঘর জ্বালিয়ে দিল?
হামিদা- এ হোল রাজনীতি, গন্ধা রাজনীতি।
আমরা- আপনাদের এখানে অনেক দোকান জ্বলেছে, লুঠ হয়েছে।
হামিদা- হ্যাঁ এখানে হিন্দুদের দোকান লুঠ হয়েছে, মুসলিমদের হয়েছে অন্য এলাকায়।
আমরা- হ্যাঁ, যেমন জি টি রোডে দেখলাম।
হামিদা- এখানেও লুঠ হয়েছে, আগুন জ্বলেছে, ওখানেও লুঠ হয়েছে, আগুন জ্বলেছে।
আমরা- জি টি রোডে লুঠ হওয়া দোকানের মালিক শুনলাম তেলেনিপাড়ার।
হামিদা- হ্যাঁ লুঠ হুয়া হামারা ঔর ইহা লুঠেরা ভি হম হ্যায়।
আমরা- আপনাদের এখানে হিন্দুদের দোকান লুঠ হোল, আপনি বলছেন লুটেরা যারা লুণ্ঠিতও তারা?
হামিদা- হ্যাঁ তাই তো। এখানে মুসলমানরা হিন্দুদের দোকান লুঠ করেছে, অন্য জায়গায় হিন্দুরা। মতলব তো এহি হুওা না?
(১)
আগুন ও ছাই
প্রশাসনের কাছে কতগুলি বাড়ি ভাঙ্গা হয়েছে, কতগুলি বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে, কটা পরিবারের জিনিষপত্র লুঠ হয়েছে (এবং আরও কিছু তথ্য)জানতে চেয়ে ‘আমরা’-র পক্ষ থেকে গত ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে হুগলী জেলা শাসকের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি দেওয়া হয়। না আজ পর্যন্ত কোন উত্তর আসেনি। স্থানীয় বন্ধু এবং আমরা সদস্যদের মিলিত দল বার বার মুখোমুখি হয়েছে আগুনের, ছাইয়ের। এখানে কয়েক টুকরো।
সত্যপীরের ভাঙ্গা মাজারের সামনে
বাংলার জনজীবনে সত্যপীর বা সত্যনারায়ণ এক উল্লেখযোগ্য লোকসাংস্কৃতিক(এবং লোকধর্ম) পরিস্রবণ। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিভিন্ন জনপদে সত্যপীরের মাজারে সমবেত হওয়া, সিন্নি দেওয়া, মানত করা এখনও সহাবস্থানের ঐতিহ্য বহন করে। আমরা জানি এই ঐতিহ্য ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জনপদে দেখা যায়। মাজার ঘিরে বা মাজারকে কেন্দ্র করে যে মেলা বা বাৎসরিক উরুস হয় তা থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা বা খাদেমদের রোজগার হয়, এটা আর একটি দিক। কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষ রোগ মুক্তি, পারিবারিক বা সামাজিক সমস্যার সুরাহা করতে মাজারে যায়, আর খাদেমরা তাবিজ, মাদুলি, জল পরা ইত্যাদির মাধ্যমে রোজগার করে। মাজারে কাওয়ালী গান, ফকীরি গান হয়। জি টি রোডের ওপর ভদ্রেশ্বরের এই সত্যপীরের থানটিও সেইরকম একটি কেন্দ্র। এলাকার কসমোপলিটান চরিত্র অনুসারে এখানে উর্দু, হিন্দি, ওড়িয়া, তেলেগু এবং বাংলাভাষী মানুষ প্রচুর। সত্যপীরের মাজারটি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান নির্বিশেষে তাদের সকলের মিলনায়তন হয়ে উঠেছিল। ১২ জুন, ২০২০ হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজরা এটি আক্রমণ করে। ভেঙে চূর চূর করে দেয়, ইট-বালি-সুরকির ইমারত। বাস্তবে ভাঙ্গা হয় সহাবস্থানকেই, ভালোবাসাকে।
ভদ্রেশ্বরের জি টি রোডের পাশে এই তেলেনিপাড়ার বাবুবাজারে সত্য পীরের মাজার। ২০০ বছরের পুরনো এই মাজার, এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী বদর উদ্দিন সাহেব।৩০-৩৫ বছর আগে এটা এত সুন্দর ছিল না, ছিল মাটি দিয়ে নির্মিত একটি সাধারণ মাজার। বাউন্ডারি বানানো ছিল। ওই সময় রাধেশ্যাম ঘোষ, কোলকাতার কলেজ স্ট্রিটে যার মিষ্টির দোকান, ঢাকেশ্বরী মিষ্টান্ন ভান্ডার, উনি ‘স্বপ্নাদেশ’ পান এবং উনি এটি পুনর্নির্মাণ করেন। সেই ৩০-৩৫ বছর আগের কথা। ওনার নাম গেটে লেখা আছে। বর্তমানে ওনার বয়স হয়েছে, অসুস্থ, আসতে পারেন না। এলাকায় গিয়ে লোক মুখে আমরা এইসব তথ্য জানতে পারি।
১২ তারিখের দাঙ্গা শুধু ইমারত নয় সমাজের মনে কতটা ক্ষত এনেছে তা বুঝতেই আমরা কথা বলি বিভিন্ন জনের সঙ্গে। কথা বলি বর্তমান খাদেম আবদুল মল্লিকের সঙ্গে। ওনার বাবা শেখ জুম্মা মল্লিক আগে খাদেম ছিলেন, উনি মারা যাবার পর আবদুল মল্লিক মাজার দেখভাল করতে থাকেন। কথাবার্তার শুরুতে ওনাকে উত্তেজিত মনে হয়। ‘এই সব কথা বলে কি হবে, আমার ওপর যা হবার তো হোল, আজও হয়রানি চলছে’- এই ছিল তাঁর অভিব্যক্তি। আমরা তাঁর উস্মা, উদ্বেগকে বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের কথা চলাকালীন উনি ওনার ‘ব্যবসা’ চালিয়ে যান। প্রচলিত ‘বিশ্বাস’কে পুঁজি করে কাউকে মাদুলি, কাউকে মালা দিতে থাকেন। ‘রুগী’ কারা? সব সম্প্রদায়ের, সব ভাষার মানুষ।
আমরা- যখন ভাঙচুর হচ্ছিল, আপনি মাজারে ছিলেন?
খাদেম-আমি বারোটার সময় চলে গেছি। আমরা সকাল ন'টায় আসি বারোটায় চলে যাই। আবার বিকেল পাঁচটায় এসে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা আটটার মধ্যে চলে যাই।তার মধ্যেই লোকজন এলে তাদের গা ঝাড়া, জল পড়া যেমন আছে সেসব করে দি, কাদের জন্ডিস হয়েছে জন্ডিসের মালা দিই। এই যে দরজা টা ভেঙে দিয়েছিল আমি বসিয়েছি নতুন।(কথা বলতে বলতে দেখালেন)
আমরা- যখন ঘটছে তখনই খবর পেয়েছেন তো?
খাদেম- তখনই খবর পেয়েছি।এখানেই পাশের থেকে সবাই খবর দিয়েছে। দেখো তোমাদের এখানে ভাঙচুর হচ্ছে, গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, তোমার এমন জিনিস নেই যা লুট হচ্ছে না সব কাঁধে করে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
আমরা- আচ্ছা স্থানীয় মানুষরা তো এখানে আসে?
খাদেম- স্থানীয় মানুষরাই তো করেছে। বিশ্বাসের সাথে কি আছে, এ তো পার্টি পলিটিক্স।আমার গাড়িগুলো থানা নিয়ে গেছে সেগুলো কিছুতেই ফেরত দিচ্ছ না বলছে কেস হয়েছে, আমার গাড়ির ব্লু বুক আছে, সব আছে কাগজপত্র। শুধু ইনসিওরেন্স নেই। ঠিক আছে ইনসিওরেন্স আমি করাইনি, কিন্তু থানা আমায় গাড়ি গুলো ফেরত দিচ্ছ না কেন? আমি কি কারুর নামে কেস করেছি? আমিতো কেস করিনি।
আমরা- এরকম একটা ধর্ম স্থানের উপর আঘাত এল?
খাদেম- সে তারা এখন আফসোস করছে। আফসোস করে আর কি করবে? সেদিন তারা যখন রুখতে পারেনি।
আমরা- কেউ এগিয়ে এসে রোখার চেষ্টা করেছিল?
খাদেম- না না সেসব কেউ করেনি। যে যার নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছে, বলছে আমরা দেখছি। আর কেই বা আসবে? ওতো লোক ওরা এসেছিল, একজন দুজন বেরোলে তারাই তো মার খাবে। আমি থাকলে,আমাকেই তো সেদিন মেরে দিত। কেউ বাধা দিতে পারে?এখন বললে অনেক কিছুই বলা যায়, না বললে কিছুই বলা যায় না । কারা করল না করল সবাই সব জানে।
আমরা- আপনি রাজনীতিকে দায়ী করছেন। কিন্তু এতদিন তো হয়নি, এখন হচ্ছে কেন?
খাদেম- ওই যে রাজনীতির জন্য। এর আগেও রাজনীতি ছিল, কিন্তু এইরকম ছিল না।
আমরা- আপনার কি মনে হয় আবার একসাথে থাকা যাবে? আবার সবাই আসবে এই মাজারে, উরুসে?
খাদেম- হ্যাঁ, আসবে।
আমরা- এই মাজার কতদিন আগেকার?
খাদেম- সে দুশো বছর আগেকার হবে আরও বেশি হতে পারে। হাজী বদর উদ্দিন সাহেব এই পীরতলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একে সত্য পীরতলা বলে সবাই জানে। সেই মাজারকে ভাঙলো। ছিঃ!
আমরা- এগুলো সংস্কারের জন্য কোন টাকা পাওয়া গেছে? কি কি ক্ষতি হয়েছে মাজারের?
খাদেম- আমি মিউনিসিপালিটি তে গেছিলাম ওরা বলছে যে কাউকে আট দিচ্ছি কাউকে দশ দিচ্ছি প্রচুর লোকের প্রচুর গেছে। আমি বলি যে দশ দিলে আমি নেব না, আমার তাতে কিছুই হবে না। তখন ভাইস চেয়ারম্যান সাহেব ডেকে কথা বলে কুড়ি হাজার টাকা আমাকে দিয়েছে। তাই দিয়ে এই বিম কিনতে পেরেছি। এই সামনের পাঁচিলটা আমাকে করতেই হবে। কিন্তু মাজারের এই সংস্কার আমার একার পক্ষে সম্ভব না। আমার যা পুঁজি ছিল সিন্দুকের মধ্যে সব নিয়ে চলে গেছে। সিন্দুক ভেঙে দিয়েছে। সিন্দুকে কিছু রাখেনি। এইযে সিন্দুকের ছবি। লোহার সিন্দুক ভেঙে ভেতরে যা ছিল সব নিয়ে গেছে, পেতলের জিনিস ছিল, তামার পাল্লা ও বাটখারা ছিল, আমাদের তো ওষুধের লাইন, নিক্তি ছিল তামার। মাজারে বড় বড় ফুলদানি ছিল, লাইট ছিল বেলজিয়াম গ্লাসের, সব ভেঙে দিয়েছে। সামনে শাটারের লক ভেঙে দিয়েছে। এই দেখুন শাটার, উপর থেকে খোলার চেষ্টা করেছিল। আমার ঘরে যা জিনিস ছিল সব নিয়ে গেছে।শাটার টা পুরো ভাঙতে পারেনি এটা ভাঙতে পারলে তারও জিনিস নিয়ে যেত। এটা ছেলের দোকান। ছেলের নাম শেখ আব্দুল মল্লিক।ঘরের ভেতরে যা জিনিস ছিল নিয়ে গিয়ে বাইরে পুড়িয়ে দিয়েছে। টেবিল-চেয়ার যা ছিল সব নিয়ে চলে গেছে।
আমরা- আপনাদের এখানে উরুস কবে হয়?
খাদেম- ফাল্গুন মাসের দ্বিতীয় শনিবার। দুই সম্প্রদায়ের মানুষ আসে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি আসে।
ভাঙা মন্দিরের সামনে
ভিক্টরিয়া জুট মিল সংলগ্ন রাজাবাজার এলাকায় একটি মন্দিরে ভাঙচুর হয়, মূর্তির গায়ে অন্তর্বাস চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয় কয়েকটি হিন্দু পরিবার। ১৬ জুন, ২০২০ তথ্যানুসন্ধান চলাকালীন তারা মন্দিরের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখান ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন।সংলগ্ন কয়েকটি হিন্দু পরিবারের সম্পূর্ণ ভস্মীভূত বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জনৈক জয়সোয়াল পরিবারের এক মহিলা মন্দির ভাঙচুরের যথাযোগ্য ক্ষতিপূরণও দাবী করেন। মন্দিরটি ১০ মে আক্রান্ত হয়েছিল বলে জানানো হয়। এক্ষেত্রে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হলে, মহিলা জানান, ‘না কোন গ্রেফতার হয়নি’। এর বেশি কথা বলা যায়নি।
(২)
কান্না ও কষ্টের মুখোমুখি
বাস্তবে প্রথম পর্বের হিংসার পরেপরেই আমরা’র তথ্যানুসন্ধান দল তেলেনিপাড়ায় যায়। প্রথম যাওয়া হয় ১১ মে, ২০২০। সর্বশেষ যাওয়া ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০। প্রায় চার মাসের অধিক সময়ে কমপক্ষে ১৮ বার আমাদের দলটি কথা বলে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে। তা সত্ত্বেও দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সকলের কাছে আমরা পৌঁছতে পারিনি, এ আমাদের ব্যর্থতা। প্রয়াস সত্ত্বেও অনেকে আমাদের কাছে মুখ খোলেন নি, তাঁদের কাছে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা দেখাতে পারিনি, এ আমাদের অসম্পূর্ণতা। অনেকে মুখ খুললেও নাম প্রকাশ করতে চাননি, আমরা অঙ্গিকারবদ্ধ। এখানে এই বাস্তবতার ঝলক রাখা হোল।
(ক)
দাঙ্গা যাদের কেড়েছে অনেককিছু
১। অনিতা কুমারী পাসওয়ান
৩ জুন, ২০২০ আমরা কথা বলি, তখন সকাল ১১ টা। সেই সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া হিন্দু বস্তি সারানোর কাজ হচ্ছিল। ওয়ার্ড নম্বর ১৩-র বিজেপি থেকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কমিশনার পান্নালাল সাহুর তত্ত্বাবধানে মেরামতির কাজ হচ্ছিল।
অনিতা- এখানকার কথা বলছি শুনুন,সকালে ১১টার দিকে, হামলোগ খানাউনা বানা রহেথে, উপরসে বোতল ফেকনে লাগা,(পিছনের একটি চারতলা বাড়ি দেখিয়ে),বোতলে পেট্রোল ভরে ভরে ছুড়ছিলো,তাই দেখে বাচ্চা, বড়ো যত ছিলাম আমরা এক কাপড়ে পালাতে থাকি।কোনও সামান উমান কিছু বাঁচাতে পারিনি।ঘরে মান্ডির ৪০ হাজার টাকা ছিলো পুড়ে গেছে,দেখুন আমার সেলাই মেশিনের অবস্থা দেখুন, সব সামান দেখুন,পুড়ে শেষ, কেউ কিছু দিচ্ছেনা, তিন তিনটে ঘর... কত ধরে করে ৫ হাজার টাকা করে পেয়েছি।ওই তো বাবার পায়ে চোট লেগেছে ইস্কুলে খাবার আনতে গিয়ে,এখন আমরা কোনদিকে যাবো,বাবার চিকিৎসা করাবো, না ঘর বসাবো? (ক্রন্দনরত)
আমরা- কারা করেছে এই ক্ষতি?
অনিতা- মুখ তো চিনিনা,ওই সেলিমের কোঠি থেকে বোম ছুঁড়েছে,তখন আমরা পালাবো না ওদের মুখ দেখবে,আর কারুর নাম বলতেও সাহস পাচ্ছি না।
আমরা- এসব হলো কেনো?কোনও টেনশন ছিলো মহল্লায়? কিছু আভাস পাচ্ছিলেন?
অনিতা- কিছুই বুঝতে পারিনি, কেন হলো, একদম আচানক।বুঝতে পারলে আমরা ঘরের জিনিসপত্র সরিয়ে নিতাম কি না? আমার ২২-২৪ বছর বয়স হলো, ছোট থেকে কখনও এই ঝামেলা দেখিনি।শুনতাম তেলিনী পাড়ায় গোন্দোল পাড়ায় এদিক ওদিক ঝামেলা হয়েছে,কিন্তু আমাদের এখানে হয়নি।দেখুন এই যে দরকারী কাগজ পত্র, ছটপুজোর পিতলের বাসন সব পুড়িয়ে দিয়েছে।কে দেবে এত কিছুর ক্ষতিপূরণ?
অনিতা কুমারী পাসওয়ান কথোপকথন এর সময়ে
২। আসমা ফিরদৌস, দিনেমার ডাঙ্গা
আমরা- বলুন কি হয়েছিল ওইদিন?
আসমা- আরে পুরা ঘর জ্বালা দিয়া।
আমরা- লোকাল লোকজন ছিল?
আসমা- চিনবো কি করে? মুখ তো সব বাঁধা ছিল গেরুয়া রঙের কাপড়ে।
আমরা- কতজন ছিল?
আসমা- (আঙুল দিয়ে একটা বাড়ি দেখায়) ওইখানে সব দাঁড়িয়ে ছিল। আমার বাড়িতে ১০-১২ জন হামলা চালায়। অনেক জিনিস ছিল বাড়িতে। মেয়ের বিয়ের জিনিষ।
আমরা- আপনার স্বামী কি কাজ করেন?
আসমা- আমার স্বামী মৌলানা। রেডিমেড কাপড়ের ব্যবসা আছে। আমার বড় মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার। ইনফোসিস-এ চাকরি করে। ওর নাম আরজু ফিরদৌস।
৩। সরওয়ারি বিবি, ৩ নম্বর লাইন, পাইকপাড়া
আমরা রাস্তার ভিখারি হয় গেছি। না একটা গ্লাস না একটা বাটি। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যা কিছু ছিল সব নিয়ে গেছে ঘর থেকে। আমাদের দরজা বন্ধ ছিল। আমরা ভিতর ছিলাম। আমরা বেরিয়ে যাবার পর আগুন লাগিয়েছে।
পুরো পুড়িয়ে দিয়েছিল। এইতো সবে মাত্র বানাচ্ছি। একদম তো ময়দান ছিল। এখন এদের দেওয়া পুরনো জামা কাপড় আছে শুধু। এই ঘর এই ঘর পাশে সমস্ত ঘর পুড়ে গেছিল। সরকার থেকে মাত্র ৮০০০ টাকা পেয়েছি।
এটা ১২ তারিখের ঘটনা। দুপুর দেড়টায় পুড়িয়েছে।
ঘর নিজের পয়সায় সারিয়েছি। সরকারের ৮০০০ টাকায় কি হয়? এখন তো আমাদের টাকা পয়সা নেই। একটা থালা বাটি ও নেই। আমরা ভাত খাব কি করে? এসব পুরোনো কাপড় পড়ে আছি। অন্য লোকের সাহায্য সাহায্য দেওয়া। আমরা এক কাপড়ে বেরিয়ে গেছিলাম। অন্যের দেওয়া কাপড় পড়েই চলছে। এই পরবের সময় আমরা স্কুলে ছিলাম। কি করে কি করব? একটা জলখাবার ক্লাস অবধি নেই।
এখন এই ঘরটা হচ্ছে তাই দিনের বেলা আসি। রাত্রে আবার চলে যাব। কিভাবে থাকবো? ইলেকট্রিক তো নেই। লাইট নেই ফ্যান নেই। খাওয়া-দাওয়া সব এখন স্কুলেই। এখন তো এখানে থাকা সম্ভব নয়। কি করে আমরা থাকব সেটাই ভাবছি।
আমরা দরখাস্ত লিখেছিলাম। কি কি ক্ষতি হয়েছে তার একটা তালিকা। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ওরা দরখাস্ত নেইনি। বলল এসব এখানে জমা হবে না।
লকডাউনের সময় ছিল। আমরা এখানকার বাড়িতে গেছিলাম। ওরা বললো এখানেই সব চলবে না। কিছুই জমা নেয়নি।
এ সব ছেলেরই আমাদের সাহায্য করেছিল। লতিফের ছেলে। এরা সবাই রাত্রে এসে আমাদের বার করে নিয়ে গেছে।
এখানে এমডি আরমান আর নঈম ভাই ছিলেন। এরা সিভিক পুলিশ। এরাই ফ্রনট্রে ছিল। ইমাম উদ্দিন, আরমান এরা ছিলেন সামনে। এটাই সামনে থেকে সবাইকে বার করে নিয়ে গেছে।
আমরা এখান থেকে বেরিয়েছি আর পুড়িয়ে দিয়েছে। নাহলে তো আমরা ঘরের মধ্যেই পূড়ে মরতাম।
আমার ১৯৮০ সালে বিয়ে হয়েছে। ৫৩-৫৪ বছর হয়ে গেল। কখনো এরকম দেখিনি। ২০০১-এ হয়েছিল। কিন্তু এরকম হয়নি। আমরা এরকম দেখিনি।
৪। সালমা বিবি(নাম পরিবর্তিত), দিনেমার ডাঙ্গা
আমরা- কিছু কি বলবেন?
সালমা বিবি- চান করে এসেছিলাম তখন। তেলেনিপাড়ায় দুচারটে বোমা পড়লো। পুলিশ ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশ সবাইকে ডাকছিল, এস ভাই।
ওদের হাতে সবই ছিল। পিস্তল, বোম। আমাদের ঘরে কিছু ছিল না যে চালাবো। আমার ভাইরা ঠেকাতে পারেনি।
আমরা- কোথা থেকে লোক এসেছিল?
সালমা বিবি- সব জায়গা থেকে হিন্দুরা এসেছিল। মালাপাড়া, টিনাবাজার,উর্দিবাজার থেকে এসেছিল। অর্জুন সিং এই কাজ করিয়েছিল।
আমরা- আমরা শুনেছি অর্জুন সিং-এর লোকজন ঢুকেছে।
সালমা বিবি- হ্যাঁ নদী পেরিয়ে এসেছে, রাতের অন্ধকা্রে। শ্রীরামপুর থেকেও এসেছে। ১৫০ লোক নিয়ে এসেছে।
আমরা- আপনার কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে?
সালমা বিবি- হ্যাঁ হয়েছে। এতো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে আমরা কোথায় যাবো, বল?
এরপর তিনি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখাতে নিয়ে যান। আবার বলতে শুরু করেন,
একটু বসার জায়গাও নেই। আমার বাচ্চাদের কোথাও আশ্রয় নেই। আমরা ইস্কুলে ছিলাম, সেখানেও চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। আমরা চলে এলাম।
৫। সালাউদ্দিনের পরিবারের মহিলা, জি টি রোডের উপরে মাংসের দোকানের পাশের গলিতে
বহু বছর থেকে আছি, কখনও এরকম হয়নি।এই প্রথম...ওইদিন আমাদের পাশাপাশি লোক ও সাহায্য করেনি।সাড়ে বারোটা নাগাদ, সবে রান্না সেরে স্নান করবো, তখনই জামাই এসে বললো আগুন লেগে গেছে, পালাও পালাও করে পাঁচিল টপকে বাঁচতে হয়েছে,ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ভয়ে শুকিয়ে গেছে, তারপর থেকে ওরা আর এখানে ফিরে থাকতেই পারছে না,দিদার বাড়ি চলে গেছে।একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা, আর একজন আছে ৬ মাসের দুধের শিশু।
আমরা- ৫-৬ বছরের বাচ্চাটা বোধহয় খুব ভয় পেয়ে আছে?
মহিলা- হ্যাঁ, ওতো দেখেছে, বোধ হয়েছে। এখানে আনলেই বলছে এখানে থাকলে আবার যদি হয়। ঘুমের মধ্যে কেঁদে কেঁদে উঠে বলছে, আমায় নিয়ে চলো এখান থেকে, এখানে থাকবো না আমি। ওর আব্বু বোঝাচ্ছে, মোবাইল দেবো, এটা সেটা দেবো। বাচ্চা বলছে না,না আমি কিছু নেবো না,আমায় নিয়ে চলো,আমি শুধু তোমার কাছে থাকবো। ওর সামনে ইস্কুলের পরীক্ষাও আছে,কিন্তু ওর বই খাতা সব নষ্ট হয়ে হয়ে গেছে।কি করে কি করবে!
আমরা- ও কি পরীক্ষা দেবে?
মহিলা- উচ্চমাধ্যমিক।
আমরা- এটা কোন বাচ্চাটা?
মহিলা- এটা আমাদের আরেকটা বাচ্চা, এই যে বড়োছেলেটা।এডমিট কার্ড, আগের রেজাল্ট সব জ্বলে গেছে,গান্ধী ইস্কুলে পড়ে।ইস্কুলে চাল দিয়েছিলো, সেই চাল অব্দি পুড়ে গেছে।
আমরা- আপনাদের কেউ মারধর করেছে?
মহিলা- না, 4জন এসে ঘরের দরজায় লাথি মারছিলো, দরজা বন্ধ ছিলো, ভেঙে ঢুকতে পারেনি।ওদের মুখে সব ঢাকা দেওয়া ছিলো। পরে দমকল ,পুলিশ সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছিলো, কেউ আসেনি।শেষে সামনের বাড়ির লোক এসে জল ঢেলেছিলো।
আমরা- সামনের বাড়ির লোক?ওরা কি মুসলিম না হিন্দু?
মহিলা- না ওরা হিন্দুও না,মুসলিম ও না,ওরা বাঙালি আছে।আমরা ভাবছিলাম কোথায় যাবো?ওই বাঙালিবাবু সবাইকে নিয়ে গেলো, জল দিয়ে সবাই মিলে আগুন নিভিয়ে ছিলো।
আমরা- আপনারা বলছেন এর আগে কখনও কিছু হয়নি?
মহিলা- সেটাই তো, কখনও হয়নি। ওইদিকে তো হচ্ছিলো, হঠাৎ করে জানতে পারে এখানে দুটো মুসলিম ঘর আছে, দিই পুড়িয়ে। ঠাকুর্দার টাইম থেকে আছি, মিলেজুলে থাকবো, আমাদের বিয়েশাদীতে তোমরা আসবে, তোমাদের বিয়েশাদীতে আমরা যাবো। তোমার দোকানে আমরা যাবো, আমার দোকানে তোমরা আসবে, জিনিসপত্র কিনবে, এমন চলছিলো, এটা কি হলো মাঝখান থেকে...
(আবার একটা বাচ্চাকে কাছে নিয়ে এসে বলেন) এরা এসে থেকে দুপুরে খাবার খাচ্ছেনা, খালি এক কথা জিগ্যেস করছে, মা কি করে পুড়লো, কি হয়েছিলো,...
আমরা- আবার কি হতে পারে, কি মনে হচ্ছে?
মহিলা- একবার হয়ে গেলো, এবার ভয় ধরে গেছে আবার যদি হয়,মানুষতো জানছে না,তোমার মনে কি আছে,আমার মনে কি আছে।
আমরা- আচ্ছা এখানে করোনা ছড়িয়েছে?
মহিলা- এখানে, কই এদিকে তো ধরা পড়েনি একটাও।
৬। ঝুমা জায়সোয়াল
ভিক্টরিয়া জুট মিলের গেট থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে ১নম্বর কল বস্তি এলাকায় সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললেন বছর ৩৫এর ঝুমা জয়সোয়াল।
ঝুমা জায়সোয়াল- আমার স্বামীর নাম বিজয় জয়সোয়াল।উনি এখন ঘরে নেই, ঘর সারানোর টালি আনতে গেছেন।ওইদিন এগারোটা নাগাদ আমরা সেদিকে চলে গেলাম, বোমাবাজি হচ্ছিলো।শুনলাম ঝামেলা আবার হবে,পুলিশ ছিলো, পুলিশ ওদেরকেই পুরোপুরি সাপোর্ট করেছে।অন্ততঃ এখানে যে পুলিশরা ছিলো। সামনে লেডিজরা ছিলো,পিছনে জেন্টসরা দাঁড়িয়ে বোমা ছুঁড়ছিলো।পুলিশ ওদের কিছুই বলছেন,অথচ আমাদের কেউ ঠেকাতে এলে বলছে 'সরে যাও সরে যাও'।
আমরা- এটাকি পার্টি পার্টি নিয়ে লড়াই হলো?
ঝুমা জায়সোয়াল- না এটা পার্টি পার্টি নিয়ে না, এটা করোনা থেকে হলো। ওদের (মুসলিম) হচ্ছে যে, ওরা দেখাবে না, ট্রিটমেন্ট করাবে না,শুধু ছড়াবে।ওরা ট্রিটমেন্ট করতে নারাজ।এই ঘটনা শুধু এবছর না,তিন বছর আগেও হয়েছিল, তখন শুধু আমার ঘরটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো, এবার পুরোটা মানে ধরুন ২৭ থেকে ৩২ খানা মতো ঘর জ্বালিয়েছে।ওদের টার্গেট হচ্ছে বারবার এরকম করবে যাতে ভয় পেয়ে আমরা যে ক ঘর হিন্দু আছি, আমরা উঠে চলে যাই, ওরা খালি করে বাজার পর্যন্ত এলাকা নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেবে।
আমরা- ঘর পুড়ে গেছে তো কোথায় এখন কদিন থাকছেন?অসুবিধার মধ্যে কাটছে তো খুব?
ঝুমা- অসুবিধা তো হচ্ছেই।কি করবো।এতদিন স্কুলে (শাস্ত্রী স্কুলের ত্রাণ শিবির) থাকলাম,এবার স্কুল ও বলছে যে যার নিজেদের ব্যবস্থা দেখো।কতদিন দেখবে?কেউই তো চিরদিন থাকতে দেবেনা।
আমরা- আবার ঝামেলা হওয়ার ভয় আছে কী? এখানে এসে আবার থাকতে পারবেন, কি মনে হচ্ছে?
৭। সালাউদ্দিন আনসারি
ভদ্রেশ্বরে জি টি রোডের ওপর সালাউদ্দিনের বাড়ি এবং দোকান। ১২ মে সংগঠিতভাবে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা তাঁর দোকান লুঠ করে। এখানে তাঁর সঙ্গে আমাদের কথোপকথনের নির্যাস।
সালাউদ্দিন- আমার নাম সালাউদ্দিন আনসারি। কয়েক পুরুষ ধরে এই বাংলায় বাস। কিন্তু হটাৎ সব উলটপালট হয়ে গেলো। ১২ মে ২০২০ দুপুর ১২ টা ৪৫ নাগাদ এখানে দাঙ্গা শুরু হয়। প্রাণ বাঁচাতে এই ঘরে এসে বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওরা লুঠপাট চালাচ্ছে। দোকানে অনেক জিনিস ছিল, সব নিয়ে ওরা পালিয়েছে। যাবার আগে দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই ঘরেও লাথি মারছিল, আমি আর আমার ছেলে মিলে কোনরকমে ধরে রেখেছিলাম। ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল, সেই সিলিন্ডার দেখে ওরা পালিয়েছে। যদি আগুনে সিলিন্ডার ফেটে যায়, সেই ভয়ে।
আমরা- কতজন এসেছিল?
সালাউদ্দিন- লোক তো অনেক ছিল। আমরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঘরে এসে বন্ধ হয়ে ছিলাম।
আমরা- কেউ কি আপনার বা আপনাদের পরিচিত মুখ ছিল। স্থানীয় কেও?
সালাউদ্দিন- না আমরা তো দেখতেই পায়নি। আমরা তো ঘর বন্ধ করে রেখেছিলাম।
আমরা- এই এলাকায় কয়টি মুসলিম ঘর আছে?
সালাউদ্দিন- এই এলাকায় একটিই মুসলিম পরিবার।আমাদের পরিবার। আর একটি মাংসের দোকান। ওদের তেলিনিপাড়ায় বাড়ি।
আমরা- হ্যাঁ ফেরি ঘাট স্ট্রিটে।
সালাউদ্দিন- আর একটা সাইকেলের দোকান আছে। ওই দোকানটাও ভাঙচুর করেছে। কিন্তু আগুন লাগায়নি। বাঙালি একজনের দোকান ছিল। মাংসের দোকানটা ওই তেলিনিপাড়ার। ওটার শাটার ভেঙ্গেছে।
আমাদের এখানে একটা মাজার আছে। সেখানেও ভাঙচুর করেছে। মাজারওয়ালার গাড়ি ছিল একটা, স্প্লেন্ডার, ওটাকে রোডের ওপর ফেলে জ্বালিয়ে দিয়েছে। একটা এম এইট্টি গাড়ি ছিল, ওটাকেও ভাঙচুর করেছে। ওদের বাক্স ভেঙেছে।
আমরা- কোন পীরের মাজার?
সালাউদ্দিন- সত্যপীরের মাজার।
আমরা- সত্যপীরের মাজার। সেখানে নিশ্চয় সকলে আসতো। হিন্দুরাও তো আসতো?
সালাউদ্দিন- সবাই আসতো। সব জাতির মানুষ আসতো। হিন্দু, মুসলমান, মাদ্রাজি, উড়িয়া সবাই।
আমরা- বেছে বেছে এই মাজারকেই আক্রমণ করা হল। কোন আন্দাজ ছিল এই আক্রমণের?
সালাউদ্দিন- না কোন আন্দাজ ছিল না। এতদিন আছি এখানে, বাবা, ঠাকুর্দা থেকে আজ অব্দি, কোনদিন এইরকম হয়নি। এর আগে এত বড় বড় দাঙ্গা হল। ১৯৯২ সালে তো ভয়াবহ। কিন্তু আমাদের এইদিকে কখনও হয়নি। সব নিজের মত হয়ে গেছিলাম।
আমরা- এখন কি আবার পর হয়ে গেলেন?
কিছুক্ষণ চুপ থাকেন সালাউদ্দিন আনসারি। উত্তর দেন না বা দিতে পারেন না।
আমরা- কতদিন আছেন আপনারা এখানে।
সালাউদ্দিন- ওই ব্রিটিশ আমল থেকে। আমাদের চার পুরুষ হল। আমার বাবা চটকলে কাজ করতেন। ভদ্রেশ্বর জুটমিল।
আমরা- এখন কেও চটকলে কাজ করেন?
সালাউদ্দিন- আমার ছোট ভাই, নিজামুদ্দিন কাজ করে। ৩৪০ টাকা দিনমজুরি ছিল, এখন একটু বেড়েছে, ৩৯০ টাকা হয়েছে।
আমরা- আপনাদের পরিবারে সদস্য কয়জন?
সালাউদ্দিন- আমরা চার ভাই। আমাদের চার ভাইয়ের চার স্ত্রী। দাদা ভাই মিলে তিন ছেলে, দুই মেয়ে।
আমরা- লুঠপাটের পর রাজনৈতিক দলের লোকজন কি এসেছিল? প্রশাসনের কেউ কি এসেছিল?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ আমাদের হেল্প করেছে, আমাদের পার্টির তরফ থেকেও হেল্প করেছে।
আমরা- আপনাদের পার্টি মানে?
সালাউদ্দিন- মানে পার্টির তরফ থেকে আমাদের পরিবারকে হেল্প করেছে। আশেপাশের লোকজনও হেল্প করেছে।
আমরা- আশেপাশের মানে কারা?
সালাউদ্দিন- আমাদের পাশের বাড়ি, পাড়ার কিছু লোক।
আমরা- তাঁরা হিন্দু?
সালাউদ্দিন- তাঁরা হিন্দু। মানুষ হিসাবেই সাহায্য করেছেন তাঁরা।
আমরা- আক্রমণের সময় কি কোন শ্লোগান উঠেছিল?
সালাউদ্দিন- না শ্লোগান এখানে ওঠেনি। ওই হৈহল্লা হল। আমি ছেলেকে পড়াচ্ছিলাম ঘরে। হটাৎ দুমদাম, ইট পাথর চলতে লাগলো। আমরা এই ঘর (ঘর দেখিয়ে) থেকে বেরিয়ে এইদিকে আসলাম। আগুন আগুন লেগে গেলো সব। আমার দোকান পুড়িয়ে দিল।
আমরা- যারা এসব করছিল তাদের হাতে অস্ত্র ছিল কি?
সালাউদ্দিন- (সন্ত্রস্ত) আমরা দেখিনি। যখন ওইসব দুমদাম আওয়াজ হচ্ছিল আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এই ঘরে বন্ধ হয়ে গেলাম। আমরা লোক দেখিনি।
আমরা- সাইকেলের দোকানটা কার?
সালাউদ্দিন- আমার।
আমরা- কি কি জিনিষ পুড়েছে?
সালাউদ্দিন- ওই তো, সাইকেলের পুরো রিপায়ারিং পার্টস ছিল, সব পার্টস লুঠ হয়েছে। লুঠ করে ওরা সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। যতটা পেরেছে লুঠ করেছে, তারপর জ্বালিয়েছে। রবারের মালগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে।
আমরা- আপনাদের ভিতর পর্যন্ত আক্রমণ করতে আসেনি?
সালাউদ্দিন- ভিতর পর্যন্ত এসেছিল। ভিতরের ঘর, লকার ভেঙে সব গয়না, ঘড়ি, মোবাইল লুঠ করেছে। ভেবেছিলাম বুঝি পুড়ে গেছে। মোবাইলে আমি দাঙ্গার পর ফোন করেছি দুদিন, রিং হয়ে গেছে। এখন কিন্তু সুইচ অফ বলছে। থানায় অভিযোগ জানাতে যাচ্ছি, থানা কোন অভিযোগ নিচ্ছে না।
আমাদের যত ডকুমেন্ট ছিল সব পুড়ে গেছে, থানা বলছে সেসব মিশিং বলে লিখতে হবে। সেটাও যখন দিচ্ছি, তখন বলছে নাম্বার দিয়ে লিখতে হবে। আমরা কি করে নাম্বার পাবো বলুন? আমার ছেলের বারো ক্লাসের পরীক্ষা আছে সামনের মাসে, এখন সে যে পরীক্ষা দেবে তার কোন কিছু ডকুমেন্ট নেই।
আমরা- কিন্তু পুড়িয়েছে, লুঠ হয়েছে এটা তো চোখে দেখা যাচ্ছে, তবুও এফ আই আর নিচ্ছে না?
সালাউদ্দিন- কোন এফ আই আর নিচ্ছে না, বলছে নাম দিয়ে অভিযোগ জানাতে। আমরা দেখিনি কাউকে কি করে নাম নেবো?
আমরা- লিখিত দরখাস্ত করেছেন আপনারা?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ অনেকবার থানায় গেছি আমরা। কমপক্ষে দশ বার তো হবেই। একবারও দরখাস্ত নেয়নি। ডকুমেন্ট পুড়ে গেছে বললাম, বললো পুড়ে গেছে বলা যাবে না, বলতে হবে হারিয়ে গেছে। ছেলের পরীক্ষা বলে তাতেই রাজি হলাম, তো বলছে নাম্বার দিতে হবে। অ্যাডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন নাম্বার আমাদের কি মনে আছে? ইস্কুলে গেলাম, মাস্টার বললেন, ইস্কুল এখন বন্ধ, যখন খুলবে তখন আসবে।
আমরা- নেতারা তো এসেছিল বললেন, পুলিশ থেকে কেউ তদন্ত করতে এসেছিল। বা বিডিও, এসডিও কেউ চোখে দেখতে আপনাদের অবস্থা?
সালাউদ্দিন- না কেউ আসেনি।
আমরা- ক্ষতিপূরণ কিছু পেয়েছেন?
সালাউদ্দিন- পৌরসভা থেকে আট হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতা বলে দিয়েছে। আর কিছু দেয়নি।
আমার- টাকা দিয়েছে মানেই তো আপনাদের ক্ষতি হয়েছে তা স্বীকার করছে, অথচ আপনাদের কমপ্লেন নেয়নি?
সালাউদ্দিন- না কমপ্লেন নিচ্ছে না। সি এন চ্যানেল আমার কথা লিখেছে, টিভিতেও দেখিয়েছে, কিন্তু প্রশাসন কিছু মানছে না। খবরও হয়েছে এই দাঙ্গা এবং আমাদের অবস্থা।
আমরা- সাইকেলের দোকানটা কার নামে, আপনার নামে?
সালাউদ্দিন- হ্যাঁ আমার নামেই। লাইসেন্স আছে। তার পাশে আর একটা সাইকেলের দোকান আছে, তেলেনিপাড়ায় থাকে, দোকানটার নাম স্টার সাইকেল, মুসলমানের দোকান। পাশে যে মাংসের দোকান ওরও তেলেনিপাড়ায় বাড়ি, এখানে দোকানদারি করে।
আমরা- কিছুক্ষণ আগে এই যে বললেন বাঙালির দোকানে হাত দিতে গিয়েও দেয়নি?
সালাউদ্দিন- না ভাঙচুর করেছে, সাইকেলগুলো বের করে সব পুড়িয়েছে।
আমরা- ওরা যে হিন্দুদের বা বাঙালিদের দোকান আক্রমণ করেনি আশেপাশেই তো বহু আছে, তার মানে ওরা জানতো কোনটা কার দোকান। কেউ চিনিয়ে দিয়ে থাকবে।
সালাউদ্দিন- কি করে আমরা বলতে পারি? আমরা যদি দেখতে পেতাম তাহলে বলতে পারতাম কে দেখিয়ে দিল?
আমরা- শুধু কি থানায় দরখাস্ত নিয়ে গেছিলেন?
সালাউদ্দিন- গেছিলাম। কাগজ সব কাউন্সিলর লিখে দিলেন। ওপর থেকে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ফোন করেছেন। বলছে কি যাও, চেয়ারম্যানকে ভোট দাও আর চেয়ারম্যান থেকে নাম্বার (হারিয়ে যাওয়া ডকুমেন্টগুলোর) টুকে নিয়ে আসবে।
এইসব জানিয়ে চেয়ারম্যানকে বলছি, জানতে চেয়েছি, বলুন কি করবো? উনি বলেন, নতুন সব অফিসার এসেছে, কি করবো?
আমরা- আপনার হিসাব অনুযায়ী কত টাকার ক্ষতি হয়েছে?
সালাউদ্দিন- দোকানে ছিল আশি হাজার, আমার বউয়ের কাছে ছিল বাইশ হাজার, মোট এক লাখ দুই হাজার। আর মাল ছিল প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার। ঘরের জিনিসপত্র লকার ভেঙে নিয়ে গেছে, ঘড়ি, কানের দুল।
আমরা- থানায় লিখিত অভিযোগ নিয়ে গেছিলেন যাতে এফ আই আর হিসাবে নেওয়া হয় তা তো নেয়নি জানালেন। আর কোথাও গেছিলেন? যেমন এসডিও বা বিডিও অফিস বা জেলাশাসকের কাছে? বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ?
সালাউদ্দিন- না, এখানে যখন জমা হচ্ছে না তখন আর যাব কোথায়?
৮। গুলাম সরওয়ার, পাকিজা এফ জি স্ট্রীট
আমরা- কি হয়েছিল সেদিন?
গুলাম- ঝামেলা হয়েছিল রাত্রের বেলায়, মেন ব্যাপার হচ্ছে, এখানে একটা লোককে বলেছিল করোনা হয়েছে, করোনা নিয়ে ঝামেলা। লোকটার আগে থাকতেই শরীর খারাপ ছিল লকডাউনের মধ্যে। এখানে একটা হেলথ সেন্টার আছে আমাদের সেগুন বাগানে, ওই হেলথ সেন্টারে এসে গলা চেক আপ করেছে, হয়ত শরীর কিছু ডিস্টার্ব ছিল। ২-৪ দিন বাদে রিপোর্ট এলো কি নাম আছে ‘আসিফ’, ৫৬ বছর বয়স...সব কিছু হোল তো...তারপর লোকটাকে আমাদের ফাঁড়ি থেকে জেনারেল সাহাব এলেন, হয়তো ওনার কাছে ম্যাসেজ এসেছে, কাগজ বা কিছু এসেছে, কি এনাকে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হবে করোনার জন্য...কোয়ারেন্টাইনের জন্য, যতদিন থাকবে ততদিন রাখতে হবে, তাই নিয়ে গেলো লোক।
এইটা নিয়ে কানে কানে রটে গেলো কি আমাদের সেগুন বাগানে করোনা হয়েছে, কিন্তু...৩- ৪ দিন পর...তারপর এখানে একটা আমাদের তেলিনিপাড়া ফাঁড়ির সবথেকে ভালো কাজ করেছিল, বাজারে বেশি ভিড়ভাড় হচ্ছিল। জাস্ট এইটা একটা ময়দান আছে (ওনার বাঁদিকে) এখানে সবজির হাট বসালো, আর আমাদের নেহেরু স্কুল আই জায়গা বলে নাম আছে, সেটা...পরে...এম এল লেন জায়গার নাম হচ্ছে মুকারমাই লেন আমরা এম এল লেন শর্টকাটে বলি। ওই জায়গাটা...ওই জায়গাটা অর্ধেক ভাগ করে দিল, ওইখানে সবজি লাগাবে......এই খানে সবজি লাগাবে। লাগানোর পর লোকগুলো একটু অ্যাডজাস্ট হবে যেন একটু গায়ে গায়ে না থাকে। তারপর সবজির লোক এসেছে বেচার জন্য...গরিব লোক সকাল বেলায়, একটা লোক এখানে কল আছে...ওই পাড়াটা হচ্ছে হিন্দু পাড়া আমাদের পাঁচিল টপকে (ওনার ডানদিকে), হিন্দু পাড়া আর এইদিক সব মুসলিম পাড়া। তো এই গেছিল জল আনতে...তো বললো তোমাকে জল দেবো না আমরা, তোমাদের করোনা হচ্ছে...তো জাস্ট এই কথা নিয়ে ঝামেলা হল, সবজি-টোবজি ওরা এসে ফেলে দিলো। তো...আমাদের তেলিনিপাড়া জুটমিলের আগে মাদ্রাজি লাইন আছে, ওইখানে চেল্লামিল্লি হয়ে গেলো, কি না মুসলিমদের করোনা হয়েছে, আমরা কিছু নেবো না, আমরা কিছু দেবো না, এই সব নিয়ে ঝামেলা হবার পর...এইখানে রাত্রের বেলা হিন্দুরা ঝামেলা বাড়িয়ে দিলো...মুসলিম ভি বহুত আয়ে হয়ে থে, ওরা কিন্তু...ওরা অনেক কিছু চার্জ করছে...সেটা...বললে কি হবে সবাই জানে...আর এইটা করার পর, ওইখান থেকে লোক এইদিক থেকে এলো...চারদিক থেকে অ্যাটাক করছে, বলছে মুসলিমদের করোনা হয়েছে, চারদিক থেকে অ্যাটাক। কি মুসলিমরা আমাদের মারছে...কিন্তু সেটা কিছু হয়নি।
আমরা- কিন্তু মুসলিমরাও তো এককাট্টা হয়েছিল। আপনি জানালেন।
গুলাম- আমরা এক জায়গায় রয়েছিলাম...চারদিক থেকে লোক ঘিরে আসছে। আমাদের ওপর চার্জ করছে তারপর দিন...সরি সেইদিন এই লোকগুলো...বাইরে থেকে ৩০০-৪০০ লোক এসেছিল। খবর এসেছে কানে কানে ৩০০-৪০০ লোক ওপার থেকে এসেছে, সেই লোক হচ্ছে অর্জুন সিং-এর লোক। অনেক লোক বলল কি অর্জুন সিং-এর লোক। ওখান থেকে এসে মারামারি করলো, গুলি চালালো, বম্ব চালালো, আমার ঘরটা নষ্ট করলো...খুব কম করে ৪-৫ লাখ টাকা নষ্ট করলো। ঘরের ভিতর এসে আমার দুটি বৌদির বিয়ের সামান-এইসব ছিল সব নষ্ট করেছে। আমার দুটো নিজের গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে...আমার বোনের পেটে বাচ্চা ছিল, ডেলিভারি কেস...তো ওকে বাঁচানোর জন্য আমাদের ইট লেগেছে। এই তো দাগ আছে মুখে (তাঁর মুখ দেখালেন)। সেটিং এখনও করায়নি, যাচ্ছিনা...ভয় লাগছে বাইরে যেতে যদি কিছু হয়ে যায়...তো দুদিন পর চন্দননগর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম বোনকে, সিজার হল, বাচ্চা হল, পেটে ব্যাথা ধরল...
ওই তারপর একদিন ঠিক ছিল, শান্তি ছিল। তারপর আবার মঙ্গলবার ঝামেলা শুরু হল। ১১ টা থেকে শুরু চললো প্রায় চার-পাঁচ ঘণ্টা। ঘরে কম সে কম ৩০-৪০ জন লোক এসেছে, ঘরের ওপর বোম চার্জ করেছে...গুলি চালিয়েছে...পাথর ছুড়েছে।
আমাদের এখানে শারমিন ডাক্তারের ওখানে হেলথ সেন্টার আছে...রাত্রে ওখানে এসে পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, আমরা অনেক বললাম, ‘স্যার ওখানে দেখুন, ওরা ঘর পোড়াচ্ছে’, আমরা গেলাম কথা বলতে...আমাদেরকে বন্দুক দেখিয়ে বললো, ‘তোরা যা ওইদিকে’।
আমরা চলে এলাম...এইখানে। ৩০-৪০ জন মিলে আগুন লাগিয়েছে, হাতে বন্দুক-ফন্দুক নিয়ে, গাঁজা খাচ্ছিল, বসে ছিল, নটার সময় এই ঘরটাতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে গেলো ওপারে। তারপর থেকে ওপরে খবর গেলো কিনা জানিনা, পুলিশ অ্যাটাক করলো, ওরা সব পালিয়ে গেলো।কিছু লোক ধরা পড়লো, আর কিছু লোক পালিয়েছে। বেশি লোক বাইরে থেকে এসেছিল। এই জায়গার নাম হচ্ছে তাঁতিপাড়া, আর ওইদিকে গোন্দলপাড়া। আছে তালেনিপাড়া মাদ্রাজি লাইন, ভদ্রেশ্বর। চারিদিক থেকে লোক এসেছিল, বাইরে থেকে লোক এসেছিল, কম করে ৩০০-৪০০ জন লোক এসেছিল বাইরে থেকে মারার জন্য।
আমরা- এখন আপনারা কোন কোন জায়গা অ্যাভয়েড করছেন মানে যাচ্ছেন না।
গুলাম- মার্কেটে যাওয়া আসা করছি, কিন্তু জানে ভয় আছে।
আমরা- কোনদিকে বেশি ভয় আছে?
গুলাম- চারিদিকেই ভয় আছে। আমরা আস্তে আস্তে যাচ্ছি, যাওয়া হচ্ছে বাইরের জিনিষ আনার জন্য। বাইকে করে যাচ্ছি, মানে বেশি হাঁটাহাঁটি করছি না আমরা এখন।
আমরা- আপনারা কি গোয়ালাপাড়ার দিকে যাচ্ছেন?
গুলাম- গোয়ালাপাড়া আমরা যাচ্ছি না। ওইদিক থেকে অ্যাটাক হয়েছে, আমার বোন যার বাচ্চা হয়েছে, ওর শ্বশুর আর ছোট এক দেওর ছিল। ফ্ল্যাট থেকে টেনে এনে পুলিশ খুব মেরেছে, টেনে নিয়ে চলে গেছে। ওরা বলেছে কি আমরা রাইফেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করি, আমার বোনের শ্বশুর বললো, পুলিশ শুনল না, ওদেরকে টেনে নিয়ে চলে গেছে, কোন কথা শুনল না। অনেক লোক ধরা পড়েছে, ফ্লাটে অনেক ক্ষতি হয়েছে, ওইদিক থেকে লোক এসেছে, হাত নৌকা করে, যেটা করে মাছ ধরা হয়। কালো নৌকা। অনেক লোক এসেছিল, কয়েকজন ধরা পড়েছে, বোমা পেয়েছে।
আমরা- ওদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ?
গুলাম- ওরা নাকি দাঙ্গায় জড়িত। সব মিথ্যা অভিযোগ।
আমরা- কি মনে হচ্ছে আপনাদের, এখন কি শান্তি কায়েম হবে না আবার কিছু হবে?
গুলাম- এখন তো দেখছি ৪-৫ দিন ধরে শান্তিই আছে, বলা মুশকিল, কখন কি হয়, কেউ কিছু জানেনা...যখন বোম ফাটছে নিশ্চয় ওরা কিছু না কিছু রেডি করছে, এটাও হতে পারে, বলা মুশকিল এখন, কখন কি হবে।
আমরা- ক্ষতিপূরণ কিছু কি পেয়েছেন?
গুলাম- ও...আমার একজন লোক আছে ওখানে, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটির ওখানে দরখাস্ত লেখা হয়েছে, থানাতে দেওয়া হয়েছে, হয়ত আমার বোনাই গিয়েছিল, কিছু পেয়েছে, আসলে এটা হচ্ছে আমার বোনাইয়ের ঘর, আমার নিজের ঘর হচ্ছে ওইদিকে, সেগুন বাগান মসজিদের কাছে আমার নিজের ঘর তৈরি হচ্ছে, লকডাউনে কাজটা বন্ধ হয়েছে, তাই এখানে থাকলাম, দুটো বৌদিও ছিলেন, ফুল ফ্যামেলি এখানে থাকলাম। ঘরের মধ্যে কিছু বাঁচেনি। লোকে জামা কাপড় দিচ্ছে, আমরা পরছি। এইতো কাল থেকেই এই গেঞ্জি পরে আছি, লুঙ্গি পরে আছি। নিজের কাছে টাকাও নেই যে কিছু কিনতে পারব, এমন অবস্থা। বোনের এক থেকে ডের লাখ টাকা নগদে ছিল, বৌদিদের সোনার চেন ছিল- সব নিয়ে পালিয়েছে। তারপর আগুন লাগিয়েছে। কিছু বাঁচেই নি। আপনি এই ঘরের ছবি তুলুন, ভিডিও তুলুন, এই ঘরের কিছু নেই।
আহত জনের বিবরণ-
এই দাঙ্গায় আহত ক’জন, এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমরা প্রশাসনের কাছ থেকে পায়নি। স্থানীয় মানুষ যা বলেছেন তার সাপেক্ষে কাউকে হাজির করাতে বা তাঁদের পরিবারের কারুর সাথে কথা বলাতে পারেননি। স্বভাবতই এর সংখ্যা এবং আক্রমণ কারা প্রথম শুরু করেছিল এই তর্কে হারিয়ে গেছে প্রকৃত তথ্য। আমাদের তথ্যানুসন্ধানে আমরা দুইজন আহত ব্যক্তির কথা জানতে পারি।
১০ মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৭ টায় ভদ্রেশ্বর এস এন জুটমিলের ৯ নম্বর এবং ১০ নম্বর লাইনের মধ্যে শ্লোগান দিতে দিতে আসে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দাঙ্গাবাজরা। পাল্টা শ্লোগান এবং আতঙ্কের আওয়াজ মুসলিমদের মধ্যে থেকেও শোনা যায়। এই ঘটনার কিছু ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকে (আমরা, এক সচেতন প্রয়াস ফোরাম এর সত্যতা পরীক্ষা করেনি)। এই সন্ধায় মুসলিম শ্রমিক কলোনি আক্রমণের ঘটনা আমরা হাজি মুহম্মদ মহসিন গার্লস স্কুলের ত্রাণ শিবিরে থাকা মুসলিম মহিলাদের কাছে শুনেছি। শুনেছি সিভিক পুলিসের কাছেও।
মুহম্মদ আজাদ এবং মঞ্জুর আলম এই আক্রমণে মারাত্মক জখম হন। রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁদের ভদ্রেশ্বর অঙ্কুর হাসপাতালে (এই ভদ্রেশ্বর পুরসভা পরিচালিত হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। মুহম্মদ আজাদের মাথা ফেটে গেছিল, আঙুল কেটে গেছিল। মঞ্জুর আলমের হাত ভেঙে গেছিল। জুনের ১০ তারিখে আমরা যখন ওনাদের কোয়ার্টারে যায় তখন ওনাদের নিজ পরিবারের কেউ ছিলেন না। আহত দুইজন তখনও হাসপাতালে। প্রতিবেশিরা যা জানান তা নিম্নরূপ-
আমরা ভাবিনি কখনও এইরকম হবে। আতঙ্কে বাচ্চারা অনেক রাত ঘুমতে পারেনি। মঞ্জুরের দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে। আজাদেরও দুই সন্তান। এত রক্ত দেখে ওদের অবস্থা কি হবে বুঝুন। ওরা এখন কেউ এখানে থাকছে না।
প্রচুর খরচ হয়ে গেছে ওদের। কয়েক লক্ষ হবেই। তৃণমূল কংগ্রেস কিছুই দেয়নি। পুরসভা থেকে মাত্র চার হাজার। এদের হালাত খুব খারাপ। ঠিকা শ্রমিক এরা, কোন কাজ করতেও পারবে না।
(খ)
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-১
শাস্ত্রী হিন্দি হাই স্কুল, গোন্দলপাড়া
তেলেনিপাড়া ও গোন্দলপাড়া পাশাপাশি দুটি জনপদ। গোন্দলপাড়াতে এই হিন্দি মিডিয়াম স্কুলটি। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুরা এখানে আশ্রয় নেয়। সবমিলিয়ে ২৫ টি পরিবার তখন ছিলেন। ৩ জুন, ২০২৯০ তারিখে আমরা যখন পৌঁছয় তখন সকাল ১১ টা। ক্যাম্পে তখন কয়েকজন মহিলা। বাকিরা বাড়িতে। পুরুষরাও বাড়িতে, যেহেতু পৌরসভার অর্থে মেরামতির কাজ চলছে। মেরামতির জায়গায় এবং শাস্ত্রী স্কুলে আমাদের দেখা হয় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি ওয়ার্ড কমিশনার পান্নালাল সাহুর সঙ্গে। পৌরসভার অর্থেই এই মেরামতির কাজ চলছে, তিনি জানান। রাজ্য সরকারের প্রদেয় ত্রাণ এই শিবিরে দেওয়া হচ্ছে, তিনি জানান। তবে সরকার এই শিবির বেশি দিন চালাবে না তাও জানান। কেন তা মনে হচ্ছে, জানতে চাইলে উনি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসেন। উনি এর বেশি কিছু বলতে চাননি।
মুসলিম পাড়া, কালি মন্দির ইত্যাদি স্থান থেকে দাঙ্গাপীরিতরা এখানে আসেন। মুসলিম পাড়ার বাসিন্দা বছর ষাটের সাবিত্রী দেবী বলেন,
সাবিত্রী- এই স্কুলে এসে প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি। না হলে মুসলমানরা আমাদের যে কি করতো?
আমরা- হটাত এই রকম হোল না আগে থাকতে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন?
সাবিত্রী- না, বেটা। আগে কখনও এইরকম হয়নি।
আমরা- কেন হোল?
সাবিত্রী- ওরা আমাদের তাড়াতে চাইছে।
আমরা- কেন?
সাবিত্রী- আমাদের অনেকে ভাড়া ঘরে থাকে, তাড়াতে পারলে মুসলিম ভাড়াটে রাখতে পারবে। বা...।
আমরা- বা?
সাবিত্রী- বড় মকান বানাতে পারবে।
উল্লেখ্য, ‘আমরা’ তথ্যানুসন্ধান দলের মহিলা সদস্যা এখানের (এবং পরবর্তী দিনে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলের)মহিলাদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন। মহিলারা অন্তর্বাস, স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পরিধানের সমস্যার কথা জানান। ১১ জুন দুটি স্কুলেই মহিলাদের হাতে উক্ত দ্রব্যগুলি দেওয়া হয়। সঙ্গে আশ্রয় শিবিরে থাকা শিশুদের জন্য খেলনা।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-২
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুল, তেলেনিপাড়া, ভদ্রেশ্বর
ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পরিবারগুলো আশ্রয় নেয়। গত ৩ জুন, ২০২৯০ তারিখে আমরা প্রথমবার তাঁদের সঙ্গে মিলত হোই। ইস্কুলের এক ক্লাস রুমে আমাদের কথাবার্তা হয় দাঙ্গাদুর্গতদের সঙ্গে। সকলের নাম আমরা জানতে চাইনি, যারা নিজে থেকে নাম বলেছিলেন এবং প্রকাশিতব্য রিপোর্টে তাঁদের নাম রাখতে আপত্তি নেই জানিয়েছিলেন তাঁদের নাম এখানে রাখা হল। অন্যরা ‘জনৈক ব্যক্তি’ হিসাবে এই আলোচনায় থাকছেন। এখানে সেই কথোপকথনের নির্যাস।
সেলিম খান- আমি গোন্দালপাড়া জুট মিলে কাজ করি। মিল বন্ধ আছে ২ বছর ধরে।এইখানে গোন্দালপাড়া গড়ের ধারের ৬১ টা পরিবার আছে, আর নেহেরু স্কুল এলাকার ১২ টা ফ্যামিলি আছে, এফ জি স্ট্রিট-এর ফ্যামিলি আছে, আগওয়াতলা’র ফ্যামিলি আছে, টোটাল লোক এখানে আছে ৩৫০ জন। সব থেকে বেশি লোক গোন্দালপাড়া গড়ের ধার এর লোক, ২৫০ জনের বেশি লোক আছে ওখানের। সব ঘর পুড়ে গেছে, সেই জন্য সরকার আমাদের এই ক্যাম্প এ জায়গা দিয়েছে, এই ক্যাম্প এ আছি, সরকার এর কাছে আমাদের একটা নিবেদন আছে যে আমাদের ঘর তৈরি করে দেওয়া হোক। প্রাণ ছাড়া সব কিছু, সব জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেছে।
আমরা- ক্যাম্প এ কবে এসেছেন আপনারা?
সেলিম খান- যেই দিন ঘটনা টা ঘটেছে, তার ২ দিন পরে এসেছি আমরা।
আমরা- ঘটনা টা ঘটেছে কবে?
সেলিম খান- ১২ জুন, ২০২০।
আমরা- সময়টা যদি বলেন।
সেলিম খান- ওই ধরুন দুপুর ১২ টা ৩০।
আমরা- একটু যদি ১২ তারিখের দুপুর ১২ টা ৩০-এর ঘটনাটা একটু আমাদের বলেন।
সেলিম খান- হটাৎ সব আগে তো ১০ জুনে কিছু অল্প রাত্রির বেলায় ৮ টার সময়, ইট, পাথর চালিয়ে ছিল মোড়ের মাথায়, তখন আমরা সব ঘরেই ছিলাম, রোজা চলছিল আমরা বাড়িতে সবাই নামাজ পড়ছিলাম, হটাৎ দেখছি বোমা ফাটছে, ইট পাথর ছুড়ছে, অবাক হয়েগেলুম, লোক সব পালাচ্ছে। তারপর সেদিনের ঘটনার পর শান্তি হয়ে গেল, ১১ তারিখও শান্তি ছিল। সেই সব লোক এইদিক ঐদিক চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে ফিরে বাস করছিল। তারপর ১২ তারিখ ১২ টার হঠাৎ চারদিক থেকে ঘিরে বোমা পরতে লাগলো; ইট, পাথর আমাদের বাড়ির ওপর পরতে লাগলো, আমাদের তো হাতে...কিছুই ছিল...না, আমরা তো কোনোদিনও ঝুট ঝামেলা করিনি আজ পর্যন্ত, রেকর্ড আছে আমাদের। এখানে আপনারা জিজ্ঞেস করে নেবেন, গড়ের ধার-এ (যেখানে উনি থাকেন) আজ পর্যন্ত কোনো ঝুট ঝামেলার লোক নেই। হটাৎ চারদিক থেকে বোমা ছোড়াছুড়ি। ওই কোম্পানির গ্রাউন্ডে হাজারে হাজারে লোক, বোম নিয়ে, পিস্তল সব নিয়ে আমাদের ঘরের ওপর, যখন বোমা মেরেছে, আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে সব এইদিকে চলে আসি। বাড়িঘর সব ফাঁকা হয়ে যেতেই, সব পেট্রোল ছিটিয়ে ঘর পুড়িয়ে দিলো, কিছু বাঁচেনি আমাদের।
আমরা- এই ঘটনা কতক্ষণ ধরে হয়েছিল?
সেলিম খান- টানা ৮ ঘণ্টা ধরে এই লুঠ, আগুন লাগানো চলেছিল সারা তেলেনিপাড়া জুড়ে। প্রশাসন পুলিশ কেউ আসেনি।
আমরা- সাহায্য চেয়ে আপনারা নিশ্চই ফোনে করেছিলেন প্রশাসনকে?
সমস্বরে- অনেক ফোনে করা হয়েছিল, সব জায়গা থেকে ফোন করা হয়েছে যে ঘটনা তা ঘটছে আসুন, তাও আসেনি।
আমরা- আসেনি কেন? কি বলছিল পুলিশ?
সেলিম খান- শুধু বলছিল আসছি, আসছি! প্রায় ৪ ঘন্টার পর পুলিশ এসেছিল, তারপর মোটা মোটি একটু কন্ট্রোল হলো।
আলি- ব্যারাকপুরের এমপি অর্জুন সিংহকে দেখা গেছে আমাদের হুগলি জেলায়, উনি লকেট চ্যাটার্জির সঙ্গে মিলে যত বাইরের লোক ঢুকিয়েছেন। অর্জুন সিংহ ছাড়া কেউ করতে পারবে না, একটা দুটো লোক ছাড়া বেশি ভাগ বাইরের লোক, একদম নতুন চেহারা, আমরা চিনি না তাদের...। আর এই বিকেল ৪ থেকে ৪:৩০ ঘন্টার মধ্যে আমরা অনেকবার পুলিশকে ইনফর্ম করেছি, পুলিশ বলতে পারবে না যে আমরা করিনি, পুলিশ আস্তে পারেনি, এটাও...হতে পারে পুলিশ কন্ট্রোল করতে পারেনি, তারপর যখন ফোর্স এলো ৪ টে নাগাদ তখুন একটু ঝামেলা শান্ত হলো।
আমরা- আপনি কি এখন এই হাইস্কুলেই থাকছেন? মনে, আপনি ও আপনার পরিবার?
আলি- হাঁ এখানেই থাকি, আমারও বাড়ি গড়ের ধারেই।
জনৈক ব্যক্তি- সব একই পাড়া থেকে এসেছি, সব ঘর জ্বলে গেছে তো ! কোথায় থাকবো আমরা? তাই ডি এম সাহেব এবং কিছু সংস্থা মিলে এইখানে রিলিফ ক্যাম্পের মত অর্গানাইজ করে রেখেছে।
আমরা- খরচ সরকার বহন করছে?
আলি- হ্যাঁ।
আমরা- সরকার মানে স্থানীয় সরকার, ভদ্রেশ্বর মিউনিসিপ্যালিটি, তাই তো?
সেলিম খান- হ্যাঁ, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে। আমাদের দুই বেলার খাবার দাবার মিউনিসিপ্যালিটির মারফতেই চলছে, ডি এম সাহেবের অর্ডারে এই কাজ হচ্ছে।
আমরা- আচ্ছা, সেলিম ভাই এই যে আপনারা এত গুলো পরিবার এখানে এসেছেন, তেলেনিপাড়ার কোন কোন এলাকা থেকে আপনারা এসেছেন? কতজন এসেছেন, পরিবার হিসাবে কটা পরিবার বা মোট কতজন মানুষ? সরকার থেকে যখন রিলফ দেওয়া হচ্ছে তখন তালিকা তো থাকবে? নির্দিষ্ট সংখ্যা থাকবে। প্রথমে আপনারা বলেছেন, কিন্তু নির্দিষ্ট তালিকা কিভাবে পাবো?
সেলিম খান- হ্যাঁ অবশ্যই আছে। আপনাকে তালিকা এই স্কুল কর্তৃপক্ষও দিয়ে দেবে।
আমরা- আমরা জানি যে তেলেনিপাড়া হোক বা পাশের চাঁপদানি বহুবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, হিংসা দেখেছে। আপনাদের সকলের কাছেই জানতে চাইছি এবারের আর আগেরবারের মধ্যে পার্থক্য কি বা ফারাক কোথায় ?
সেলিম খান- অনেক ফারাক। আমরা কোনো দিন ভাবিনি যে এরম হটাৎ ঘটনা ঘটবে, আমরা তো সব নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, নামাজ পরছি বা অন্যকিছু করছি। লকডাউন এ সব লোক ঘরের ভিতরে আছে। হটাৎ ! কি করে হয়ে গেল, কেউ ভাবতে পারিনি। ওরা আমাদের যত ঘর ছিল জ্বালিয়ে দিলো। এতটা কোনোদিন হয়নি এখানে।
জনৈক ব্যক্তি- আমাদের ছেলে আর মেয়েদের সব ডকুমেন্টস পুড়ে গেছে। যত বছর আমরা পড়াশোনা করেছি সব , আমি ১৯৯০ সালে মাধ্যমিক পাস করেছি, ১৯৯৩ সালে উচ্চমাধ্যমিক। আমার সব ডকুমেন্টস বাড়ি সমেত পুড়ে গেছে, একটা জিনিসও বাঁচে নি।
আমরা- আপনারা এই ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে কি প্রশাসনকে জানিয়েছেন ? ওনারা কি কোনো কাজ আরম্ভ করেছে?
সেলিম খান- কাজ আরম্ভ হয়েছিল মোটা মোটি ১০-১২ দিন কাজ হলো, এখন কাজ বন্ধ আছে। করপোরেশনে মনে হয় কিছু হয়েছে কি না জানি না, আমরা ঠিক বুঝতে পারছিনা।
আমরা- আপনারা যে থাকেন আপনাদের কি নিজেদের বাড়ি ? নাকি কেউ কেউ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।
সেলিম খান- সব নিজেদের বাড়ি, কিছু ভাড়াটিয়া আছে , কিন্তু আমাদের নিজেদের বাড়ি, আমরা বাড়ি ওয়ালা।
আমরা- আর আপনারা যারা জুট মিলে কাজ করেন তারা তো অনেকই লাইনে (শ্রমিক কলোনি) থাকেন ।
সেলিম খান- না না আমাদের ম্যাক্সিমাম মানুষ এইখানেই থাকে। আমরা কিছু গোন্দালপাড়া জুট মিলে কাজ করি আর কিছু লোক তেলিনিপাড়া জুট মিলে কাজ করে। বেশিরভাগ মানুষের গড়ের ধারেই বাড়ি। ( সেলিম খান )
আলি- কিছু বাইরেও কাজ করে ।
জনৈক ব্যক্তি- যাদের এখানে বাড়ি নেই তারা কোয়ার্টারে থাকে, আর যাদের বাড়ি আছে তারা এখানে মিলে কাজ করে যদিও নিজের বাড়িতে থাকে।
আমরা- আপনাদের কি আশঙ্কা, যে আবার হতে পারে ? নাকি এই অশান্তি সাময়িক?
জনৈক ব্যক্তি- আমরা খুবই আতঙ্কিত, মানে কখন কি হবে আমরা খুবই আতঙ্কিত।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের শিবির-৩
হাজি মোহম্মদ মহসিন উর্দু প্রাইমারি স্কুল (বালিকা), পাইকপাড়া, ভদ্রেশ্বর
এখানে দুটি প্রাইমারি স্কুল আছে, সমাজ সংস্কারক হাজি মোহম্মদ মহসিনের নামে, একটি বালকদের জন্য, অন্যটি বালিকাদের জন্য। উর্দু মিডিয়াম। বালিকাদের স্কুলে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম মহিলারা ও শিশুরা আশ্রয় নিয়েছে, বালকদের স্কুলে পুরুষরা। গত ১০ এবং ১৭ জুন আমরা যখন সেখানে যায় তখন পুরুষরা অনেকেই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। আমরা কথা বলি বালিকা বিদ্যালয়ে, মহিলাদের সঙ্গে। তখন স্কুলে নির্মাণের কাজ হচ্ছিল। চারিদিকে বালি, সিমেন্ট। বাচ্চা ও মহিলারা তার মধ্যেই ছিল। অপরিস্কার।
হালিমা বিবি (নাম পরিবর্তিত) বছর ৩৫-এর, সঙ্গে কয়েকটি বাচ্চা, ইস্কুলের দোতলার ঘরে তখন রান্না হচ্ছিল। জানালেন তাঁর অভিজ্ঞতা।
হালিমা- হটাৎ ওরা (হিন্দুরা) আমাদের পাড়া আক্রমণ করলো।
আমরা- কবে?
হালিমা- (পাশে দাঁড়ানো স্বামিকে তারিখ জিজ্ঞেস করে) ১২ মে, সন্ধ্যের সময়।
আমরা- তারপর কি হোল?
হালিমা- হাতে তলোয়ার নিয়ে একদল এলো। আমাদের লাইনে।
আমরা- সেটা কোথায়?
হালিমা- ৯ নম্বর লাইন। ওরা ১০ নম্বর লাইনেও আক্রমণ চালায়। চিৎকার চেঁচামেচি, বোম পড়লো।
আমরা- আপনার বাচ্চা (বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে) ওরা কোথায় ছিল?
হালিমা- ওরা ঘরেই ছিল। আমরা প্রাণভয়ে ঘরের মধ্যে। রাত্রেই এখানে এই স্কুলে চলে আসি। এখনও বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে থাকে।
আমরা- শিশু মনে ক্ষত থেকে যায়, কিভাবে ভোলান?
হালিমা’র স্বামী- আমরা’ই ভুলতে পারছি না, ওদের কিভাবে ভোলাবো?
(৩)
যারা আগুন লাগালো
(ক)
ভাটপাড়া-তেলেনিপাড়া আঁতাত
গঙ্গার ওপার থেকে অর্থাৎ ভাটপাড়া থেকে দাঙ্গাবাজদের আনা হয়েছে ১১ মে রাত্রের অন্ধকারে, এসেছে নৌকোয় চেপে, কয়েকটি বাড়িতে রাখা হয়েছে, ১২ মে তারা দাঙ্গা চালিয়েছে- এইরকম খবর তেলেনিপাড়ায় শোনা গেছে। বিশেষ সূত্রে আমরা কয়েকটি ভিডিও (এর সত্যতা আমরা যাচাই করিনি), ছবি পেয়েছি। আমাদের নিজস্ব তদন্তে যা জানতে পেরেছি-
ভাটপাড়ার কয়েকটি আঘাটা ব্যবহার করেছিল অর্জুন সিংহের বাহিনী। ভাটপাড়া পৌরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত আতপুর ফেরিঘাট (ইন্ডিয়া জুটমিল ঘাট)ও তারা ব্যবহার করেছিল বলে জানা যাচ্ছে। রাত্রে ২টো থেকে ৩টে ছিল তাদের পারাপারের সময়। আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা ছিল যথেষ্ট তবে তলোয়ার ছিল বেশি। মোট ৮ থেকে ১০ টি নৌকো বা ট্রিপ ব্যবহার করা হয়।
ভাটপাড়ায় ঘাট সংলগ্ন এলাকায় বসবাসরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এমন কয়েকজন প্রতক্ষ্যদর্শী জানাচ্ছেন, ৮ থেকে ১০ জনের যুবকের দল যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির একজন জানলা থেকে উঁকি মারলে বলা হয়, ‘ভিতরে রহিয়ে’, আধা বাংলা-আধা হিন্দি শব্দ।
তেলেনিপাড়ায় আমরা একটি বাড়ি চিহ্নিত করি যেখানে কথিত দাঙ্গাবাজরা রাত্রে ছিল। বাড়িটি নদী সংলগ্ন। তেলেনিপাড়ার হিন্দুরা এই বিষয়ে মুখ খুলতে চায়নি। একজন মুসলিম মহিলা নির্দিষ্টভাবে বাড়িটির প্রসঙ্গ তোলেন। বাড়িটি ......।
(খ)
আর এস এস-এর মুখ। গোপাল চন্দ্র উপাধ্যায়, এই এলাকার আর এস এস-এর পরিচিত মুখ। গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ আমরা ওনার সঙ্গে ফোনে কন্টাক্ট করি। ওনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে ওনার সময় চাওয়া হয়। উনি সময় দিয়েও, পরে জানান উনি ‘বিজেপি’তে যোগদান করেছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহ জনসংযোগের কাজে ব্যস্ত থাকবেন। এর পরে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও উনি ফোন তোলেন না। স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
ফিরোজ খান, কাউন্সিলর, তৃণমূল কংগ্রেস
তেলেনিপাড়া দাঙ্গার তথ্যানুসন্ধান পর্বের প্রথম দিন থেকেই আমরা ফিরোজ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু অসফল থাকি। ওনার ফোন ‘সুইচ অফ’ বলে, একনাগাড়ে। শেষপর্যন্ত গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ আমরা ওনার সঙ্গে ওনার কথা বলি। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ওনার কথিত অফিসে বসে কথা বলতে পারি। দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল তার প্রতি। ছিল মোবাইলে মোবাইলে ঘুরতে থাকা উস্কানির ভিডিও।
ফিরোজ- ১০ মে যা হয়েছিল, তা ‘ঘটনা’ ছিল, কিন্তু পরে যেটা হোল সেটা অরগানাইজড ছিল। করোনা নিয়ে হয়েছিল প্রথম ঘটনা।
আমরা- আমরা শুনছিলাম অনেক দোকান বিশেষিত মুসলিমদের আক্রান্ত হয়েছে?
ফিরোজ- না না দেখুন, কমবেশি দুই পক্ষেই লোকসান হয়েছে। আমি মুসলমান বলে বলবো মুসলমানদের লোকসান হয়েছে তা নয়। হিন্দুদের ক্ষতি হয়নি তা নয়। ঝামেলা হলে কারও বেশি কারও কম হয়।
আমরা- ১০ মে’তে যা হয়েছিল তা ঘটনা ছিল বলছেন কেন?
ফিরোজ- দেখুন এখানে করোনার চেক আপ হয়। তিনজনের পজিটিভ বেরোয়। তিনজনেই মুসলমান। একজন ইমরান, একজন নাজির, আর এক জন কাউন্সিলরের হাসবেন্ড। কাউন্সিলর হলেন রেশমা খাতুন। চারিদিকে মুসলমানদের করোনা হয়েছে বলে প্রচার হতে থাকলো। হিন্দুরা কমন জায়গা থেকে মুসলমানদের জল আনতে বাধা দিল। একজন মহিলা প্যাকেট বিক্রি করছিল তাকে বলল মুসলিম পাড়ায় যাওয়া যাবে না। রোজার মাস, ইফতার চলছিল। ইফতারের সময় আমরা সবাই ব্যস্ত থাকি জানেন, সেই সময় অর্জুন সিং বলে একজন এবং আরও কয়েকজন বাঁশের ব্যারিকেড দিতে থাকলো। এর ফলে উত্তেজনা হোল, ১০ তারিখের ঘটনা হোল।
আমরা- হিন্দুদের দোকান আক্রান্ত হোল?
ফিরোজ- দেখুন আমি মাইনরিটির মধ্যে আছি। আমার নাম হয়েছে। যার নাম হয়, তার বদনামও হয়। যেমন বিদ্যাসাগরের। ওনাকে একবার কেউ বলে, ওই পাড়ার লোক আপনার খুব বদনাম করছে। উনি উত্তর দেন, ওই পাড়ায় তো আমি কোন কাজ করিনি, কাজ না করলে বদনাম কি করে হবে?
আমরা- মিলের কোন শ্রমিকের কি করোনা পজিটিভ এসেছিল?
ফিরোজ- হ্যাঁ, হয়েছিল। মিল মালিকরা তাদের ১৪ দিন আসতে মানা করেছিল।
এই সময়ে একজন আসেন, যার বাড়ির ঢালাই হয়েছে বলে কাউন্সিলরকে মিষ্টির প্যাকেট দিতে। ফিরোজ খান বলেন, এই দেখুন আমি ঘুষ খাই না, ওর কিছু ফাইন হয়, আমি মুকুব করে দেই তাই ও মিষ্টি খাওয়াতে এসেছে।
আমরা- বাঃ, বেশ ভালোই তো! আপনার তো বেশ জনপ্রিয়তা আছে দেখছি, তো সেই যে বদনামের কথা বলছিলেন, কিভাবে তা হোল?
ফিরোজ- ঘটনার তিনদিন আগে (১০ মে, ২০২০), পাইকপাড়ার কথা। ওখানে মুসলিম কম আছে। ওখানে বিহারী হিন্দুরা ফাঁড়ি ঘেরাও করেছিল, বলছিল পাবলিক টয়লেট মুসলিমদের ব্যবহার করতে দেবো না। সেখানে আমি পৌঁছালে আমাকে একজন হাত দিয়ে আটকে দেয়। আমি তখন সেন্টিমেন্টে নিয়ে নিই, আমি উল্টোপাল্টা বলেছিলাম, আমি বলি, এখানে আমরা কম আছি, এখানে আটকাচ্ছিস, যেখানে আমরা বেশি আছি সেখানে তোদের যেতে দেবো না। এখানে এইসব ঝামেলা করছিস, ওখানে বড় ঝামেলায় পড়বি, এটা আমি বলি। এইটাই মোবাইলে ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রচার হয়ে গেলো। ১৫ মিনিটের মধ্যে খালি করিয়ে দেবো, এটা করিয়ে দিল।
আমরা- এটা আপনি বলেন নি?
ফিরোজ- ওই যে মোবাইলে বানিয়ে দিল।
আমরা- কিন্তু এই বিষয়ে আপনার বয়ান ভিডিওতে অনেকেই দেখেছে।
উত্তরে উনি নিশ্চুপ থাকেন।
আমরা- আপনি যা বলছেন বলে স্বীকার করছেন, তাও তো বেশ আক্রমণাত্মক।
এবারেও উনি কোন উত্তর দেন না।
আমরা- একজন কাউন্সিলর হিসাবে বা রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে কি মনে হয় আবার কি এইরকম উত্তেজনা, হিংসা হতে পারে?
ফিরোজ- ২০২১ সাল পর্যন্ত এইরকম হবে। আমি দুবার কাউন্সিলর হয়েছি, প্রথমবার কংগ্রেস থেকে, এখন তৃণমূলে। ২০২১ পর্যন্ত সারা পশ্চিমবঙ্গেই এইরকম হতে থাকবে, এই যা তেলিনিপাড়ার দাঙ্গা নিয়ে একটা বদনাম হয়ে গেলো। যেখানে বিহারী, উত্তর ভারতীয়রা আছে, যেমন এই তেলেনিপাড়া, চাঁপদানি, নৈহাটির ওখানে হাজিনগর, ভাটপাড়া এইসব জায়গায় হতেই থাকবে। এখন দেখলে বুঝতে পারবেন না। ওপরে ছাই আছে, ভিতরে আগুন। দেখুন, আমি স্পষ্টভাবে একটা কথা বলছি, যে কোন সময় আবার আগুন জ্বলে উঠবে।
আমরা- তেলেনিপাড়ার এই দাঙ্গায় স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানরাও যুক্ত ছিল, যারা আবার তৃণমূলের সমর্থকও। এই বিষয়ে কিছু বলুন।
ফিরোজ- দেখুন, প্রথম দিন যে ঝামেলা হয়েছিল সেটা এক্সিডেন্ট ছিল। দ্বিতীয় দিনের টা পরিকল্পিত।
আমরা- এফ আই আর হয়েছে নিশ্চয়ই, স্থানীয় মানুষজনের নাম এসেছে?
ফিরোজ- আমার নাম আসেনি। ৫০ জনের মত মানুষের নাম এসেছে। ৫ জন ঝামেলা করেছে, তো হাজার জনকে পরেশানি করেছে।
আমরা- কেন এমন হচ্ছে? অনেক নিরপরাধ মানুষ, মহিলাদের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে, আমরা শুনেছি।
ফিরোজ- পুলিশ এইরকম করছে। কি করবো বলুন?
আমরা- পুলিশ তো আপনার সরকারের অধীন?
ফিরোজ- দেখুন ওরা বদলে গেছে। ঘরের লোক যখন বদলে যায় না, যেমন অর্জুন সিং, এতদিন তৃণমূলে ছিল, ও তো দলের হালহকিকত সব জানে।
আমরা- অর্জুন সিং যখন তৃণমূলে ছিল তখনও তো দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ ছিল।
ফিরোজ- দেখুন এই ঘরে আমরা ২০ জন আছি, ১ জন বেরিয়ে গেলো, সে তো জেনে গেলো কে কোথায় আছে। প্রথমে মুকুল রায় গেলো, ওতো ছিল গ্রাস লেভেলের নেতা। তেমনই শুভেন্দু অধিকারী।
আমরা- যাচ্ছেন নাকি বিজেপিতে? প্রতিদিনই তো ‘খবর’ হচ্ছে।
ফিরোজ- হ্যাঁ ওকে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।
আমরা- সেতো সৌরভ গাঙ্গুলির কথাও ভেসে আসছে।
ফিরোজ- শুভেন্দুর কথা আলাদা ওর জনভিত্তি আছে।
আমরা- আপনি বলছিলেন, প্রথম দিন যা হয়েছে তা এক্সিডেন্ট।
ফিরোজ- হ্যাঁ তাই তো।
আমরা- সেইদিন কাদের দোকান ভাঙচুর হয়?
ফিরোজ- হিন্দুদের। একদম ১০০ % ওদেরই। দেখুন, আমি মিথ্যা কথা বলিনা।
আমরা- সংঘর্ষ কি মুখোমুখি হয়েছিল?
ফিরোজ- না। বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আর এর জন্যই আপনার বদনাম, তাই তো?
ফিরোজ- হ্যাঁ।
আমরা- পার্টি আপনার কাছে কিছু জানতে চাইনি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে।
ফিরোজ- হ্যাঁ আমরা কথা বলে নিয়েছি।
যাদের হাতে জল ছিল
পাইকপাড়ার অদূরে গোয়ালা বস্তি। ৫০-৬০ ঘর যাদব, মূলত বিহার থেকে আসা গরু ও মহিষ পালন ও দুগ্ধ ব্যবসায়ে সঙ্গে যুক্ত এঁরা। দাঙ্গার কালো আগুনে যখন অন্ধকার চারিদিক ঠিক সেই সময় ‘জল’ হাতে দাঁড়িয়েছিলেন এঁরা। মুসলমান পরিবারগুলির পাশে থেকে দাঙ্গাবাজদের ঠেকিয়েছেন, সদর্পে। আমরা কথা বলি এনাদের সঙ্গে, খাটালে। কৃষ্ণ কুমার যাদব, বছর ৫৫-র, নির্মেদ শরীর, ঋজু কণ্ঠস্বর। ছিলেন মুকেশ রাই (৬০ বছর), দিলিপ যাদব (৪১ বছর)।
কৃষ্ণ- ৪০-৫০ বছর ধরে আমরা এখানে আছি। সবার সঙ্গে একটা আত্মিয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। চাচা ভাতিজা, ভাই দাদার মতো সম্পর্ক। আমাদের সুখ দুঃখের সঙ্গে ওরা জড়িয়ে আছে। ওদেরও সুখ দুঃখের সঙ্গে আমরা জড়িয়ে আছি। আমাদের কোন সমস্যা হলে ওরা এগিয়ে আসে। ওদের ক্ষেত্রে আমরা। অনেকদিন পাশাপাশি থাকলে এমনই হয়।
আমরা- ১২ মে, ২০২০ হিন্দু দাঙ্গাবাজরা এদিকে এসেছিল, মুসলিম পাড়া আক্রমণ করতে। এমনিতেই হাজি মুহম্মদ মহসিন স্কুলে অনেক ঘর ছাড়া মুসলমান পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল, এখনও আছে। সেইদিনের ঘটনা আমাদের বলুন।
কৃষ্ণ- অনেক লোক এসেছিল। সব অস্ত্র নিয়ে। আমরা এখানে যাদবরা রুখে দাঁড়ায়। ওদের ঢুকতে দিইনা।
আমরা- কতজন আছেন আপনারা?
কৃষ্ণ- আছে প্রায় ৫০-৬০ টি পরিবার। অনেকে দেশে আছে, লকডাউনের জন্য আসতে পারেনি। প্রায় ১৫০ জন মানুষের বসবাস। আমরা আমাদের পাড়ার মুসলিমদের জিম্মায় রেখে দিয়েছিলাম। এহি বাত হ্যায়।
এই রাজ্যে প্রায় ১০০ বছর ধরে আমরা আছি, যাদবরা। আমাদের বাপ-ঠাকুর্দার সময় থেকে। আমি নিজে, ১৯৬৫ থেকে এখানে।
আমরা- এর আগে এইরকম দাঙ্গা কি হয়েছিল। আপনাদের অভিজ্ঞতা কি বলে?
কৃষ্ণ- এত বড় দাঙ্গা কখনও হয়নি। আমাদের বাবাদের আমলে টুকটাক কিছু ঘটনা হয়। আমার বাবা ও তার বন্ধুরা সে সময় সেগুলো রুখে দিয়েছিলেন। জাত ধর্মের ভেদাভেদ আমাদের কাছে কখনও ফ্যাক্টর ছিল না, এখনও নয়। মানবতাই আমাদের মূল কথা।
আমাদের অনেকের জন্ম, বড় হওয়া এখানে। আমার জন্ম হয়ত এখানে নয়। কিন্তু পড়াশোনা, বড় হওয়া সবই তো এখানে। আমার মুসলিম বন্ধু নেই? আছে। থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
সব মানুষ একরকম হয়না। আমরা কৃষ্ণের সাথী, প্রেম ও সদ্ভাবে বিশ্বাসী।
আমরা- আবার যদি এইরকম হয়?’
কৃষ্ণ- আমরা রুখবই।
মুকেশ- আবারও রুখবো। আমাদের না জানা থাকলে, হটাত কিছু হয়ে গেলে অন্য কথা। কিন্তু আমাদের জ্ঞাতসারে এখানে দাঙ্গা হবার নেই। সবার জানের দাম আছে, সবার বালবাচ্চা আছে।
এই কথোপকথনের শেষে আমরা পার্শ্ববর্তী মুসলিম মহল্লায় যায়, শেখ আজমল (৩০ বছর) আমাদের নিয়ে যান এক অশ্বত্থ গাছের নিচে। খাটিয়ায় তাঁদের বাৎচিত চলছিল। কথা হয় বয়স্ক কয়েকজন মুসলিম মুরুব্বীর সাথে। সেই কথার সংক্ষিপ্ত রূপ-
‘মসিহা হ্যায় ইয়ে লোগ। আমাদের বাঁচিয়েছে। আমাদের মহিলাদের ইজ্জত বাঁচিয়েছে। আমাদের বাচ্চাদের শৈশব। আমাদের চাচা বলে কৃষ্ণ, ওর বাপের বন্ধু ছিলাম আমরা। আমাদের বাঁচিয়েছে বলে আমার বন্ধু ওই আকাশ থেকে ওকে, আর অন্য যাদবদের দোয়া করবে।’
আমরা- কিন্তু আজমল (আজমলকে) এই সংবাদ তো ব্রাত্য থেকেছে, শুধু হিংসা আর আগুনের কথাই আমরা জেনেছি।
আজমল- হ্যাঁ, বাস্তবিক এখানে কোন পার্টিই কিছু করেনি। করেনি পুলিশ। অনেক জায়গায় যাদবরা দাঙ্গায় হয়তো যোগ দিয়ে থাকবে, কিন্তু এখানের চিত্র আলাদা।
আমরা- কেন?
আজমল- আমি ওই কৃষ্ণকে বড়ে ভেইয়া বলি, বড় দাদাই হচ্ছে সে আমার। বিপদে আপদে একে অন্যের কাছে ছুটে যায়। এখানের তৃণমূলের মুসলিম নেতার ভূমিকা ঠিক নয়। এখন অনেকে মুসলিমদের পাশে আছি, এটা দেখাতে চাইছে। উস্কানিও আছে।
আমরা- আর?
আজমল- আর এস এস তো আছেই, এতো পরিকল্পিত আক্রমণ হোল, ওরা ছাড়া কিভাবে হবে।
আমরা- কিন্তু অন্য পাড়াতেও তে এইরকম একসাথে থাকার বহু স্মৃতি, বহু গল্প আছে। সেখানে ফাটল হোল কেন?
বয়স্ক একজন- বাত কৃষ্ণ অউর নবীকা নেহি হ্যায় বেটা, বাত দুসরা হ্যায়।
আমরা- বাত ক্যা হ্যায় নানা?
বয়স্ক অন্যজন- বাত কুর্সি কা হ্যায়।
সকলে একসাথে হেঁসে উঠলেন। সে হাসিতে বিকেলের রোদ এসে থেমেছিল।
(৪)
পুলিশ পলিটিক্স এবং
তেলেনিপাড়ায় পুলিশের ভূমিকা ঠিক কি ছিল এই প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়েছে আমাদের তথ্য অনুসন্ধান পর্বে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যে কথাগুলি বলেছে তা হোল এইরকম-
১। দাঙ্গা হয়নি, দাঙ্গা করতে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ এই দাঙ্গা ঘটতে দেওয়ার ভুমিকায় স্পষ্টত দৃশ্যমান না হলেও নেপথ্যে তাদের ভূমিকা ‘স্পষ্ট’। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যখন মুসলিম নিন্দা ও করোনা ছড়ানোর প্রচার চালানো হচ্ছে তখন পুলিশ নির্লিপ্ত।
২। ১০ মে’র সাম্প্রদায়িক হিংসার পরে যে কোন দিন আবার সংঘর্ষ হতে পারে এই আঁচ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কিছু ব্যবস্থা নেয়নি। ভাটপাড়া থেকে দাঙ্গাবাজরা এসেছে, বিভিন্ন জায়গা থেকে হিন্দুত্ব শক্তি গুন্ডা জড়ো করেছে, পুলিশের না জানলে এটা হয়?
৩। এফ আই আর নিতে না চাওয়া, লুঠ হওয়া বা আগুনে পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও জোর করে ‘হারিয়ে গেছে’ এই বয়ানে দরখাস্ত লেখা করানো।
৪। পুলিশের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণে ঘটনায় ইন্টারভেন করার ভূরি ভূরি অভিযোগ এসেছে। ১০ মে দৃশ্যত হিন্দু ব্যবসায়ীদের দোকান ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ, লুঠ করা হয়। দুদিন বাদেই, ১২ তারিখ তার ‘বদলা’ নিতে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষের মতে দুটি ‘চিত্রনাট্য’ই পুলিশের। ১০ মে মুসলিম দাঙ্গাবাজদের জিতে যাওয়া, ১২ মে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের জিতিয়ে দেওয়া। প্রযত্নে পুলিশ, প্রশাসন। প্রযত্নে রাজনীতি। মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ‘আমরা’ প্রায় শচারেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে তেলেনিপাড়ায়, দাঙ্গা বিধস্ত এলাকায়। যারা উপরিউক্ত অভিযোগগুলি করেছেন, সোজাসুজি। ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। রাখা হচ্ছে কতিপয় কথোপকথন।
(ক)
সিভিক পুলিশের সঙ্গে কথোপকথন
সিভিক পুলিশ- যেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, তেলেনিপাড়া থেকে ফোন এলো যে এখানে ঢুকে মারছে। আমি আমাদের আইজি সাহেবকে ফোন করি। উনি বলেন ঠিক আছে,আমি ফোর্স পাঠাচ্ছি।এরপরে খানিকক্ষণ চলে যায় ,তারপরে আমি আবার ফোন করে বলি , স্যার ফোর্স তো এখনও আসেনি। স্যার বলেন ঠিক আছে, তোমার সাথে কে আছে? আমি বলি আজহারউদ্দিন(নাম পরিবর্তিত, অন্য সিভিক পুলিশ)। উনি বলেন তোমরা যাও, ফোর্স চলে গেছে।আমরা এলাকায় আসি, দেখি কেউ আসেনি। আর ওরা তরোয়াল দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দোকান ভাঙছে, স্করপিও গাড়ি ভাঙছে।
আমরা- কোথায়?
সিভিক পুলিশ- ওই যে ৯ নম্বর লাইনে। আমরা এসব দেখে আবার ফিরে চলে আসি।তারপর এখান থেকে আমি লালা ভাই, ইমামুদ্দিন, আর আলীকে নিয়ে যাই। তারপর ওরা পালায়, ফাঁকা হয়। তারপর আমরা ওখানকার লোকেদের বের করি।তারপরের দিন আর কিছু হয়নি।। তারপরের দিন হঠাৎ এখানে ঝামেলা হয়ে যায়। ১২টা -১২.৩০ এর সময় ঝামেলা হয়। এরপর আমি তখনও ওই স্কুলের কাছে বসে স্যারকে ফোন করি।
আমরা- ৯ নম্বর লাইনে ঝামেলা কবে হয়েছিল?
সিভিক পুলিশ- ১০ তারিখ এখানে হয়, মারাত্মক আহত হন দুইজন। তারপর আবার ১২ তারিখ হয়। ওইদিন মুসলমানদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়।
এরপর আমি অঙ্কুর নার্সিং হোমের কাছ থেকে (ওখানেই ডিউটিতে ছিলাম)সাহেবদের ফোন করি কিন্তু ওনারা বসে ছিলেন। বড়বাবুকে ফোন করেছিলাম, উনি ধরছিলেন না।
আমরা- বড়বাবু এখনও আছেন?
সিভিক পুলিশ- না বদলি হয়ে গেছেন। ওনার নাম নন্দন পানিগ্রাহি।এরপর আমি আর বেশি ফোন করিনি। রোজা চলছিল। এরপর রাতে চেয়ারম্যান স্যারের লোক আসে, আমরা বলি সব।
আমরা- কি বলেন?
সিভিক পুলিশ- হ্যাঁ কোনো প্রশাসন আসেনি। পাবলিক তো দেখেছে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান কেউ আসেনি। অঙ্কুর নার্সিং হোমের পাশেই ফায়ার ব্রিগেড, আসতে এক মিনিট টাইম লাগে কিন্তু আসেনি। জল বন্ধ ছিল। তবে তাকে দোষ দেবো না, জল যে চালু করে ও তো মানুষ, ও ফেঁসে গেছিলো। পরে গিয়ে জলের পাম্প হাউস খোলা হয়। এইসব কথা ডি এম সাহেবের লোককে বলেছিলাম , যে চেয়ারম্যান ,ভাইস চেয়াম্যান কেউ আসেনি আমাদের এলাকায়। ৯ নম্বর লাইনের দাঙ্গা পীরিত মুসলমান পরিবারগুলোকে এখানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেসব কেউ দেখতে আসেনি। সব কিছু হয়ে যাবার চারদিন বাদে কিছু লোক এসেছিল। এইসব কথা বলেছিলাম বলে ওনার খারাপ লেগেছিল। ইমাম উদ্দিন এর ভাইজার বাড়িতে ওই লোকেদের রাখা হয়েছিল তাকে ফোন করে ভাইস চেয়ারম্যান বলে, ‘তোমাদের বহুৎ নাটক হচ্ছে’, মানে হুমকি দেয়। ইমামের ভাই বলে যে আপনি ভাইস চেয়ারম্যান তো কি হয়েছে যা মনে হবে তাই করবেন। এটাই গিয়ে ওরা ডিএসপি সাহেবকে বলে দেয়।তারপর আমাদের ফাঁড়িতে ডাকা হয় তারপর আমাদের বলা হয় যে তোমরা তো প্রশাসনের লোক তোমাদের তো এইসব বলা উচিত নয়। আমি বলি প্রশাসনের লোক তো ঠিক আছে কিন্তু আপনাকে তো দেখতে হবে কে ঠিক বলছে কে ভুল বলছে?
এইসব প্রশ্ন তোলার জন্য আমাদের দুজনকে ট্রান্সফার করা হয়েছে।
আমরা- কোথায়?
সিভিক পুলিশ- এখন চন্দননগরে।
(খ)
আমরা তথ্যানুসন্ধান দলঃ হুমকি, আটক এবং তেলেনিপাড়ার সেপাইরা
১০ জুন, তেলেনিপাড়ার সাম্প্রতিক সাম্প্রয়াদায়িক হিংসার ঠিক এক মাস। আমরা গিয়েছিলাম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে, কথা শুরু হয় ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্কুল থেকে। এখানে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
তখন বেলা প্রায় দেড়টা। তথ্যানুসন্ধান দলের দুইজন, ফারুক উল ইসলাম ও শুভঙ্কর সেনগুপ্ত তেলেনিপাড়ায় এফ জি স্ট্রিটের পাকিজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন, কথা বলছিলেন জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে। বোঝার চেষ্টা করছিলেন দাঙ্গার স্বরূপ, ব্যক্তি মানুষের অসহায়ত্ব। হটাৎ পুলিশ বাহিনীর আগমন। ভদ্রেশ্বর থানার আই সি, কৌশিক কুমার ব্যানার্জির নেতৃত্বে ১০-১২ জনের সেই দলটি তাদের ঘিরে ধরে, বলে, ‘আপনারা এখানে ছবি তুলছেন কেন, কথা বলছেন কেন?’ উত্তরে ফারুক জানান, ‘মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবো না? তাছাড়া এখন তো ১৪৪ ধারা লাগু নয়।’ উত্তরে উক্ত আই সি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে থানায় চলুন’। ফারুক ও শুভঙ্করকে তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফোন মারফৎ এই খবর পেলে দলটির ওপর দুই সদস্য শুভ প্রতিম রায় চৌধুরী এবং অমিতাভ সেনগুপ্ত তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে যান।
প্রায় দের ঘণ্টা বসার পর আমাদের ডাকা হয় তেলেনিপাড়া আউটপোস্টের ইন চার্জ অতনু মাজি’র অফিসঘরে। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন ভদ্রেশ্বর থানার আই সি, কৌশিক কুমার ব্যানার্জি এবং ডি এস পি, চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট, পলাশ চন্দ্র ঢালি, আই পি এস। শুরু হয় কথিত ‘ইন্টারোগেশান’। এখানে ব্যক্তি বিশেষের নামেই এই কথোপকথন রাখা হোল।
কৌশিক- কয়জন ছিলেন আপনারা?
শুভ প্রতিম- আমরা চারজন।
কৌশিক- চারজন কোথায়? আরও কয়েকজন তো ছিলেন? ওখানে তো দুজনকে দেখলাম, আরও ছিল।
শুভ প্রতিম- না আমরা চারজনই ছিলাম। লোকাল একজন ছিলেন যে আমাদের জাস্ট দেখিয়ে দিচ্ছিলো।
কৌশিক- আপনার কোথায় ছিলেন?
শুভ প্রতিম ও অমিতাভ- আমরা পরে এলাম। আমরা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ উর্দু হাইস্কুলে ছিলাম।
কৌশিক- ওই তো আপনার সঙ্গে তো আরও দুইজন ছিল (শুভঙ্করকে দেখিয়ে)
শুভঙ্কর- না, ওই তো ওই ছেলেটা ছিল যার বাড়িতে গিয়েছিলাম, চশমা পড়া ওই ছেলেটা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছিল।
পলাশ চন্দ্র- আপনাদের টিমে কয়জন লোক ছিল?
শুভঙ্কর- চারজন।
পলাশ চন্দ্র- সেই চারজনই এসেছেন?
শুভঙ্কর- হ্যাঁ।
পলাশ চন্দ্র- হ্যাঁ তো আপনারা কি জন্যে এসেছেন? আপনারা কারা?
শুভ প্রতিম- আমরা একটা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত, আমরা রিসার্চের কাজ করি।
পলাশ চন্দ্র- কি আছে, প্রমাণ কি আছে? (কাগজপত্র দেখতে চেয়ে)
শুভ প্রতিম- না আমাদের কাছে কোন কাগজপত্র নেই। আপনাকে আমরা ইমেলে পাঠাতে পারি। আমরা এখানে আসি, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ স্কুলের ম্যাথস-এর টিচার, উনি আমাদের বলেন যে এখানে কিছু সমস্যা আছে, এরকম না যে এখানে থাকা মানুষজন খাবার পাচ্ছে না, কিন্তু এখানে টুকটাক কিছু সমস্যা আছে, আপনারা যদি আসেন।
পলাশ চন্দ্র- আমার কথা শুনুন।
শুভ প্রতিম- হ্যাঁ বলুন।
পলাশ চন্দ্র- আপনারা এখানে এসেছেন, জানেন এখানের অবস্থা কি?
শুভ প্রতিম- এখন তো ১৪৪ ধারা নেই।
কৌশিক- ১৪৪ নেই তো কি?
পলাশ চন্দ্র- আশ্চর্য লোক তো!
কৌশিক- আপনারা আউটসাইডার, আপনারা প্রভোকেসান দিতে এসেছেন কিনা বুঝবো কি করে?
শুভ প্রতিম- তাহলে আমাদের কাজ দেখতে হবে। প্রভোকেশানের কথা আসছেই না।
কৌশিক- ১৪৪ নেই বলে আপনারা আউটসাইডার এখানে ঢুকে যাবেন?
শুভ প্রতিম- আমাদের আউটসাইডারের সংজ্ঞা জানা নেই। আমরা আউটসাইডার নই। আমরা তো এখানেরই লোক।
কৌশিক- কোথা থেকে এসেছেন?
শুভ- হুগলী জেলার কেউ শ্রীরামপুর, কেউ চন্দননগর। কেউ অন্য জেলা থেকে।
কৌশিক- আপনারা কেউ ভদ্রেশ্বর বা তেলেনিপাড়ার নন।
পলাশ- কোন বেসিসে আপনারা এখানে এসেছেন?
শুভ প্রতিম- বললাম তো, রিসার্চ গ্রুপ হিসাবে এসেছি। আমরা পিস নিয়ে কাজ করি।
পলাশ- বললেই হোল?
শুভ প্রতিম- তাহলে তো দেখতে হয় আমাদের কাজ, দেখুন।
পলাশ- কি আছে, কোন আইডেন্টিটি কার্ড?
শুভ- আছে। (দেখানো হোল)
পলাশ- এটা কি কোন এন জি ও?
শুভ- এটা একটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।
পলাশ- আমি যেটা বলবো, সেটা ডাইরেক্টলি উত্তর দেবেন।
শুভ- আমি তো আপনাকে ডাইরেক্টলি উত্তর দিচ্ছি।
পলাশ- আমার কথা শুনুন (জোরে) আপনাকে যেটা জানতে চেয়েছি সেটা বলুন। আই ডোন্ট লাইক ইট।
শুভ- সেটা আপনি বুঝে নিন। আমি তো বললাম, ফ্রন্ট লাইন ডিফেন্ডার একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেমন অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশানাল। সেইরকম।
(কার্ড দেখার পর)
পলাশ- ঠিক আছে, এখন বলুন আপনাদের আসার প্রয়োজনটা কি?
শুভ- ওই যে বললাম, আমরা একটি রিসার্চ গ্রুপ, এখানে ইস্কুলে এসেছিলাম দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের অবস্থা বুঝতে। আমরা যদি কিছু সাহায্য করতে পারি এই উদ্দেশ্যেই আসা। আমরা ইতিমধ্যে আমপান দুর্গতদের জন্য গিয়েছিলাম। এখানে উপস্থিত এমন দুইজন গিয়েছিল। (ফারুক ও অমিতাভকে দেখিয়ে)। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। (অমিতাভকে দেখিয়ে)।
এখানেও মানুষজনের ক্ষতি কি বুঝতে চাইছি, ওদের দুবেলা খাবার শিবিরে পাচ্ছে, কিন্তু আরও প্রয়োজন আছে। অনেকে এক কাপড়ে চলে এসেছেন, অনেকের নিত্য ওষুধ দরকার। মেডিক্যাল ক্যাম্পের কথা হচ্ছিল, কিন্তু সেক্ষেত্রে গেদারিং-এর ব্যাপার আছে, এখন তা সমস্যার। প্রশাসনের অনুমতি দরকার। এইসব নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা।
পলাশ- কথা বলে কি হবে? শুভ প্রতিম বাবু, আপনাদের পারপাসটা কি?
শুভ- বললাম তো কয়েকবার, কথা বলে বোঝা ওদের সমস্যাটা কি? এটা আমাদের কাজ। এই যেমন মেডিক্যাল ক্যাম্পের প্রস্তাব। মেয়েদের শালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি দেওয়ার প্রস্তাব।
অমিতাভ- আপনারা যদি আমাদের রিপোর্ট দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন আমরা কি করি। কোন প্রোভকেসনের কাজ আমরা করিনা।
পলাশ- আপনারা যে বলছেন, তার প্রমাণ কি? দেখুন আপনারা বোকা নন, আমিও বোকা নই। এটা সেন্সেটিভ ইস্যু। গ্রুপ থিয়েটার এসে ভুলভাল, একটা রিউমার ক্রিয়েট করার চেষ্টা করে, যাদের এগেন্সটে আমরা ১৭ টা কেস করেছি। অভিযোগ, স্প্রেডিং অফ ফলস ইনফরমেসান। প্রচুর লোক বলেছে, আর ওদের এগেন্সটে যথাসম্ভব আমরা কেসেস স্টার্ট করেছি। এটা এমন কোন বিশেষ এলাকা নয় যে আপনারা আমপানের মত এসে কিছু করবেন।এটা ভেরি কমুন্যালি সেন্সেটিভ এরিয়া। বহুবছর ধরে সেন্সেটিভ এরিয়া। তারপর আপনাদের যে বলা এখানে সেক্সান ১৪৪ নেই, আমরা আসতে পারি, এটা আপনাদের ভুল। তাহলে এখানে একমাস আমরা ডিউটি করতে আসতাম না।
তাই জানতে চাইছি আপনারা কেন এসেছেন? এই আপনারা ফটো তুললেন, তারপর কোথাও পাঠিয়ে দিলেন তখন?
অমিতাভ- আমরা মিডিয়া নই।
শুভ- যেমন ভাটপাড়া, সেখানে দাঙ্গা পীরিতদের জন্য আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাচ্ছি, কোলকাতার দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সহায়তায়। এখন লকডাউন বলে অবশ্য বন্ধ। সেখানে আমরা প্রশাসনকে জানিয়েই সেসব করেছি।
পলাশ- দেখুন এখানে আলাদা। আপনারদের মনে হোল না যে থানার পারমিশান নেওয়া দরকার।
শুভ- দেখুন এখানে ১৪৪ ধারা লাগু নেই, আমাদের মনে হয়নি অনুমতি নিতে হবে।
অমিতাভ- রিলফের ব্যাপারে যদি কিছু করা হতো, আপনাদের কাছে আসতাম।
পলাশ- আপনারা ঢুকছেন, আপনাদের মনে হোল না একবার বড়বাবুকে জানায়, ‘যে স্যার আমরা এনকোয়ারি করবো, এনকোয়ারি যাইহোক।‘ আপনাদের মনে হোল না?
শুভ- দেখুন মানুষ যখন ডাকছে, তারা কথা বলতে চাইছে, তাঁদের সাহায্যের প্রয়োজন...
পলাশ- কে ডেকেছে?
শুভ- ওই যে বললাম, ইস্কুলের মাস্টার, এলাকার সমাজসেবী, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ, আপনারা না জানলেও, আমাদের পরিচিতি আছে যেহেতু আমরা সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিয়ে কাজ করি।
পলাশ- মনে করলেন না বড়বাবুকে জানানো উচিত? আপনি জানেন না আপনারা কোন বিপদে আছেন। (সজোরে) আই অ্যাম ট্রাইং টু হেল্প ইউ।
শুভ- থ্যাংকস ফর দ্যাট
পলাশ- ডোন্ট ট্রাই টু জাস্টিফাই
শুভ- নো উই ডিডনট জাস্টিফাই আওারসেল্ভ। আমরা আমাদের কাজ করেছি মাত্র।
পলাশ- ১৮ নম্বর কেসে আমরা আপনাদের এগেন্সটে বলবো।
শুভ- (হেঁসে) তা আপনি করতে পারেন।
পলাশ- আপনাদের ভালোর জন্য বলছি, আর আপনি বলছেন? আপনাদের বিরুদ্ধে কেস করবো। এখানে ইনভেস্টিগেসান করতে এসেছেন, ফটো তুলেছেন, কথা বলেছেন, দেখাবো আপনাদের কি করতে পারি? জানেন আমরা কি করতে পারি? আপনাদের বিরুদ্ধে কেস করবো।
শুভ- আমাদের যা বলার আমরা বলেছি, আপনি যা করার করুন।
কিছু ক্ষণ বাদে, আবার-
পলাশ- আপনারা ভাবেন কি, আপনারা হিউম্যান রাইটস আছেন বলে আপনারা যা ইচ্ছে করতে পারেন, একটা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে...
কৌশিক- আপনাদের কি এন এইচ আর সি’র আপ্রুভ আছে?
শুভ- এন এইচ আর সি’র আপ্রুভ আবার কি?
কৌশিক- স্টেট হিউম্যান রাইটস-এর আপ্রুভ আছে?
শুভ- আমরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে এন এইচ আর সি’কে জানাই।
পলাশ- সে তো যে কেউ জানাতে পারে।
শুভ- ঠিকই।
কৌশিক- আপনাদের কোন আফলিয়েসান আছে এন এইচ আর সি-র?
শুভ- ওরকম কোন এফলিয়েশান হয় না। ‘আমরা’ একটি রেজিস্টার্ড বডি, আমাদের কাজের ক্ষেত্রর মধ্যে মানবাধিকার আছে, ক্ষেত্র গবেষণা আছে। আমরা পিস (শান্তি) নিয়ে কাজ করি।
অমিতাভ- আমাদের রেজিস্ট্রেশান আছে।
কৌশিক- আপনারা একটি রেজিস্টার্ড অরগানাইজেশান?
অমিতাভ- অবশ্যই।
পলাশ- (কর্কশ গলায়) যেখানে ঝামেলা হয়, সেখানে আসতে গেলে অনুমতি নিতে হয়, permission of the local authority.
কৌশিক- ছবি তুলতে গেলেও অনুমতি নিতে হয়। সাধারণ মানুষকেও।
শুভঙ্কর- আমরা মিডিয়ার লোক নই।
কৌশিক- তাহলে তুলছিলেন কেন? মিডিয়াকেও নিতে হয়। আপনারা ছবি তুলছিলেন কেন? What is the purpose of video?
শুভ- মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই ভিডিও তোলা হচ্ছিল। এটাই purpose.
শুভঙ্কর- দোকানটা ভাঙচুর হয়েছে, এটা দেখাচ্ছিলেন। তাও পুরোটা নেওয়ার আগেই আপনারা চলে এলেন।
কৌশিক- আমরা দেখবো, আপনারা কি শুট করেছেন।
শুভঙ্কর- অবশ্যই।
কৌশিক- কি উদ্দেশ্য ছিল ছবি তোলার।
শুভঙ্কর- দেখুন আমি ফ্রিলান্স ফটোগ্রাফার। এই রিসার্চ গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানে এসেছি।
কৌশিক- কিসের রিসার্চ।
শুভঙ্কর- কিসের রিসার্চ তা বলা হয়েছে। আমরা এখানে মানুষের সঙ্গে কথা বলে কিছু ত্রাণ দেওয়ার বিষয়েও ভাবনাচিন্তা করছিলাম। আর তাই ছবি তোলা হচ্ছিল।
কৌশিক- কিসের ত্রাণ?
শুভঙ্কর- কিসের ত্রাণ তাও আপনাকে বলা হয়েছে, উনি (শুভ প্রতিম) যা বলেছেন তাই।
কৌশিক- আপনাদের উদ্দেশ্য কি? কি করতে চাইছেন?
আমিতাভ- আমরা মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে চাইবো।
কৌশিক- এখন কি করে সম্ভব?
অমিতাভ- হ্যাঁ, এইজন্য প্রশাসনের অনুমতি নিতে হলে নেবো। আমরা জামাকাপড়ও দিতে চাই। আমরা কিনেছি জামাকাপড়।
কৌশিক- ওইসব দিতে গেলে আপনাদের লোকাল থানায় পারমিশান নিতে হবে। কিন্তু আজ এসেছিলেন কেন বুঝতে পারছি না।
ফারুক- আপনাদের অনেকবার বলা হয়েছে।
কৌশিক- এসে শুধু একশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
শুভ ও ফারুক- না আমরা সকলের সঙ্গেই কথা বলতে চাই, বলেছিও।
শুভ- শাস্ত্রী স্কুল, যেখানে দাঙ্গা ...।
কৌশিক- আপনারা এসেছিলেন বলে ক্রাউড অ্যাসেম্বেল হচ্ছে, সোশ্যাল ডিস্টান্সিং ভায়োলেট হচ্ছে, সোশ্যাল গ্যাদারিং হয়েছে, লকডাউন ভায়োলেট হচ্ছে বলে আপনাদের আগেন্সটে কেস করবো।
শুভ প্রতিম- করুন।
পলাশ- ওদের ডিটেলস নিয়ে নিন (কৌশিক বাবুকে নির্দেশ)। কটা ক্যামেরা আছে আপনাদের কাছে (শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে)?
শুভঙ্কর- দেখুন, ক্যামেরা আছে, কিন্তু ছবি কিচ্ছু নেই। আমরা তখন কিছু শুরু করিনি (ফটোগ্রাফি)। সবে ক্যামেরা বেড় করেছি, আপনারা বাধা দিয়েছেন।
এরপর ক্যামেরা থেকে ডিস্ক খোলা হয়, পলাশ বাবু তা ল্যাপটপে দেখেন।
শুভ প্রতিম- আমাদের নাম, ধাম কে নেবেন?
তপন নামে কাউকে উচ্চস্বরে ডাকেন পলাশ বাবু। বলেন আমাদের কাছে থেকে কার্ড নিতে। এরপর ওনারা দুজন আমাদের উক্ত চেম্বারে বসিয়ে রেখে বাইরে যান। কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসেন উভয়েই, শুরু হয় একে একে আমাদের নাম-ধাম লেখা। কে কি করেন, এই প্রসঙ্গে অমিতাভ জানান তিনি একটি কলেজে পড়ান ইত্যাদি। এই পর্ব শেষ হলে কৌশিক বাবু বলেন, আপনাদের বসতে হবে, এখানের ইনচার্জ অতনু মাজি জানাবে আপনাদের কি করতে হবে, কখন যাবেন।
আমাদের চাম্বারের বাইরে বসতে বলা হয়। আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর, অতনু মাজি আসেন, তিনি বলেন,
অতনু মাজি- আমরা জেনেছি আপনারা কারা। আপনাদের বিষয়ে একাধিক ফোন আসে। আসলে আমাদের এগুলো করতে হয়।
আমরা- বুঝলাম। তাবোলে আমাদের এতক্ষণ বসিয়ে রাখবেন, আমাদের কাজে একরকম বাধা দেওয়া হোল। আমরা তো মানুষের সঙ্গে কথা বলতেই পারি।
অতনু মাজি- হ্যাঁ বুঝেছি। ঠিক আছে, আপনারা কোন সহযোগিতা লাগলে জানাবেন।
আমরা- ধন্যবাদ। আমরা কি এখন যেতে পারি?
অতনু মাজি- হ্যাঁ।
উল্লেখ্য আমরা তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে আমাদের বেআইনি আটক এবং গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়ার প্রেক্ষিতে চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটকে ঘটনার পরদিন, ১১ জুন, ২০২০ তারিখে অভিযোগ দায়ের করি। আমরা জানাই ওই এলাকায় যাবার জন্য পুলিশের অনুমতি নেওয়ার পুলিশি দাবি সম্পূর্ণ বেআইনি একটি দাবি। আমরা এই এলাকায় সংঘর্ষের স্বরূপ বুঝতে আমাদের সংগঠনের নীতি অনুসারে ক্ষেত্র গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে চাই, তা যেন নির্বিঘ্নে করতে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানানো হয়।
১৩ জুন, ২০২০ আমরা’র পক্ষ থেকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের এবং মানবাধিকার কর্মীদের কাছে অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার আর্জি জানিয়ে অভিযোগ জানানো হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এই অভিযোগ পত্র গ্রহণ করে (DIARY NUMBER- 7817/IN/2020)।
যা হারালাম গঙ্গাপারে
(ক)
পাটকলের পড়োশি
আমরা, এক সচেতন প্রয়াস-এর তরফে তেলিনিপাড়া অঞ্চলে সংঘর্ষ পরবর্তী তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে এক বিচিত্র জনবিন্যাসকে আমরা দেখেছি। ভিক্টরিয়া বা গোন্দোলপাড়া জুটমিল সংলগ্ন শ্রমিক মহল্লায় কুরমালী ভোজপুরীর মতো আঞ্চলিক হিন্দি ভাষী গরীব মানুষ, ঐতিহ্যগতভাবে উর্দুভাষী (অধুনা হিন্দিভাষী) সম্পন্ন মুসলিম,বা দরিদ্র হিন্দি-উর্দুভাষী মুসলিম, খাটাল ব্যবসায় যুক্ত বড়ো সংখ্যার হিন্দিভাষী গোয়ালা, দর্জির কাজে যুক্ত বা ছোট অস্থায়ী চাকরী করা হিন্দু বা মুসলিম মানুষ- যারা অধিকাংশই প্রায় তিন প্রজন্মের বেশি এখানে কাটিয়ে ফেলেছেন। আর অদ্ভুত ভাবে স্থানীয় মানুষের মুখে একটি ভাগ করা করি চালু আছে, হিন্দু, মুসলিম আর বাঙালি। শ্রমিক মহল্লার বাইরে জি টি রোডের উপরে মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, চাকুরীজীবী বাংলাভাষীরাই- ‘বাঙালি’। তারা অতীত থেকেই হিন্দিভাষী দলিত হিন্দুদের থেকে আলাদা রয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে সংঘর্ষের হেতু খুঁজতে গেলে জনবিন্যাস আর সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে না বুঝলে অনেকটাই না বোঝা থেকে যাবে।
হুগলী নদীর তীরের অবস্থিত চন্দননগর,ভদ্রেশ্বর,চাঁপদানী, রিষড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটির মতো জনপদগুলিতে সুদূর অতীত থেকেই জলপথের সুবিধার কারণে ডাচ, গ্রীক, জার্মান, ফরাসী, পর্তুগিজ, দিনেমার(ডেনমার্কের বণিকদের স্থানীয় উচ্চারণে 'দিনেমার' বলা হতো) ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রভৃতি ইউরোপীয় বণিকদের আগমনে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে প্রভাবিত হয়। বাংলার মুসলমানি আমলে বড়ো অংশ অবাঙালী মুসলিম প্রথমে ভদ্রেশ্বরে পরে অন্যান্য অঞ্চলে এসে বসবাস করতে থাকে। স্বাধীনতার আগে ও পরে এলাকার অর্থনৈতিক ক্ষমতা আস্তে আস্তে করায়ত্ত করে সাহু, তেওয়ারী,আগরওয়ালরা। জলপথে কাঁচামাল পরিবহনের সুবিধার জন্য অবিভক্ত নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার পাটের উপর ভরসা করে গড়ে ওঠে চটকলগুলি। মিলগুলিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো থেকে গরীব ও দলিত মানুষেরাও আসেন দলে দলে ,নদী তীরবর্তী মিল লাগোয়া অঞ্চলে বসতি ,শ্রমিক মহল্লা গড়ে ওঠে, এখানে যাকে লাইন বলা হয়। প্রসঙ্গত, ১৮৭২ সালে চাঁপদানীতে (ওম্যালি সাহেব,হুগলী ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার) এবং মতভেদে ১৮৫৫ সালে রিষরায় জর্জ অকল্যান্ড (হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ, সুধীর কুমার মিত্র, ১৯৪৮)বাংলায় প্রথম চটকল প্রতিষ্ঠা করেন। আমরা তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে দেখেছি অ্যাঙ্গাস, ভদ্রেশ্বর, ভিক্টরিয়া, গোন্দোলপাড়া এই চারটি উল্লেখযোগ্য জুটমিল, যেখানে উপদ্রুত অঞ্চলের শ্রমিকরা কাজ করেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাম শ্রমিক আন্দোলনের অনেক সক্রিয়তার সাক্ষী হুগলী তীরের জুটমিলগুলো, কিন্তু সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পরে তথ্যানুসন্ধান গিয়ে ‘আমরা’ দেখেছে শ্রমিক মহল্লার নূন্যতম জীবনধারণের সুবিধাগুলোর দিকে লেঅফ, ছাঁটাই, মজুরীবৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যুতে ব্যস্ত থাকা মজদুর ইউনিয়ন গুলোও তাকায়নি, ভদ্রেশ্বর পুরসভাও তাকায়নি। পানীয় জলের সমস্যা, স্বাস্থ্যের সুরক্ষার মতো বিষয়ে কথা উঠলে ধর্ম নির্বিশেষে মহল্লার বাসিন্দারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্যপরিসংখ্যান সূত্র দেবে যে অতীতে শ্রমিক মহল্লা গুলিতে বারবার জলবাহিত বা জীবাণু বাহিত সংক্রমক অসুখ ছড়িয়েছে। নদী পারাপারের ঘাট সংস্কার নিয়ে কথা উঠতে সাম্প্রতিক অতীতে তেলিনিপাড়া ঘাটের দুর্ঘটনার কথাও উঠে আসে।
কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন-
১) প্রথমেই প্রশ্ন থাকবে চন্দননগর,ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানি কি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নতুন দেখছে? উত্তর না। তথ্যানুসন্ধানের কাজে যুক্ত ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর এক স্থানীয় সহকর্মী যেমন জানালেন ২০০৫ সালে তার কৈশোরে তিনি এলাকায় সংঘর্ষের কারণে ৪ মাস কারফিউ দেখেছেন, তেমন রাজ্য সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মীর স্মৃতিতে উঠে এলো যুক্তফ্রন্টের আমলে দাঙ্গা বাধতে তৎকালীন পুলিশ মন্ত্রী জ্যোতি বসু এলাকায় দাঁড়িয়ে ‘দেখামাত্র গুলি’-র আদেশ দিয়েছিলেন। বোঝায় যাচ্ছে দাঙ্গার এক ধারাবাহিক ইতিহাস আছে চন্দননগর-ভদ্রেশ্বর-চাঁপদানিতে।
২) তেলেনিপাড়ার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটা উঠছে যে, এটা তেলিনীপাড়া অঞ্চলে শুরু হলেও চন্দননগর উর্দিবাজার থেকে ভদ্রেশ্বরের আরও কিছু জায়গায়ও বিক্ষিপ্তভাবে ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই একে ‘তেলিনিপাড়া দাঙ্গা’ বলা হবে কিনা? বা আদৌ ‘দাঙ্গা’ বলা যাবে কিনা? যদিও সাধারণ ও ব্যবহৃত শব্দের দিকেই আমরা আস্থা রেখেছি। মুখোমুখি দুই সম্প্রদায়ের সশস্ত্র সংঘর্ষ প্রায় ঘটেনি বললেই চলে। প্রাণহানি, বা যৌন অপরাধ যা দাঙ্গার দুটি সার্বজনীন লক্ষণ তাও ঘটেনি, তবে ঘটেছে ব্যাপক লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, সম্পত্তিহানি, আর অপরপক্ষকে সন্ত্রস্ত করা, এবং স্থানচ্যুত করার উদ্দেশ্যে ভয় এর পরিবেশ বজায় রাখা। আহতের তথ্য আমরা জেনেছি, কিন্তু ‘অনেকে আহত হয়েছেন’-এই তথ্যর সত্যতা জানা যায়নি।
৩) বেছে বেছে বাড়ি, দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজাবাজার অঞ্চলের হিন্দু পরিবারগুলি, বা দিনেমারডাঙার সারি দিয়ে পুড়ে যাওয়া মুসলিম বাসিন্দারা, সবাই জানাচ্ছেন অন্য সম্প্রদায় তাদের উচ্ছেদ করে দিতে চায়, তাই আবারও যেকোনও দিন হামলা হতে পারে। অতীতে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ দেখলেও মূলতঃ মুসলিমরা জানান এতোটা পরিকল্পিত ও সংগঠিত আক্রমণ তারা এর আগে দেখেননি।
সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। 'আমরা এক সচেতন প্রয়াস' কালিয়াচক থেকে ধুলাগড়, বসিরহাট থেকে রাণীগঞ্জ আসানসোল, বা অতি সম্প্রতি গঙ্গার এপার ওপারে ভাটপাড়া ও তেলিনিপাড়ায় ঘটে যাওয়া সংঘর্ষের নিবিড় তথ্যানুসন্ধানের কাজ করেছে। পশ্চিমবঙ্গে দাঙ্গার একটা প্যাটার্ন বা ধাঁচা, ছক খুঁজতে চেয়ে যেটা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়েছে তা হলো পলিটিক্যাল রিলিজিওন বা রাজনৈতিক ধর্মের রিভাইভ্যাল বা নবোত্থান, যা গোটা দেশের গত একদশকের পালাবদলেরই সমান্তরাল। ‘আমরা’ একটি বাক্যে যার নির্যাস টানে ‘হিন্দু আরও হিন্দু হয়েছে, মুসলমান আরও মুসলমান’। তেলিনিপাড়ার ক্ষেত্রেও ছবিটা একই, হুগলী পাড়ের চটকল অর্থনীতি নির্ভরশীল জনপদ দাঙ্গা আগেও দেখেছে বারবার। দলিত হিন্দু আর গরীব মুসলিম পাশাপাশি থেকেছে, ‘পার্থক্য’ নিয়েই, অসূয়া সংঘর্ষে গড়িয়েছে আবার রুটি রুজির নৈমিত্তিক সমস্যায় তা থিতিয়েও গেছে। কিন্তু লাগাতার রাজনৈতিক ইন্ধন এবারের ছবিটায় নতুন কিছু উপাদান যোগ করেছে, ‘আমরা’ এটাকে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন হিসেবেও দেখছে। সহাবস্থানের যুক্তিকে যেখানে অসহিষ্ণুতার যুক্তি পর্যুদস্ত করে ফেলছে। ‘আমরা’-র তথ্যানুসন্ধানে উঠে আসা স্থানীয় বাসিন্দাদের মৌখিক অভিযোগ, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা আর মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো সংঘর্ষ ক্ষয়ক্ষতির ছবি, রাজনৈতিক নেতাদের বিবৃতি - এসব আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয় গত বছরে প্রায় একই ধাঁচে ঘটনা ঘটেছিলো নদীর ওপারে নৈহাটি ভাটপাড়ায়। বাইরে থেকে সশস্ত্র বহিরাগতদের জড়ো করা, ঘর দোকান বেছে বেছে লুঠ, সংগঠিত আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ,রাজনৈতিক নির্দেশে পুলিশ ও দমকলের রাশ টেনে রাখা,ঘটনাস্থলে দেরীতে পৌঁছনো, থানায় অভিযোগ না নিতে চাওয়া, দাঙ্গা ঠেকাতে সক্রিয় না হওয়া, অলিখিতভাবে প্রশাসনের মধ্যে রাজনৈতিক শিবিরে ভাগ হয়ে যাওয়া-এসব আসন্ন বিধান সভা নির্বাচনের আগে বারবার সংঘর্ষ ঘটার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে, এবং অতীতের তুলনায় নির্দিষ্ট ভাবে পার্থক্য চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। প্রসঙ্গতঃ বসিরহাটের ক্ষেত্রে নমঃশুদ্র ও পৌন্ড্রক্ষত্রিয়দের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ক্রবর্ধমান সক্রিয়তা যেভাবে লক্ষ করা গেছে, সেভাবেই ভাটপাড়া ও তেলিনিপাড়ার ঘটনায় হিন্দিভাষী দলিত হিন্দুদের মধ্যে অসূয়া ও আগ্রাসন রোপন করা হচ্ছে। রাণীগঞ্জ আসানসোলের তথ্যানুসন্ধানের সময়ও দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রামনবমীকে কেন্দ্র করে নতুন ‘পরিকল্পিত আগ্রাসন’-এর দিকে আঙ্গুল তুলেছেন। বলেছেন রামনবমীর জুলুস মিছিল বহু বছর ধরেই স্বাভাবিক ধর্মীয় আচরণ হিসেবে দেখেছেন তারা কিন্তু সম্প্রতি তার বদলে যাওয়া চেহারা তাদের ভয় ধরাচ্ছে। ‘আমরা’ খতিয়ে দেখেছে, লুঠ, আগুন লাগানো, অন্য সম্প্রদায়কে এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার ভয় দেখানো- এগুলো ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে। গোটা রাজ্য জুড়ে ছোট ছোট মাত্রার দাঙ্গা ঘটিয়ে চলা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনার অংশ। তেলেনিপাড়ার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী মানুষ ‘আমরা’কে জানিয়েছেন এবারের দাঙ্গা দেখে তাদের মনে হয়েছে ‘এত বছর থেকেছি, কিন্তু আর বোধহয় থাকা যাবে না, চলে যেতে হবে’। কোথায়? তারা জানেন না কোথায়। ‘আমরা’ টের পেয়েছি, হয়তো সত্যিই উচ্ছেদ লক্ষ্য নয়, সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ভীত সন্ত্রস্ত এক সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’-র কুঁকড়ে থাকা নাগরিকে পরিণত করা। আর অগ্রাসী ধর্ম সাংগঠনিক ভাবে নিজের অনুগামীদের আত্মবিশ্বাস দিতে চায়, কাজ না থাকা যুবকদের ঝিমিয়ে পড়তে না দিয়ে ‘দাঙ্গা’র নেশায় ডুবিয়ে রাখে। যুবকদের অনেকের রিংটোনে রামকে নিয়ে অধুনা প্রচলিত ঝংকার সমৃদ্ধ গান। তেলিনিপাড়াতেও অভাব বেরোজগারী ভোলাতে পরিচিত রাস্তাই বেছে নেওয়া হয়েছে।
(খ)
সামাজিক (ও সমাজ-মনের), রাজনৈতিক (ও প্রশাসনিক) চিহ্নগুলি
১। প্রাচীর দীর্ঘ ও মজবুত হচ্ছে। দাঙ্গাগ্রস্ত পাইকপাড়া এলাকায় ত্রাণ শিবির করা হয়, দুই সম্প্রদায়ের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের অনেকেই আসেন। আরও কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয় দুই সম্প্রদায়ের মন বুঝতে, কাছাকাছি আনতে। বলা যায়, প্রাচীরে ফাটল ধরানো এখনও দূরের নক্ষত্র।
২। লকডাউন পর্বে, করোনা অতিমারির ঘোর দুর্দিনে এই সাম্প্রদায়িক অশান্তি। করোনাকে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের রক্তাক্ত নজির। বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের এবারের সাম্প্রদায়িকতায় শামিল হওয়া। শ্রমিক বস্তিগুলোতে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের শূন্যতা। সূচক একাধিক।
৩। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব হিন্দু ও মুসলমান শিবিরে বিভক্ত। অর্থাৎ হিন্দু নেতা হিন্দুদের হয়ে, মুসলিম নেতা মুসলিমদের হয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভাজনে, হিংসায় শরিক হয়েছে। আরএসএস-এর উপস্থিতি যতটা না প্রকট তার চেয়ে বেশি প্রকট সমাজমনে হিন্দুত্বের উপস্থিতি। সংগঠিত আক্রমণ, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে আরএসএস মাথা কাজ করছে, তেলেনিপাড়ার বাতাসে বারুদের গন্ধ প্রকট।
৪। গঙ্গার দুইপারের বিজেপির দুই সাংসদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রশ্নাতীত। অথচ তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোন আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আইনি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া তো দূরের কথা কোন দলীয় তদন্তের কথা জানা যায়নি তৃণমূলের অভিযুক্ত কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। ঘৃণা ও সন্দেহ ছড়ানোর দায়ে সোশ্যাল মিডিয়ার কোন গ্রুপের বিরুদ্ধে সাইবার অপরাধের কোন ধারা প্রয়োগের খবর নেই। যদিও প্রায় এক পক্ষ কাল এই অঞ্চলে বন্ধ করা হয়েছিল ইন্টারনেট পরিষেবা।
৪। প্রশাসনের ‘দাঙ্গা করতে দেওয়া’, বিভিন্নভাবেই স্পষ্ট হয়েছে। ২০২১ সালের নির্বাচনের আগে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করতে হলে মিথ্যা প্রচার, উত্তজনা, দাঙ্গা দরকার হবে। এটি ঘটমান বর্তমান।
৫। হুগলী নদীর দুই পার (এবং সারা রাজ্যেই) ধরে বিগত চার বছরে উৎসব, পূজাপার্বণ-এর বৃদ্ধি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নজরে আসে। উৎসবের সার্বজনীনতার, জৌলুসের পাশাপাশি রাজনৈতিক ধর্মের উত্থান ঘটে চলেছে। মিশ্র জনবসতি এলাকায় এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিযোগিতা। বারুদ মজুদ থাকলে একটা দেশলাই যথেষ্ট।
৬। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিক হয়ে হিন্দি বলয়ের শুরু। শেষ হয়েছে, রাজস্থানে। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দুত্বের সামাজিকীকরণ প্রায় সম্পূর্ণ। পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশ, শরিয়তি ইসলামের সামাজিকীকরণ সেখানেও প্রায় সম্পূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ক্রমে সংঘর্ষের চিহ্নগুলি ফুটে উঠেছে। সমাজ হস্তগত হলে, রাজনৈতিক ধর্মের জয় হাসিল করা সহজ হয়ে ওঠে।
সংযোজনী-
১।
|
Thu, Jun 11, 4:27 PM |
|
||
|
To Date-11.06.2020
The Commissioner
Chandannagore Police Commissionerate
Chandannagore, Hooghly.
Subject: Police excess committed in Telinipara upon Human rights activists.
Dear Sir,
On behalf of AAMRA EK SACHETAN PRAYAS FORUM (an organization working on conflict resolution and civil rights), we are drawing your urgent attention and to take prompt and needful action as on the following facts as we were wrongfully restrained in police Outpost at Telinipara under Bhadreswar Police Station for several hours on 10 June, 2020 by the Officer-in-charge of the said Police station under your Commissonerate.
Since our inception of the oranisation, we have been working as a research group on Conflict and peace study by way of documentation, analyzing and publishing reports and acting as peace volunteers by initiating peace process. We are also providing support and aid to the victims on humanitarian ground according to our organizational capacity.
Under continuation of our work, we went to Telinipara on 10.6.2020 and met the victims living in the camp from both communities who were affected by recent communal violence. They took shelter in Faiz Ahmed Faiz Urdu High School, Haji Muhammad Mohosin Primary School and Gondolpara Sastri Hindi School. We met some of them and also with some individuals of the area. The people we met, by and large requested us to provide them support like arranging Medical camp, awareness program on health, providing garments etc. We assured them that we would try to arrange and fulfill their requirement with our resources and taking help from other friendly right based organizations and also after getting permission from administration, if required. When we were discussing with one victim in his house near Pakija, FG Street, Telinipara, some Police personnel appeared there and asked two of our colleagues, Faruque Ul Islam and Suvankar Sengupta about their purpose of visit. Our colleagues replied that we were talking with the victims as they requested us, to assess their loss, damages and allied problems. Kaushik Kumar Banerjee, Inspector-in-Charge, Bhadreswar Police Station asked them why they came there and why they were taking photographs. Our fact-finding team replied that they were free to come there as there was no prohibiting order under section 144 of Cr.P.C. then, and politely informed the police that they came to the place to discharge their duties as a right based organization and to function as social research group. But the police took our team at Telinipara Outpost at about 1.58 p.m. After getting information about such development, two other members of our organization, Subha Protim Roy Chowdhury and Amitava Sen Gupta who was at that time at Faiz Ahmed Faiz Urdu High School went to said Police Outpost. All members of our team were made to sit in the police station for One hour without any call from deputed Police officer.
Finally, at about 3.20 pm, two police officers interrogated us. One of them was Kaushik Kumar Banerjee, IC, Bhadreswar Police Station. They accused us alleging that though section144 was not imposed there, our entry was illegal and we should have taken permission from Police Station before entry, we were also accused of doing illegal work by talking with the people and also blamed us of instigating the people. All these allegations were without any substance and our organization went there on purely benevolent and research purpose. We repeatedly disclosed our purpose of visit and also told the police officers that it is our fundamental right to enjoy free movement anywhere within the country and to meet anyone unless prohibited by law. The second officer of the outpost told us aggressively that he could arrest us by six or more than six charges. Both officers threatened us repeatedly. They took possession of our camera and through their laptop scanned it several times by infringing out right to privacy. They noted down our names, addresses and other personal details which we shared merrily and after 40 minutes we were told that we could leave this outpost when officer in charge of said outpost would give consent. Finally, Mr. Atanu Maji, officer in charge of Telinipara Outpost permitted us to leave the police outpost.
Entire incident was unfortunate and we visited the concerned area number of times and the local people have confidence in our organisation. Whisking our team to police station from the spot with mere allegation of talking to the affected people is purely against the spirit of law and gross violation of human rights. We being the citizens of a free country can move anywhere and can talk to any people of our choice and eligible to probe into the problem of the people. The interference by the police officers by this manner, interrogating us and threatening us to rope in police case, detaining in police outpost for hours are blatant attack on our personal life and liberty. Our democratic state does not permit such action of police.
It is absolutely illegal demand of the police to seek permission from them for every visit to the area by our organisation. We have been conducting our research work in said area with different civil liberty groups for long and the police interference is absolutely unwarranted.
Hence, you are requested to look into the matter and take appropriate step against the concerned police officers and ensure our organizational right to work freely in the area as a registered research group and we earnestly desire to continue our work in Telinipara and other area.
Thanks and regards.
Mohit Ranadip
Subha Protim Roy Chowdhury
Directors, AAMRA EK SACHETAN PRAYAS FORUM
(An Assemblage of Movement Research and Appraisal)
২।
মুখ্যমন্ত্রী সমীপেষু
মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গ
নবান্ন, হাওড়া
মাননীয়া,
লকডাউন পর্বে অধিকার রক্ষাকর্মীদের ওপর আক্রমণের প্রতিকার চেয়ে দাবীসনদ
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গণসংগঠন যারা মানুষের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আজ সারা রাজ্যে অধিকার রক্ষাকর্মীদের ওপর লকডাউন পর্বে নেমে আসা আক্রমণের প্রেক্ষিতে নিম্নবর্ণীত দাবীসনদ পেশ করছে। পরিযায়ী শ্রমিক, আমপানে ক্ষতিগ্রস্ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে, তাঁদের নায্য দাবী তুলে ধরতে গিয়ে আজ অধিকার রক্ষাকর্মীরা প্রশাসন ও শাসকদলের আক্রমণের শিকার।এখানে গত ২৩ মার্চ, ২০২০ থেকে বলবৎ লকডাউন পর্ব হতে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার কর্মীদের ওপর আক্রমণের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ রাখা হল। ২৩ মে, ২০২০ জল ও বিদ্যুতের দাবীতে দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুর বিডিও অফিসে বিক্ষোভ দেখচ্ছিলেন স্থানীয় মানুষ। বিডিও পুলিশ ডাকেন, পুলিশ এসে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে। উপস্থিত জনতা প্রতিরোধ করলে পুলিশি আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। র্যা পিড অ্যাকশান ফোর্সের জওয়ানরা ও পুলিশ বাড়ি বাড়ি ঢুকে মহিলাদেরও মারধর করে। মানবাধিকার সংগঠন, এপিডিআর-এর কর্মী সরোজ বসুর বাড়ি বিডিও অফিসের কাছে। তিনি এবং এলাকার অন্যান্য কয়েকজন বয়স্ক মানুষ পুলিশের মারধোরে আপত্তি জানিয়ে কথা বলতে গেলে পুলিশ তাদেরই ধরে সোনারপুর থানায় নিয়ে যায়। সেখানে মারাত্মক কয়েকটি ধারা, (যেমন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৮৬/৩৪১/৩২৩/৩৫৩/৩৬৭/৪২৭/৩৪ এবং ওয়েস্ট ৯ বেঙ্গল মেন্টিনেন্স অফ পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট, ৩ প্রিভেনশান অফ ড্যামেজ টু পাবলিক প্রোপার্টি অ্যাক্ট)দিয়ে তাঁদের (মোট ১১ জন)গ্রেফতার করা হয়। পরে কোর্টে তুললে কোর্ট-এর রায়ে তাঁদের ১৪ দিনের জন্য জেল হয়। গত ৫ জুন তাঁদের জামিন হয়।
গত ১০ জুন, ২০২০ হুগলী জেলার তেলেনিপাড়ায় ক্ষেত্র গবেষণা এবং অধিকার সংগঠন ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর চারজন সদস্যকে দুই ঘণ্টার অধিক সময় ভদ্রেশ্বর থানার অধীন তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে আটক করে রাখা হয়। এলাকায় ১৪৪ ধারা না থাকায় তাঁরা এসেছিলেন এবং সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন আশ্রয় নিয়েছিলেন একাধিক সরকারি বিদ্যালয়ে, তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। ভদ্রেশ্বর থানার আই সি, কৌশিক কুমার ব্যানার্জি এবং একজন আই পি এস পুলিশ আধিকারিক তাঁদের গ্রেফতারের হুমকিও দেয়।মানুষের সঙ্গে কথা বলার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। ‘আমরা’র পক্ষ হতে তাঁদের জানানো হয় ‘এখানের মানুষ লকডাউন, দাঙ্গা এবং আমপান-ত্রিবিধ আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত, আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াতে চাইছি’। উত্তরে উক্ত পুলিশ আধিকারিক বলেন, ত্রাণের জন্য অনুমতি নিতে হবে এবং ত্রাণ সামগ্রী থানায় জমা দিতে হবে। ‘আমরা’-র পক্ষ থেকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে জানিয়ে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের দাবী জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়।
গত ১১ জুন, ২০২০ সকালে মুর্শিদাবাদে পুলিশি জুলুমের শিকার হন অধিকার রক্ষা কর্মীরা।সমস্ত রাজনৈতিক, মানবাধিকার, সমাজ কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি, সোনারপুরে সরোজ বসু সহ ১১ জনের উপর থেকে সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহারের দাবীতে; নিভৃতবাসে আটক ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত জল ও খাবার সরবরাহের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে এপিডিআর, বহরমপুর শাখা সভার আয়োজন করে। লকডাউন বিধি মেনে দশজন অধিকার রক্ষা কর্মী নাক মুখ চাপা দিয়ে, আন্ত ব্যবধান বজায় রেখে সভা শুরু হয়। টোটোতে পতাকা ও মাইকের যন্ত্র রেখে সভা হচ্ছিল বহরমপুরের কান্দি বাস স্ট্যান্ডে। মিটিং শুরুর সময় পুলিশ প্রচুর ঝামেলা করে। বলে সভা করা যাবে না। মিটিং শেষ হতেই রাস্তা থেকে টোটো 'সিজ' করে বহরমপুর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। সন্ধায় ছাড়ে বহু ঝামেলার পর। ২২ জুন সোমবার বিকেলে ধর্মতলার লিন্ডসে স্ট্রিটে জড়ো হন 'জনগণমন'-এর কর্মীরা; উদ্দেশ্য গান গেয়ে, আমফান বিষয়ক পথনাটক করে পথচলতি মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলা। উল্লেখ্য আমফান-ত্রাণের জন্য রাস্তায় নেমে চাঁদা তোলার কর্মসূচি নিয়েছে 'জনগণমন'। লকডাউন পরবর্তী আনলক পর্বের যাবতীয় নিয়ম মেনে, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু, সে সব শুরু করার আগেই নিউ মার্কেট থানার সেকেন্ড অফিসার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এসে কাজে বাধা দেয়। জানানো হয়, কলকাতা পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও চলবে না; শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেও নয়।নিরুপায় হয়ে 'জনগণমন'-এর তরফে পথনাটক ও আমফান-ত্রাণের চাঁদা সংগ্রহ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, ২২ জুন, ২০২০-এই তারিখেই রাজ্যের দুই জেলায় দু'টি পৃথক ঘটনায় আমফান-ত্রাণ প্রদানকারী স্বেচ্ছাসেবীদের ওপর হামলা ও পুলিশি ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটেছে। উঃ ২৪ পরগনার দেগঙ্গায়, প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্বে সেদিন বিডিও অফিসে অবস্থান করেছিল ১৩টি পঞ্চায়েতের ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ।দাবি ছিল, ত্রাণ-দুর্নীতি বন্ধ করা ও একশো দিনের কাজ। বিকেলে তাঁদের ওপর ব্যাপক হামলা চলে। অভিযোগ, হামলা চালায় এলাকায় ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা। অভিযুক্ত শাসক দলের দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে ১৪ জন আক্রান্ত ছাত্রছাত্রী-গ্রামবাসীদেরই গ্রেফতার করে পুলিশ। দেগঙ্গার গ্রামে গ্রামে শাসকদলের নেতারা সেদিনের মিছিলে আসা মানুষজনের উপরে নানা ধরনের অত্যাচার শুরু করে। দমদম জেলে বন্দি আছেন যাঁরা তাদের সঙ্গে বাড়ির লোকজনকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ লকআপে থাকা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জুবি সাহা এবং শাওনকে জেরার নামে নানা মানসিক অত্যাচার চালানো হচ্ছে। বাড়িতে রেইড করে বইপত্র ল্যাপটপ ইত্যাদি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২৮ জুন তাঁদের জামিন হয়। অন্য ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চণ্ডীপুর থানা এলাকার। ২২ জুন ২০২০ সেখানে ত্রাণ বণ্টন করতে যান 'আরএসএফ' ছাত্রগোষ্ঠীর ছাত্রছাত্রীরা। স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস দলের পঞ্চায়েত প্রধানের সঙ্গে বিবাদ হয়। একাধিক ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। উপরিউক্ত ঘটনাগুলি প্রমাণ করে পশ্চিমবঙ্গে এইসময়ে অধিকার কর্মীদের কিভাবে পুলিশি হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে, বেআইনি আটক করা হচ্ছে, মিথ্যা মামালায় ফাঁসানো হচ্ছে। কিভাবে রাজ্যের শাসক দলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতিরা বাধা দিচ্ছে ত্রাণ কাজে, কিভাবে তারা পুলিশের মদত পাচ্ছে। তথ্যায়নের কাজে, ত্রাণের কাজে, ন্যায়সঙ্গত গণআন্দোলনের জন্য এই হেনস্থা, জেল, লকআপ প্রাপ্য তাঁদের নয়।
ভারতের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার রক্ষায় অধিকার রক্ষা কর্মীরা কাজ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুচ্ছেদ ৯ অনুসারে কাউকেই বিধিবহির্ভূত উপায়ে গ্রেফতার, আটক করা যায় না। অনুচ্ছেদ ১৮, ১৯ এবং ২০ অনুসারে যথাক্রমে প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তার অধিকার, মতামতের ও মতপ্রকাশের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার আছে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ এইগুলি লঙ্ঘন করে চলেছে। একই সাথে শাসকদলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতিরা আইনকে অবমাননা করে নিজেরাই সমান্তরাল প্রশাসন হয়ে উঠেছে।শাসকদলের নেতারা গ্রামে গ্রামে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি এবং ত্রাস চালাচ্ছে।
নিম্ন-উল্লিখিত অধিকার সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে আমাদের দাবী- ক) মানবাধিকার কর্মী, গণ-আন্দোলনের কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী ত্রাণকর্মী, গণসাংস্কৃতিক কর্মী-সহ গণতান্ত্রিক অধিকারকামী সকল সাধারণ মানুষের' হয়রানি, বেআইনি আটক, গ্রেফতারের হুমকি, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো বন্ধ হোক। খ) অভিযুক্ত পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। গ)অভিযুক্ত দুষ্কৃতিদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক। ঘ) ত্রাণ-দুর্নীতিতে যুক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হোক, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া হোক।
ধন্যবাদ তারিখ- ৪ জুলাই, ২০২০
ধীরাজ সেনগুপ্ত, এ পি ডি আর অমিতদ্যুতি কুমার, এ পি ডি আর রঞ্জিত শূর, এ পি ডি আর সুমন সেনগুপ্ত, সমমন, যাদবপুর বাসুদেব ঘটক, এখন বিসংবাদ মৌতুলি নাগসরকার, জয়েন্ট ফোরাম এগেইন্সট করোনা ক্রাইসিস অভিনব মাজি,জয়েন্ট ফোরাম এগেইন্সট করোনা ক্রাইসিস তিমির বসু, প্রতিবাদের অধিকার মঞ্চ রবিন চক্রবর্তী, প্রতিবাদের অধিকার মঞ্চ কস্তুরি বসু, পিপুলস ফিল্ম কালেকটিভ দ্বৈপায়ন ব্যানার্জি, পিপুলস ফিল্ম কালেকটিভ শুভঙ্কর দাশশর্মা, জনগণমন মণিদীপা সেন হালদার, জনগণমন বিশ্বজিৎ দাস, জনগণমন রাজা বিশ্বাস, জনগণমন মোহিত রণদীপ, আমরা এক সচেতন প্রয়াস ফারুক উল ইসলাম, আমরা এক সচেতন প্রয়াস শুভ প্রতিম, আমরা এক সচেতন প্রয়াস অমিতাভ সেনগুপ্ত, আমরা এক সচেতন প্রয়াস
(এই দাবীসনদ আমাদের পক্ষ হতে ৪ জুলাই, ২০২০ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে) |
৩।
|
Fri, Sep 4, 11:48 AM |
|
||
|
To
The District Magistrate
Hooghly
Respected Sir, 4 September, 2020
On behalf of AAMRA EK SACHETAN PRAYAS FORUM, a research group working on Conflict and Coexistence study is requesting your good office to provide us following information.
1. Goods of how many household were looted in communal violence on 10 and 12 June, 2020 at Telinipara under Police Station- Bhadreswar?
2. How many houses were burnt on 10 and 12 June, 2020 at Telinipara, Police Station- Bhadreswar?
3. How many household got compensation from West Bengal Government on said violence?
4. How many camps were running for the shelter of riot-victims on said violence?
Thanks and regards
Mohit Ranadip
Subha Protim Roy Chowdhury
Directors, AAMRA EK SACHETAN PRAYAS FORUM.
40/1 N.C Banerjee Road, Baidyabati, Hooghly-712222.
৪।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এ পাঠানো আমরা এক সচেতন প্রয়াস-এর তথ্যানুসন্ধান দলটিকে তেলেনিপাড়া ফাঁড়িতে পুলিশের বেআইনি আটক, শাসানি ও হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও মামলা-
দাঙ্গা চিত্রঃ
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.-
FACT-FINDING REPORT ON HALDWANI VIOLENCE OF FEBRUARY 8, 2024 AND ITS AFTERMATH
Violent incident occurred on 8.02.2024 in Banbhulpura,... -
‘We are same boat-brother’, Picnic of Bengal Peace Centre, Bhatpara, 26 December, 2021
Our aim is not to only talk about peace but to involve... -
The Language of the People by the River
The rivers that flow by the hills have strong current.... -
Muslims against Partition
'Muslims against Partition' is an important work for...