অপারেশান ‘বেটি উঠাও’ - সংঘ পরিবারের নাবালিকা পাচার

নেহা দীক্ষিত। নির্ভীক সাংবাদিকতার একটি প্রতিমূর্তি। বিগত ১০ বছরের সাংবাদিকতার কর্মজীবনে উত্তর দিল্লির মাদ্রাসার শিশু পাচার কিংবা সারান্ডার জঙ্গল কিংবা ওড়িশা ঝাড়খণ্ড সীমান্তের মাওবাদী সংগঠনগুলির শিশুদের সেনা প্রশিক্ষণ, এই সকল বিষয়ে তাঁর কলম তরোয়ালের ফলার মতো ঝলকে উঠেছে। আর এস এস পরিচালিত শিক্ষায়তনে কিশোরী মেয়েদের ‘ভজন’ ও ‘সংস্কার’ শেখানো হয়, যাতে ‘আরও ভালো হিন্দু’ হওয়া যায়, এই কর্মকান্ডের অন্তরালে যে কিশোরী পাচার চক্র কাজ করছিল, তারই সুলুক সন্ধানে তাঁর ‘অপারেশন বেটি উঠাও’।

অপারেশান ‘বেটি উঠাও’

সংঘ পরিবারের নাবালিকা পাচার

নেহা দীক্ষিত

অনুবাদ : সুমন নাথ

Conflict area study - 5

Operation ‘Beti Uthao’

(A fact finding report by Neha Dixit on behalf of Outlook India)

Published : 1st July, 2017

অপারেশান ‘বেটি উঠাও’

সংঘ পরিবারের নাবালিকা পাচার

প্রকাশ : ১৬, আষাঢ়, ১৪২৪ (১ জুলাই, ২০১৭)

তথ্যানুসন্ধান : নেহা দীক্ষিত

ফোটোগ্রাফ : সন্দীপন চ্যাটার্জী

সৌজন্যে : ‘আউটলুক’ এবং ‘কালধ্বনি’ পত্রিকা

অনুবাদ : সুমন নাথ।

অক্ষর বিন্যাস : ‘আমরা’- এক সচেতন প্রয়াস

সম্পাদনা, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করন : অনুপম দাস অধিকারী

প্রকাশক : ফারুক উল ইসলাম।

‘আমরা’- এক সচেতন প্রয়াস

৩৯৩, সার্ভেপার্ক, কলকাতা – ৭০০ ০৭৫

ফোন : ৯০৩৮৫ ৩০৬৯০, ৮০১৭৯ ৫৪১২৬

ই-মেল : aamrasachetan@gmail.com

মুদ্রণ : লেজার এইড ৩৫-এ/৩, বিপ্লবী বারীন ঘোষ সরণী,

কলকাতা – ৭০০০৬৭

বিনিময় : ২০টাকা

সচেতন প্রয়াস

নেহা দীক্ষিতের পাঁচ পর্যায়ের তদন্ত প্রতিবেদন হল, ‘অপারেশন বেবি লিফ্ট’ যা ‘আউটলুক’ পত্রিকায় ২৭ জুলাই, ২০১৬তে ছাপা হয়। প্রতিবেদনে জানা যায় কিভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আর এস এস অনুমোদিত ‘রাষ্ট্রীয় সেবিকা সমিতি’, ‘সেবা ভারতী’ ও ‘বিদ্যাভারতী’ ৩১টি উপজাতি কিশোরীকে আসাম থেকে পঞ্জাব ও গুজরাটে ‘হিন্দুকরণ’-এর উদ্দেশ্যে পাচার করেছে, কিভাবে লঙ্ঘন করেছে। ভারতীয় আইন এবং আন্তর্জাতিক আইন। ২০১৫ সালের জুন মাসে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে তাদের বাবা মায়ের কাছ থেকে অবৈতনিক শিক্ষার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চালান করা হয়। তার পর থেকে বাবা মায়েদের কাছে মেয়েদের কোন খবর নেই। স্বাধীন সাংবাদিক হিসাবে নেহা পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে প্রথমে ঘটনাটির অনুমান-ধারণা তুলে ধরেন। কাহিনীটি মঞ্জুর হলে লেখা শুরু করেন।

উল্লেখ্য সাংবাদিক জীবনের বিগত ১০ বছর নেহা শিশু পাচার নিয়ে একাধিক কাজ করেছেন। ২০১০ সালে উত্তর দিল্লির কিছু মাদ্রাসায় শিশু পাচার নিয়ে তার প্রতিবেদন যথেষ্ট আলোড়ন তোলে। প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে উদ্ধার হয় ২৫০টি শিশু। একই রকমভাবে সারান্ডার গভীর জঙ্গলে বা ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে কয়েকটি মাওবাদী সংগঠন কিভাবে শিশুদের সেনা প্রশিক্ষণ দেয় তা জানা যায় তাঁর লেখায়। এইসব কাজের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় স্তরে পরিচিত হন নেহা, পান পুরস্কারও। নেহা দীক্ষিতের কথায়, “এই কাজের জন্য আমি তখন ‘হিন্দু মৌলবাদী সংঘী’ বা ‘পুঁজিবাদের দালাল’ বলে কোন গালাগাল শুনিনি। কিন্তু ‘অপারেশন বেটি উঠাও’ চিত্র পাল্টে দিল। এটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুপঠিত ও প্রচারিত হয়। আক্রমণ আসে আর এস এস ও ভারতীয় জনতা পার্টি থেকে। যুক্তিহীনভাবে তারা আর এস এস-এর কন্যা শিশু পাচারকে সমর্থন করতে থাকে। তারপর চলে তুমুল গালিগালাজ। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি আপলোড করে লেখা হয় নেহা দীক্ষিতের ঘরে এই পুরুষটি কে?”

জানুয়ারি ২০১৭তে কালধ্বনি পত্রিকায় ‘সংবাদমাধ্যম কাদের হয়ে শব্দে শব্দে বাক্য গড়ে’ এই শিরোনামে নেহা দীক্ষিতের একটি লেখা অনূদিত হয়। তিনি জানান কোন সরকারী বা রীতিসম্মত শিক্ষালয়ে মেয়েগুলিকে ভর্তি করা হয়নি। সরজমিনে তদন্ত করে নেহা জানতে পারেন আর এস এস পরিচালিত শিক্ষায়তনে তাদের ‘ভজন’ ও ‘সংস্কার’ শেখানো হচ্ছিল, যাতে ‘আরও ভালো হিন্দু’ হওয়া যায়। নেহা বিভিন্ন পর্যায়ে মেয়েদের ও তাদের অভিভাবকদের, আর এস এস কর্মী, সরকারী আধিকারিকদের সাক্ষাৎকার নেন। গৌহাটি হাইকোর্টে ঐ লেখা প্রকাশের জন্য সহকারী সলসিটর জেনারেল পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্ত হন নেহা। কিশোরী মেয়েদের পাচারের বিষয়টি লঘু হয়ে যায়, বাতাসে ভাসতে থাকে সাংবাদিক হিসাবে নেহার যোগ্যতা, এই লেখার পিছনের অভিসন্ধি, নেহার চরিত্র। সম্পাদককে কোন কৈফিয়ত ছাড়াই সরিয়ে দেয় পত্রিকা কর্তৃপক্ষ।

বাস্তবতা হল নেহা এর আগেও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। খাপ পঞ্চায়েত বা অনার কলিং নিয়ে লেখার সময়। হুমকি দেওয়া হয়েছে দৈহিক নির্যাতনের। কনে পাচার নিয়ে লিখতে গিয়ে শুনেছেন ধর্ষণের হুমকি। তাঁর বয়ানে, “প্রায়ই বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে ধারাল লোহার রড বা কাঁটার ফলা আমার গোপনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে; যখন লিখছি লাভ জেহাদ নিয়ে তখন আমাকে ‘লস্কর-এ তৈবা’-র সদস্য বলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এইসব ভয় দেখানো, সাংবাদিকদের চুপ করানোর পক্ষে যথেষ্ট।”

নেহার ওপর এই আক্রমণ প্রমাণ করে নির্ভীক সাংবাদিকতা এবং বিশেষত ‘অপারেশন বেটি উঠাও’ ক্ষমতার কোন মৌচাকে ঢিল ছুড়েছিল। কিশোরী পাচারে সংঘ পরিবারের জড়িত থাকার এই অকাট্য প্রমাণ আর এক বার মুখোশ খুলে দেয় হিন্দুত্ববাদীদের। আমাদের পক্ষ থেকে ‘অপারেশন বেটি উঠাও’-এর বাংলা সংস্করণের প্রস্তাব যায় নেহার কাছে, সাগ্রহে সম্মতি জানান তিনি। ইতিমধ্যে পরিস্থিতির যা যা পরিবর্তন হয়েছে তা জানিয়ে কিছু সংযোজন পাঠান তিনি।

আমরা (AAMRA- An Assemblage of Movement Research and Appraisal, Kolkata), কলকাতার প্রকাশনা, আমরা এক সচেতন প্রয়াস থেকে এই প্রতিবেদন আমাদের সঙ্ঘর্ষ সমীক্ষা’ (Conflict Study) ধারাবাহিকতায় এক ব্যাতিক্রমী প্রয়াস, যার ক্ষেত্র সমীক্ষায় আমরা যুক্ত ছিলাম না। রাজনৈতিক ধর্মের উপনিবেশ বিস্তারের প্রকল্পে কিশোরী পাচার পশ্চিমবঙ্গে একটি তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত বা অনালোচিত দিক। আমাদের উদ্দেশ্য সেই তথ্য উন্মোচিত করার। আর এস এস-এর কিশোরী পাচার কাণ্ড বাঙালি পাঠকদের সামনে তুলে ধরার। মৌল ধর্ম এবং রাজনৈতিক ধর্মের স্বরূপ প্রকাশে আমাদের প্রচেষ্টা জারি থাকবে।

অনুপম দাস অধিকারী

আমরা’র পক্ষে

সংঘের ধর্মযুদ্ধ, শিশু চুরি

কিভাবে সংঘ পরিবার দেশের প্রত্যেকটি শিশু বিষয়ক আইনকে অবজ্ঞা করে ৩১টি জনজাতি শিশুকে অসম থেকে পঞ্জাব এবং গুজরাটে পাচারের মাধ্যমে তাদের ‘হিন্দুকরণ’ করে এবং এর ফলে তাদের বাবা-মায়েরা কতটা হতাশ হয়।

২০১৫ সালের এক বৃষ্টি মুখর জুন মাসের ৯ তারিখ ববিতা গুজরাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আসামে সেই সময় দ্বিতীয় বারের জন্য বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। এই সময় গ্রামের চারিদিক সবুজ হয়ে ওঠে, আর ‘খাঙ্গক্রাই’ কাঁকড়ারা বানভাসি হয়ে গর্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে বাধ্য হয়। থেবা বাসুমাতারি, ববিতার বাবা। ওনার বিঘা তিনেক জমি আছে আর সেখান থেকেই ববিতা কাঁকড়াদের উঠে আসা দেখত। লালচে খয়েরি রঙ এর আট পা ওলা প্রাণীগুলোকে দেখে আট বছরের ববিতার আনন্দের সীমা থাকত না। দু হাত তুলে খুসিতে নাচতে থাকতো সে।

প্রতি বর্ষায় ববিতা কাঁকড়া ধরে বাঁশের চুপড়ি তে তুলে রাখত এবং রান্না করে দেবার জন্য বায়না করত তার মায়ের কাছে। ২০১৫ সালেও তাঁর ব্যাতিক্রম হয়নি। ববিতার মা চম্পা’র মনে পড়ে, যাবার আগের দিন ববিতাকে তিনি অনেক ঝক্কি সত্ত্বেও খাঙ্গাই কাঁকড়া রান্না করে খাইয়েছিলেন। মেয়ে তো এই খাবার হস্টেল-এ পাবে না! থেবা, এই কথা শুনে উঠে পড়েন, দেওয়ালের দিকে হেঁটে গিয়ে বলে ওঠেন, “তোমরা চুপ করবে?” এই কথা বলার সময় তাঁর চোখ ভিজে ওঠে।

৯ তারিখ করবী বাসুমাতারি ও সন্ধ্যাবেন তিকদে, ববিতা সহ ৩ থেকে ১১ বছর বয়েসি, আরো একত্রিশ জন আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে চাপেন। কথিত উদ্দেশ্য এদের পড়াশোনার দায়িত্ব এখন থেকে ওঁদের। ওঁরা বলেছিলেন মেয়েদের পাঞ্জাব ও গুজরাটে নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাবেন। এঁরা সংঘ পরিবারের রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি এবং সেবা ভারতি’র সাথে যুক্ত। এই তিরিশ জন মেয়ে অসমের সীমান্তবর্তী জেলাগুলি যেমন কোকরাঝাড়, গোয়ালপাড়া, ধুবরি, চিরাং, এবং বঙ্গাইগাঁও ইত্যাদির অধিবাসী। একবছর হয়ে গেল, ববিতা সহ বাকি কারোরই কোন খবর নেই। সেই ৯ তারিখের পর থেকে কোন পরিবারই তাদের সন্তানের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন নি।

তিনমাস ব্যাপি একটি অনুসন্ধানের মাধ্যমে ‘আউটলুক’ পত্রিকা সংঘ পরিবারের এই জঘন্য কার্যকলাপ জনসমক্ষে তুলে আনেন। এই তথ্যভিত্তিক গবেষণার ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার হয় যে, সংঘ পরিবার দ্বারা পরিচালিত সংস্থা গুলি গুজরাত ও পঞ্জাব সরকারের সাহায্য নিয়ে Assam State Commission for the Protection of Child Rights (ASCPCR), The Child Welfare Committee (CWC), Kokrajhar, The State Child Protection Society and Childline ইত্যাদি সরকারি দপ্তরের সমস্ত নিয়ম অগ্রাহ্য করে এই সমস্ত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়।

চম্পা বসুমাতারি, বছর গড়াতে চললো, এখনো জানেন না মেয়ে কোথায় আছে?

প্রথম অধ্যায় : শিশু ছিনতাই

সংঘ পরিবারের এজেন্ডা জনজাতিদের সর্বপ্রাণবাদী ধর্ম পালনের বিবিধতাকে নিঃশেষ করেছে।

২০১০ সালের ১লা সেপ্টেম্বর মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট “Exploitation of Children in Orphanages, State of Tamil Nadu vs Union of India and Other [Writ Petition (Criminal) No. 102 of 2007]” সংক্রান্ত মামলায় অসম ও মনিপুর সরকারকে নির্দেশ দেয় যে ১২ বছরের কম বয়েসি আর কোন শিশুকে কোন ভাবেই যেন রাজ্যের বাইরে শিক্ষার জন্য না পাঠানো হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ৭৬ জন শিশুকে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা তামিলনাড়ুতে পাচার করে দেবার যে চিত্র উঠে আসে তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই রায়দান করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট-এর এই আদেশনামা থাকা সত্ত্বেও CID-র রিপোর্ট মোতাবেক প্রায় ৫০০০ শিশু ২০১২ - ২০১৫ সালের মধ্যে শুধু অসম থেকেই পাচার হয়ে গেছে। অধিকার রক্ষা কর্মীদের মতে এই সম সংখ্যক শিশুই আসলে পড়াশোনার নাম করে পাচার করানোর অভিযোগ রয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ৮০০ জন শিশু হারিয়ে যাবার খবর আছে।

কোকরাঝাড় জেলার গোঁসাইগাও মহকুমার, বাসভারি গ্রাম। আমার সামনেই আধা হাঁসদা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, “আমি কোনোদিন চাইনি আমার মেয়েকে অতদূরে পাঠাতে। যদি ও অসুস্থ হয়ে থাকে? যদি ওর আমাকে দরকার হয়? ওকে এখন কথায় খুঁজি? ওই লোকটা জোর করল বলেই আমার মেয়েকে ছাড়লাম।” মজার কথা হল মঙ্গল মারডি এবং আর একজন আর এস এস কর্মী আমাকে আধা হাঁসদা’র কাছে নিয়ে আসেন। তারা চাইছিল আমি আধার কাছ থেকে যেন নিজে কানে শুনে নেই যে তারা কত মহান সামাজিক কর্মকাণ্ড করছে। আধা হাঁসদার অকস্মাৎ এই রকম বিপরীত অভিব্যাক্তি দেখে মঙ্গল মারডি অসমিয়া ভাষায় কিছু একটা বলে ওঠেন, তবে আধা তাতে পাত্তা দেন না। আধা চিৎকার করে ওঠেন “শ্রীমুক্তি তাহলে গেল কোথায়? বল? তুমিই তো তাকে পাঠিয়েছিলে?” আর্তনাদ করে ওঠে আধা হাঁসদা। আধার স্ত্রী ফুলমনি আধাকে সান্ত্বনা দেন শান্ত করেন।

আমি জিজ্ঞাসা করি “তুমি কি তোমার বাকি তিন সন্তানকেও পাঠাচ্ছো? শ্রীমুক্তি’র মতই?” জবাব আসে “না” “ওঁরা টাকা দিলেও পাঠাব না!”

এই কথা শুনে মঙ্গল যেন একটু কুঁকড়ে যায়। বাড়ির একটা পিলারে হেলান দিয়ে নিজের স্মার্ট ফোন ঘাঁটতে থাকে। দৃশ্যতই অস্বস্তিতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তিরিশ বছর বয়েসি আধা, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন ভূমিহীন মজুর। তাঁর চার সন্তান। দৈনিক আয় মাত্র ২০০ টাকা। তাঁর মেয়ে শ্রীমুক্তি ওই ৩১ জনের একজন। বোঝাই যায় এই ধরনের সহায় সম্বলহীন মানুষেরাই আসলে টার্গেট।

“কিন্তু তুমি ওকে পাঠালে কেন?” আমি জিজ্ঞেস করি।

“কারণ ও (মঙ্গল) আমাকে ২০০৮ এর দাঙ্গার পরে বাড়ি বানাতে সাহায্য করেছিল!”

বোড়ো-আদিবাসী দাঙ্গার পরে আধা দীর্ঘদিন ক্যাম্পে কাটান। সে সময় মঙ্গল নিজেকে আর এস এস স্বেচ্ছাসেবক পরিচয় দিয়ে আধাকে বাড়ি তৈরীতে সাহায্য করেছিল।

হঠাৎ মঙ্গল বলে ওঠে “তুমি এমন ভাবে বলছ, যেন সাহায্যটা আমি নিজের জন্য করেছিলাম! তোমার মেয়ে পড়তে গেছে, ঠিক একই ভাবে আমার মেয়েও তো গেছে।”

আধা রাগত স্বরে বলে ওঠে “তুমি তো তোমার মেয়ের সাথে রোজ কথা বল, আমি তো বলতে পারি না, গত এক বছরে একদিনও কথা বলতে পারলাম না কেন?” “ও আদৌ স্কুলে আছে নাকি অন্যত্র পাচার হয়ে গেছে কে বলতে পারে?”

মঙ্গল আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে “এ পাগল হয়ে গেছে, আপনি আমার সাথে চলুন!”

আধা ও মঙ্গলের মেয়েরা যথাক্রমে শ্রীমুক্তি ও রানী, দুজনেরই ছ’বছর বয়েস। দুজনেই একসাথে গুজরাতে পড়াশোনা করতে গত বছর গেছিল। “শ্রীমুক্তি নাকি পঞ্জাবে আছে, আগামি চার বছরে ফিরবে না, এ আবার কেমন পড়াশোনা যেখানে বছরের পর বছর বাচ্চাদের তাদের বাবা-মা’র সাথে দেখা করতে দেয় না? মঙ্গলের মেয়ে এবং আমার মেয়ের তো একসাথে থাকার কথা ছিল, কই সেরকম তো হল না!” – অভিযোগ করে আধা। ফুলমনি বলে ওঠে “আমরা কার কাছে খোঁজ নেব এখন? এই মঙ্গলের মৌখিক আশ্বাস ছাড়া আর কোন কিছুই আমাদের কাছে নেই।”

শ্রীমুক্তির মা-বাবা, আধা হাঁসদা এবং ফুলমনি।

আধা হাঁসদা’র থেকে মঙ্গলের বাড়ি অন্তত দশগুণ বেশি বড়। মংগলের বাড়িতে সম্পন্নতার আভাস সুস্পষ্ট। উঠোন সংলগ্ন সর্বাপেক্ষা বৃহৎ দেওয়ালটিতে রাম-এর একটা চকচকে পোষ্টার চোখে পড়ার মত। কপালে গেরুয়া টিকা, গলায় লাল রঙ এর পৈতে ইত্যাদি তে মঙ্গলের হিন্দুত্ত্বের চিহ্ন চোখে পড়ার মতই। কায়দা করে আমার ছবি নিজের মোবাইলে তুলে রাখছিল। আমি বুঝতে পেরে পোজ দিই। তাতে অপ্রস্তুত হয়ে বলে ওঠে “এই নিয়ে চারবার এই বিষয়ে জানার জন্য লোক এল, আমি তো বুঝতেই পারছি না ব্যাপারটা কি?”

১৬ই জুন, ২০১৫, এই ঘটনার ঠিক এক সপ্তাহ পরে, আসাম স্টেট কমিশন অফ চাইল্ড রাইটস বা Assam State Commission of Child Rights (ASCPCR), ADGP, CID কে একটা চিঠি’তে (ASCPCR 37/2015/15) এই ঘটনার উল্লেখ করে জানানো হয়, যে এই ঘটনা জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট, ২০০০ বা Juvenile Justice Act 2000 অনুসারে বেআইনি এবং এটিকে একটি শিশু পাচারের ঘটনা হিসেবেই দেখা হবে। কমিশন পুলিশকে এই ঘটনার তদন্ত করতে অনুরোধ করে, এবং ৩১টি শিশুকেই ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেয়। এমনকি পুলিশকে এই সংক্রান্ত অ্যাকশন টোকেন রিপোর্ট (Action Taken Report) পাঁচ দিনের মধ্যেই ASCPCR আধিকারিকের কাছে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এখন অবধি কোন তদন্ত হয়নি। এমনকি বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ন্যাশানাল কমিশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস বা National Commission for the Protection of Child Rights এই ঘটনা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। ASCPCR-এর চিঠির পরে কোকরাঝাড়-এর চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি (Child Welfare Committee) বা (CWC) ঐ ৩১ জনের পরিবারের সাথে একাধিকবার দেখা করেছে।

Juvenile Justice (Care and Protection of Children) Act 2000 এর আদেশানুসারে প্রত্যেক রাজ্য সরকারই প্রত্যেক জেলায় CWC তৈরি করেছে। CWC-র ক্ষমতা একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা ফাস্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট-এর সমতুল্য। যে কোন শিশু CWC-র কাছে নিজে বা অন্য কারোর সাহায্য নিয়ে যেতে পারে। যে কোন শিশু এভাবে CWC-র কাছে পৌঁছালে CWC-র আধিকারিকেরা তার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে শিশুটির পক্ষে যেটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে সেই পদক্ষেপ নেবে — এমনটাই হবার কথা। CWC এধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চার মাসের মধ্যে অন্তিম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য।

সুতরাং, সেবা ভারতী, বিদ্যাভারতী এবং রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির মত সংস্থাগুলি স্পষ্টতই সুপ্রিম কোর্ট সহ Juvenile Justice Act কেও অমান্য করেছে। Juvenile Justice Act অনুসারে এরকম ক্ষেত্রে, উল্লিখিত শিশুকে CWC মাধ্যমে No Objection করিয়ে নিয়ে যাবার কথা। কিন্তু সেই নিয়মকেও উপেক্ষা করা হয়েছে।

২২শে জুন, ২০১৫ কোকরাঝাড় জেলা CWC-র চেয়ারপার্সন মালায়া দেকা, গুজরাটের সুরেন্দ্র নগর জেলার CWC’কে একটি চিঠি লেখেন (CWC/KJR/06/2015)। সেখানে তিনি সুরেন্দ্র নগরের সরস্বতি শিশু মন্দিরে বসবাসকারি অসমিয়া শিশুদের অসমে ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। চিঠিতে শিশুদের অল্প বয়েসে বাবা মা-এর কাছ থেকে দূরে থাকার উদ্বেগ, কষ্ট ইত্যাদির কথা বলা হয়। এমনকি এও বলা হয় যে, Juvenile Justice Act অনুযায়ী এভাবে শিশুদের রাখা বেআইনি। তাঁর তরফ থেকে বলা হয় ঐ শিশুদের গৌহাটি পৌঁছে দিলে, CWC তাদের নিজেদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেবে। এই খবর পাবার পরে সেবা ভারতি এবং রাষ্ট্র সেবা সমিতি শিশুদের অভিভাবকের কাছ থেকে এফিডেভিট যোগাড় করে। সেই এফিডেভিট এ সই করা হয় নোটারি আধিকারিক ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-এর সামনে। সই এর তারিখ ১৩ই জুলাই, ২০১৫। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে মেয়েদের নিয়ে যাবার অনেক পরে অভিভাবকদের সম্মতি নেওয়া হয়েছে। আউটলুক পত্রিকা প্রতিটি এফিডেভিট যোগাড় করেছে। দেখা গেছে প্রত্যেকটিই ইংরাজিতে লেখা, অথচ যারা সই করেছেন তাঁরা প্রায় কেউই শিক্ষিত নন। এফিডেভিট-এ ৬টি বিষয়ের উল্লেখ আছে,

১। আমি চাষি, এবং দাঙ্গা-আক্রান্ত।

২। ২০১৪ সালের ২৫ শে জানুয়ারির দাঙ্গাতে আমার ঘর সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গেছে।

৩। আমি এখনো ত্রাণকেন্দ্রে রয়েছি।

৪। আমার কোনো রোজগার নেই।

৫। আমি আমার মেয়ের স্কুলে পড়ানোর খরচ বহন করতে অসমর্থ।

৬। সুতরাং আমি স্বেচ্ছায় আমার মেয়েকে গুজরাটে পাঠাচ্ছি ভালভাবে পড়াশোনা করার জন্য।

CWC-র আধিকারিক মালায়া দেকার মতে এমনিতেই বেআইনি এই কাজের সমর্থনে যে এফিডেভিট দাখিল করা হল, সেটিও কিন্তু বেআইনি। পরবর্তী কালে এফিডেভিট-এর বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেল কোন পরিবারই আসলে দাঙ্গা-আক্রান্ত নয়, এমনকি তাঁরা কেউ কস্মিনকালেও ত্রাণকেন্দ্রে থাকেননি। এদের অনেকেই প্রান্তিক চাষি কিম্বা অন্য কোন আর্থিক উপার্জনের মধ্যে আছেন। ঐ এফিডেভিট-এ যে বোরো ও আদিবাসী দাঙ্গা’র উল্লেখ আছে, তার সময়কালও ভুল। ওখানে বলা আছে যে, ঐ দাঙ্গা জানুয়ারী ২০১৪-য় হয়েছিল, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হল ঐ দাঙ্গা ডিসেম্বর ২০১৪-য় হয়। মালায়া দেকার কথায়, “২০১৬ সালে CWC-র তদন্তকারি আধিকারিককে মঙ্গল ভয় দেখায়। মঙ্গলের বিরুদ্ধে FIR করা হয়, কি%޻?9*QU_ 5ETHI67~]`s觜)KMjǛ൧oশাসন এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়নি।” ২০১৬ সালে মালায়া দেকা গৌহাটি হাই কোর্টে এই মর্মে একটি চিঠি লিখে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবার কথা বলেন, এমনকি একথাও উল্লেখ করেন যে এফিডেভিটগুলি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কিন্তু এখনো অবধি সে চিঠির কোনো উত্তর আসেনি।

হিন্দুত্বকরণ

মঙ্গল আমাকে জিজ্ঞেস করল “কোনো হিন্দু তাঁর সন্তানকে হিন্দু সংস্থায় পড়াশোনার জন্য পাঠালে আপনার আপত্তি কোথায়?”

আমি বললাম “সমস্ত আদিবাসীরাই হিন্দু নন।”

সাঁওতালরা মারাংবুরু (বোঙা) সহ অনেক দেবতার পূজা করেন। তাঁদের পূজা পার্বণ জীবন চক্র, কৃষি ইত্যাদির সাথে যুক্ত। মঙ্গলের অবশ্য নিজস্ব যুক্তি আছে, তাঁর মতে “যারাই ভগবান মানেন তারাই হিন্দু, এই বিশ্ব একসময় শুধু হিন্দু অধ্যুষিত ছিল।” ঠিক একই কথাতো আমরা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়ার মুখেও শুনেছি ২২ ডিসেম্বর ২০১৪ সালে ভুপালে VHP-র মিটিং-এ। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দুদের সংখ্যা ৮২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করা হোক। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে ফুলেন্দ্র দত্তর কথা, যিনি প্রায় ১৯ বছর ধরে RSS এর হয়ে কাজ করছেন কোকরাঝাড় জেলায়। তাঁর মতে যে সকল আদিবাসীরা গাছ, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা করেন, তাঁরা আসলে হিন্দু।

মঙ্গলকে জিজ্ঞাসা করলে ও বলে, “আমি রাম, দুর্গা, হনুমান, শিব, তুলসি এবং ভারত মাতার উপাসক।” তাঁর মতে বোড়োরা শিবে বিশ্বাসী তাই তাঁরা আদিবাসীদের থেকে আলাদা।।

সত্যি বলতে বোড়োদের আসল ধর্ম ‘বাথৌ ধর্ম’। এর কোন লিখিত রূপ, মন্দির ইত্যাদি নেই। বাথৌ শব্দটি বোড়ো ভাষায় পাঁচটি বিষয়কে বোঝায় ‘বার’-বাতাস, ‘স্যান’-সূর্য, ‘হা’- পৃথিবী, ‘অর’- আগুন, ‘অখ্রাং’- আকাশ। তাঁদের প্রধান দেবতা বাথৌবৌরাই। বৌরাই’ শব্দটির অর্থ বয়স্ক। ঐ পাঁচটি বিষয় বাথৌবৌরাই-এর সৃষ্টি।

উল্লেখ্য বিষয় হল, বোড়ো এবং আদিবাসীদের মধ্যে যে বিভাজনের কথা সংঘ প্রচার করছে সেটা তাঁদের তৈরি করা এবং নিজেদের সুবিধে মত করা। এখানে বোড়োদের সাথে সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি আদিবাসীদের সমস্যা বহুদিনের। এবং অসম সরকার সাঁওতাল, মুন্ডাদের আদিবাসী অবস্থান মানেনি। যদিও এঁরা ভারতের অন্যত্র ST বা Scheduled Tribe তথা তপসিলি জনজাতি হিসেবে স্বীকৃত, অসমে তা নয়। অসম সরকারের যুক্তি হল, এঁদেরকে শ্রমিক হিসেবে আনা হয়েছিল, সুতরাং এঁরা কেউই সে অর্থে আদিবাসী নন। এই সুযোগটা সংঘিরা পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে। তাঁদের মতে বোড়োরা শিববাদী আর আদিবাসীরা বৈষ্ণববাদী। ফলে এই জাতি বিদ্বেষের লড়াই এখনো চলছে।

মঙ্গলের মত লোকেরা বিশ্বাস করে যে তাঁরা হিন্দুদের সংস্কার শেখাচ্ছে, এবং হিন্দু জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত করে তুলছে। যে কোনো প্রশ্নেই মঙ্গলের উত্তর যেন তৈরীই আছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, যে ঠিক কবে থেকে আরএসএস এর মত হিন্দুত্ব সংগঠনের সাথে তুমি যুক্ত?

অর্থবহ হাসি সমেত উত্তর আসে “সব হিন্দুই আসলে এটার অংশ। তবে আমি ২০০৩ থেকে যুক্ত হয়েছি, যবে থেকে কোকরাঝাড় জেলা পরিষদের আরএসএস প্রচারক বীরেন্দ্র লষ্কর আমাদের এ ব্যপারে জানান।”

“একজন সদস্য হিসেবে তুমি কি করো?”

“লোকজন ধর্মীয় দায়িত্ত্ব, নিয়মকানুন, আচার ব্যবহার, সংস্কার সব ভুলে যাচ্ছে। এই যেমন সব বাড়িতেই তুলসী মঞ্চ আর তুলসীগাছ থাকা উচিৎ। আমি এদের হিন্দুত্ত্ব পরিচয়ের শিক্ষা দিয়ে থাকি, হিন্দু জাতি ও জাতির প্রতি তাদের কর্তব্য বিষয়ে।”

“হিন্দু জাতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব কি?”

মঙ্গল-এর মুখ চোখ এবার বদলে গেল, এড়িয়ে গেল প্রশ্নটা “আপনার সাথে আর আমি কোন কথা বলতে পারব না, আপনি করবীকে জিজ্ঞাসা করুন”।“মুসলিম আর খ্রিস্টান আক্রমণকারীদের হাত থেকে একে রক্ষা করা। বাংলাদেশী আর মিশনারীদের দেখুন তারা কি করছে এখানে।”

“মেয়েদের জোর করে অন্য রাজ্যে পাঠিয়ে হিন্দু জাতির কিভাবে লাভ হয়?

“এটা মেয়েদের নিজেদের ভালোর জন্যেই। হিন্দু মেয়েদের অবশ্যই সংস্কার শিখতে হবে। আধার মত অশিক্ষিতরা কিছুই জানেনা।

জিজ্ঞেস করলাম “কিন্তু বাবা-মা এঁরা কেন ওদের সাথে কথা বলতে পারছে না? কেন দেখা করতে দিচ্ছে না?”

মঙ্গল-এর মুখ চোখ এবার বদলে গেল, এড়িয়ে গেল প্রশ্নটা “আপনার সাথে আর আমি কোন কথা বলতে পারব না, আপনি করবীকে জিজ্ঞাসা করুন”।

জালের আড়কাঠি - সংঘ কর্মী মঙ্গল মারডি নিজের বাড়িতে (গোঁসাইগাঁও)।

দ্বিতীয় অধ্যায় : বিতত বিতংস

অসমের সীমান্ত এলাকায় সংঘ পরিবারের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক আছে, এরা জনকল্যাণের ‘সাইনবোর্ড’ সামনে রাখে।

করবী বাসুমাতারি রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির একজন বোড়ো অ্যাক্টিভিস্ট। ২০০৮ সাল থেকে তিনি প্রচারিকা অর্থাৎ ফুলটাইমার হয়ে ওঠেন এই এলাকায়। তাঁর সাথে আমার প্রথম আলাপ ২০১২ সালে মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদে। সুদূর কোকরাঝাড় থেকে করবী এখানে এসেছিলেন। ২০০৪ সালে একটা রিলিফ ক্যাম্প থেকে বছর ২০’র করবীকে এখানে নিয়ে আসা হয়। করবীর ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে আত্মীয় পরিজনরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় বোড়ো-মুসলিম দাঙ্গায়। উনি নিজের সর্বস্ব হারিয়ে হিন্দুত্ত্ব প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। সুনীতা নামের এক অভিজ্ঞ প্রচারিকা, যিনি মহারাষ্ট্র থেকে প্রায় দু দশক আগে নেল্লী গনহত্যার সময় থেকে এই উত্তর-পূর্বে এসে কাজ করছেন, তিনিই করবীকে চিহ্নিত করে কিশোরী বর্গ বা কিশোরীদের প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে আসেন। একজন শিক্ষানবিশ থেকে সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে উত্তীর্ণ হওয়া প্রচারিকা করবী বলেন “এটা যেন নিজের হাতের মুঠোয় ভবিষ্যৎ পরিচালনের ক্ষমতা পাওয়া।” ।

প্রচারিকাদের, হিন্দুত্ববাদে এক বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রচারকদের মত এঁদেরও আধাসামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সকল প্রকার পার্থিব সুখ, যৌন জীবন প্রভৃতি ত্যাগ করেন বলেও এদের হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে কদর আছে।

ক্যাম্পে করবীর সাথে আমার কথোপকথন মনে পড়ে — “একজন সেবিকা সমিতির প্রচারিকা হিসেবে আমি শিখেছি, কিভাবে সংগ্রাম করে নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে হয়” কথাগুলো বলার সময় ওর মুখ লাল হয়ে, একটা নিশ্চিত প্রতিশোধের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছিল। এই ঘটনার ৪ বছর পরে ৩২ বছরের করবী এবং সন্ধ্যাবেন তিকদেকে ASCPCR, ৩১ জন শিশু পাচারের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। করবীর হিন্দুত্ব কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন প্রমাণ করে যে, কিভাবে সংঘ পরিবার এই দাঙ্গাদীর্ণ উত্তর-পূর্বের কিশোরীদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা আর উচ্চাকাঙ্খকে ছলনায় ভালোতে সক্ষম হচ্ছে যা আসলে সরকারী ব্যর্থতার ফলে তৈরী শূণ্যতা। এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের ঘনঘন জাতি-সঙ্ঘর্ষও তাদের প্রচেষ্টার সহায়ক হয়। সংঘ পরিবার উত্তর-পূর্ব ভারতে আরও অনেক করবী তৈরি করতে চাইছে।।

যখন আমরা কোকরাঝাড়ের মালগাঁও গ্রামের দিভি বসুমাতারীর বন্ধ ঘরের বাইরে অপেক্ষা করছিলাম তখন একটা রাগত স্বর আমাদের দিকে ধেয়ে আসে —

“তোমরা আবার কারা? কি চাইছো?”। পিঠে বাঁধা বছরখানেকের মেয়ে অরুণিকা আর দুহাতে দুটো জলের পাত্র সমেত তিরিশের কোঠার সুঠাম চেহারার রোপিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। আমি তাকে বলি আমরা তাঁর কাছে জানতে এসেছি তাঁর ৫ বছর বয়েসী মেয়ে দিভি’র কথা, যে ওই ৩১ জন নিখোঁজদের মধ্যে একজন।

“প্রথমে তোমরা ওকে নিয়ে গেলে, তারপর ওর সবকটা ছবিও” কথাগুলো যেন ও ছুঁড়ে মারলো। “ও কবে ফিরে আসবে?”

জানতে পারি যে, করবী লোক পাঠিয়ে তাঁর মেয়ের সমস্ত ছবিগুলোও নিয়ে গেছে। রোপি আমাকেও করবীর লোক ভেবে প্রাথমিক ভাবে খুব খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। পরে আমাকে বলে ওর মেয়ের আর কোনো ছবিই নেই। “আপনাদের মত শহুরে লোকতো আমরা নই দিদি, আমার মেয়ের ঐ দুটো ছবিই ছিল।” রোপি একজন বোড়ো মেয়ে। ওঁদের ঐতিহ্যবাহি হস্তশিল্প ‘দোখানা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্বামী বকুল বাসুমাতারি গৌহাটি শহরে একটি কেবল কারখানায় কাজ করে। বছরে বার দুয়েক বাড়ি ফিরতে পারে। রোপি তাঁর মেয়ে দিভিকে করবীর কথায় বাইরে পাঠায়। এখন তাঁর স্বামী তাঁকেই মেয়ে হারানোর জন্য দোষারোপ করছেন। করবী তাঁদের বলেছিল বছরে একবার মেয়ের সাথে দেখা হবে, মেয়ে ভাল পড়াশোনা করবে, সে জন্যই রোপি তাঁদের মেয়েকে বাইরে পড়তে পাঠায়।

শর্মিলা সুরগি, সুকুরামনি প্রভৃতি মেয়েরাও ঐ ৩১ জনের মধ্যে ছিল। তাদের বাবা মা এর কাছে জানতে পারি CWC এবং ASCPCR-এর তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবার পরেই করবী তাঁর লোক পাঠিয়ে মেয়েদের ছবিগুলোকেও নিয়ে যায়। রোপির মতোই ৩১টি পরিবারের কারোর কাছেই তাঁরা যে মেয়েদের পাঠিয়েছেন তাঁর কোন অফিসিয়াল প্রমাণ নেই। রোপিকে জিজ্ঞেস করলাম “তোমার মেয়েকে পাঠাতে কে বুদ্ধি দিলো?” উত্তর এল “সেবা ভারতী।”

* * * * *

সেবা ভারতীর অসমের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রভাব চোখে পড়ার মত। সেবা ভারতীর নেটওয়ার্ক’ও অত্যন্ত শক্তিশালী। হেলথ ক্যাম্প ইত্যাদি পরিচালনার মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। বিদ্যা ভারতী, একাল বিদ্যালয় ইত্যাদি সংগঠনগুলি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দ্বারা অনুপ্রাণিত শিক্ষার প্রসারে মগ্ন। বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, এবং friends of tribal society প্রভৃতি সংগঠনগুলি আদিবাসীদের কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। পরিচারিকা’রা সহজেই এই সংগঠনগুলিকে কাজে লাগিয়ে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদের বীজ এই সমস্ত প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে।

প্রসংগত উল্লেখ্য সেবা ভারতী বালাসাহেব দেওরাস এর হাত ধরে তৈরি হয় ১৯৭৮ সালে। বালাসাহেব ছিলেন RSS এর তৃতীয় সরসংঘচালক। সেবা ভারতীর উদ্দেশ্য সমাজের প্রান্তিক মানুষদের RSS এর কর্মকাণ্ডের সাথে নিযুক্ত করা। সুতরাং একথা অনুমেয় যে আখিল ভারতীয় সহসেবা প্রমুখ-এর মাধ্যমে সেবা ভারতী সংঘ পরিবারের কাঠামোর সাথে সরাসরি যুক্ত। সেবা ভারতীর ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখলাম এঁরা সারা ভারতে দেড় লাখের মত প্রজেক্ট পরিচালনা করে। তাঁরা কম বয়েসি আদিবাসী ছেলে মেয়েদের জন্য হোস্টেল বানিয়েছে, তাদের অনেক অপ্রচলিত ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।

* * * * *

সন্তান হারা-রোপি, নিখোঁজ ৩১টি শিশুকন্যার মধ্যে তাঁর মেয়ে দিভি’ও আছে।

রোপির কথায় ফিরে আসি। বছর দুয়েক আগে রোপি ও তার মেয়ে দিভি একসাথে অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে সময় কাঞ্ছাই তাকে ‘সেবা ভারতী’র সন্ধান দেয়। সেবা ভারতী সে সময় মেডিক্যাল ক্যাম্প চালাচ্ছিল গ্রামে। ক্যাম্প শেষে কাঞ্ছ ‘মাতৃমন্ডল’ নামে একটা সংস্থা চালু করে। মুলত গ্রামের ‘মা’দের নিয়ে একটি কমিটি। এখানে আমরা গান বাজনা করতাম। আমাদের টয়লেট ব্যবহার, স্যানিটারি প্যাড কিভাবে তৈরি করা যায়, কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেসব শেখানো হত। কাঞ্ছাই আমাকে করবীর সাথে দেখা করতে বলে এবং মেয়েকে গুজরাতে পাঠাতে বলে।

এই পদ্ধতি সংঘের একদম প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটা। প্রথমে এঁরা জনকল্যাণের রূপ নিয়ে আসবে। এঁরা জনভিত্তি তৈরি করবে, খুঁজে নেবে কিছু স্থানীয় মানুষ, যাদের দিয়ে পরবর্তী কাজগুলো করানো যাবে। এঁরা ধীরে ধীরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার পরে আসবে স্থানীয় স্তরের রাষ্ট্র সেবিকা ও আর এস এস-এর ফুলটাইমারা। যে সব জায়গায় রাষ্ট্র সরাসরি মানুষের দৈনন্দিন চাহিদাগুলি পূরণ করতে ব্যর্থ হয় সেখানেই এই ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়। গ্রামীণ মানুষ মনে করেন তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য সেবা ভারতী নিয়ে গেছে, কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে যে হিন্দুত্ব ভাবধারার প্রভাব বিস্তারের জন্যই এই প্রয়াস, সেকথা তাঁদের পক্ষে অনুধাবন করা দুষ্কর।

বোড়ো-মুসলিম দাঙ্গা, বোড়ো-আদিবাসী জাতিদাঙ্গাদীর্ণ অসম-এর সমস্যায় জর্জরিত, সীমান্তবর্তী গ্রামে গেলে দেখা যায় ওঁদের কাছে ক্রমেই নিজেদের জাতিসত্ত্বা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ঠিক ও বেঠিকের তারতম্য করার সম্ভবনা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসছে। বদ্ধমূল ধারণা এবং অন্য জাতির প্রতি অবিশ্বাস হিন্দুত্বের পথকে সুগম করে তুলছে।

* * * * *

কাঞ্চাই ব্রহ্মা হলেন সেবা ভারতীর গোঁসাইগাঁও এলাকার সক্রিয় কর্মী। বয়েস ৩৪ বছর। গোঁসাইগাঁও কোকরাঝাড় এর একটি ছোট মহকুমা শহর। তার জীবন কাহিনীও করবী সহ অন্য ৩১টি বাচ্চার মতোই। কুমুরস্বামী গ্রামে পনেরো বছর বয়েসে তিনি সেবা ভারতী পরিচালিত কিশোরীবর্গের ক্যাম্প-এ যোগ দেন। আমার সাথে দেখার হবার পরে বলেছিলেন ঐ ক্যাম্পগুলো মানুষকে সংস্কার শেখায়। এই কথা বলার সময় কাঞ্চাই আমার ছবি তুলে নিল।

“কি ধরনের সংস্কার?” – আমি জিজ্ঞাসা করলাম

“মেয়েদের বোঝানো হয় যে তাঁরা তাঁদের নিজেদের ঐতিহ্য ভুলে গেছে। তাঁরা এখন নমস্কার বলার পরিবর্তে হ্যালো বলতে শিখেছে। প্যান্ট পরে, নিজেদের পোশাক ভুলে গেছে। এ সবই খ্রিস্টান প্রভাবে হয়েছে। আমরা শেখাই নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী এই দেশের একজন সৎ নাগরিক কিভাবে হয়ে ওঠা যায়।”

কাঞ্চাই ব্রহ্মা, দরিদ্র পরিবারগুলিকে সাহায্যের ছলে সঙ্ঘ পরিবারকে সাহায্যকারী।

আউটলুক এ ২৮-এ জানুয়ারি ২০১৩ সালে ঔরাঙ্গাবাদের ক্যাম্প সম্পর্কে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা গেছে সংস্কারের নামে তাঁদের কিভাবে হিন্দুত্ববাদী করে তোলা হচ্ছে। এমনকি এটাও দেখানো হয় কিভাবে এদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিস্টান-বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা হচ্ছে। যেহেতু কাঞ্চাই বা করবি’র মত মেয়েরা একই কমুউনিটি’র মানুষ ফলে এঁদের পক্ষে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা খুবই সহজ। কাঞ্চাই উত্তরপ্রদেশে ট্রেনিং নিয়েছিলেন ২০০৪ সালে। পরে ফিরে এসে তিনি অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড় এবং চিরাং-এ প্রচার শুরু করে দেন। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ৫০০ জন মেয়েকে ওখান থেকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেন। কাঞ্চাই’র মত মেয়েদের কাছে এটা অত্যন্ত বড় সাফল্য। ঐ ৫০০ জনের মধ্যে অনেকে ফিরে এসে বিয়ে করেন, কিন্তু তাঁরা এখন গৃহিণী সেবিকা হিসেবে পার্ট টাইম কাজ করেন।

সেবিকা

যে সমস্ত বাবা-মায়েরা সেবা ভারতীর প্রধান কর্মকাণ্ডের সাথে সংযুক্ত থাকেন না, তাঁদেরকে নানা রকমের হয়রানির সম্মুখিন হতে হয়। সংঘের কর্মীদের ঐ সমস্ত মানুষের সম্বন্ধে বলার লোকের অভাব হয়না। কাঞ্চাই বিশ্বাস করে যে বোড়ো উপজাতীদের খ্রিস্টানরা প্রতারিত করেছে আর মুসলিমরা মেরেছে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী সেবা ভারতীর সাথে যুক্ত হবার প্রধান কারণ এটাই। সেবা ভারতীর মাধ্যমে সে বোড়ো উপজাতির হিন্দুত্ব রক্ষা করতে চায়। এবং ভারত মাতার উন্নয়নে ব্রতী হয়ে থাকতে চায়। বর্তমানে কাঞ্চাই একাল বিদ্যালয়ের মাধ্যমে লোক জোগাড় করছে। একাল বিদ্যালয়ে নন ফর্মাল বা অ-প্রথাগত পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়। এখানে দেশভক্তির পাঠ দেওয়া হয়। কাঞ্চার কথায় ‘ব্যা ব্যা ব্ল্যাকশিপ’ শিখিয়ে আমরা ভারত দেশ, মেরা দেশ, মেরি মাতা আউর প্রাণেষ’, ‘মেরি জান, মেরে প্রাণ, ভারত মাতা কো কুরবান’, শেখানো হয়। “সমবেত ভাবে (কোরাস) গান গাওয়ার দিকে ঝোঁক দেওয়া হয় এতে ঐক্য, দৃঢ়তা ও দলবদ্ধতার ভাব তৈরী হয়। হিন্দু মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতীয় ইতিহাস লোকগীতির মাধ্যমে মেয়েদের শেখানো হয়। সেবাভারতী আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন চিকিৎসা শিবির, মাতৃমণ্ডলি সমেত স্থানীয় নানা পরবে বা উৎসবে মনরঞ্জনের জন্য এই মেয়েরা গান গায়।” উদ্দেশ্য নিপে ও সূক্ষ্মভাবে হিন্দুত্বের মতবাদে বিশ্বাসী গড়ে তোলা।

একাল বিদ্যালয় ২০০০ সালে রেজিস্ট্রেশন হয়। তবে এই স্কুলগুলির সূচনা বহু আগে ১৯৮৬ সাল থেকে। ২০১৩ সালে এই ধরনের স্কুলগুলি প্রায় ৫২০০০ আদিবাসী গ্রামে রয়েছে। এই স্কুলগুলি বিশ্বহিন্দু পরিষদ তথা সংঘ পরিবারের সাথে যুক্ত। জি-নিউজ-এর সুভাষ চন্দ্র অতীতে এর দায়িত্বে ছিলেন। বিজেপি এম.পি. হেমা মালিনী ব্র্যান্ড-এ্যাম্বাসেডর হিসেবে এর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কোকরাঝাড়ের আর এস এস কর্মী ফুলেন্দ্র দত্তর মতে শুধু মাত্র কোকরাঝাড়েই প্রায় ২৯০টির মত একাল বিদ্যালয়। একাল বিদ্যালয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত থাকে “বন বন্ধু পরিষদ” নামক সংস্থাটি। বন বন্ধু পরিষদ একাল বিদ্যালয়ের “বনযাত্রী (আদিবাসী)-দের সংস্কার ও শিক্ষা প্রদান পরিকল্পনার পদ্ধতি তৈরীতে সাহায্য করে। বন বন্ধু পরিষদ স্কুলে শেখানো নানা বিষয়কে আরো উন্নত করে তুলে ধরে। এই তুলে ধরার মধ্যে থাকে হিন্দুত্ব বোধকেন্দ্রিক ইতিহাস, ভূগোল, জীবনবিজ্ঞান। এই ধরনের প্রশিক্ষণ - ধার্মিক, বিনয়ী, আত্মবলিদানে প্রবৃত্ত হিন্দুত্ববাদী তৈরী করার জন্য গঠিত। সেবা ভারতী বালবর্গ ও কিশোরী বাহিনীর মাধ্যমে এই স্কুলগুলিতে বাচ্চাদের ভর্তি করতে সাহায্য করে। সন্তর্পনে নীতি-পুলিশের সংস্কৃতি আমদানি করে বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের স্বাভাবিক বৈচিত্রকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে, তা বলা বাহুল্য।

সেবাভারতী’র সেবিকা কাঞ্চাই।

কাঞ্চাই-এর কথায় মেয়েদের ঐতিহ্য-এর পাঠ দেওয়া অত্যন্ত জরুরী, কারণ মেয়েরাই সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তাঁরাই তো পরিবার গঠন করবেন, হিন্দুরাষ্ট্র তৈরী করার গুরুদায়িত্বও তাঁদেরই। একারণেই আমরা মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে বারণ করি সবসময়। আমি জিজ্ঞাসা করলাম — কেন ওঁরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে বারণ করেন? ভেবেছিলাম উত্তর-ভারতের খাপ পঞ্চায়েতের থেকে আলাদা কোনো উত্তর পাব।

কাঞ্চাই বললেন “হিন্দুধর্ম অনুযায়ী হিন্দু মেয়েদের হিন্দু ছেলেদেরই বিয়ে করা উচিৎ। মেয়েরা ফোনে ছেলেদের সাথে কথা বলে আর তার পরে অন্য ধর্মের লোকের সাথে বিয়ে করে। খুব সম্প্রতি আমরা একটি মেয়েকে তাঁর মুসলিম স্বামীর খপ্পর থেকে উদ্ধার করতে রীতিমত বেগ পেয়েছি। গর্ভবতী হওয়ার কারণে প্রথম দিকে না মেনে নিলেও পরে আমাদের লাগাতার চেষ্টায় ও স্বামীকে ছেড়ে দেয়। আমরা ওকে বোঝাই, কিভাবে পাশের গ্রামগুলোতে মুসলিমরা বোড়োদের খুন করেছিলো। ও নিজেই কারণ খুঁজে পেয়েছে। স্বামীকে ছাড়ার পর ও এখন সেবাভারতীতে কাজ করছে।”

কাঞ্চাই এবং করবী দুজনেই সংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোয় মেয়ে যোগাড়ে অত্যন্ত কার্যকর নিয়োগকারী হয়ে উঠেছেন। কাঞ্চাই কিংবা করবীরা মেয়ে ও বোড়ো উপজাতির সদস্য হবার সুবাদে খুব সহজেই যে কোন পরিবারের আস্থাভাজন হতে পারে। যেটা ছেলেদের পক্ষে অতটা সহজ নয় এবং এই সুযোগটা এঁরা ব্যবহার করেন। এরা মেয়েদের কাছে নিজেদের বিকাশ ও উন্নতির উপস্থাপনা করে, আসামের বাইরে তাদের নিজেদের ট্রেনিং ও অভিজ্ঞতার সুন্দর বর্ণনায় অন্যদের প্রবলভাবে উৎসাহিত করতে সক্ষম হন। মেয়েরা সেই উন্নতি প্রবলভাবে কামনা করতে থাকে। এটা হিন্দুরাষ্ট্রের বিকাশের জন্য মা, বোন, স্ত্রী, কন্যার ভূমিকাবোধকে প্রশ্নাতীত ভাবে মহিলাদের মনের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়।

করবীর সাথে ঔরঙ্গাবাদ ট্রেনিং ক্যাম্পে দেখা হওয়ার চার বছর বাদে একজন নিখোঁজ হওয়া মেয়ের বাড়িতে, করবীর ফোন পেয়ে সন্ত্রাসের পরিবর্তিত অবস্থা আমার নজরে আসে। সেই সময়ের করবী ছিল খুব দৃঢ় ও বিনয়ী। আর এখন তার কথাবার্তার ভঙ্গী রক্ষণাত্মক ও রুক্ষ।।

কোকরাঝাড়ে অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন পরিবারেও আমি গেছি। সেখানে দেখেছি যে, তাঁরা কিন্তু তাঁদের মেয়েদের সাথে প্রায়শঃই কথা বলতে পারেন। এরকমই একটি পরিবারের কর্তা ঘন কান্ত ব্রহ্ম। বিশাল বাড়ি এনার। সম্ভবত দাওদশী গ্রামের সবচেয়ে বড়গুলোর মধ্যে একটা। আমি যখন ওর দাওয়ায় বসে বাড়ির দেওয়ালে আঁকা কারুকাজের প্রসংসা করছিলাম, তখন ওর স্ত্রী সুভদ্রা, আমায় পান আর সুপারীর তাম্বুল সহযোগে আসামের ঐতিহ্য অনুযায়ী স্বাগত জানালেন। ঘন কান্ত ব্রহ্ম শুধু নিজের মেয়েকে পাঠিয়েছেন তাই নয়, তিনি আরও তিনজন মেয়েরও ব্যবস্থা করেছেন তাঁর মেয়ের সাথে গুজরাতে পাঠানোর জন্য। করবীর সাথে যোগসাজশ করে তিনি তাদের পাঠিয়েও দিয়েছেন। এরকম একটি মেয়ের’ই নাম সুকুরমনি। সুকুরমনির বাবা দেনা টুডু অভিযোগ করেন, “ব্রহ্ম তাঁর মেয়ের সাথে রোজ কথা বলে, আমি জানিই না আমার মেয়ে কোথায় আছে, গরীব বলে কি আমায়, মেয়েকে দান করে দিতে হবে ?” নিখোঁজ তিনটি মেয়ের অভিভাবকেরা আমায় জানায় যে কিছুদিন আগে সম্পন্ন হওয়া অসমের বিধানসভা নির্বাচনে ব্রহ্ম, স্থানীয় বিজেপি’র সঞ্চালকের ভূমিকা নিয়েছিলেন।

ব্রহ্ম-র এফিডেভিটটা দেখতে দেখতে একটা জিনিস চোখে পড়ল, যে তিনিও দাবি করছেন তাঁর উপার্জন নেই ও তিনি দরিদ্র। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে তাঁর ২০ বিঘে জমি থাকা সত্ত্বেও কি করে তিনি নিজেকে দরিদ্র বলতে পারেন। তাঁর উত্তর ছিল “এমনি।” আমাকে অবাক হতে দেখে বলল “মুসলিম ও খ্রিস্টানরা আমাদের ধর্মান্তরিত করতে চায়। তো ধর্মান্তরিত হয়ে, জমি হারিয়ে, বেঁচে থাকার থেকে এটাই ভাল যে করবী আমাদের মেয়েদের হিন্দু জীবন ধারার শিক্ষা দিক। বোড়োরা তো আসলে হিন্দুই।”

এসব আসলে এক ধরনের “ঘর ওয়াপাসি” ব্যবস্থাপনারই অঙ্গ। ফরমুলাটাও মোটামুটি একই। সবার মধ্যে একটা ভয় ঢুকিয়ে দাও যে তাঁদের অস্তিত্ব সংকটে। তারপর ঘোষণা কর যে সমস্ত আদিবাসী, মুসলিম ইত্যাদিরা প্রত্যেকেই আসলে হিন্দু এবং তারপর তাঁদের ধর্মান্তরকরণ করা। ২০১৪ সালে ব্যাপক হারে ঘর ওয়াপসি করা হয়েছিল মুসলিম ও বৌদ্ধ’দের। অখিল ভারতীয় বনবাসী কল্যান আশ্রম একটি রিপোর্ট-এ দেখায় যে, প্রায় ১০ কোটি আদিবাসীর মধ্যে ১.২২ কোটি মানুষ খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরকরণ করা হয়েছে। এবং আশ্রম প্রায় ৫৩০০০ গ্রামবাসী’কে ২০১৫ সালের মধ্যে ১.০৯ লাখ আদিবাসী’কে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরকরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।

আমি ব্রহ্মকে বললাম “কিন্তু এফিডেভিট-এ মিথ্যে কথা বলাটা বেআইনি জানেন তো?”

ব্রহ্ম রাগত স্বরে বোড়ো ভাষায় কিছু একটা বলে উঠল, এবং নিজের বিশাল বড় স্মার্ট ফোনে আমার একটা ছবি তুলল। এবং একটা নম্বর ডায়াল করল আর আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দিল।

আমি বললাম “হ্যালো”

“আপনারা রোজ রোজ এখানে এসে এই অভিভাবকদের কেন বিরক্ত করছেন বলুন তো? যখন মুসলিমরা এখানে এসে নির্বিচারে মানুষ মেরেছে তখন আপনারা ছিলেন কোথায়?” – বেশ শুদ্ধ হিন্দিতে শ্লেষাত্মকভাবে এই কথা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন এক ভদ্রমহিলা।

“আপনি কে কথা বলছেন, একটু বলবেন” আমি জিজ্ঞাসা করলাম

“আমার নাম করবী, আর আমি মোটেই আপনাদের ভয় পাই না, যা ইচ্ছে লিখুন আপনাদের সংবাদপত্রে, আমার কিছু যায় আসে না”।

আমি বললাম “আপনি আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন না কেন?”

উত্তর এল “আমি কারোর সাথে দেখা করব না। আপনারা হিন্দুদের নিয়ে একটুও চিন্তিত নন। শুধু মুসলিম বাংলাদেশীদের নিয়ে আপনাদের যত মাথাব্যাথা। আপনারাতো একথাও রটাচ্ছেন যে আর এস এস নাকি বাচ্চা পাচার করছে।”

আমি বললাম — “আমি কোনদিনই বলিনি যে আর এস এস বাচ্চা পাচার করছে, বরং আপনিই একথা বললেন।”

“আমি আর কিছুই বলছি না, আপনি দিল্লি ফিরে যান, নিজের অফিসে গিয়ে এই সব প্রশ্ন করুন গিয়ে।” এটুকু বলেই করবী ফোনটা কেটে দিলেন।

তৃতীয় অধ্যায় : ছোটা কাশীর রানীরা

বার্তা পরিষ্কার, যদি তুমি উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে আগত, তবে তুমি অবশ্যই হিন্দু। এই তরুণী মেয়েদের এই মতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

ইউ এন কনভেনশন-এর ৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শিশু অধিকার আইনে বলা আছে- বাচ্চাদের নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কোন কারনেই তাদের বাবা-মা’র থেকে আলাদা করা বে-আইনি। বাচ্চাদের অভিভাবক সম্পর্কে মতামত দেবার অধিকার আছে। এবং বাচ্চাদের তাদের দুজন অভিভাবক-এর সাথেই থাকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে, যদি না এতে বাচ্চার কোন রকম ক্ষতি হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ভারতবর্ষ ১৯৯২ সালে এই আইন মেনে নেয়। ২০১৫ সালের ASCPCR এর একটি চিঠির (ASCPCR 37/2015/1) উত্তরে, অসম পুলিশ জানায় যে চাইল্ড লাইন ইন্ডিয়া নামক কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাটি অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং ইউনিট এর সাহায্যে ঐ ৩১ টি মেয়েকে ১১ই জুন নয়া দিল্লী’র পাহাড়গঞ্জ স্টেশন থেকে উদ্ধার করেছে। ঐ মেয়েদের সম্পর্কে জেনেই চাইল্ড লাইনের কোঅর্ডিনেটর সাইজু দিল্লির চাইল্ড অয়েলফেয়ার কমিটির চেয়ার পার্সন সুষমা ভিজ কে এ-সম্পর্কে জানান। তাঁর চিঠিতে লেখা ছিল “কোকরাঝাড়-এর সন্ধ্যা নাম্নি একজন মহিলা ৩১-টি মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের পুলিশ ধরেছে, এবং তাঁদের সঙ্গের নথিপত্র পরীক্ষা করে দেখছে। অদ্ভুতভাবে ঠিক এই সময় সুরেন্দ্রনগরের CWC-র হস্তক্ষেপে একদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ তদন্ত না করেই এই মেয়েদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং তাঁরা নিজেদের গন্তব্যে রওনা হয়। ২০ জন চলে যায়। হাম্বাদ, গুজারাটে আর ১১ জন যায় পাঞ্জাবের পাতিয়ালাতে। সাইজু এর পরেও CWC কে চিঠি লেখেন এবং উল্লেখ করেন যে “এই সমস্ত বাচ্চাদের সঙ্গের নথি’র গুরুত্ব সহকারে বিশ্লেষণ দরকার।” CWC-র দিল্লী শাখা এর কোন উত্তর দেয়নি। ASCPCR এই ঘটনার গুরুত্ত্ব বুঝে ADGP অসম কে একটি চিঠি দেয়। এবং সেখানে সুরেন্দ্রনগরের CWCর চিঠি’র তারিখের একটি অসংগতি’র কথা উল্লেখ করে। দেখা গেল যে ১১ই জুন মেয়েদের উদ্ধার করা হয় অথচ সুরেন্দ্রনগরের CWC’র তারিখ ৩ জুন ২০১৫। আরো প্রশ্ন ওঠে যে কিভাবে তাঁরা বাচ্চাদের CWC-র সামনে উপস্থিত না করেই ছেড়ে দিলেন? জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট এর ৩৩ নম্বর ধারা-কে এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে বলেই উল্লেখ করা হয়।

ASCPCR অসম পুলিশকেও নির্দেশ দেয় যে তাঁরা যেন যে কোন ভাবে মেয়েদের অসমে ফিরিয়ে আনেন। তাঁরা একথাও বলেন যে, অসম সরকার শিশু উন্নয়নে অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। মেয়েরা বাইরে আরও ভাল শিক্ষার জন্য কেন যাবে? তাঁদের তো এখানেই উন্নয়ন সম্ভব। এভাবে মেয়েদের নিয়ে যাওয়াকে শিশু পাচারই বলা উচিৎ। ঠিক ১৭ জুন, গুজরাট সমাচারে একটি খবর বেরোয়। সেখানে বলা হয় যে বিদ্যাভারতী ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত সরস্বতী বিদ্যামন্দির দিল্লির একটি মিটিং-এ ২০ জন কে দত্তক নেয়। এই মেয়েরা সকলেই অসমের বন্যায় অনাথ হয়েছে, সুতরাং এই সাহায্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গুজরাটের মুখ উজ্জ্বল করল।

১৮ই জুন State Child Protection Society-র Member Secretary, একজন আই এ এস অফিসার কুমুদ কালিটা , কোকরাঝাড় ও বাসাই গাঁও এর CWC কে পুরো ঘটনার বিবরণ সহ একটি চিঠি লেখেন। এবং মেয়েদের ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেন। এর পর কোকরাঝাড়ের CWC, সুরেন্দ্রনগরের CWC কে চিঠি লেখেন ও মেয়েদের ফিরিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করেন সে চিঠির উত্তর পাওয়া যায়নি। সুরেন্দ্রনগরের CWC একটিই চিঠির উত্তর দিয়েছে এখনো অবধি। সে চিঠিটি অসম সরকারের মেম্বার সেক্রেটারি অরথাকুরকে। সেখানে তাঁরা অসম সরকারের কাছে ঐ সমস্ত মেয়েদের “হোম স্টাডি রিপোর্ট” চেয়ে পাঠান। জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট অনুসারে “হোম স্টাডি রিপোর্ট” হল একটি বাচ্চার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি বিস্তারিত দলিল। যা সেই এলাকার CWC দেখে যদি মনে করে যে এদের শিশু কল্যাণকারী কোন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া প্রয়োজন তখনই সেই শিশুকে ঐ ধরনের কোন সংস্থাতে পাঠানো যেতে পারে। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে সুরেন্দ্রনগরের CWC হোম স্টাডি রিপোর্ট ছাড়াই ঐ মেয়েদের রাষ্ট্রীয় সেবা সংস্থানের হাতে তুলে দিয়েছে।

অসম থেকে বহু দুরে - হাল্ডাদে অবস্থিত সরস্বতী শিশু মন্দিরের তোরণ।

সকাল ৬টা ৪৫, অত্যন্ত গরমের এক সকালে গিয়ে হাজির হই হাল্ডাদের সরস্বতী শিশু মন্দিরে। সেখানে দেখি মেয়েরা গরমে উস্কোখুষ্কো অবস্থায়, এলোমেলো ভাবে মাঠে খেলা করছে। কথা হয় সুনিতার সাথে, তিনি ওখানকার সঙ্গীত শিক্ষিকা। আমার কথা শুনে তিনি দিভি, ভুমিকা, অম্বিকা, ববিতা কে লাইন করে দাঁড় করান এবং বলে ওঠেন “ববিতা দিদিকে তোমার পচ্ছন্দের গল্পটা বলে শোনাও” ববিতা বলে ওঠে, “কোনটা ঐ ছোট কাশীর রানীরা?”

ববিতা বলতে থাকে ছোট কাশীতে এক রাজা ও রানীর গল্প। কিভাবে তাঁদের রাজত্ব খানরা দখল করল। এবং রাজা যুদ্ধে পরাজিত হবার চিহ্ন হিসেবে, ছোট কাশীর পতাকা নাবিয়ে ফেলা হচ্ছে দেখে; রানী ও তাঁর দাসীরা কিভাবে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেদের মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করল, এবং নিজেদের দেশভক্তির প্রদর্শন করল। সেই রাতে রাজা ফিরে এলেন এবং বুঝলেন যে ভুলবশত কেউ পতাকা নামিয়ে ফেলার ফলে রানী ভস্মীভূত হয়ে গেছে। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে শিব রাজাকে রক্ষা করায় ব্রতী হলেন। পরের দিন রাজা বীর বিক্রমে এমন লড়াই করলেন যে খানসেনারা পরাজিত হল এবং সুলতান পালিয়ে গেল। এর পর থেকে ছোট কাশীতে আর কখনো কোন সমস্যা আসেনি, কারণ স্বয়ং শিব এর রক্ষা করেন। গল্পের বর্ণনার মধ্যে লুকিয়ে ছিল খানদের প্রতি ববিতার ভয় এবং ঘৃণা। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ববিতা এখন একটি আদর্শের অংশ মাত্র, যেখানে যুক্তিবোধ আর কাজ করবে না।

হাল্ডাদ নামক জায়গাটাই আসলে ছোটা কাশী নামে পরিচিত।

প্রার্থনায় অংশগ্রহনে অসমের উপজাতি মেয়েরা । (ছবি – ময়ুর ভট্ট)

সকাল ৭টা ১৫ তে মেয়েরা একসাথে একটা হলঘরে প্রার্থনার জন্য জড়ো হয়। হল ঘরে একটা বিশাল মঞ্চ আছে, সেখানে সমস্ত হিন্দু দেবদেবীর ছবি আছে। আর আছে গান্ধী, বল্লভ ভাই প্যাটেল, সাভারকার, জিজাবাই, ভারত মাতার ছবি। দেওয়াল জুড়ে গেরুয়া পতাকা। দশম শিখ গুরু, গুরু গবিন্দ সিংহ কে বলা হয়েছে হিন্দু ধর্ম রক্ষক। দেখলাম ৬০ জন মেয়ে ও ৩০ জন ছেলে আলাদা করে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। সুনিতা এদের সামনে গায়ত্ৰীমন্ত্র উচ্চারণ শুরু করল। বাকিরা, বলার অপেক্ষা রাখে না, বোড়ো মেয়েরাও ঐ মন্ত্র উচ্চারনের চেষ্টা চালিয়ে গেল। চার বছর বয়েসি বোড়ো মেয়ে দেবী একটা চোখ শক্ত করে বন্ধ রেখে অন্য চোখে সুনীতার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নেয় ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে উচ্চারণ বুঝে নিতে। হ্যাঁ মোটে চার বছর বয়েসিদের জন্য এই মন্ত্র উচ্চারণ বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরকম আরও কিছু মন্ত্র গাওয়া হল, এবং অনুষ্ঠান শেষ হল “বন্দে মাতরম” গেয়ে।

আধ ঘন্টার এই সমাবেশ শেষ হওয়ার পর সুনীতা ও অন্যদের কাছে অসমের ২০টি মেয়ের সাথে আলাদা করে কথা বলার সুযোগ করে নিলাম। বাকিরা চলে গেলেও অসমের ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনকে হলে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি হিন্দিতে এদের নাম জিজ্ঞাসা করলে সুনীতা তা গুজরাটী ভাষায় তাদের অনুবাদ করে দিতে থাকে। তারা একে একে তাদের নাম বলে- “অম্বিকা, ববিতা, মরবী, দিভী, সুরাগ্নি, সরোগী, শুকুরমনি, রিয়াজাজত্ সুরীয়া, নেহা, ভূমিকা, সুস্মিতা, সুশিতা, রানী, গুজিলা, রুমিলা, সুর্মিলা, দেবী, মুলিতা”। শুরু থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা গুজরাটি ভাষার মাধ্যমে দেওয়ার কারণে বেশীরভাগ মেয়েরা এখন কেবল গুজরাটি ভাষাই বোঝে, যদিও তাদের হিন্দী শেখার জন্যেও উৎসাহ দেওয়া হয়, অথচ অসমে তারা তাদের বাড়িতে বোড়ো অথবা অসমীয়া ভাষাতেই কথা বলতো।

আমি সুশিতাকে জিজ্ঞাসা করি, “তুমি কি বাড়ি ফিরতে চাও?”

সুশিতা মাথা নেড়ে বোঝায় ফিরতে চায়। সুনীতা কঠিনভাবে জিজ্ঞাসা করে “তুমি বাড়ি ফিরতে চাও ?” এবার সুশিতা কার্পেটের দিকে চোখ নামিয়ে বলে “না”। আমাকে কিন্তু সুশিতা আলাদা করে বলেছিল যে সে এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাইনা। কিন্তু ঐ সঙ্গীত শিক্ষিকার সামনে ঠিক উল্টোটাই বলল। দিভিকে কোন ক্লাসে পড়ে জিজ্ঞাসা করায় সে বললো ‘ভজন ক্লাসে পড়ে। আমি বুঝতে না পেরে সুনীতার দিকে তাকাই। সুনীতা জানায় এদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন হওয়ার কারণে সবাইকে ক্লাসে ভর্তি করা যায়নি। এভাবেই অম্বিকা বলে সে “সংস্কার” শেখে। সংস্কার মানে মেয়েদের সম্ভ্রম রক্ষা, মাতৃভূমির প্রতি দায়বদ্ধতার সংস্কার, পশু হত্যা না করার দায়বদ্ধতা ইত্যাদি ওঁরা শেখে। জিজ্ঞাসা করলাম সম্ভ্রম রক্ষা ব্যাপার টা কি? বলল নিজেদের কে বাঁচানো দরকার, বাংলাদেশী ও খ্রিস্টান অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে। এই বাঁচানোর নামই তো সম্ভ্রম রক্ষা। সুশিতা বলে উঠল, আমরা যে হিন্দু এটাতো জানতামই না। আপনি জানেন কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণী আমাদের জাত থেকেই এসেছেন?

সুশিতার কথা থেকেই মনে পড়ে গেল ৭ই ডিসেম্বর ২০১৪ সালের ঘটনা। ঐদিন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানোদয় এক্সপ্রেসের (train of learning to the North East) উদ্বোধন করার পরে আর.এস.এস এর যুগ্ম সম্পাদক কৃষ্ণ গোপাল বলেছিলেন কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণী অরুণাচল উপজাতীর সদস্যা ছিলেন। ঐ দিনেই তিনি রানী গাইদিনলিউ’র কথা উল্লেখ করেন। রানী গাইদিনলিউ উত্তরপূর্ব ভারতে আদিবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে ধরমান্তরিত করার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

ববিতাকে জিজ্ঞাসা করলাম “তুমি আমিষ খাবার খেতে ভালবাস না? বিশেষ করে কাঁকড়া’র ঝোল? শুয়োরের মাংস?” ববিতা সম্মতিসূচক হ্যাঁ বলল মাথা নেড়ে, আর বলল “কিন্তু কোন ভাল হিন্দু মেয়ে আমিষ খায় না!” একটি একমাত্রিক হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের জন্য ছোট ছোট মেয়েদের ইচ্ছে, ভালোলাগা ইত্যাদি কে এখানে যে খুন করা হচ্ছে সেটা বেশ ভালই বোঝা গেল।

এই কথা শেষ হবার আগেই ওখানকার গার্ড এসে আমাকে কথা বলা বন্ধ করতে বলল। ছবি তুলতেও নিষেধ করে গেল। আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং চলে যাবার জন্য উদ্যত হলাম। কিন্তু গার্ড বেরতে দিল না। বলল যে ঐ স্কুলের ট্রাস্টি ঘনশ্যাম দাভের সাথে কথা না বলে যাওয়া যাবে না। ঘনশ্যাম দাভেকে ফোন করে লাভ হল না, ফোন ধরল না। একঘন্টা অপেক্ষা করার পর গার্ডকে বল্লাম আমি বেরোলাম। গার্ড আমার গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেল পথ আটকে। আমি বললাম আমার ফ্লাইট আছে দিল্লী ফেরার, মিস হয়ে যাবে। গার্ড কিছুতেই ছাড়বে না। আমি বললাম তুমি আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারো না, আমি পুলিশ ডাকব। গার্ড বলল “ঘনশ্যাম দাভেকে আপনি চেনেন না, ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, চাইলে আপনি পুলিশ ডাকতেই পারেন। আমার ড্রাইভার বলল “ঘনশ্যামের এক ভাই বিজেপি নেতা আর এক ভাই পুলিশে চাকরি করে” অগত্যা আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আরো প্রায় ঘন্টা খানেক পরে বাইকে চেপে মাথায় তিলক কাটা ঘনশ্যাম এলেন। আমার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বললেন “কদিন আগে দুটি মেঘালয়ের মেয়ে হারিয়ে গেছে, তাঁদের এখনো কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে জন্যই আমি আপনাকে যেতে দিতে চাইনি, তবে আপনি তো ব্রাহ্মণ, আপনি আমাদের কোন ক্ষতি করবেন না আমি জানি!”

ওনার অফিসের দেওয়ালে একাধিক শংসাপত্র টাঙানো আছে। তার মধ্যে একটি হল নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের মন্ত্রী বসুবেন ত্রিবেদীর দেওয়া, সেখানে লেখা আছে যে এই সংস্থার উদ্বোধক হলেন মোদী স্বয়ং। আর একটিতে সোশ্যাল ডিফেন্স এর তরফ থেকে বলা হয়েছে “এই প্রতিষ্ঠানটি তৈরীই হয়েছে জুভেনাইল জাস্টিস এর তরফ থেকে, যাতে শিশুদের সঠিক দেখভাল করা সম্ভব হয় সেইজন্য। যদিও সে শংসাপত্র ৩রা মার্চ ২০১৬ সালে তার বৈধতা হারিয়েছে, এবং জুভেনাইল জাস্টিস এর নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চারা শুধু মাত্র স্বীকৃত সংস্থাতেই থাকতে পারে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এই হোম তথা ঘনশ্যাম দাভে’র বাড়বাড়ন্ত বিজেপির ছত্রছায়াতেই হয়েছে।

ম্যান-ইন-চার্জ ট্রাস্টী ঘনশ্যাম দাভে/ (ছবি – ময়ুর ভট্)

১৭-জুন, ২০১৫ গুজরাট সমাচার, আহমেদাবাদ এডিশনে হাল্ডাদের সংবাদ।

চতুর্থ অধ্যায় : ‘ঐ নিচু জাতের মেয়েরা’

সত্যই যদি তারা মেয়েদের সাহায্য করতে চায়, তাহলে অসমেই করছে না কেন?

প্রসঙ্গত জানানো উচিত, United Nations Convention on the Rights of the Child (UNCRC)-এর ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রত্যেক শিশুর তার মাতৃভাষা, প্রথা ও ধর্ম ব্যবহারের সম্পূর্ণ অধিকার আছে।।

চাইল্ডলাইন (Childline), দিল্লী ২৩ জুন ২০১৫ সালে চাইল্ডলাইন, পাতিয়ালাকে অসমের ১১টি মেয়ের পাচারের তদন্ত করার জন্য নির্দেশ দেয়। চাইল্ডলাইন, পাতিয়ালার আধিকারিকরা পাতিয়ালার সিরহিন্দি গেটের কাছে অবস্থিত মাতা গুজরি কন্যা ছাত্রাবাস এ গিয়ে তদন্ত করেন। প্রথমেই সেখানকার কেয়ারটেকার হরজিন্দর কৌর তাঁদের ঢুকতে বাধা দেন। এর ফাঁকেই তাঁরা ঐ ছাত্রাবাসের ঘরগুলিতে যেতে সক্ষম হন। তারপর তাঁরা সেখানকার জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিকের সাথে দেখা করেন। তাঁরা রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, হোমে ৩১ জন আবাসিক আছে, তাঁরা প্রত্যেকেই স্কুলে যায়। তবে নতুন ১১ জন অসম থেকে আসা আবাসিকেরা এখনো স্কুলে যাওয়া শুরু করেনি। ঐ ১১ জনের ঘুমানোর জায়গা পর্যন্ত নেই। তাঁরা মেঝেতে বিছানা করে ঘুমায়। এর মধ্যেই ওখানকার লোকজন আমাদের সাথে খারাপ ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। আমরা তাঁদের জিজ্ঞাসা করি যে এই সব মেয়েদের শিশু কল্যাণ কমিটি বা CWC-র সামনে উপস্থাপন করা হল না কেন? আমরা ওঁদের কাছে ঐ মেয়েদের উপস্থিতি সংক্রান্ত বৈধ কাগজপত্র দাবি করি। সেটাও ওঁরা দেখাতে পারেননি। উল্টে ওনারা আমাদের সাথে ঝগড়া করতে শুরু করে দেন, কোন উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। এর মধ্যেই শিশু কল্যাণ কমিটির মেম্বার মিঃ জিন্দাল ওখানে আসেন। আমরা জানতে পারি যে উনি ঐ হোমের একজন ট্রাস্টি। উনি আমাদের চ্যালেঞ্জের সুরে বলতে থাকেন “আপনাদের এই হোমে ঢোকার সাহস কে দিয়েছে? এর মধ্যেই রাজনৈতিক চাপও আসতে শুরু করে এবং পুলিশ আমাদের ওখান থেকে চলে যেতে নির্দেশ দেয়। চাইল্ডলাইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেসন, যারা কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু মন্ত্রকের অধীনে কাজ করে, সেখানে এই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট জমা পড়ে, কিন্তু সেখান থেকেও কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

শিশু কল্যাণ কমিটির চেয়ারপার্সন ডঃ এস এস গিল, এই হোমটিকে বে-আইনি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন রাষ্ট্রের সাথে সংঘের সুনিবিড় সম্পর্কের জন্যই এঁরা এই হোমগুলিকে চালিয়ে যাচ্ছে। এর সব থেকে বড় উদাহরণ হল শিশু কল্যাণ কমিটির এক জন সদস্য এই বেআইনি প্রতিষ্ঠানের এক জন ট্রাস্টি। তিনি বলেন, “এই কিশোরীদের হোমে রেইড করার সময়, কেয়ারটেকার বীণা লাম্বা এবং সেবিকা সমিতির অন্য সদস্য পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক করে তোলেন। আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনেন যে, আমি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ বলে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছি। কিছু আর.এস.এস এর কর্মী আমাদের ভয় দেখাতে শুরু করে এবং সে সময়ে আমরা চলে যাই।”

পাতিয়ালা চিল্ডেন্স হোমে হাল হকিকত বুঝতে তদন্তে যান আধিকারিকরা।

জেলা শিশু সুরক্ষা আধিকারিক (District Child Protection Officer) সাইনা কাপুর জানান যে ঐ হোম বেআইনি, কারণ ওটা জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (Juvenile Justice Act) -এ স্বীকৃত নয়। দেখা গেছে ঐ হোমটা শুধু মাত্র ১৮৬০ সালের সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট (Society’s Registration Act)-এ নিবন্ধিত। দেখা গেছে যে সমস্ত সংস্থাগুলি নারী ও শিশু পাচারের সাথে যুক্ত থাকে সে সমস্ত সংস্থাগুলিও ঐ আইনেই নিবন্ধিত। সাইনা কাপুরের কথায় “আমরা যখন হোমে যাই তখন সেখানে কোন প্রহরা দেখিনি, বাচ্চাদের সুস্থ ভাবে থাকার জন্য ঠিকমত কোন ব্যবস্থা পর্যন্ত করা নেই। আবাসিক মেয়েদের কোনো আইনসঙ্গত কাগজপত্র নেই, এমনকি মেয়েদের শারীরিক পরীক্ষা পর্যন্ত করা হয়নি। অন্য রাজ্য থেকে এভাবে মেয়েদের নিয়ে আসাটাই বেআইনি একটা প্রক্রিয়া। যদি মেয়েদের সাহায্য করাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তাহলে তো অসমে করলেই হয়। ওঁদের তো পাতিয়ালা’র বাচ্চাদেরকেই সাহায্য করা উচিৎ। তাঁর পরিবর্তে ওঁরা যা করছেন সেটা সম্পূর্ণ আইন বিরুদ্ধ।”

সম্পূর্ণ তদন্ত করার পরে সাইনা কাপুর কয়েকজন অভিভাবকের সাথে যোগাযোগ করেন। মনোবিনা ও দিব্যজ্যোতীর বাবা মা আসেন। এঁরা হোস্টেলে ছিলেন। এদের বাবা-মায়েরা এঁদের বিগত দুবছর ধরে খুঁজছিলেন। আমরা যখন তাঁদের জিজ্ঞাসা করি যে ওরা বাড়ি যেতে চায় কি না, ওরা বলল “হ্যাঁ”। এবং ওরা ওদের বাবা-মা এর সাথে বাড়ি চলে গেল। “আমরা বাকিদের সাথে এটা করে উঠতে পারিনি কারণ, মাতা গুজরি কন্যা ছাত্রাবাস আমাদের এটা করতে দেয়নি।” সাইনা কাপুর বলেন।

“মাতা গুজরি” নামটি এসেছে নবম শিখ ধর্মগুরু তেঘ বাহাদুরের স্ত্রীর নাম থেকে। পাতিয়ালার প্রতি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি মাতা গুজরির নামে করা হয়। তাঁর নামে অন্তত তিনটে স্কুল আছে এখানে। এই মাতা গুজরী ছাত্রাবাসের খুব শক্তপোক্ত গেট আছে এবং তা সবসময়ই বন্ধ রাখা হয়। সাইনা কাপুর বলেন “আমরা ঢোকার চেষ্টা করতে গেলে ভীনা লাম্বা এসে আমাদের সাথে দেখা করেন। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখানে রাষ্ট্র সেবিকা সমিতির প্রতিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীবাঈ কেলকার এর একটি ছবি ঝালোনো ছিল আর ছিল ভারত মাতার ছবি। লাম্বা নিজেকে কেয়ার টেকার হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি আমাদের মেয়েদের সাথে দেখা করতে দেন নি, শুধু বলেন যে হ্যাঁ ঐ মেয়েরা অসমের এবং এও বলেন যে রাষ্ট্র সেবিকা, লক্ষ্মী অসম গেছে, করবীর মাধ্যমে আরও মেয়েদের আনার জন্য।”

আমি জিজ্ঞাসা করলাম “মেয়েরা কি স্কুলে যায়?” উনি উত্তর দিলেন “কেউ কেউ যায়, তবে আমাকে আর কোন প্রশ্ন করবেন না, আমি আর কিছু বলতে পারব না।” এর পরদিন সকালে সাইনা কাপুর সহ সদলবলে এলাকার একটি উঁচু বাড়ির ছাদে গিয়ে আমরা দেখার চেষ্টা করি যে ওখানে কি হচ্ছে। দেখলাম সকালে গেরুয়া পতাকার সামনে ওরা প্রথমে প্রার্থনা করল কিছুক্ষণ, তারপর কবাডি খেলা হল, এবং সব শেষে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হল। সেখানে একদল কাশ্মীর-এ পাকিস্থানি সৈন্য সাজল আর একদল ভারতীয় সৈন্য। তারপর খেলা শেষ হল “কাশ্মীর হামারা হ্যায়” এই স্লোগান দিয়ে। আমরা যখন ওঁদের ছবি তুলছি তখন বাড়ির একজন উপরে উঠে এসে বলল “ওঁরা এখানে নিচু জাতের মেয়েদের এনে পি টি শেখাচ্ছে। এখানে কি ভিখারির অভাব যে বাইরে থেকে ভিখারি আনতে হচ্ছে ?”

মেয়েরা “কাশ্মীর হামারা হ্যায়’ খেলা খেলছে।

পঞ্চম অধ্যায় : মেয়েদের ঘর ওয়াপসি?

বোড়ো এবং আদিবাসী মেয়েদের, নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের বাড়ি থেকে বহু দূরে; মায়ের আদর, বাবার পিঠে চাপা, ভাই-বোনের খুনসুটি, লুকোচুরি-কুমিরজল থেকে বহু দূরে। এখন তারা পুরুষতন্ত্রের আবর্জনাগুলিকেই আলিঙ্গন করছে, বাস্তবতা হল করতে বাধ্য হচ্ছে, যেমন পারিবারিক সম্মান, সতী, জওহর ব্রত।

টুথ এন্ড পলিটিক্স (Truth and Politics) নামক গ্রন্থে, জন্ম সুত্রে জার্মানি কিন্তু নাগরিকত্বে আমেরিকান প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিক হ্যানা আরেন্ডট নাৎসিবাদ ও স্তালিনবাদের উত্থান প্রসঙ্গে বলেন “আমাদের প্রতিদিনের ঘটনাবলির অস্তিত্ত্ব কতটা ভয়ানক সেটা ঐতিহাসিকরা জানেন। একটা সামান্য মিথ্যাও যে কতখানি বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে সেকথা ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়। সেখানে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে সংগঠিত মিথ্যা কি করতে পারে। মিথ্যেবাদীরা জানে যে মানুষ আসলে কি শুনতে চায়, তাঁরা এর সুযোগ নিয়ে চলে সর্বক্ষণ।

ববিতা “বাইরের লোকেদের কাছ থেকে মেয়েদের সম্মান রক্ষার শেখানো বুলি আউড়েছিল, কিন্তু সে নিজেই এটা জানে না যে সে কতখানি “বাইরের লোক” এই গুজরাটে। শ্রীমুক্তি তো আসলে পাতিয়ালাতে অচ্ছুৎ অথচ সে কাশ্মীরে পাকিস্তানী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শিখছে। বাইরের লোককে বিতাড়ন ও হিন্দু রাষ্ট্রের সুরক্ষা সুচারু ভাবে এই আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ এরা নিজেরাই এই পদ্ধতিতে বাইরের লোক হয়ে যাচ্ছে। আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে পুরুষতন্ত্রের বীজ বপন করা হচ্ছে, ফলে তাঁরা পুরুষতান্ত্রিক সতী, নারীসন্ত্রম ইত্যাদি শিখছে, কিন্তু ভুলে যাচ্ছে নিজেদের পরিচয়। ওঁরা তেংফক্রির মত যোদ্ধা না হয়ে সতী হবার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখন এঁদের সমস্ত সাহসিকতাকেই যুক্ত করা হচ্ছে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরীর পক্ষে। সাহসিকতার মানে যেন শুধু অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা।।

গত দুই দশকে বোড়োল্যান্ড এলাকাতে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রভাব চোখে পড়ার মত। তারাও বাচ্চা ও মেয়েদের একই ভাবে নিয়ে যেত, শিক্ষিত করবার, সভ্য’ করবার প্রলোভন দেখিয়ে। প্রায় একই ভাবে সংঘ পরিবারও তার প্রভাব বিস্তৃত করেছে। তাঁরা আরও একটি বেশী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তা হল সামাজিক উন্নয়নের ছদ্মবেশে হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পদক্ষেপ। কোকরাঝাড়ের জনৈক শিশু অধিকার কর্মীর মতে “ইউনিসেফ (UNICEF)-এর মত প্রতিষ্ঠান যেখানে বাচ্চাদের তাঁদের নিজেদের অঞ্চলেই সাহায্য করার কথা বলে সেখানে আর এস এস জোর করে মেয়েদের বেআইনি ভাবে নিয়ে যাচ্ছে।” হেসে তিনি এটাও বলেন “বোঝা যায় প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বহু প্রচারিত ‘বেটি বাঁচাও ও বেটি পড়াও’ প্রকল্পের আসল উদ্দেশ্য কি।”

ASCPCR অসমের চেয়ারপার্সন রুনুমি গোগৈ বলেন “ওঁরা যদি মেয়েদের শিক্ষিত করতেই চায় তো ওরা এসে অসমে কাজ করুক। কেন মেয়েদের গুজরাট ও পঞ্জাবে নিয়ে গিয়ে শিক্ষা দিতে হবে?”

অসমের অশান্তিপূর্ণ জেলাগুলিতে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের জীবন এতই সমস্যা-সঙ্কুল যে তাঁদের বাবা-মার কাছে সুযোগ খুব সীমিত। ওখানে সরকারের সুযোগ সুবিধেগুলিও ঠিক মত পৌঁছায় না। বোড়োদের মধ্যে ইসলাম ও খ্রিস্টান বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলা হয়েছে। সাঁওতাল ও মুন্ডাদের মধ্যেও জাতিবিদ্বেষ তৈরি করা হয়েছে। সংঘ পরিবারের মদতে এই প্রত্যেক জনজাতিদের মধ্যেকার সদ্ভাব নষ্ট হচ্ছে। সব থেকে ভয়ের বিষয় হল একটি এলিট ক্লাস হিন্দু ধর্মের মতাদর্শ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেবা ভারতী ও রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি যে ৩১টি মেয়ের পাচারের সাথে যুক্ত সেই পাচার কাহিনি অত্যন্ত জটিল এবং অস্পষ্ট। এখানে ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র ইত্যাদি মিলেমিশে এক হয়েছে, যে কারণে মেয়েদের হয় বিজেপি শাসিত গুজরাট কিংবা শিরোমনি অকালি ও বিজেপি শাসিত (সেই সময়ে) পঞ্জাবে রাখা হয়। রাষ্ট্রের মদতেই এবং প্রশ্রয়েই এরা আইনকে পাশকাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। আর আজকের বাস্তবতা হল, এখন অসমে বিজেপির শাসন। শিশু কল্যাণ আধিকারিকের বর্তমান অবস্থান অজানা। সরকারের নীতির বিরোধী কোন পদক্ষেপ তারা নেবে এরকম আশা করা যায় না। অসম তথা সমগ্র উত্তর-পূর্বে যেভাবেই হোক ক্ষমতা দখল নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন। মনিপুরে সরকার গঠন কিভাবে হল আমরা দেখেছি। আশঙ্কার কথা হল, হিন্দুত্বকরণের সর্বগ্রাসী প্রকল্পে উপজাতি মেয়েরা অন্যতম লক্ষ্য।

ববিতার বাবার একটা কথা এখনও কানে লেগে আছে আমার, “দিদি, আমি আমার মেয়েকে পড়াতে পাঠিয়েছিলাম। গরীবরা কি কিছু না হারিয়ে কিছু পাবে না? সেবা ভারতী আমার মত বাবাদের মৃত্যু ঘটিয়ে কিরকম ভারত তৈরি করতে চায়?”

ফুটনোট - ১

Exploitation of Children in Orphanages, State of Tamil Nadu vs Union of India and Other [Writ Petition (Criminal) No. 102 of 2007

JUDGEMENT

(1.) PURSUANT to this Court’s order dtd 31/3/20101 in the matter of exploitation of children in orphanages in the State of Tamil Nadu, the National Commission for Protection of Child Rights (ncper) has submitted a detailed report. The learned Standing Counsel for the States of Assam and Manipur as well as the learned ASG appearing for the Union of India seeks time to file their response to the report submitted by the Commission. Two months’ time is granted to file the response. Response from the States of Tamil Nadu, Kerala and Karnataka shall also be filed within two months from today.

(2.) BUT in the meanwhile, it is just and necessary to direct: 2.1. The Deputy Commissioner of NC Hills should ensure that the schools, hostels and children home complex presently occupied by the armed/security forces are vacated within a month’s time and it should be ensured that the school buildings and hostels are not allowed to be occupied by the armed or security forces in future for whatsoever purpose. 2.2. The States of Manipur and Assam are directed to ensure that no child be low the age of 12 years or those at the primary school level are sent outside for pursuing education to other States until further orders. 2.3. The Ministry of HRD, Govt. of India is directed to submit a list of schools and hostels (districtwise), collected from the State Exploitation of Children in Orphanages in State of Tamil Nadu, In re, (2010) 15 SCC 297 Governments/Union Territory Administrations which are currently occupied by the armed/security forces in the NorthEastern States duly indicating the date from which or duration for which such schools and hostels have been occupied by the security forces. 2.4. The Ministry of Doner is directed to hold special meetings with North-Eastern States especially Assam, Arunachal Pradesh, Manipur, Meghalaya and Nagaland to assess their requirement in terms of educational infrastructure, such as construction of school buildings. Hostels and children homes for support by the Ministry. The NCPCR shall continue to be engaged with the "source as well as destination"

States for addressing the protection issues concerning children taken from one State to another. It is directed to hold meetings and apprise the situation/progress in this matter to this Court. The Union of India and all the State Governments are directed to render necessary assistance to NCPCR.

(3.) THE Ministry of Home Affairs is directed to ensure that the paramilitary forces vacate the school and hostel buildings occupied by them and submit an Action Taken Report to this Court as well as NCPCR within two months from today. The Ministry shall file a proper affidavit in this matter on the next date of hearing of this writ petition. (Contd)

ফুটনোট - ২

চৈনিক-তিব্বতী ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্গত তিব্বতী- ব্রহ্মদেশীয় শাখার অন্যতম ভাষা হল বোড়ো ভাষা। উত্তরপূর্ব ভারত সহ নেপাল, বাংলাদেশেও বোড়ো ভাষাভাষী মানুষ বসবাস করে। বাক্য ও শব্দ গঠন, শব্দ ভাণ্ডার ও ধ্বনিগত ভাবে বোড়ো ভাষার সঙ্গে কোকবরক, ডিমাসা, গারো ভাষার মিল প্রচুর। প্রাচীন সময়ে বোড়োরা সর্বপ্রাণবাদী ছিল। ১৯৯১ এবং ২০০১ সালের জনগণনার নিরিখে যা ক্রমহ্রাসমান, যথাক্রমে ২,৪৭৮ এবং ১৪১। বাথৌ ধর্ম বোড়োদের মধ্যে বংশপরম্পরায় ধরে প্রচলিত, এই ধর্মে পূর্বপুরুষদের পূজা এবং সিজউ গাছের পূজা করা হয়। বাথৌ শব্দের মধ্যে বা মানে হল পাঁচ এবং থৌ মানে গভীর। বোড়োরা ঈশ্বরকে পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি বলে মনে করে, উপাদানগুলি হল- জমি, জল, বাতাস, আগুন এবং আকাশ। বাথৌ দর্শনে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পূর্বে ছিল বিশাল শূন্যতা, সেখানে বিরাজ করত ‘অহম গুরু’ বা আনান বিনান গোঁসাই। নিজস্বতা ছিল বোড়োদের ধর্মের, দর্শনের তথা যাপনের। কিন্তু চিত্র পাল্টাতে লাগলো। বোড়ো ভাষা দেবনাগরী অক্ষরে লেখা, বোড়ো ভাষাভাষী মানুষদের হিন্দু জনসংখ্যার অংশ হিসাবে দেখানো হতে থাকলো। ২০১১ জনগণনায় অসমের বোড়োল্যান্ড টেরিটরিয়াল কাউন্সিলে হিন্দু জনসংখ্যা ৭১.২৪ শতাংশ, বাথৌ ধর্ম বলে কিছু নেই।

About author
Generic placeholder image
আমরা: এক সচেতন প্রয়াস
AAMRA is an amalgamation of multidisciplinary team of researchers and activists erstwhile worked as an assemblage of movement, research and activism. Popular abbreviation of AAMRA is, An Assemblage of Movement Research and Appraisal.
Do you want to get informed about new articles?

Related articles
Most Viewed
0 Comments
Leave a reply